তাকিয়ে তাকিয়ে প্রাণ চমকে উঠল। রাত-বিরেতে ওরকম একখানা পেল্লায় ইঁদুর যদি কারও ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে, তা হলে আর দেখতে হবে না। কামড়ে-ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেবে একেবারে।
লোকটা ধমক দিয়ে বললে, কী হে–হাঁ করে সবাই দাঁড়িয়ে রয়েছ যে বড়? বোম্বাচাক লেগে গেল নাকি তোমাদের? মাকে পেন্নাম করলে না?
বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা চারজনে একেবারে সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে পড়লুম।
লোকটা বলে চলল, হেঁ–হেঁ, ভারি দুর্লভ মূর্তি! দুনিয়ার কোথাও দেখতে পাবে না। এঁর প্রিতিষ্ঠে করেছেন কে জানো? বাবা বিটকেলানন্দ। তাঁর নাম শুনেছ তো?
আমরা এ ওর মুখের দিকে চাইলুম। বিটকেলানন্দ! স্বামী ঘটুঘুটানন্দের সঙ্গে একবার রায়গড়ের জঙ্গলে আমাদের দারুণ রকমের একটা মোলাকাত হয়েছিল—তাকে মুলা কাত-ও বলা যায়, কারণ তিনি আমাদের চারজনকে প্রায় কাত করে ফেলেছিলেন। বিটকেলানন্দ তাঁরই মাসতুতো ভাই কি না, কে জানে!
ক্যাবলা ঘাড়-টাড় চুলকে বললে, আজ্ঞে, তা—তা শুনেছি বইকি। বাবা বিটকেলানন্দের নাম কেই বা না জানে!
লোকটা ফোঁস করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল : সে কথা আর বোলো না। তোমরা বুদ্ধিমান বলে তাঁর খবর রাখো, তাই চাঁদনিতে গিয়ে খালের জলের কবিতা আউড়ে এখানে আসতে পেরেছ। কিন্তু অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখো, ঠোঁট উলটে অমনি বলে বসবে—অ্যাঁ, বিটকেলানন্দ? সে আবার কে!—লোকটার মুখ মনের দুঃখে যেন লম্বা হয়ে গেল : ছাঃ, এই জন্যই দেশটার কিছু হয় না।
সঙ্গে সঙ্গে টেনিদাও কেমন বাজখাঁই গলায় বলে বসল, আজ্ঞে যা বলেছেন—এই জন্যেই দেশের কিছু হয় না। কী রকম বাঘাটে গলায় টেনিদা বলে ফেলল কথাটা, ঘর গম্ করে উঠল, লোকটাও যেন চমকে গেল। তারপর বললে, অথচ দ্যাখো বাবা বিটকেলানন্দ স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। চালাকি নয়?
খাইছে!–হাবুল আর থাকতে পারল না। –খাইছে?—লোকটা আবার চমকে গেল : তার মানে? কী খেয়েছে? কোথায় খেয়েছে?কেনই বা খেল? ক্যালা বললে, যেতে দিন—যেতে দিন, ও মধ্যে মধ্যে ওই রকম বলে—কেউ কিছু খায়নি। এখন আপনি যা বলছিলেন বলুন।
—আমি বলছিলুম, স্বপ্নাদেশ।—লোকটা একবার গলাখাঁকারি দিলে : বাবা বিটকেলানন্দ ছেলেবেলা থেকেই ভাবুক। ইস্কুলে মাস্টার পড়া জিজ্ঞেস করলে মৌনী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, পাষণ্ড মাস্টারগুলো ভাবত বাবার মাথায় কিছু নেই, তাই তাঁকে গোরুর মতো ঠ্যাঙাত। তারা তো জানত নাবাবা তখন ধ্যান করছেন। কিছু না বুঝেই মহাপাপী মাস্টারেরা পিটিয়ে তাঁর ধুন্ধুড়ি উড়িয়ে দিত ক্লাসে প্রোমোশন দিত না।
