Site icon BnBoi.Com

মায়া রয়ে গেল – নবনীতা দেবসেন

মায়া রয়ে গেল - নবনীতা দেবসেন

১. চিঠি লেখা

প্রথম অধ্যায়। চিঠি লেখা

শিলুবাবা,
যেখানেই থাকো, ঈশ্বরের কৃপায় আশা করি ভালো আছ। বুড়ো বাবা-মায়ের ওপর রাগ করে দুরে থেকো না। বাড়ি ফিরে এসো। দিদি যে তোমাকে কত ভালোবাসে, তা কি তুমি সত্যিই জানো না? খুকু আর তুমিও আমাদের প্রাণে আলাদা হতে পারো না। দুজনের সমান অধিকার। এটা তোমাদের দুজনেরই নিজস্ব ঘর। খুকু এখন বীরভূমে। তুমিও আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান একথা ভুলো না, সে তুমি যেমনই হও। আমরা তোমার ও বউমার পথ চেয়ে বসে রইলাম। আমাদের কথা ভেবে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।
—সুরমা, আদিত্য রায়।

রায়-টা কেটে দিলেও হয়। শুধু নাম থাক, সুরমা, আদিত্য।

নাঃ, নামই বা থাকবার কী দরকার? শুধু মা, বাবা বললেই তো হয়। শিলু ঠিকই বুঝবে। না খুকুর বদলে শ্রাবস্তী বলবেন? শ্রাবস্তী এখন বীরভূমে। নাঃ খুকুই ভালো। অনেকবার কেটেকুটে অবশেষে আদিত্য একটা খসড়া খাড়া করলেন। তারপর সুরমার দিকে ফিরলেন।

হয়ে গেছে?

একরকম। ফার্স্ট ড্রাক্ট। দ্যাখো তো এটা চলবে কিনা? প্যাডটা সুদ্ধ সুরমার সামনে মেলে ধরলেন আদিত্য। পড়তে পড়তেই সুরমা উত্তর দেন–

কেন চলবে না? বেশ হয়েছে। তবে অত কথা লেখবার দরকার নেই। খুকু আর তুমি থেকে আলাদা হতে পারো না পর্যন্ত কেটে দাও। নাঃ, অধিকার পর্যন্ত কেটে দাও। কেমন লিগ্যাল টার্মিনোলজির মতন শোনাচ্ছে। বরং বলা যাক, তুমি আর খুকু আমাদের প্রাণ। আবার ওই এটা তোমাদেরই নিজস্ব ঘর।–এরপর লেখো বউমারও। তাহলে একটু বেটার হয়। তাই না।

ক্লান্ত চোখে সুরমা হাসলেন। আর ওই তুমি যেমনই হও অংশটা একদম কেটে দাও। ওটা বড্ড খারাপ শোনাচ্ছে। আর তুমিও আমাদের প্রাণাধিক চলবে না! শুধু তুমি বলো। খুকুর কথা বরং উহ্য থাক এখানে।

আদিত্য প্যাডটি টেনে নিয়ে আবার টেবিলে গিয়ে বসেন। সুরমা উঠে এসে তাঁর পিঠের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছেন। উষ্ণতায় আচ্ছন্ন আদিত্য ভাবলেন, পঞ্চান্নতেও সুরমা কত সুন্দরী! শিলুর বউ হিংসে করবে না? আদিত্য শিলুর বউটিকে অনুকম্পা করলেন মনে মনে। বিয়ে যদিও হয়নি। কিন্তু মনে হয়েছিল ওরা নিজেরা কথা পাকা করে ফেলেছে।

কী যে হল কিছু বোঝা গেল না। সুরমা আপত্তি করেননি, আদিত্যও বাধা দেননি। মেয়েটির চালচলন তাদের পছন্দ ছিল না, হাবভাবে অতিরিক্ত পশ্চিম-ঘেঁষা, পোশাক-পরিচ্ছদে তো বটেই, ভাষাও ইংরিজি, হাতে সর্বদা সিগারেট পুড়ছে। সুরমা-আদিত্যর সামনে শিলু সিগারেট খায় না, কিন্তু লিসা অসঙ্কোচ। লিসার পুরো নাম মোনালিসা গর্গ, পাঞ্জাবি মেয়ে, শিলাদিত্যর সঙ্গেই এন. এস. ডি-তে ছাত্রী। ছুটিতে ওকে শিলু নিয়ে এসেছিল গেলবার।

গ্রীষ্মে দু-মাস ছুটি থাকে। সেই দুটো মাসেই কী যে হল, সংসারটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।

দু-ভাইবোনের ভাব সমাজে আলোচনার বিষয় ছিল। দিদির সঙ্গে শিলুর ঝগড়াও হতে দেখেনি কেউ। কিন্তু সেই শিলু, দিদির নাম শুনলে যেন ক্ষেপে উঠছিল। শ্রাবস্তীর দোষ, দিল্লিতে সে মোনালিসা গর্গের নামে কী সব নিন্দে শুনে এসেছিল, সেগুলো সব শিলুকে জানিয়েছিল। দিল্লিতে প্রচুর বন্ধু হয়েছে শ্রাবস্তীর–আই. এ. এস. ট্রেনিংয়ে গিয়ে। মোনালিসা গর্গকে চেনেনা এমন অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে দিল্লিতে বোধহয় নেই। একবার তাকে দেখলে মনে না রাখা কঠিন। শিলাদিত্য কথাগুলো শুনে দিদির ওপরেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। কথাগুলো কি তা কিন্তু শ্রাবন্তী তাদের জানায়নি। আজ অবধি সুরমা জানেন না, কী নিয়ে ভাইবোনে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। ঝগড়ার পর শ্রাবস্তী বলল, যদি মোনালিসা গর্গ এ বাড়িতে থাকে আমি তাহলে অন্য জায়গায় গিয়ে থাকব। এ বাড়িতে ওরকম অসভ্যতা চলবে না।

কীরকম অসভ্যতা?

শ্রাবস্তী জবাব দেয়নি।

রাত্রে শিলুর ঘরে ওরা ড্রিংকস্ আনত, ওদের পার্টি চলত অনেক রাত অবধি। ছাদের ঘরে কী হচ্ছে, তাতে মাথা ঘামাতেন না আদিত্য। শিলু বাজনা বাজায়, গান করে, তার ঘরে হইচই-তে ছোটবেলা থেকে বাড়িসুদ্ধ অভ্যস্ত–গিটারের ঝঙ্কার, সিনথেসাইজারের বিচিত্র শব্দরূপ, সমবেত গলার প্রাণোচ্ছল গান, এতে খুকুরও তো যথেষ্ট উৎসাহ ছিল। এবার আকস্মিক হলটা কি? খুকু যেন হঠাৎ খঙ্গহস্ত হয়ে উঠল ওই মোনালিসার ওপরে। এমন মূর্তি তার কখনও দেখেননি আদিত্য-সুরমা! কিছুতেই মিশতে দেব না ওদের দুজনকে–ওকে বাড়িতে রাখলে আমি এখানে থাকব না!

এ কী অদ্ভুত ঈর্ষা? কিন্তু শিলুর তো অনেকগুলি বান্ধবী আছে–প্রেমিকাও ছিল, শুভা। খুকুকে তো এমন কাণ্ড করতে দেখা যায়নি? তা যতই খুকুর অপছন্দ হোক, তাই বলে সুরমা তো শিলুর বান্ধবীকে তাড়াতে পারেন না? কটা দিনই তো মাত্র। একটু ধৈর্য ধরো–

বলে খুকুকে বোঝাতে গিয়েছিলেন। খ্যাপা পাগলের মতো কেঁদে ফেলে, রাগারাগি করে, খুকুটা সত্যি সত্যি চলে গেল। সে মেয়ে আই. এ. এস হয়ে গেছে, দিব্যি এম. এল. এ হোস্টেলে থাকতে লাগল। আর শিলাদিত্য সেই যে দিল্লিতে ফিরে গেল, আর বাড়ি আসেনি।

বাড়ি আসেনি, চিঠি লেখেনি, ফোন করেনি, এন. এস. ডি-তেও নেই। ছিল, কিছুদিন পর্যন্ত। নাকি ক্লাসও করেছিল। তারপর উধাও। দিল্লিতেও কেউ জানে না সে কোথায়। সঙ্গে সঙ্গে মোনালিসাও উধাও হয়েছে। দুজনে মিলেই ইলোপ করেছে।

অথচ ইলোপ করার কোনোই প্রয়োজন ছিল না। মোনালিসা গর্গের মা-বাবার যদিও ডিভোর্স হয়ে গেছে, তার মা যদিও আবার বিয়ে করেছেন, দুজনেই কিন্তু মেয়ের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অঢেল ধনবর্ষা ঝরিয়ে যাচ্ছেন। পূর্ণবয়স্ক ছেলে-মেয়ে তারা, বিয়ে করে লিসা নিজের বাড়িতেই থাকতে পারত। শ্রাবস্তী খবর এনেছিল, এখান থেকে ফিরে গিয়ে শিলু আর হোস্টেলে যায়নি, লিসার সঙ্গেই ছিল। হঠাৎ কেন উধাও হয়ে গেল সেখান থেকে দুজনে? পালানোর কী ছিল? কার কাছ থেকে?

সুরমা-আদিত্য তো এখানে, কলকাতায়। শ্রাবস্তীও বীরভূমে। মোনালিসার মা দ্বিতীয় বিয়ের পর কানাডায় সেটলড। বাবার ব্যবসা চণ্ডীগড়ে। তিনি অবশ্য সাতরাজ্য ঘুরে বেড়ান। দিল্লির বাড়িতে মোনালিসা একাই রাজত্ব করে দাসদাসী, বন্ধুবান্ধব, সাঙ্গপাঙ্গো নিয়ে। শিলুর তো অসুবিধে হবার কথা ছিল না।

তবে হঠাৎ ইলোপ করা কেন? এ তো ওলড় ফ্যাশানের কাজ। অতিরিক্ত রোমান্টিকতাদুষ্ট–অনাবশ্যক পলায়ন।

প্রসেনজিতের ছেলে হলেও বা হয়তো তার এমন একটা ধাক্কার প্রয়োজন হতো পিতার ধর্মজ্ঞানের দড়িদড়া থেকে মুক্তি পেতে।

কিন্তু আদিত্য? সুরমা? এ বাড়িতে তো একত্রে বসবাস করেই গেল দুজনে বিয়ে না হতেই। সে মেয়ে কি নিজের ঘরে শুত? রোজ সকালে চা দিতে গিয়ে সুরমা দেখতেন শিলুর খাটেই দুজনে ঘুমোচ্ছে। কোনো লজ্জা-সঙ্কোচের বালাই নেই।

নতুন প্রজন্ম এরই নাম।

এমন আ-ঢাকা হয়ে গেলেই সুখ হয়?

সুখ বড় বালাই। না থেকেও থাকে। আবার থেকেও থাকে না।

প্রসেনজিতকে দ্যাখো। আর সুষিকে।

একজনের সব থেকেও সুখ নেই।

আরেকজনের সুখ কিছুতেই কেড়ে নেওয়া যাচ্ছে না। রাজশেখরবাবুর মেয়েরা দুঃখী হতেই শেখেনি। কি সুষমা, কি সুরমা। আনন্দ তাদের শ্বাসবায়ু।

অন্তত তাই তো ভেবেছিলেন সুরমা এতদিন। কিন্তু শিলুটা সব গোলমাল করে দিল। সাত-মাস খবর নেই–দিল্লি থেকে চলে গেছে। আর এখান থেকে গেছে তো আরও আগে। বছর পার হতে চলল–শিলু একটিবারও যোগাযোগ করেনি। না মা-বাবার সঙ্গে; না দিদির সঙ্গে। খবরের কাগজে এতদিন বিজ্ঞাপন দেননি। পুলিশে খোঁজ দিয়ে রেখেছেন। শ্রাবস্তী প্রচুর তল্লাশি চালাচ্ছে। কিন্তু শিলুর খোঁজ পাচ্ছে না পুলিশ। মোনালিসারও নয়। যেন উবে গেছে দুজনে।

.

