- বইয়ের নামঃ কম্বল নিরুদ্দেশ
- লেখকের নামঃ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. অনেক ভেবে-চিন্তে চারজন
অনেক ভেবে-চিন্তে চারজন শেষ পর্যন্ত বদ্রীবাবুর দি গ্রেট ইন্ডিয়ান প্রিন্টিং হাউস-এ ঢুকে পড়লুম। নাম যতই জাঁদরেল হোক, প্রেসের ভেতরটায় কেমন আবছা অন্ধকার। এই দিনের বেলাতেও রামছাগলের ঘোলাটে চোখের মতন কয়েকটা হলদে হলদে ইলেকট্রিকের বাল্ব জ্বলছিল এদিকে-ওদিকে; পুরনো কতকগুলো টাইপ-কেসের সামনে ঝুঁকে পড়ে ঘষা কাচের মতো চশমা পরা একজন বুড়ো কম্পোজিটার চিমটে দিয়ে অক্ষর খুঁটে খুঁটে গ্যালি সাজাচ্ছিল; ওধারে একজন ঘটাং ঘটাং করে প্রেসে কী ছেপে যাচ্ছিল, উড়ে পড়ছিল নতুন ছাপা হওয়া কাগজ—আর একজন তা গুছিয়ে রাখছিল। পুরনো নোনাধরা দেওয়াল, কুলুঙ্গিতে সিদ্ধিদাতা গণেশ রয়েছেন, তাঁর পায়ের কাছে বসে একজোড়া আরশোলা বোধহয় ছাপার কাজই তদারক করছিল, হাত কয়েক দূরে পেটমোটা একটা টিকটিকি জ্বলন্ত চোখে লক্ষ করছিল তাদের। ঘরময় কালির গন্ধ, কাগজের গন্ধ, নোনার গন্ধ, আর তারই ভেতরে টেবিল-চেয়ার পেতে, খাতা কাগজপত্র, কালি কলম, টেলিফোন এই সব নিয়ে বদ্রীবাবু একমনে মস্ত একটা অ্যাঁলুমিনিয়ামের বাটি থেকে তেলমাখা মুড়ি আর কাঁচালঙ্কা খাচ্ছিলেন।
টেনিদা আর হাবুলের পাল্লায় পড়ে বদ্রীবাবুর প্রেসে ঢুকে পড়েছি, নইলে আমার এখানে আসবার এতটুকুও ইচ্ছে ছিল না। ক্যাবলারও না। আমরা দুজনেই প্রতিবাদ করে বলেছিলুম, কী দরকার? যাদের বাড়ির ছেলে, তাদের যখন কোনও গরজ নেই, আমরা কেন খামকা নাক গলাতে যাই?
কিন্তু টেনিদার নাকটা একটু বেয়াড়া রকমের লম্বা আর লম্বা নাকের মুস্কিল এই যে, পরের ব্যাপারে না ঢোকালে সেটা সুড়সুড় করতে থাকে। টেনিদা খেকিয়ে উঠে বললে, বা-রে, তাই বলে পাড়ার একটা জলজ্যান্ত ছেলে দুম করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে?