আমি বললুম, আহা! ক্যাবলা বললে, আহা-হা! হাবুলও যেন কী একটা বলতে যাচ্ছিল, ঘাড়ে একটা থাবড়া বসিয়ে টেনিদা তাকে থামিয়ে দিলে। লোকটার গলার স্বর ভাবে কাঁদো-কাঁদো হয়ে উঠল, সে বললে, আহো-হো! যাক, তারপরে শোনো। ঠ্যাঙানি খেতে খেতে বাবা বিটকেলানন্দের মতো মহাপুরুষেরও ধৈর্যচ্যুতি হল। তিনি ভেবে দেখলেন, মাস্টারের গাঁট্টাতেই যদি তাঁকে মহাপ্রস্থানে যেতে হয়, তা হলে তিনি ধ্যান-জপ করবেন কী করে—আবার জীবেরই বা গতি হবে কী! তারপর একদিন তিনি বাড়ি ছেড়ে সটকালেন।
ক্যাবলা বললে, বুদ্ধের গৃহগ আর কি।
লোকটা মাথা নাড়ল : যা বলেছ, ব্যাপার প্রায় সেই রকম। কিন্তু জানো, বুদ্ধের কাল তো এটা না, মহাপুরুষকে এখন আর চেনে কে! তাই বাবা আর বোধিবৃক্ষের তলায় বসলেন না, তার বদলে গিয়ে চাকরি নিলেন বড়বাজারের পেটমোটা এক শেঠজীর গদিতে। সেখানে দেখলেন, অনেক শিখলেন, চালে কাঁকর মেশানো, আটায় ভুষি মেশানো, ওষুধে ভেজাল দেওয়া—সব জানলেন। জেনে-শুনে বাবার মগজ সাফ হয়ে গেল—তখন তিনি স্বপ্ন দেখলেন।
-কী স্বপ্ন?—টেনিদা জিজ্ঞেস করলে।
-দেখলেন, স্বর্গে পালে-পালে নেংটি ইঁদুর হানা দিয়েছে সেখানকার চাল-ডাল-মধু-সুজি-ফল-পাকড় সব খেয়ে ফেলেছে, দেবতাদের ঝাঁকে ঝাঁকে তাড়া করেছে, ইন্দ্র-চন্দ্র কার্তিক-টার্তিক সবাই বাপ রে মা-রে বলে ছুটে পালাচ্ছে। আর ইন্দ্রের ফাঁকা সিংহাসনে বসে গোঁফ ফুলিয়ে দেবী নেংটীশ্বরী বলছেন—দেখছিস কি এখন থেকে স্বর্গে-মতে-পাতালে আমারই রাজত্ব শুরু হল। আমার হুকুমমতোই সব চলবে। আজ থেকে তোদের কাজ হল নেংটি ইঁদুরের মতো চুরি করা—গর্ত কেটে, যেখানে যা পাওয়া যায়—সব লোপাট করা। বাঁচতে হলে এখন থেকে এই রাস্তাই তোদের ধরতে হবে। দেবী এই পর্যন্ত বলতে বলতেই দুটো বেড়ালের ঝগড়ার আওয়াজে বিটকেলানন্দের ঘুম ভেঙে গেল, হুলোর ভয়েই দেবী উধাও হলেন কি না কে জানে! আর বাবা বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন, বললেন, পেয়েছি—পেয়েছি। তারপরেই দেবী নেংটীশ্বরীর এই মন্দিরপ্রতিষ্ঠা।
ক্যাবলা বললে, উঃ, কী রোমাঞ্চকর।
টেনিদা ঘাড় নেড়ে বললে, হুঁ, পয়লা নম্বরের মেফিস্টোফিলিস।
–মেফিস্টোফিলিস? লোকটা চোখ পিটপিট করে বললে, তার মানে?
আমি বললাম, তার মানে–ইয়াক ইয়াক!
—ইয়াক ইয়াক? সে আবার কী?—লোকটা খাবি খেল : তোমরা কোন্ দেশের লোক হে? তোমাদের যে বোঝা যায় না।
ক্যাবলা তাড়াতাড়ি বললে, ছেড়ে দিন ওদের ছেলেমানুষি ছেড়ে দিন। মানে, খুশি হলে ওরা অনেক সময় ও-সব বলে, ওগুলোর কোনওকালে নেই। এখন আপনি যা বলেছিলেন বলুন।
লোকটা বিরক্ত হয়ে বললে, বলতেই তো চাচ্ছি, কিন্তু তোমরা কী সব বিচ্ছিরি ভাষা আউড়ে সব গোলমাল করে দিচ্ছ?