মোনালিসারও সুরমাকে পছন্দ হয়নি। আদিত্য বেশ বুঝতে পেরেছিলেন। পছন্দ হবে কেন? সুরমার পাশে মোনালিসাকে মলিন, কাঠখোট্টা দীনহীন দেখাত, তার উগ্র যৌবন, সাহেবী রং, কটা চোখ, কাটা কাটা নাক-চোখ নিয়েও।

শ্রাবস্তীর সঙ্গে ভাবও করল না। করবে কি? শ্রাবস্তী কথা বললে সেখানে মোনালিসাকে তো বাজ পড়ে ঝরে পড়া শুকনো গাছের মতন লাগত। ভিতর তো ফাঁকা। ওই মেয়ে অভিনেত্রী হবে, শিল্পী হবে? এখানে তো সৌজন্যের অভিনয়টুকুও করেনি। গোমড়ামুখে খাবারটেবিলে এসে বসত। সর্বক্ষণ ছাদের ঘরে দরজা বন্ধ করে দুজনের আড্ডা। শ্রাবস্তীও তো অল্পবয়সি মেয়ে। তার সঙ্গেও তো মেলামেশা করবে? তা নয়, শ্রাবস্তীর ধারে কাছে যেত না।

অন্য সময় শিলু এলেই ভাইবোনে জোর আড্ডা হয়। শিলু আবাল্য দিদিভক্ত, দুজনে কখনো কনসার্টে, কখনো থিয়েটারে, কখনো বা ব্ল্যাকে টিকিট কেটেও শাহরুখ খানকে দেখতে ছুটত। এবারে সেই ভাইবোনে কী আশ্চর্য ভাবে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল লিসার কল্যাণে।

এবার শিলুর সময় ছিল না কোনোই। তার ওপরে খুকুর ওই কী সব কথাবার্তা!

খুকু, তুই শিলুকে কী বলেছিলি লিসার নামে? যার ফল এমন তীব্র বিষময়? কী বলেছিলি তুই? কেন চলে গেলি তুই বাড়ি ছেড়ে? কী ভূত ঢুকেছিল তোর মাথায়? তুই তো ঠান্ডা মেয়ে।

সুরমার এসব প্রশ্নগুলি করা হয়নি, কেননা খুকুও আসছে না ছুটিতে। তাই আদিত্য আর সুরমাই একবার গেলেন বীরভূমে। সেখানে মেয়ের প্রতিপত্তি–এস. ডি. ও সাহেবের খানদানি কাণ্ডকারখানা দেখে আনন্দের সুরটা নষ্ট করতে চাননি। বলবার হলে খুকু নিজে বলত। যা বলল তার মানে নেই। সর্বনাশী মেয়েটার পাল্লায় পড়ে এবার শিলু শেষ হয়ে যাবে! যাবে মানে? গেছেই তো! শিলু তো নেই। শিলু কোথায়? খুকুরে, শিলু কই? শিলু?

আছে তো কোথাও। ঠিক সারফেস করবে। টাকাকড়ি ফুরোলেই ফিরবে।

কিন্তু ফুরোবে কেন? লিসার তো অঢেল ঐশ্বর্য।

চাকরি-বাকরি না করলে অঢেল ঐশ্বর্যেও ঢিলে পড়ে, মা! ওরা করছে না তো কিছু।

সুরমার ধারণা খুকু জানে শিলু কোথায়। খুকুকে তেমন বিচলিত লাগছে না। সত্যি সত্যি শিলু হারিয়ে গেলে খুকু অমন শান্ত থাকত না। কিন্তু বলছেও তো না আমাদের কিছু! দেখছে আমরা এত ছটফট করছি। এত কষ্ট পাচ্ছি। শিলুও কি বুঝছে না? শিলুর মতো নরম স্বভাবের ছেলে কেমন করে এতদিন রইল চুপচাপ? ও খুব ভালো জানে ওর বাবার ওকে চক্ষে হারাই স্বভাব। সুরমা বরং সংযত। আদিত্যের তুলনায় তিনি কঠিন বেশি। শিলুটা নিজেও তার বাবার মতোই। ভেতরে ভেতরে খুব নরম। সেই নরম শিলু এত কঠোর হল কেমন করে? একটা চিঠি নেই। ফোন নেই। কোনো যোগাযোগ নেই। মা-বাবা মরে গেছে না বেঁচে আছে তাও জানতে চায়নি। কী এমন অপরাধ করেছিলাম আমরা? খুকুর ওপর রাগ করে তুই আমাদেরও পরিত্যাগ করলি শিলু?

.

দ্বিতীয় খসড়াটা লিখতে লিখতে আদিত্যর কী মনে হল, হঠাৎ মুখ তুলে বললেন, বাংলা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে কিই-বা হবে? শিলু কি আর ওখানে বসে বসে বাংলা কাগজ পড়ে? ওরা তো কিনবে ইংরিজি কাগজ-ইন্ডিয়ান এক্সেপ্রেস, টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া, হিন্দুস্থান টাইমস্, হিন্দু, ডেকান হেরাল্ড–এই সবে বিজ্ঞাপন দেবার মানে হয়। বড় জোর কলকাতার এশিয়ান এজ, দি টেলিগ্রাফ, স্টেটসম্যান। বাংলা কাগজ ওদের নজরে আসবেই না। বাংলাদেশে কি আর ওরা আছে? লিসা শহুরে মেয়ে–মুম্বাই-দিল্লি-চেন্নাই-ব্যাঙ্গালোরের মধ্যেই থাকবে। বড় জোর হায়দ্রাবাদ কি চণ্ডীগড়। নাঃ, বাংলা বিজ্ঞাপনে কেবল আত্মীয়-বন্ধুদেরই নজর কাড়া হবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।

সুরমা চেয়ারের পিঠ ছেড়ে একটু সরে দাঁড়ান। ভুরু কুঁচকে যায়। চোখে পড়বে না? ইংরিজিতে বলতে হবে? কী ভাষায় এই বেদনার কথা বলা যাবে ইংরিজি কাগজে? সুরমা দ্বিতীয় খসড়াটি হাতে তুলে নিলেন।

শিলুবাবা,
যেখানেই থাক ঈশ্বরকৃপায় আশা করি ভালো আছ। বুড়ো বাবা-মায়ের ওপরে রাগ করে দূরে থাকতে নাই। বাড়ি ফিরে এস। তোমার দিদি তোমাকে কত ভালোবাসে তা কি তুমি জান না? দিদির মন খুব খারাপ। তুমি আমাদের প্রাণ। এ বাড়ি তোমাদের দুজনেরই নিজের ঘর। এবং লিসারও। খুকু এখন বীরভূমে। তুমি যে আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান, একথা ভুলো না। আমরা তোমার ও লিসার পথ চেয়ে বসে রয়েছি। আমাদের কথা ভেবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে এসো। টাকা লাগলে জানাও।
—শুভার্থী মা, বাবা।

মা-বাবাই তো? নাকি সুরমা-আদিত্য লিখব? বউমা না লিখে লিসাই বললাম।

ভালো করেছ। কিন্তু ইংরিজি কাগজে তো এটা দেওয়া যাবে না!

নাঃ। ইংরিজিতে নোটিশ লিখতে হবে।

নোটিশ?

না, মানে এইরকম চিঠি। আদিত্য কিঞ্চিত অপ্রস্তুত।

ইংরিজি বললেই কেমন যেন নোটিশ নোটিশ মনে হয়না গো? সুরমা হেসে ফেলেন। আদিত্য মুগ্ধ হয়ে দেখেন। তারপর কলম কামড়ে আবার ভাবনা শুরু। এবার ইংরিজিতে।

সুরমা জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ান। আশ্চর্য একটা সময়। ঘোর বর্ষা নেমেছে। অথচ কৃষ্ণচূড়া গাছটা ফুলে ফুলে ভরা। গাছের তলার রাস্তাটা ভিজে লাল ফুলে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। এখন আদিত্যকে তাহলে ইংরিজিতে লিখতে হবে পথ চেয়ে আছি–লিখতে হবে–বুড়ো বাবা-মায়ের ওপর রাগ করে দূরে থাকতে নেই। প্রাণাধিক-এর ইংরিজি কী হবে? নাঃ, ইংরিজিতে মনের কথা কিছুই বলা যাবে না শিলুকে। কেবল বিজ্ঞাপনই দেওয়া যাবে। ওই যে বললেন, নোটিশ। সেটুকুই হবে। সুরমা দীর্ঘনিঃশ্বাসটা চাপতে পারলেন না। শিলুবাবা, ফিরে আয়–এর ইংরিজি কী?

.

আদিত্য বললেন, নাও, পড়ো।

তুমিই পড়ে শোনাও না।

শোনাব? পড়ছি তাহলে। শোনো।

আদিত্য একটু গলা ঝেড়ে নিয়ে শুরু করলেন

Shilu, dearest,
Please come back, we are missing you every moment. There is no reason for Lisa to feel unwanted here in your own home. Do not misunderstand Didi, she loves you, you know it in your bones, She is posted in Birbhum, and is missing you terribly. Please excuse her if she has hurt your feelings. We all make mistakes, but never doubt our intentions. Please forgive us and come home. Lets know if you need money.
—Ma, Baba

বেশি বড় হয়ে গেল। না গো? এটা ঠিক আছে? আসলে আমি

উদ্বিগ্ন, অনিশ্চিত গলায় কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যান। কাগজ নামিয়ে রেখে মাথা তুলে সুরমার মুখে প্রশ্নভরা চোখ রাখেন আদিত্য। অনেকবার কেটেকুটে এই খসড়াটা প্রস্তুত করেছেন। সুরমা ঘরের উল্টোদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে মোড়া পেতে বসে জানলা দিয়ে বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে শুনছেন।

হয়েছে?

সুরমা হাসি হাসি চোখে তাকালেন।

বেশ হয়েছে। শেষটাতে দুটো কথা যোগ করা যায়?

কেন যাবে না, কি লিখব বলো?

ওই If you need money-র পরে বরং লেখো, We are counting days for your return, আরও লেখো, Love and blessings,, ওই সবশেষে ঠিক মা-বাবার আগে।

সত্যি সুরমা। তুমি না হলে হয়? এই সুন্দর টাটা মায়ের হাতের না হলে হত কখনো? বাবাদের বড় কাঠখোট্টা, কেজো ভাষা!

মোটেই কাঠখোট্টা কেজো ভাষা হয়নি ওটার। হৃদ্‌প্লাবন বইয়ে না দিলেই বুঝি কাঠখোট্টা? আসলে ইংরিজি ভাষার গুণেই আমাদের আবেগকে সংযত ভদ্র করে দেয়। বাংলা, ঠিক তার উলটোটি। আহ্লাদে গদগদ ভাষা!

সুরমা উঠে পড়লেন।

কোথায় চললে?

রান্নাঘরে, রুটি করতে।

তার আগে একটু চা হবে না?

অতি অবশ্যই। কিন্তু এখন কটা বেজেছে?

চা খাবার ঢের সময় আছে। ডিনার খেতে এখন অনেক দেরি।

কোথায় কোথায় পাঠাবে চিঠিটা?

দেখি। ওই যে নামগুলো বললুম? আগে এটা টাইপ করতে হবে, তারপর আট-দশটা কপি করে প্রত্যেকটা কাগজের ঠিকানায় পাঠাতে হবে।

ও বাবা! একসঙ্গে আট-দশটা? সে অনেক খরচার ব্যাপার! একেই এত বড় সুদীর্ঘ চিঠি! একটু ছোট করো।

তাহলে কী সাজেস্ট করছ?

ওই তো। এক এক সপ্তাহে বরং এক একটা কাগজে দিয়ে দ্যাখো।

ওতে চোখে পড়বে না। ও যে কোন কাগজটা দেখবে–মাত্র একবারই বেরুলে, ব্যস–

শুধু রবিবারে রবিবারে বিজ্ঞাপনটা দিও। প্রতি রবিবারে, বিভিন্ন কাগজে বেরুতে থাকুক। একবার না একবার নজরে পড়বেই। প্রত্যেক সপ্তাহে ধরেই রাখো, শিলুর জন্য এই একটা বড় খরচ। কী বলো?

মন্দ বলোনি। রোববার রোববার। চিঠিটাকে বরং সংক্ষিপ্ত করা যাক। সংখ্যায় বেশিবার বেরুনোটা তার চেয়ে জরুরি।

তা ঠিক।

সুরমা রান্নাঘরে চলে গেলেন। আদিত্য আবার নতুন করে ঝুঁকে পড়লেন প্যাডের ওপরে। আরেকটা খসড়া চাই। ছোট চিঠি। কোন লাইনগুলো অতিরিক্ত? কোন কথাগুলো না বললেও চলবে? কী কী না বললেই নয়? Shilu, dearest; নাঃ–ঠিক শোনাচ্ছে না।

Shilu Baba,
We are sorry, Please come bask home and try to excuse our faults. We are getting old and silly but we love you, Didi is missing you terribly, She is posted in Birbhum. Please bring Lisa, this is her home as well. Let us know if you need money. Countings days, waiting for you, with love as ever, Ma & Baba.