হয়ে যাক না ক্যাবলা খুশি হয়ে বললে, অমন ছেলে কিছুদিন নিরুদ্দেশ থাকলেই পাড়ার লোকের হাড় জুড়োয়। কুকুরের ল্যাজে ফুলঝুরি বেঁধে দেবে, গোরুর পিঠে আছড়ে পটকা ফাটাবে, বেড়ালছানাকে চৌবাচ্চার জলে চুবোবে, গরিব ফিরিওলার জিনিস হাতসাফাই করবে, ছোট-ছোট বাচ্চাগুলোকে অকারণে মারধোর করবে, ঢিল ছুঁড়ে লোকের জানলার কাচ ভাঙবে—ও আপদ একেবারেই বিদায় হয়ে যাক না। হনলুলু কিংবা হন্ডুরাস যেখানে খুশি যাক, মোদ্দা পাড়ায় আর না ফিরলেই হল।
শুনে, নাকটাকে ঠিক বাদামবরফির মতো করে, টেনিদা কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ক্যাবলার দিকে। তারপর বললে, ইস্স, কী পাষাণ প্রাণ নিয়ে জন্মেছিস ক্যাবলা! তুই শুধু পরীক্ষাতেই স্কলারশিপ পাস, কিন্তু মায়া-দয়া কিছু আছে বলে তো মনে হয় না। না হয় কম্বল এক-আধটু দুষ্টুমি করেই, তাই বলে একটা নিরীহ শিশুকে–
নিরীহ শিশু। ক্যাবলা বললে, দুবার ক্লাস সেভেনে ডিগবাজি খেল, তলা থেকে ও শক্ত হয়ে আসছে—এখনও শিশু! তা হলে দেড় হাত দাড়ি গজানো পর্যন্তও কম্বল শিশুই থাকবে, ওর বয়েস আর বাড়বে না। আর নিরীহ! অমন বিচ্ছু, অমন বিটলে, অমন মারাত্মক–
আমি সায় দিয়ে বললুম, মারাত্মক বলে মারাত্মক। কম্বলকে সাধুভাষায় সর্বার্থসাধক, কিঞ্জল্ক, ডিণ্ডিম, এমন কি সুপসুপা সমাস বললে–ও অন্যায় হয় না। এই তো সেদিন পয়লা বোশেখে আমায় বললে, প্যালাদা, তোমার একটা নববর্ষের পেন্নাম করব। আমি অবাক হয়ে ভাবছি, ব্যাপারটা কী, কম্বলের অত ভক্তি কেন—আর ভাবতে-ভাবতেই পেন্নামের নাম করে আমার দুপায়ে বিচ্ছুটির পাতা ঘষে দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। তারপর একঘণ্টা ধরে আমি দাপিয়ে মরি। ও রকম বহুব্রীহি-মাকা ছেলের চিরকালের মতো নিরুদ্দেশ হওয়াই ভালো—আমি ক্যাবলার কথায় ডিটো দিচ্ছি।
টেনিদা রেগে বললে, শাটাপ! ফের কুরুবকের মতো বকবক করবি, তা হলে এক-এক চড়ে কানগুলো কানপুরে পাঠিয়ে দেব।
হাবুল অনেকক্ষণ ধরে একমনে কী যেন খাচ্ছিল, মুখটা বন্ধ ছিল তার। এতক্ষণে সেটাকে সাবাড় করে ঘাড় নেড়ে বললে, কানগুলান কর্ণাটেও পাঠাইতে পারো।
তাও পারি। নাক নাসিকে পাঠাতে পারি, দাঁত দাঁতনে পাঠাতে পারি, আরও অনেক কিছুই পারি। আপাতত কেবল ওয়ার্নিং দিয়ে রাখলাম। ক্যাবলা—প্যালা—নো তর্ক, ফলো ইয়োর লিডার—মার্চ।
ক্যাবলা গোঁজ হয়ে রইল, আমি গোঁ গোঁ করতে লাগলুম। হাবুল আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে। বললে, আরে, না হয় দিছেই তর পায়ে বিছুটা ঘইষ্যা—তাতে অত রাগ করস ক্যান? ক্ষমা কইরা দে। ক্ষমাই পরম ধর্মজানস না? শুনে আমি হাবুলের কানে কুটুস করে একটা চিমটি দিলুম-হাবুল চ্যাঁ করে উঠল।
আমি বললুম, রাগ করিসনি হাবলা, ক্ষমাই পরম ধর্ম—জানিস না?
টেনিদা বললে, কোয়ায়েট। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ফাঁটির কোনও মানে হয় না। এখন অতি কঠিন কর্তব্য আমাদের সামনে। আমরা বদ্রীবাবুর ওখানে যাব। গিয়ে তাঁকে জানাব যে কম্বলকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে আমরা তাঁকে সাহায্য করতে প্রস্তুত।
ক্যাবলা কান চুলকে বললে, কিন্তু তিনি তো আমাদের সাহায্য চাননি।
আমরা উপযাচক হয়ে পরোপকার করব।
আমি বললুম, কিন্তু বদ্রীবাবু যদি আমাদের তাড়া করেন?
ভুরু কুঁচকে টেনিদা বললে, তাড়া করবেন কেন?
বদ্রীবাবু সকলকে তাড়া করেন। দরজায় ভিখিরি গেলে তেড়ে আসেন, রিকশাওলাকে কম পয়সা দিয়ে ঝগড়া বাধান—তারপর তাকে তাড়া করেন, ঝি-চাকরকে দু বেলা তাড়া করেন, বাড়ির কার্নিসে কাক বসলে তাকে–