কি সুরমা চা হল? এইটে কীরকম হয়েছে দেখে যাও। নিউ, ইমন্ড অ্যান্ড অ্যাব্রিজড় ভার্শন!

কাগজটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দেন আদিত্য।

.

দ্বিতীয় অধ্যায়। যেতে নাহি দিব

সুষি, প্লিজ এখন বেরিয়ো না, আমার আজ মাথাটা ভীষণ ধরে আছে।

সুষমার ভুরুটা কুঁচকে উঠল। কপালে টিপটা এঁটে নিয়ে ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক লাগাতে থাকেন। লিপস্টিক লাগিয়ে ঠোঁট দুটো টিপে ঘষে নেন। চশমাটা পরে ভালো করে এদিক-ওদিক থেকে মুখটা দেখে নেন, তারপর আরেকবার সরু চিরুনিটা চালান সরু সিঁথির দু-পাশে। নিজের নুনমরিচ ছড়ানো চুলটা দেখতে বেশ লাগে আজকাল। চিরুনিতে সিঁদুর নিয়ে সিঁথিতে টানছেন। প্রসেনজিৎ আবার বলে ওঠেন, কথা বলছি, শুনছ না? বেরিয়ো না। আমার মাথা ধরেছে। সুষি প্লিজ। চশমার ওপাশ দিয়ে তাকালেন সুষমা। প্রসেনজিৎ শুয়ে আছেন তাকিয়া ঠেস দিয়ে। বিশাল মেহগনি কাঠের পালঙ্ক। প্রসেনজিতের হাতে জরিজড়ানো গড়গড়ার নল থাকলে খুব মানাত। কিন্তু ওর কোনো নেশা নেই, শুধু পান। মাঝে সিঁথি। চুল একটু পাতলা হয়ে এসেছে। কিন্তু গোঁফটা খুব ঘন। প্রতাপবান। চুল অনেকটাই সাদা, কিন্তু এখনো বেশ কিছু কালো চুল রয়েছে পেছন দিকটায়। গোঁফ কিন্তু অনেকদিনই পুরো সাদা। আগে আগে কত যত্ন করে কলপ লাগাতেন প্রসেনজিৎ। এখন ছেড়ে দিয়েছেন। প্রসেনজিতের পাশের খাটের ওপরে চারখানা খবরের কাগজ, দুটো ইংরিজি, দুটো বাংলা। আরও একটা। বাংলা কাগজ আসে। সেটা এখনও নীচে।

মাথা ধরল কেন? পেটটা পরিষ্কার আছে তো? ইসবগুল খেয়েছিলে?

তারপরেই ডাক, মণির মা! মণির মা!

থাক, আর ওকে ডাকতে হবে না। কিন্তু মণির মা এসে গেছে।–দাদাবাবুকে কি ইসবগুলের শরবৎ দিয়েছিলে?

কেন? দোবো না কেন?

ও আবার কি? বলো, হ্যাঁ দিয়েছি।

চা দিইচি, জলখাবার দিইচি, ফল দিইচি, বেলের পানা দিয়েছি, ইশগ্লুল দিইচি, সেই সক্কাল থেকেই তো দাদাবাবুর চলতেচে!

বাঃ, কথার কি ছিরি! আশ্চর্য! যাও নিজের কাজে যাও এবার। বড়ো বুড়ো হয়ে গেছ সত্যি!

কাজই তো কচ্ছিলুম। তুমি ডেকে আনলে তাই। বুড়ো হব না তো কি হুঁড়ি হব? বলি বয়সটা কত হল, সে খেয়াল আচে?

কী কাজ কচ্ছিলে?

পান সাজতিচি।

সাজো গে যাও। ভালো করে ধুয়ে নিয়েছ তো পটাশ পারমাঙ্গানেট দিয়ে?

ওই বেগনে ওষুধে তো? হ্যাঁ গো হ্যাঁ।

মণির মা চলে যেতেই প্রসেনজিৎ বললেন, পটাশিয়ান পারমাঙ্গানেটে বিশ্রি আঁশটে গন্ধ করে। ওতে কেন পান ধোও?

এবার সুষমা হেসে ফেলেন।

তুমি তো জর্দার সুগন্ধেই সব কুগন্ধ ঢেকে নেবে। কঁচা কাঁচা পাতাগুলো যে খাবে কে জানে কী বীজাণু আছে? তার ওপর পেস্টিসাইড থাকতে পারে। সতর্ক হওয়া ভালো। স্যালাড আর পানের বেলায় বিশেষ করে। তুমিই তো আমাকে এটা শিখিয়েছ! নিজে ডাক্তার–আর আমাকে জিগ্যেস করছ?

ব্যাগটা তুলে নিয়ে সুষমা কব্জির দিকে তাকান। তারপর দেওয়ালঘড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে প্রসেনজিতের চোখও যায় সামনে দেওয়ালঘড়িতে। তিনি বলে ওঠেন, এত করে বলছি, যেও না। তবু যাচ্ছ? বলছি মাথাটা ধরেছে, একটু বোসো না বাবা মাথার কাছটায়। তোমার বাইরে এত কী কাজ?

কী করে বসি বল তো? আজকে যে অ্যাডভাইজারি কমিটির মিটিং ঠিক এগারোটার সময়। তুমি ততক্ষণ চানটা সেরে নাও। লাঞ্চের পর বরং আমি আর থাকব না। বাড়িতে চলে আসব। কেমন?

সুষমার গলা কিঞ্চিত বিপন্ন।

গাড়ি নিয়ে যাচ্ছ?

নাঃ। ওরা গাড়ি পাঠাবে।

বলতে বলতেই গেটে বেল বেজে ওঠে। ওই এসে গেল তোমার জয়রথ।

জয়রথই বটে! সুষমা ব্যাগটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে যান।

বাচ্চু! রঘু! মণির মা! কে আছিস?

বাচ্চু, রঘু, মণির মা তিনজনেই এসে পড়ে প্রসেনজিতের হুঙ্কারে।

টাইগার বামটা কোথায়? মালিশ করে দে মাথাতে একটু

বাচ্চু, মণির মা, রঘু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপর বাচ্চু যায় টাইগার বাম আনতে ড্রয়ারের দিকে। বাকি দুজন পালায়। পড়ার চশমা পরে নিয়ে প্রসেনজিৎ একটা কাগজ তুলে ধরেন চোখের সামনে। বাচ্চু টাইগার বামের ডিবে হাতে করে এসে দাঁড়াল। বাবু চশমা না খুললে কপালে মালিশ করবে কী করে? কিন্তু কথাটা বলবেই বা কী করে! মলমের কৌটো বাচ্চুর মুঠোয়। বাচ্চু দাঁড়িয়েই থাকে। প্রসেনজিৎ কাগজ পড়েন। কান খাড়া থাকে, কখন নীচে গাড়ি স্টার্ট করার শব্দ হবে।

.

এই যে মিতালি। ওদিকের সবাই এসে গেছেন?

ব্যাঙ্গালোরের প্লেন লেট দিদি। ডঃ এস. বি রাও এসে পৌঁছতে পারেননি এখনও। বাকিরা এসে গেছেন।

গাড়িতে পা দিতে দিতে সুষমা জিগ্যেস করেন, গেস্টহাউসে ওদের কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো? এই নতুন গেস্টহাউসটা তো এবারই প্রথম ট্রাই করলাম আমরা।

না, না, এখানে সবকিছুই সুবিধের দিদি–একটাই শুধু মুশকিল, বাড়ির সামনের রাস্তায় বড্ড জল জমে যায়। কালকের বৃষ্টিতে বেশ জল দাঁড়িয়ে গেছে। তবে ওদের অসুবিধে হয়নি, টাটা সুমোটা গেছে তো–বেশ উঁচু আছে।

মিতালির বাকি কথাগুলো সুষমার আর কান আসছে না। প্রসেনজিৎ প্রচণ্ড গোলমাল বাধিয়েছেন রিটায়ার করার পর থেকে। বাড়িতে বসে বসে টি. ভি. দেখে, আর কাগজ পড়ে সময় কাটাচ্ছেন। কিছুতেই চেম্বারে বসবেন না। এতদিনের দীর্ঘ ডাক্তারির অভ্যাস ছিল। প্র্যাকটিস করলে সময় কাটে, ব্যস্ত থাকেন। মাথাটাও একটু পরিষ্কার থাকে। আর সুষমাও বাঁচেন। কিন্তু প্রসেনজিৎ প্র্যাকটিস করবেন না। রিটায়ার করবার আগেই সুষমা যত্ন করে নীচের তলায় তিনটে ঘর জুড়ে চমৎকার চেম্বার সাজিয়ে দিয়েছিলেন। সেসব কোনো কাজে লাগেনি। শূন্য পড়ে আছে। সমস্ত পরিশ্রম জলে গেল এবং খরচাপাতিও কম হয়নি। তাই সুষমা ভাবলেন ওঁদেন সংগঠনের কাজে লাগাবেন জায়গাটা। একটা ডাক্তারি পরীক্ষার কেন্দ্র খোলা যেতে পারে। বালিকা সুরক্ষা সমিতি ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সংঘ থেকে ক্রমশ সুষমার কাজে এসে পড়েছে যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য নিয়ে জাতীয় এড়স নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যেও। কত জরুরি কাজে যে লাগানো যেতে পারে এই সাজানো ঘর কটিকে।

কিন্তু তাতেও বাদ সাধলেন প্রসেনজিৎ। তোমার ওসব বাইরের কাজ বাইরেই থাকুক, বাড়ির মধ্যে টেনে আনা চলবে না। আজ তোমার আদরের প্রস্টিটুটরা আসবে, কাল তোমার সোহাগের এক্স রুগিরা-ওসব এখানে চলবে না। ভট্টচায্যিবংশের বসতবাটি এটা। তোমার বোধহয় মনে নেই।

সত্যি, মনে ছিল না সুষমার। আটত্রিশ বছর হয়ে গেছে তাঁর এই বাড়িতে। এ বাড়ি প্রসেনজিতের। তার অনুমতি বিনা সুষমা এটা ব্যবহার করতে পারেন না। ঝকঝকে। ফার্নিশড। তিন তিনটে ঘর। এমন ভালো রাস্তায়। সাজানো।

তবে ভাড়া দিয়ে দাও কোনো নতুন ডাক্তারকে?

পাগল? ভাড়া দিই আর সে এখানে মৌরসী পাট্টা গেড়ে বসুক? ভাড়াটেই তো এযুগে মালিক। কেন, তোমার কি ভাত জুটছে না যে ঘরের মধ্যে ভাড়াটে ঢোকাতে চাইছো? তারপর একটু হেসে, নাকি এই বুড়ো ডাক্তারটাকে আর মনে ধরছে না–একটা ছোকরা ডাক্তারের দরকার হয়ে পড়েছে এই বাড়িতে?

চুপ করে যান সুষমা।

এই চিমটি কাটা কথাগুলো তিনি শুনছেন বহুকাল। সেই সতেরো বছরের মেয়ে এ বাড়িতে এসেছিলেন। প্রসেনজিৎ সদ্য এম. বি. বি. এস. করে এম. ডি. করছেন। সাতাশ বছরের ব্রিলিয়ান্ট যুবক–মহেন্দ্ৰনিন্দিত কান্তি, রাজেন্দ্রদর্শন। এমন সুপুরুষ কিশোরী সুষমা তার জীবনে আর দেখেননি।

মা-হারা মেয়ে দুটিকে বুকে করেই মানুষ করেছিলেন রাজশেখরবাবু যদিও তাকেও সরকারি চাকরিতে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। বাইরে বাইরেই মানুষ সুরমা আর সুষমা। যমজ বোন, কিন্তু অবিকল একরকম দেখতে নয়। মুখ-চোখ-চুল গড়ন সব এক–শুধু সুষমার রংটি দুধে-আলতায় ধোয়া, আর সুরমা শুধু গৌরী।

কচি মেয়ে দুটিকে ফেলে ওদের মা চলে গেলেন কদিনের জ্বরে। মফস্সল টাউনে ঠিকমতো চিকিৎসা হয়নি। ওরা তখন পাঁচ বছরের। রাজশেখরবাবু মেয়েদের মানুষ করায় কোনো অবহেলা করেননি। মা-বাপের যত্ন-স্নেহ একাই উজাড় করে দেবার চেষ্টা করেছেন। বদলিতে ঘুরে বেড়ানোর চাকরি বলে আত্মীয়-স্বজনের বলটাও ছিল না হাতের কাছে। যদিও তাঁর দিদি বলেছিলেন মেয়েদের তার কাছে জলপাইগুড়িতে রেখে মানুষ করতে। রাজশেখরের শ্বশুর-শাশুড়িও তখন বেঁচে। তারাও চেয়েছিলেন নাতনিদের ভার নিতে। কিন্তু সন্তান-অন্ত প্রাণ পিতা তিনি নিজেই কিছুতেই ছাড়তে পারেননি ছোট ছোট মেয়েদের।

অবশ্য সুষমা-সুরমা মানুষ হয়েছেন ভালোই–বাবার আদরে-আহ্লাদে নষ্ট হয়ে যাননি। বরং ছোটবেলা থেকেই তারা একই সঙ্গে লেখাপড়া, ঘরকন্নার কাজ শিখেছেন। নিজেদের ভার যেমন নিজেরা নিতে শিখেছেন, তেমনি বাবার দায়িত্বও ভালোবেসে অনায়াসে বহন করেছেন দুই বালিকাতে।

দেখেশুনেই বিয়ে দিয়েছিলেন রাজশেখর। প্রথম যে ভালো সম্বন্ধটি এল, দুই রূপসী মেয়েকেই দেখালেন; বড়লোকের ডাক্তারছেলের সঙ্গে বেশি ফর্সা মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। একটু কম ফর্সা বলে সুরমার বিয়ে হল তার পরের বছর। পাত্র অধ্যাপক। দুই বোনই বিয়ে হয়ে কলকাতাতে সংসার পাততে এলেন। বাবা দূরে থাকলেও ভাগ্যগুণে বোনেরা রইলেন কাছাকাছির মধ্যেই। এখনও আছেন। এটা তাদের মস্ত জোর।

দিদি একটু দেখে নামবেন, এখানটায় একটু কাদা রয়েছে–

মিতালির সতর্কবাণীতে সুষমার খেয়াল হয়। এসে গেছেন সভাগৃহে। ঘড়ি দেখলেন। এখনও দশ মিনিট সময় আছে। তার মধ্যে অ্যাজেনডাটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে হবে। ডাঃ, রাওয়ের প্রতিবেদনটি তো এসে পৌঁছল না, অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

.

তৃতীয় অধ্যায়। কচুপাতার টুপি

সুষমার ফোন এসেছিল। তুমি কি থাকবে কাল বিকেলে?

চা ঢালতে ঢালতে সুরমা মুখ তুলে তাকান স্বামীর দিকে

কেন? সুষি আসবে বলল?

বোধহয়। তুমি একটু জেনে নাও। মনটন ভালো মনে হল না।

চিড়েভাজার প্লেট এগিয়ে দিয়ে সুরমা বলেন,

মন ভালো থাকবে কেমন করে? জামাইবাবু যা কাণ্ডকারখানা শুরু করেছেন, সুষির কাজকর্ম সব বন্ধ করে দেবার জোগাড়। সত্যি সত্যিই যদি কোনোদিন, ভগবান না করুন–উনি যদি কখনো কোনো রোগে পড়েই যান–তখনই যে কী করবেন!

তখন প্রসেনজিৎ যাই বলুক, সুষমা বেচারি যে কী করবে! সত্যি মেয়েটার ভাগ্য বটে! কপাল করে এসেছে একখানা!

মানুষ যা যা চায় সুষির কপালে সবই তো জুটেছিল। বাবা তো দেখেশুনেই বিয়ে দিয়েছিলেন। যদি আমি ওর মতন দুধে-আলতায় গোলা হতুম–তাহলে আজ প্রসেনজিতের ঘরে হয়তো আমিই থাকতুম।

ভাগ্যিস! দুধে-আলতায় নয়, আমে-দুধে গোলা রূপসী তুমি! অবশ্য প্রসেনজিতের ঘর করার সুযোগ তোমার চাইলে এখনো হতে পারে। প্রসেনজিতের যা আত্মগত তুরীয় অবস্থা, সে এখন আর সুরো-সুষির মধ্যে তফাত করতে পারবে না। যমজ কন্যা বলে কথা। দুজনেই তন্বী, গৌরী; সুন্দরী, হৃদয়বিদারিনী

হয়েছে হয়েছে। চুপ করো। এদিকে বলছ ওর মনটন ভালো নেই—

কিন্তু আমার মনটন ভালো নেই তো বলিনি-আদিত্য সুরমার হাতটা জড়িয়ে ধরেন।

খালি ঠাট্টা!

আস্তে হাতটা টেনে ছাড়িয়ে নেন সুরমা। আদিত্য হাসতে হাসতে চিড়েভাজা মুখে দেন। তারপর বলেন,

কিন্তু কেন বললে সুষমার কপালে সবই জুটেছিল? সবই মানে কী?

মানে, মেয়ের বিয়ে দেবার সময় বাপ-মায়ে কী কী খোঁজে? সেই সব।

যেমন?

যেমন ধরো, বংশ। তা কোন্নগরের ভট্টাচায্যি। আর কী চাই? জমিদার বংশ, তায় পণ্ডিত। তারপর, শিক্ষা। শ্বশুর ইঞ্জিনিয়ার। পাত্র ডাক্তার। এম. ডি. করছে। আর কী চাও? তিন–স্বাস্থ্য। অটুট যৌবন। ছফুট দুইঞ্চি হাইট। মনের ভেতরটা তো দেখা যায়নি? চার, রূপ–অনিন্দ্যসুন্দর, রূপবান পুরুষ। এত সুন্দর পুরুষ আমি তো আর দেখিনি সুষির বিয়ের আগে!

তার পরে তো দেখেছ? জবাকুসুমসংকাশংকে দেখছ না? কোথায় লাগে প্রসেনজিৎ? সূর্যের মতো ভিরিলিটি আর কিসের আছে? নিজের ঘরে এমন আদিত্যবর্ণং পুরুষং মহান্তম্ নিয়ে, বোনের দিকে

সুরমা কথার মাঝপথেই ঢুকে পড়েন,

জামাইবাবুর মতো অমন একমাথা চুল কি তোমার আছে? সুষির টাকে বেদম আপত্তি ছিল। হল তো? আর ধর্ম? পড়ো তুমি গায়ত্রী মন্ত্র চোখ মেলে? উনি গায়ত্রী না পড়ে জলস্পর্শ করেন না! তারপরে, জামাইবাবু সংস্কৃত জানেন, শাস্ত্রটাস্ত্র পড়েছেন। ডাক্তার হলে কী হবে তিনবেলা আহ্নিক করেন। তখন কি বুঝেছি এর মানে কী? আর তারপরে ধরো-পরিবারে শুধুই শ্বশুর-শাশুড়ি। এক ননদ। সে বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। এর চেয়ে ঝাড়াঝাঁপটা শ্বশুরবাড়ি কোথায় পাবে?এতগুলো প্লাস পয়েন্টের পরেও যেটা সবচেয়ে জরুরি, তাও ছিল–ধনৈশ্বর্যে লক্ষ্মী লাভ হবে। কোনোদিন অর্থাভাব হবার কথা নয়। শ্বশুরের এত সম্পত্তি আছে। এমনি আইডিয়াল সম্বন্ধেও মেয়ে না দিলে, কি তোমাকে দেবেন?

এবার হেসে উঠে এক হাতে সুরমার কোমরটা সহসা জড়াবার চেষ্টা করেন আদিত্য। তখুনি উল্টোপাক খেয়ে তরুণীর দ্রুততায় নিমেষে নিজেকে মুক্ত করে নেন সুরমাও। আদিত্য কিন্তু আবার পাকড়াও করেন স্ত্রীকে।

আর আমি? আমি কেমন পাত্র?

কোনো গুণ নাহি তার কপালে আগুন!

আহা সে তো শিবঠাকুর! আমি কি শিবঠাকুর?

তুমি তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের একজন।

নন্দী, না ভৃঙ্গী?

দুটোই একসঙ্গে!

আচ্ছা সুরো, আমি একেবারে প্রসেনজিতের বিপরীত মেরু, না? শুনতে শুনতে হঠাৎ স্ট্রাইক করল ব্যাপারটা। কী দেখে তোমাকে দিলেন উনি আমার হাতে? আমার তো ছিল না কিছুই, শুধু দূর আশা ছাড়া।

তাই বা খারাপ কী? একটু থেমে সুরমা বলেন, ইনফ্যাক্ট, তোমাদের বারদির ভিটেবাড়িটা একবার গিয়ে দেখে আসার ইচ্ছে আছে। ওটা তো লোকনাথ বাবারও ভিটে।

জ্যোতি বসুর বাবারও ভিটে বারদি।

কিসের সঙ্গে কী!

কেন গুরুর সঙ্গে গুরুই তো!

লোকনাথবাবা শুধু গুরু নন। অনেক বেশি।

জ্যোতিবাবুও তাই।

ঠাট্টা রাখো। জ্যোতিবাবুকে আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা হয়। হি ইজ অ্যান অনেস্ট ম্যান। নির্লোভ। ঘুষ খান না। পার্সোনাল গেইনের জন্য রাজনীতি করেন না। কত বছরের অভিজ্ঞতা বলো তো ভারতীয় রাজনীতিতে? ওঁর সঙ্গে তুলনীয় আরেকটা নাম দেখাও দেখি? কেউ নেই!

কেন, প্রিন্স অব কারগিল? কবি অটল বিহারী বাজপেয়ী!

তোমাকে নিয়ে পারা গেল না।

আরে, গিভ দ্য ডেভিল হিজ ডিউ? ও-ও পার্সোনাল গেইনের জন্য রাজনীতি করে না, অনেক বছরের অভিজ্ঞতা আছে, অ্যান অনেস্ট, অ্যান্ড লার্নেড় ম্যান, ঘুষটুষ খায় না, উপরন্তু কবিতা লেখে। ওয়ান আপঅন জ্যোতিবাবু কিনা?

আরে? তুমিও কি বেজেপি হয়ে গেলে নাকি? জামাইবাবুর মতন? কি সর্বনাশ!

আজ্ঞে না, আমি যা ছিলুম ছাত্রবয়স থেকে এখনও তাই আছি। তাই থাকব ম্যাডাম। এম. পি. তো নই, যে ফ্লোরক্রসিং করলে জীবনে উন্নতি হবে? আমার ইনসেটিভষ্টা এতে কী, বলুন? আপনি দেখছি ঠাট্টা বোঝেন না।

তবু ভালো! ঠাট্টা!

চা শেষ? যাও, তবে সুষমাকে ফোনটা করে ফ্যালো এইবারে?

ওঃ হো! থ্যাকিং য়ু–ভুলেই যাচ্ছিলাম–

চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি ফোনটা তুলে নেন সুরমা। নিজের কাপে আর একবার চা ঢালতে ঢালতে আদিত্য জিগ্যেস করেন, তোমাকে আরেক কাপ দিই? সুরমা বলেন, হ্যাঁ, প্লিজ!

.

কি রে সুষি ফোন করেছিলি?

তুই বেরিয়েছিলি কোথায়? আজ তো তোর গানের ক্লাস নেই?

নাঃ, এই একটু খুচরো বাজার করতে, দু-একজনের জন্য দু-একটা শখের জিনিস–রাস্তায় ঘুরে ঘুরে–ওই আরকি–তোরা কেমন আছিস বল? তোকে কাল রাতের খবরে টিভিতে দেখলাম। মঞ্চে বসে আছিস। পুলিশ কমিশনার আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সঙ্গে।

ওঃ! পথের শিশুদের জন্য ওঁরা একটা প্রকল্প করেছেন নবদিশা বলে। CINI, CARE বালিকা সুরক্ষা খেলাঘর এমনি অনেকগুলো NGO নিয়ে কাজ করবেন–তারই উদ্বোধনী সভা

সুন্দর লাগছিল তোকে।

সেই তো হয়েছে ঝামেলা। যত সিম্পলই সাজি না কেন, টিভিতে সুন্দর দেখাবেই। আর তোর জামাইবাবু বিচলিত হয়ে পড়াবেনই। কী যে করি, বুড়ো হয়ে মরতে চললুম, এখনও এই যন্ত্রণা কাটল না। ওঁর স্বভাব আর বদলাল না। বরং বয়স যত বাড়ছে মন্দ গুণগুলোও তত বাড়ছে।

আসলে জামাইবাবুর সেই স্বর্গ-মর্ত্য কাঁপানো রূপটা তো আর নেই। ভুঁড়ি হয়ে, নাদুসনুদুস, অন্যরকম দেখতে হয়েছেন–তায় মাথাভর্তি অত পাকাচুল। পুরো গোঁপটা সাদা! এদিকে তোকে বয়সের চেয়েও অনেক বেশি ছোট দেখায়। ফিট আছিস। টাইট, হালকা সুশ্রী আছিস তো। তাই ওঁর চোখ টাটায়। হি ইজ জেলাস অফ ইউ। হি ফিলস্ ইনসিকিয়োর।

কিসের জন্যে জেলাস হবে বল্ তো? আমি কী করেছি?

অফ ইয়োর ইয়ুথফুলনেস। ফিগারই তো শুধু নয়, মুভমেন্টস, রেসপন্সেস, তোর অ্যাটিটুড টু লাইফসবকিছুর মধ্যেই অল্পবয়সটা সারাক্ষণ ফুটে বেরোয়।

আর ইয়ুথ! তুই তো জানিস বাড়িতে কিসের মধ্যে থাকি!

থাকলেই বা? এনার্জিটাই যৌবনের আসল কথা। তুই তো হাজার কাজে সারাক্ষণ দৌড়ে বেড়াচ্ছিস একটা আরবি ঘোড়ার মতন। আর জামাইবাবু ভুড়িদাস হয়ে খাটে শুয়ে শুয়ে শরবৎ খাচ্ছেন, আর পান চিবোচ্ছেন, টি. ভি. দেখছেন আর কাগজ পড়ছেন। নড়ে বসছেন না। ওঁর তোকে হিংসে হবে না তো কি! ওটুকু এখনও তোর অভ্যেস হল না? তুই এখনও ওই নিয়ে কাঁদবি? সুষি!

অ্যাই?-আমি এবার বকব। আচ্ছা, ওই যারা তোকে এত ভক্তি করে, তোর সঙ্গে কাজ করে, সেইসব ছেলেমেয়েগুলো যদি তোকে এখন দেখতে পায়? তারা যে দিদি বলতে শ্রদ্ধায় মুচ্ছো যাচ্ছে, সেই দিদি ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছেন,–দেখলে ওরা কী ভাববে তোকে? বল তো?

তুই অনেকটা ওপরে উঠে গেছিস সুষিজামাইবাবুর নাগালের মধ্যে তুই নেই, সেইজন্যেই ওঁর এত রাগ! তুই কিচ্ছু বুঝিস না? ইগনোর করতে শেষ। ইগনোর হিম। ইগনোর হিজ ট্যানট্রামস। সব আপনিই ঠিক হয়ে যাবে।

আদিত্য এগিয়ে এসে স্ত্রীর শূন্য চায়ের কাপটা এক হাতে তুলে নিয়ে, ফোনের দিকে অন্য হাত বাড়িয়ে দেন

আমাকে একটু দেবে? সুরমা রিসিভার হাত বদল করেন। আদিত্য শুরু করেনঃ

কী গো সুষমিবাঈ? ক্যা হুয়া? দিলমে দর্দ? মেরে পাস আ যাও, সব কুছ ঠিকঠাক কর দেগা। ফার্স্ট ক্লাস দাওয়াই হ্যায়। আসবে? নাকি ইগনোর হিম করবে? না এলে আমিও কিন্তু ট্যানট্রামস ছুঁড়ব। আমি তোমার জন্যে কাল বিকেলে। ৫টা-৫ মিনিটে। খিড়কির পুকুরের সামনে। মানকচুপাতা মাথায় দিয়ে। অতি অবশ্যই। নো অন্যথা! সেই কথাই তবে রইল? ওকে? সুরমা ফোন টেনে নেন,–ওদিকে সুষমার হাসির শব্দ পেয়ে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

সেই কথাই রইল সুষি। তোর জামাইবাবু মানকচু বনে তোর পথ চেয়ে বসে থাকবেন। চলে আসিস। ঠিক তো? বিকেল বেলায়।

রিসিভার ক্রেডলে নামিয়ে রেখে সুরমা আদিত্যর দিকে হাসিমুখটি ফেরান। দুই চোখে কৃতজ্ঞতা ছলছল। আদিত্য স্ত্রীর সামনে গরম চায়ের পেয়ালাটি নামিয়ে দিয়ে সহাস্য ভুরু নাচান, ভাবখানা–কী? কেমন বলেছি?

.

সুরমা চিরদিন গম্ভীর, স্বল্পবাক্। আদিত্য তাকে ভালোবেসে, ভয় ভয় করে মেনে চলেছেন। সুষমা যেমন ভীরু, কোমল ছিলেন, কড়াকথা বলতেই পারতেন না, একটুতেই কেঁদে ফেলতেন, কেউ অন্যায় করলে ভয়ে প্রতিবাদ করতেন না, সব অত্যাচার মেনে নিতেন, সুরমা ঠিক তার বিপরীত। নিজে যেটা ভালো বুঝবেন সেটাই করবেন। স্বল্পবা, কিন্তু নির্ভয়ে সত্য বলবেন। প্রিয় হোক, বা না হোক, তা নিয়ে ভাববেন না। গুরুজনকেও রেয়াৎ করবেন না। অথচ ব্যক্তিগত অনুভূতির বেলায় চাপা। অপ্রকাশ। আদিত্যর এই মেয়েকে চিনতে দেরি হয়নি।

শ্রাবস্তী অনেকটাই তার মায়ের স্বভাব পেয়েছে। সোজাসুজি স্পষ্ট কথা বলে দেয়। আদিত্য তো বেশ ভয়ে ভয়ে থাকেন–মেয়ে যে কেরিয়ারে গেছে, সেখানে এই খোলাখুলি স্বভাবচরিত্র বড় ধাক্কা খায়। শ্রাবস্তী আই. এ. এস হয়েছে। এখন সে বীরভূমের এস. ডি. ও। এতটা রূপসী হয়নি সে মা-মাসির মতন, যদিও যথেষ্ট শ্রীময়ী, ব্যক্তিত্বময়ী–বাবার মুখশ্রী, বাবার গড়নই মেয়ে পেয়েছে।

মায়ের রূপটি পুরোপুরি পেয়েছে শিলাদিত্য। কিন্তু স্বভাবটা তার নিজস্ব। সুরমা অবশ্য বলেন মাসির মতো স্বভাব। ভীতু, নরম, কোমলপ্রাণ ছেলে সে ছোট থেকেই। চেহারাটি দেবদূতের মতো। স্বভাবের সঙ্গে মিল আছে। ছোটবেলায় ওকে মেয়ে মনে করত সকলে। এখন লম্বা হয়ে গেছে অনেকখানি, ছফুটের কাছাকাছি। কিন্তু এখনও যেন মেয়েদের মতোই কোমল তার মুখচ্ছবি, ভাবুক, দীর্ঘপ চোখ।

শিলাদিত্য গান গায়। তার মায়ের মতোই সুর আছে তারও ভিতরে। গিটার বাজিয়ে ইংরিজি গান গায় সে। অনেক গান তার নিজেরই লেখা। তানপুরা নিয়ে মায়ের মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়। শিলু কবিতাও লেখে। সেও ইংরিজি ভাষাতে। আদিত্যর তাতে আপত্তি নেই। সর্বভারতীয় পাঠক পাবে; সারা পৃথিবীর পাঠক। ইংরিজিও তো একটা ভারতীয় ভাষাই। লিখলে সারা পৃথিবীর জন্যেই লেখা উচিত। যদি হাতে সে ক্ষমতা থাকে। আজকাল তো ওতেই নামডাক!

সুরমার কিন্তু তাতে মন খুঁত খুঁত। বাঙালি ছেলে বাংলায় কবিতা লিখবে না? কবিতা কখনও অন্যের ভাষাতে লেখা যায় নাকি? প্রাণের ভাষাতে ছাড়া? ইংরিজিটাই যে শিলুর প্রাণের ভাষা, আদিত্যর কাছে সেটা স্পষ্ট, কিন্তু সুরমার এটা মেনে নিতে প্রাণ চায় না। শিলুর বাংলা ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল–চমৎকার বাংলা লিখত ছেলেটা। মা-র কাছে এসে আদর কাড়বার সময়ে তো শিলু ইংরিজি বলে না? দিব্যি পষ্ট বাংলাই বলে। তবে কেন লেখে না?

.

বাঙালি ছেলেমেয়েরা যখন সাহেব বিয়ে করে, তখনও সুরমার ঠিক এই ভাবনা হয়। ওরা ইংরিজিতে প্রেমের কথা বলে কেমন করে? কবিতা লেখাও তো প্রেম করাই।

কিন্তু সুরমার মনের এই কথাগুলি মনেই থাকে। শিলু কি জানে, তার ইংরিজিতে কবিতা লেখাটা মায়ের পছন্দ নয়? বোঝে কি? শিলুও তো চাপা। সেও বলবে না। তার মনের মধ্যে কী কী কথা আছে, সেটা তাকে লক্ষ্য করে বুঝে নিতে হয় সুরমাকে।

শ্রাবস্তী রাশভারী বটে, কিন্তু স্পষ্টবক্তা। শিলাদিত্যর স্পষ্ট নয় কিছুই। যদিও সে। নরম। তার ভাষা ইঙ্গিতের। একটুখানি ধরিয়ে দেবে মাত্র। তোমাকে বাকিটা বুঝে নিতে হবে। আদিত্যর সে ধৈর্য নেই। তিনি চেষ্টাও করেন না। সুরমা চেষ্টা করেন। তবে আগে যতটা করতেন এখন ততটা পারেন না। ছেলে বাইরে বাইরে ঘোরে, দূরে দূরে থাকে, এখন তো শহরেই নেই। দিল্লিতে National School of Drama-তে ভর্তি হয়েছে। অভিনয় শিক্ষা করছে। শিল্পী স্বভাব তার, ছবিও আঁকে। সুন্দর সুন্দর পোস্টার বানায়। তার ইচ্ছে অভিনয় করবার। আদিত্য বাধা দেননি। যদিও এটা তার মনোমতো হয়নি। নিজের মনের ভাষাকে সে মুখে প্রকাশ না করুক, অন্যের মনের ভাষাকে সে প্রাণ দিতে পারবে বলেই শিলাদিত্যর বিশ্বাস।

গত ছুটিতে শিলু এসেছিল। লম্বা লম্বা চুল পেছনে টেনে রবার ব্যান্ড দিয়ে ঝুঁটি বেঁধে রেখেছে। গলায় একটা ছোট্ট সুতোর তৈরি লকেট, না তাবিজ। বাঁ-হাতে পাঞ্জাবিদের মতন লোহার কড়া। বাঙালি ছেলে বলে মনেই হচ্ছিল না ওকে। আজকাল প্রায় সব ছেলেমেয়েকেই একইরকম দেখতে। সুরমা চেয়ে চেয়ে দেখেন কলেজে, টিভিতে, রাস্তাঘাটে। সেই ঝকের কই হয়ে গেল তাঁর শিলুও।

.

চতুর্থ অধ্যায়। কার ফোন

কাল রাত্রে কে ফোন করেছিল?

কই কেউ তো করেনি?

আমি শুনলুম, ফোন বাজল, তুমি ধরলে, তারপর অনেকক্ষণ ফুসুর ফুসুর হল। কেউ করেনি?

ও সে তো সুরো।

সুরো তো বিকেলে করেছিল। তুমি তো আমাকে বললে এসে।

রাত্রে? কে আবার রাত্রে ফোন করল আমাকে? মনে পড়ছে না তো?

মণিদীপা কি? মিতালি? ডঃ সাহা?

কই ওরা তো ফোন করেনি? কত রাত্রে বলো তো?

খাবার পরে? করেনি?

আমি কী করছিলুম তখন? শুয়ে পড়েছি?

আমি শুয়ে পড়েছি। তুমি ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছ। ফোনের আশায়। আর আমি জেগে আছি। তোমার আশায়। দেরিতে বিছানায় এসে মশারি তুলে ঢুকলে আমার ঘুম ভেঙে যায়। জানোই তো একসঙ্গে শুয়ে পড়া আমি পছন্দ করি। তা ফোনের আশায় যদি

কী যা তা বলছ, ফোনের আশায় মানে? কার ফোন? আমার মনেই পড়ছে না।

মনে করে দ্যাখো। চেষ্টা করো একটু? পারবে।

পারব না। পারব না। আমি পাগল হয়ে যাব এবারে। কেউ ফোন করেনি। তুমি কল্পনা করেছ। আমি আজকের স্পিচটা লিখছিলুম। ফুসুর ফাসুর করছিলুম না। তুমি ঘুমচোখে ভুল শুনেছ। ওটা টেবিলফ্যানের শব্দ।

স্পিচ লিখতে ওঘরে?

আলো জ্বাললে তুমি চ্যাঁচাবে তো।

কিসের স্পিচ?

রবিবার মিটিং আছে টালিগঞ্জের ইনার হুইলের। আমাকে স্পেশাল গেস্ট করেছে– স্পিচ দিতে হবে না? সেইটে লিখছিলুম।

এখনও তোমাকে লিখে বক্তৃতা দিতে হয়? এখন কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নাও? গোড়ায় গোড়ায় তো আমাকে এক্সপ্লয়েট করেছ।

এক্সপ্লয়েট করেছি? তোমাকে? আমি? পরম বিস্ময়ে সুষমার ভুরু কপালে উঠে গেল।

নাকি ঠিক তার উল্টোটা? আমার তো একটুও ভালো লাগত না তোমার হিন্দু জাগরণীর ব্যাপার-স্যাপার। ফ্যাসিস্ট মনে হত।

গেলেই বা কটা দিন? ওই তো নিজের রুচিমাফিক কাজ বেছে নিয়েছ, যত রাজ্যের ভিকিরি আর বেশ্যাদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি। সাধু-সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গ তোমার তো মোটে ভালোই লাগল না।

বালিকা সুরক্ষাশ্রয় বুঝি কেবল ভিকিরি আর বেশ্যা নিয়ে চলে? গরিব মেয়েরা সবাই হয় ভিকিরি নয় বেশ্যা, না?

নয় তো দুটোই। তুমি তো হিন্দুনারী সুরক্ষা সমিতি ভেঙেচুরে তোমার নিজের ম্লেচ্ছ বালিকা আশ্রম গড়ে তুললে, যেখানে সব ধর্মের পতিতা মেয়েদের আড্ডা! আমি যা চেয়েছিলুম, তা কি তুমি করলে? হিন্দুত্ব হেঁটে বাদ দিয়ে কি হিন্দুধর্মের সেবা হয়?

তোমাদের হিন্দুনারী সুরক্ষা সমিতি যেমন ছিল তেমনি আছে, আমি কিছুই ভাঙচুর করিনি। কেবল নিজে ওখান থেকে সরে এসেছি–এসে গড়েছি নিজস্ব নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সংঘ। তাতে অনেক হিন্দু নারীও, প্রধানত হিন্দু নারীরাই, আশ্রয় পাচ্ছে। কেননা সংখ্যায় তারা বেশি।

হিন্দু বালিকা আশ্রমটা তুলেই দিলে?

তুলব কেন? ওটার নাম পালটেছি, বালিকা সুরক্ষাশ্রম করেছি। সেকুলার। ভারতীয় সংবিধান মতো চলাটা কি অন্যায়? কোনো ধর্মেরই উল্লেখ রাখিনি। আমি ভালো করে কাগজপত্র চেক করে নিয়েছি, বালিকাশ্রমের শুরুতে যাঁরা অর্থ অনুদান দিয়েছিলেন দেখলাম তারা কেউই হিন্দু কথাটা রাখতেই হবে, এমন কোনো শর্ত দেননি। তোমার এত আপত্তি কিসের? হিন্দুধর্মের কোনো ক্ষতি হয়েছে কি এতে?

আমার আপত্তির কথা হচ্ছে না। তোমারই বা এত হিন্দু শব্দে আপত্তি কেন? হিন্দু নারী, হিন্দু বালিকা, সবই তোমার অপছন্দ।

কেননা নির্যাতিত কেবল হিন্দু নারীরাই হয়না। নিরাশ্রয় শুধু হিন্দু বালিকারাই হয় না। নিজের চোখে সেটা দেখলে আর ওভাবে হিন্দু বলে কপাট বন্ধ করতে পারা যায় না। তুমি হাতে-কলমে কিছু করোনি। শাস্ত্রে সবকিছু লেখা থাকে না। সুষমার মুখে-চোখে বিরক্তি। খবরের কাগজটা নামিয়ে রেখে এবার উঠে পড়লেন সুষমা। সকালের চায়ের আসর এবারে ভঙ্গ হবে। প্রসেনজিৎ বললেন, তুমি খুব বদলে গিয়েছ, সুষি!

বাঃ, বদলাব না? সময়ের তো সেটাই কাজ। না বদলালেই বরং খুব চিন্তার বিষয় হত। জ্যান্ত জিনিস, প্রাণ আছে, বদলাব না? বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে গাছটা, ঘাসটা পর্যন্ত বদলে যায়। আর আমি মানুষ, বদলাব না?

আমি তো বদলাইনি।

কে বলল বদলাওনি? ধুতি-পৈতে পরলেই বুঝি মানুষ অপরিবর্তিত থেকে যায়? রিটায়ার করার পরে তুমিও তো অনেক বদলে গেছে। সারাক্ষণ ঘরে বসে বসে তোমার মাথার মধ্যে মর্চে ধরে যাচ্ছে।

আমার স্ত্রী কেবল বাইরে বাইরে ঘুরে লেকচার দিয়ে মিটিংবাজি করে বেড়াচ্ছেন, আর অসুস্থ আমি ঘরে পড়ে আছি; সেই নিয়ে আহ্লাদে নাচছি না বলেই বুঝি আমার মগজে মর্চে ধরেছে? আর ছেলেটাও হয়েছে তেমনি। এই তোমার প্রশ্রয়েই উচ্ছন্নে গেছে। রুগ্ন বাপকে ফেলে ফুর্তি করবে বলে বিদেশে বসে আছে। বউ নিয়ে যত রাজ্যের অনাচারের মধ্যে ডুবে আছে। ইচ্ছে করে আঁটকুঁড়ো হয়ে রইল। বাঁজা বউ আনল ঘরে। আমার চোদ্দোপুরুষকে জল দিলে না। ছেলের দোষ বললেই বলবে মগজে মর্চে।

কেবলই ছেলে-বউয়ের দোষ না ধরে একটু বরং ওদের ভালো দিকটা ভাবো না। তাহলে মনটাও অনেক ভালো থাকত। ভালোও তো ওদের কম নেই? শুধুই লোককে মন্দ ভাবতে হয়? নিজেরই ওতে শরীর খারাপ করে।

থাক–আমার শরীরের কথা আর তোমাকে ভাবতে হবে না। ঢের হয়েছে। তুমি তোমার সংগঠনের কথা ভাবো। কটা বেশ্যার ছেলে ইশকুলে গেল। কটা ভিকিরির মেয়েকে রাস্তা থেকে তুলে আনা গেল। এইসব ভাববা। তোমাকে কি এইজন্যেই ঘরের বাইরে বের করেছিলুম? পাঠিয়েছিলুম তো হিন্দুধর্মের সেবা করতে।

হিন্দুধর্মটা কী বস্তু বলো তো? দীনদুঃখীর সেবায় বুঝি হিন্দুধর্মের ব্যাঘাত ঘটে? দরিদ্রনারায়ণটা কে তবে?

সুষি, আজকাল তুমি বড্ড আমার মুখে মুখে কথা বলতে শিখেছ!

তা শিখেছি! ছাপ্পান্ন বছর বয়েস তো হল! তোমার মায়ের তো কোনো কথারই উত্তর দিয়ে উঠতে পারিনি। একটু থেমে, একটু হেসে বললেন, বলতে পারো, তোমারই ক্রেডিট এটা। আমার মুখের ভাষা তো তুমিই জুগিয়েছ।

প্রসেনজিৎ চুপ করে থেকে বললেন,-বিকেলে আজ কোথাও বেরুচ্ছ?

একটু সুরোর কাছে যেতে হবে।

আদিত্য থাকবে?

থাকতেও পারেন। যাবে তুমি? চলো না–দুজনে মিলে যাই।

আমি? ওরে বাবা! কোথায় পদ্মপুকুর-চক্রবেড়ে, আর কোথায় সেই সল্টলেক। নাঃ, তুমি যাও। আমি থাকি।

চক্ৰবেড়ে-সল্টলেকের প্রবলেমটা কী? যাব তো গাড়িতে। বাইপাস দিয়ে আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব। চলো, বিকেল বিকেল চলে যাই। দুপুরে বরং তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো আজ।

এখন তো সবে সকালবেলা। নটা বাজেনি। বিকেলের কথা বিকেলে ভাবা যাবে।

কী মনে পড়তে সুষমা যেতে যেতে দাঁড়িয়ে যান।

অশোক তোমার সঙ্গে কথা বলেছে কি? ফোন করেছিল?

কোন অশোক?

ভৌমিক? ওদের নার্সিংহোমে ওরা বসতে বলেছিল হপ্তায় একদিন, সকাল হোক কিংবা বিকেলে। তোমার নামটা থাকলে ওদের নার্সিংহোমের মর্যাদা বাড়বে। যা রোজগার হবে সবই তোমার। জায়গার জন্য কিছু চার্জ করবে না। ভেবে দেখতে পারো। হপ্তায় তো মাত্র একটাই দিন। বেড়িয়ে আসবে একটু। এ তোমার নিজের বাড়িতে প্রাত্যহিক দুবেলা চেম্বার করা নয়। এতে স্ট্রেস অনেক কম।

অশোক-গৌরী দুজনেই তো ডাক্তার। ওদের নার্সিংহোমের মধ্যে আবার আমাকে টানা কেন? আমি বাবা কিছুর মধ্যে ঢুকতে পারব না। নার্সিংহোমগুলো আজকাল যত করাশনের ডিপো, নানারকমের ইল্লিগাল কাজকর্ম হয় সেখানে, কিসের সঙ্গে কখন জড়িয়ে পড়ব, কে জানে? না বাবা, ওতে আমি নেই। হঠাৎ কী ভেবে, আমাকে জড়াতে চাইছে? ওদের উদ্দেশ্যটা কী?

কিছুই না। ওরা তোমারই ছাত্রছাত্রী, তোমার সম্মান করে, তোমার সুনামটা যদি ওদের একটু কাজে লাগে। হপ্তায় একদিনেই তোমার রোজগার কিন্তু খুব কম হবে না, ঘরের খরচ নেই, রুগি পাবেই। বসলে ভালোও লাগবে। লোকজনের মুখ দেখবে, কাজকর্মে মনটাও ব্যস্ত থাকবে–এ্যাকটিসটা চালু থাকা সর্বদাই ভালো–

আমাকে ঘর থেকে টেনে বের করে দিতে পারলেই তুমি বাঁচো না? কেন? আমি কি তোমার চক্ষুশূল হয়েছি?

.

পঞ্চম অধ্যায়। সামুদ্রিক শাস্ত্র

মানুষ কী ভাবে, আর কী হয়। কোন বিষয়টা ঠিক? শুধু তো রূপ দেখেই নয়।

বাবা অনেক কিছুই মিলিয়েছিলেন। জন্ম পত্রিকা তো বটেই। বিবাহে প্রধানত দেখতে হবে পাঁচটা জিনিস। ঘরে বউ আনতে হলে জানতে হবে, তার অকালবৈধব্য আছে কিনা, অকালমৃত্যু আছে কিনা, দারিদ্রদোষ আছে কিনা, চরিত্রদোষ আছে কিনা, অনপত্যদোষ আছে কিনা। এই পাঁচটার যে কোনো একটা যদি থাকে, তাহলে সে সম্বন্ধ খারিজ করে দিতে হবে।

আমাদের ক্ষেত্রে বাবা নিজে আমাদের কোষ্ঠী বিচার করিয়েছিলেন। রাজযোটক মিল। পরম সুলক্ষণা বউ। শুধু কোষ্ঠী মিলিয়েই হয়নি বাবার। একটামাত্র ছেলে, তার বউ বলে কথা। আবার সামুদ্রিক জ্যোতিষ মতে বধূর লক্ষণগুলো মিলিয়েছিলেন–যা যা মেলানো সম্ভব। সব তো মেলানো সম্ভব নয়? যে নারীর বাহু রেখাযুক্ত, অধরোষ্ঠ সরলরেখা, মুখে তিলচিহ্ন আছে, তার বৈধব্যযোগ। কপালটি যার প্রলম্বিত, সে হবে শ্বশুরঘাতিনী। উদর প্রলম্বিত হলে দেবরঘাতিনী। অবশ্য বাবার পুত্রবধূর ক্ষেত্রে শেষোক্ত আশঙ্কা অমূলক, যেহেতু তার দেবরই নেই। কিন্তু বাবা সুষমার হাত ধরে আঙুলগুলি নেড়েচেড়ে দেখেছিলেন–আদর করতে নয়, হাতের আঙুলের মধ্যে ফাঁক থাকা দুর্লক্ষণ। চামড়া কর্কশ হওয়া, নাকের ডগায় তিল থাকা এসবই দুর্লক্ষণ। যে নারীর বাঁ-কপালে, বাঁ-হাতে, বাঁকানে, বাঁ-গলায়, বা-ঠোঁটের বাঁ-দিকে তিলচিহ্ন আছে সে নারী অতীব সৌভাগ্যবতী। বিশেষ করে বাঁ-কানে কি বাঁ-কপালে, বা গলার বাঁ-দিকে তিলচিহ্ন থাকলে তার প্রথম গর্ভে পুত্রসন্তান আসেই। এই সব চিহ্নগুলি মিলিয়ে বাবা দেখেছিলেন সুষমার আঙুলের মধ্যে ফাঁক নেই। ঠোঁটের বাঁ-দিকে তিল আছে, গলার বাঁ-দিকেও তিল আছে। সর্বসুলক্ষণা বধূ। সৌভাগ্যবতী পুত্রবতী হবে। একে সুন্দরী তায় সর্ব সুলক্ষণা, বাবা তো মত দিয়েই এলেন। সুষমাকে আমি প্রথম দেখলাম শুভদৃষ্টিতে। মা দেখলেন একেবারে বউ বরণের সময়ে। আজকাল এসব মানা হয় না বটে, কিন্তু আমাদের বংশে ঐতিহ্যের মূল্য খুব বেশি।

বাবা ছিলেন হিন্দু মহাসভার কর্মী। আমার পক্ষে সরকারি চাকরি করে এরকম রাজনৈতিক দলের কর্মী হওয়া মুশকিল। তাছাড়া আমি মুখচোরা মানুষজনের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতেও পারি না। রাজনীতির মঞ্চ আমার নয়। অনিল যখন বলল, বউদিকে মেম্বার করে দিন না কেন। এক টাকার তো মামলা, আমার মনে হল চমৎকার! সুষমাকেই সদস্য করে দিলাম হিন্দু জাগরণী সংঘের। জোর করে পাঠালাম দু-একটা মিটিঙে। একটা মেয়েদের ইশকুলে আলোচনা সভাতে অংশও নিল সুষমা। তখনও কি বুঝেছি ওর মধ্যে নেতৃত্বের মালমশলা দেখতে পাবে পার্টি?

হিন্দু জাগরণী সংঘের সদস্যরা যতটা সংস্কৃত জানে তত ইংরিজি জানে না, সুষমা কনভেন্টে পড়া মেয়ে। রূপসী। অভিজাত আচরণ। ইংরিজিতে কিছু বলবার দরকার হলেই ওরা সুষমাকে ডাকতে লাগল। সেসব বক্তৃতা অবশ্য লিখে দিতে লাগলাম আমিও।–শাস্ত্র থেকে কোটেশান দিয়ে বক্তৃতা লেখা সুষমার সাধ্য নেই। তখনও ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু এখন তো সুষমা সরে যেতে শুরু করেছে। হিন্দু শব্দটাকেই হেঁটে ফেলেছে তার কাজকর্ম। থেকে। এখন তার শাস্ত্রবাক্য লাগে না।

সুষমার যে ভেতরে ভেতরে এত উচ্চাশা ছিল, এত জেদ, তা কে জানত। হিন্দু জাগরণী সংঘের কাজকর্ম থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে সম্পূর্ণ ছড়িয়ে নিয়ে সুষমা কী সব নিজস্ব নারী সংগঠন তৈরি করে ফেলেছে, তারই কাজে হিল্লি-দিল্লিও করছে মন্দ নয়। আজ সোনিয়া গান্ধী তো কাল মানেকা গান্ধী। কিছু না কিছু লেগেই আছে। এই টি.ভি.-র খবরে সুষমা ভটচায্যি দেখা যাচ্ছে, এই খবরের কাগজে পড়ছি সুষমা ভটচা লেকচার দিচ্ছে। মানবাধিকার কমিশনেও কী যেন হয়েছে সে, কাগজে পড়লাম। সে বলেনি!

অনিলের মুখে শুনলাম আর সুষমা হিন্দু জাগরণী সংঘের সদস্যই নেই মোটে। যেজন্য ওকে বাড়ি থেকে বের করলাম সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দিয়েছে সুষমা। আমাকে কিছু বলেওনি। আসলে ওর কাজকর্মের বিষয়ে কিছু বলতে চায় না সুষি আজকাল। নিজের জন্যে ক্রমে ওর একটা আলাদা জগৎ, একটা আলাদা জীবন গড়ে তুলেছে। সেখানে আমার ঠাই নেই।

মা বেঁচে থাকলে এসব কিচ্ছুটি চলত না। মা চলে গিয়েই এই সংসারের সর্বনাশ হয়ে গেল। মা ছিলেন বংশের কল্যাণস্বরূপিনী স্বয়ং মা লক্ষ্মী। আজ মা থাকলে শুভও কি এরকম করতে পারত?

সুষমার দোষেই আমার অমন ছেলে বিগড়ে গেল। শুভ আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যটা রাখলে না। আমাকে গ্রাহ্যই করলে না। পূত্রবধূ নির্বাচনে আমার কোনো ভূমিকাই ছিল না। আমার সঙ্গে তার তো যোগই ছিল না বিশেষ। সারাদিনই ইশকুল, টিউটোরিয়াল হোম, আর বন্ধু-বান্ধব নিয়ে কাটাত। সুষমার তো সায় ছিলই, আমার মা-রও নাতির বেলায় অন্যরকম হাবভাব দেখলাম। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বাড়িতে আসছে, হইচই করছে, সুষমা সমানে তাদের জলখাবার বানিয়ে দিচ্ছে এসব আমার বেলাতে ছিল না। মার শরীর খারাপ হলে বাড়িতে কোনো গোলমালই চলত না। বাড়ি ফিরে ঠাকুর্দার কাছে বসতাম, শাস্ত্রপাঠে অবসর সময় কাটত। যতটুকু ইশকুলে-কলেজে কেটেছে, পড়াশুনোতেই কেটেছে। বাকি সময় বাড়িতে। মা-র কাছে। ঠাকুর্দার কাছে। বন্ধু-বান্ধব হয়নি। বন্ধুত্বের অভ্যাসও হয়নি।

এখনও আমার কোনো বন্ধু নেই। চাকরি থেকে যখন অবসর নিলাম, একটা ফেয়ারওয়েল পার্টি দেওয়া হয় সকলকে। আমার বেলায় সেটা কেবল নামমাত্র হয়েছিল। সেদিনকার মিটিঙে ছিল কেবল একমুঠো লোক, যারা যারা সেদিন মেডিক্যাল কলেজে এসেছিল, তারাও সকলে। ছিল না, আমি নজর করেছিলাম। সুষমাকে বলতেই সে অম্লানবদনে বলল, আসবে কেন, তারা তো কেউ তোমার বন্ধু নয়, কোলিগ মাত্র। তুমি তো একজনের সঙ্গেও বন্ধুত্ব পাতাওনি।

বন্ধুত্ব কেমন করে পাতায়? যতদিন মা ছিলেন, ব্যাপারটা আলাদা ছিল। মা-ই ছিলেন আমাদের বাড়ির দীপশিখা। মা-ই ছিলেন আমাদের জীবনযাত্রার সর্বময়ী কত্রী, কেন্দ্রস্বরূপা, মাকে ঘিরেই বেঁচে থাকতাম আমরা সকলে। ঠাকুর্দা, বাবা, আমি। ঠাকুমাকে দেখিনি। মা-ই ছিলেন সংসারের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী। ঠাকুর্দা, বাবা দুজনেই মাকে কাবলি আঙুরের মতন তুলোর বাক্সে বসিয়ে রেখেছেন,–সারা জীবনই মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য বাড়িতে শান্তি-স্বস্ত্যয়ন হয়েছে। মা-র আয়ুষ্কাল কম, এই কোষ্ঠিবিচার ছিল বলে, আমার বাবা অতি সাবধানে, ভয়ে ভয়ে রাখতেন মাকে। আমিও তাই রেখেছি। মা-র যাতে মনে উত্তেজনা না হয়, মা-র যাতে মনে কষ্ট না হয়। মা-র যাতে শরীরে স্ট্রেন না হয়। সবসময় সেইদিকে নজর রাখতেন বাবা।

অথচ বাবা নিজেই চলে গেলেন আগেভাগে। তার যে এতটা প্রেশার ছিল, হার্টের অবস্থা এত খারাপ, বাবা আমাদের তো জানতেই দেননি। মা পাছে ভয় পান, সেটা ভেবেই বোধহয়। সেবার সুযোগটুকুও বাবা দিলেন না আমাদের। কদিনের মধ্যে সব শেষ।

তা ঈশ্বরের দয়ায় মা চুয়াত্তর বছর পর্যন্ত আমাদের মধ্যে ছিলেন। মা-র মহাপ্রয়াণের পরেই আমার অবসর গ্রহণের দিন এসে পড়ল। একটি ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই আরেকটি।

.

মায়ের ষোলো বছর বয়সে আমার জন্ম। বাবার আদরে মাকে সবসময় রঙিন শাড়িতে অলঙ্কারে সেজেগুজে থাকতে হত। আমার বিয়ে ঠিক হবার পর মা যখন বললেন এবার থেকে সাদা শাড়ি পরবেন, বাবা ঘোষণা করলেন, আমার চোখের সামনে নয়। বিধবা হবার পরে তুমি তোমার যা খুশি কোরো। বউমাকে আর শাশুড়িকে একই রকম কাপড়-গয়না এনে দিতেন বাবা। সুষমা পরমা সুন্দরী। কিন্তু সেই বয়সেও আমার মায়েরও ছিল মা দুর্গার মতো রূপ। লালপাড় হলুদ ডুরে জড়িয়ে শাশুড়ি-বউ পান সাজতে বসলে, ঠিক মনে হত, দুটি বোন।

সুষমা কনভেন্ট থেকে পাশ করে সবে আই. এ-তে ভর্তি হয়েছিল, তখন বিয়ে হয়ে কলকাতায় চলে এল। ওর বাবা যখন ওকে এখানে কলেজে ভর্তি করতে অনুমতি চাইলেন, মায়ের তাতে মত ছিল না। ঘরে বউকে পথে বের করলেই বিপদ। তায় এমন রূপের ডালি বউমা। কিন্তু সুষমা প্রত্যেক রাত্রে পড়তে চাইত। শেষকালে, আমিও ভাবলাম ও তো ঠিকই বলছে। স্ত্রীর শিক্ষিত হওয়ারই প্রয়োজন। হিন্দুধর্মের সেবায় শিক্ষিত নারীর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। বাবাকে বললাম, বাবাও অনুমতি দিয়ে দিলেন। কী ভেবে জানি না মা বাবার মতটা ফেরালেন না। কেননা, মা জোর করে না বললে, বাবাও ঠিক না বলতেন!

বাবাকে কখনো মায়ের কোনো অনিচ্ছাকে অসম্মান করতে আমি দেখিনি। এজন্য সুষমারও কোনো অনিচ্ছাকে আমি অবহেলা করতে পারি না। আমার বাবার কাছ থেকে এটাই আমার শিক্ষা যে পত্নীর ইচ্ছাকে, তার পছন্দ-অপছন্দকে সম্মান করতে হয়। ধর্মপত্নীকে আমরা বিবাহের সময়ে কথা দিই, নাতিচরিষ্যামি–তোমাকে অতিক্রম করে যাব না। সে যেমন আমার সংসারে ধ্রুব হবে, আমিও তেমনি তাকে কদাচ অতিক্রম করে যাব না এই প্রতিজ্ঞা আমি রক্ষা করে চলেছি। সুষমাও ধ্রুব হয়ে আছে। আমরা কেউ আমাদের বিবাহ মন্ত্রের শপথ অবজ্ঞা করিনি।

কিন্তু ইদানীং সুষমার আমার প্রতি সেই মনোযোগ নেই, যা আগে ছিল। আমার মাকে, আমার বাবাকে যেভাবে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে সেবা-শুশ্রূষা করেছে, মাঝে মাঝে বৃদ্ধ বয়সের দোষে, মা হয়তো একটুখানি অবুঝপনাও করে ফেলেছেন, তাতেও হাসিমুখে প্রশ্রয় দিয়েছে সুষমা। আমার বেলাতে কিন্তু তার সেই সেবাময়ী রূপটি আমি দেখতে পাচ্ছি না। তখন সুষমা ছিল পুরোপুরি ঘরণী। ঘরকন্নার বাইরে কিছু জানত না।

মায়ের মৃত্যুর পরে ওকে যেই হিন্দু জাগরণী সংঘে ভর্তি করে দিলাম, সেই হল আমার কাল। মায়ের মৃত্যুর পরে এ সংসারে দুটো বদল হল। সুষমা বাইরে বেরিয়ে পড়ল। আর আমি ঘরে ঢুকে পড়লাম। আর তৃতীয় বদলটি আরও জরুরি–সেটা অবশ্য তক্ষুনি হয়নি, আরও পরে শুভ বিয়ে করল। বিয়ে করে ম্লেচ্ছ দেশে চলে গেল। মা বেঁচে থাকলে এসব কখনো হতে দিতেন না।

সুষমাও ঘরে থাকত। শুভও। চিররুগ্না, শয্যাশায়ী মা-র সেই প্রবল ব্যক্তিত্বের জোর ছিল। আমারই বুদ্ধির ভুলে, আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সুষমা বাইরের জীবনে মিশে গেল। আর সুষমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শুভ বাইরের বিশ্বে হারিয়ে গেল।

আর আমি এলুম ঘরে। এই শরীরে কোথায় যাব? থাকবই বা আর কটা দিন? ঠাকুরঘরে সময় কাটাই। নইলে টিভি দেখি। আজকাল বই-টই পড়তে তত ভালো লাগে না। কথামৃত ছাড়া। কী পড়ব? পড়ার মতন আছেটা কী?

রোববার রোববার তাস খেলি। সুষমাই কোথা থেকে তিনজন খেলুড়ে জোগাড় করেছে, তারা দারুণ ব্রিজ খেলে। ওদের ট্যাক্সিভাড়া দিয়ে নিয়ে আসে সুষমা, সারাদিন রাখে, এক পেট খাওয়ায়। আবার পৌঁছে দেবার খরচ দেয়। এবং আমার সন্দেহ ওদের একটা কিছু দক্ষিণাও দেয় আমার সঙ্গে খেলতে আসার জন্যে। এই তিনজন মানুষের সঙ্গে এমনিতে আমার কথা কওয়া উচিত নয়, কথা বলবার মতো প্রসঙ্গ কিছু নেই। বিদ্যায় আভিজাত্যে তারা একটু নিচু শ্রেণীর। কিন্তু হিন্দু জাগরণী সংঘের সদস্য ওরা, একজনের কাপড়ের দোকান আছে, একজন মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ, আর একজন রিটায়ার্ড। পোস্টমাস্টার ছিল কোনো ছোট পোস্টাপিসের। তবে, হ্যাঁ! দারুণ ব্রিজ খেলে তিনজনই–কোথা থেকে যে সুষমা পাকড়াও করল এদের! পারেও বটে সুষি!

সপ্তাহে এই একদিন আমার কিঞ্চিৎ বাধ্যকরী সামাজিকতার অভ্যেস হয়। বাকি সবটা সময় একলা। সুষি আর আমি।

.

ষষ্ঠ অধ্যায়। জননী জন্মভূমিশ্চ

কী যে অবুঝ হয়েছেন ছেলেমানুষের মতো, কিছুতেই বুঝবেন না। ছোট বাচ্চা যেমন মাকে আঁকড়ায়, তেমনি করে আঁকড়াবেন আমাকে। তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারি না! তোমাকে না দেখতে পেলে শরীর খারাপ হয়ে যায়! তুমি কাছে থাকলেই আমি সুস্থ বোধ করি। এগুলো ব্ল্যাকমেইলিংয়ের টেকনিক সেটাও কী বোঝেন না? নিজে এত বড় চিকিৎসক, মনের অসুখ চিনতে পারছেন না?

অবশ্য কোনোদিনই চিনতে পারেননি। নিজের মায়েরও মনের অসুখ ছিল। সারাটা জীবন মা রুগ্ন হয়ে সারা পরিবারের পরিপূর্ণ মনোযোগ টেনে নিয়ে ভি. আই. পি. হয়ে রইলেন। বিয়ে হয়ে এসে দেখলাম পরমা সুন্দরী শাশুড়ি। নতুন বউয়ের মতোই সাজগোজ করে,শাড়ি গয়নায় মোড়া হয়ে, বধূবরণ করলেন। তা বধূবরণে বিয়ের বেনারসি পরার নিয়ম আছে, কিন্তু শাশুড়ির সাজগোজটা ওই এক বিকেলের জন্যে নয়। প্রত্যহই তিনি আমার সঙ্গে মিলিয়ে ঠিক দুই জায়ের মতন সাজতে লাগলেন। আমার ননদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, সেও এল একইরকম সেজেগুজে। আমি নতুন বউ বলে আমার কোনো বৈশিষ্ট্যই ছিল না। বিয়েবাড়ির হুল্লোড়ের মধ্যেই তিনি পালঙ্কে হঠাৎ শুয়ে পড়লেন। আর বাড়িসুদ্ধ জ্ঞাতিকুটুম্বের মাঝখানে শ্বশুরমশাই গিয়ে তার হাত ধরে মুখের কাছে মুখ নিয়ে লীলাবতী! লীলাবতী! করতে লাগলেন। ছেলেও দৌড়ে গিয়ে মা-র পায়ে হাত বোলাতে লাগলেন, মা! মা! করে অস্থির হয়ে। ননদ পাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগলেন। আমি বুঝতেই পারছি না কী করব। একপাশে চোর হয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। শেষে স্বামীই লুকিয়ে ইঙ্গিত করলেন মা-র মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। সেই শুরু।

সমানেই তিনি মা এবং বউয়ের মধ্যে সেতু-বন্ধনের চেষ্টা করে চলেছেন। এ বাড়িতে তিনিই আমার বন্ধু, আমার শুভার্থী, আমার নিজের লোক। তারই চেষ্টায় আমার কলেজে ভর্তি হওয়া। ইন্টারমিডিয়েট, বি. এ., সবই তার চেষ্টায়। শ্বশুর-শাশুড়ি দুজনেরই অমত ছিল। উনিই পৌঁছে দিয়ে যেতেন। প্রথম প্রথম শ্বশুর আনতে যেতেন। এইভাবে চার বছর অবশ্য চলেনি। আমার স্বামী মাইনে এনে পুরোটা মায়ের হাতে তুলে দিতেন। মা ওঁকে হাতখরচ দিতেন দৈনিক হিসেবে। বিয়ের পরেও তাই। হাতখরচ বাড়াননি। আমাকে কিছু কিনে দেবার ইচ্ছে হলে মা-র কাছ থেকে টাকা চাইতে হত ওঁকে। কৈফিয়ৎ দিতে হত কেন টাকা চাই। দুজনে সিনেমা যেতে হলে মা-র কাছে টাকা নিয়ে, বাবার কাছে অনুমতি নিয়ে তবে যেতে হত। প্রথম প্রথম নিয়ে এলেও, শ্বশুর আর কলেজ থেকে আমাকে আনতে গেলেন না। শাশুড়ি তখন আমাকে তিনদিনে এক টাকা করে দিতেন। বাসে করে বাড়ি ফেরবার ভাড়া। বৃষ্টি পড়লে, কী শরীর খারাপ করলে একদিন রিকশা নেবার উপায় ছিল না। খিদে পেলে কিছু কিনে খাবার টাকা ছিল না। স্বামীকে বললেও উনি নিরুপায়। ওঁর হাতে টাকা নেই। অথচ তখন ইনি মেডিক্যাল কলেজে চাকরি করছেন। বাড়িতে দুটো গাড়ি। একটি উনি নিয়ে যেতেন। একটা থাকত। কিন্তু আমার জন্য যেত না।

সকালবেলা শাশুড়ি আমাকে রুটি-গুড় দিতেন সব কাজের লোকদের সঙ্গে। বাসিরুটি খেতে পারতাম না, ফেলে দিয়েছিলাম। উনি রান্নাঘরের ময়লা ফেলার ঝুড়িতে সেটা আবিষ্কার করে এত রেগে গেলেন, যে তারপর থেকে আমি ব্লাউজে ভরে নিয়ে গিয়ে বাইরে ফেলে দিতাম। কিন্তু স্বামীকে বলতে পারিনি। মা-র প্রতি ওঁর মুগ্ধ ভক্তি দেখে বলতে সাহস হয়নি। মনে হয়েছিল উনি বিশ্বাস করবেন না। আমার ওপরেই বিরক্ত হবেন। ভগবানের দয়ায় আমি বি.এ. পাশ করবার আগে বাচ্চা চাননি উনিই। আমার বয়েসও অল্প ছিল। ওঁর এম.ডি শেষ হয়নি। শাশুড়ি প্রবল অশান্তি শুরু করলেন, বাঁজা বউ। ঠিক এখন লোপাকে নিয়ে ইনি যেমন করছেন। সব ভুলে গেছেন নিজের মায়ের কীর্তির কথা। মা বলতেন, আমার মেয়ের দুই ছেলে হচ্ছে দুই বাহু–তোমাদের মতন হাত-পা কাটা নয় সে, আমার বাঁজা বউ নিয়ে ঘর করার দুর্ভাগ্য ছিল। কিন্তু যখন অন্তঃসত্ত্বা হলাম, শাশুড়ি তখন অনবরত ঠেশ দিতে লাগলেন, হবে তো মেয়ে। মায়ের যেমন যমজ মেয়ে হয়েছিল, তোমারও যমজ মেয়েই হবে দেখো! শ্বশুরমশাই অবশ্য মৃদু আপত্তি করতে থাকলেন, না লীলা, বাঁ কপালে তিল আছে, গলার বাঁ দিকেও তিল আছে, বউমার নির্ঘাৎ প্রথম সন্তান পুত্র হবেই। তুমি দেখে নিও। বাবা আমাকে নিতে এলেন যখন, আমার শ্বশুর তাঁকে বললেন, আপনাদের বাড়িতে স্ত্রীলোক নেই, বউমার যত্ন হবে না, ও বরং এখানেই থাকুক। বাবা বললেন, আমিই তো ওদের শিশু থেকে মানুষ করেছি, আমি স্ত্রীলোকের বাড়া। এই তো প্রথমবার, ওর মনের আরাম হবে হয়তো আমার কাছে থাকলে। ওর বোনও চলে আসবে সেই সময়ে। আপনারা ওর জন্যে ভাবনা করবেন না– বলতে না বলতেই হঠাৎ আমার শাশুড়ি বলে বসলেন, নিয়ে যান, নিয়ে যান, আমাদের কোনোও ভাবনা নেই আপনার মেয়েকে নিয়ে। হবে তো। মায়ের মতনই যমজ মেয়ে,-ও থাকল কি গেল, আমাদের এসে যাবে না– এমন নির্মম বাক্য শুনে আমার শ্বশুরও থ হয়ে গেলেন। কিন্তু কিছুই স্ত্রীকে বলতে পারলেন না। বাবা আমাকে নিয়ে চলে গেলেন। স্বামীকে কখনও বলতে পারিনি, মা-র কথাগুলি। স্বামী তো সেখানে ছিলেন না। তিনি শোনেননি। বিশ্বাস করতেন কি? চার মাস পরে শুভ জন্মাল আরও চারমাস পরে উনি গেলেন আমাদের কলকাতায় নিয়ে আসতে।

কিন্তু গাড়ি ভবানীপুরের বাড়িতে গেল না। আমরা গেলাম বালিগঞ্জে, লেক রোডের ভাড়া বাড়িতে। অচেনা জায়গায়।

কী ব্যাপার।

অনেক কিছু।

আমার ননদ তার বাচ্চা দুটিকে নিয়ে বাপের বাড়িতে এসে রয়েছেন ছমাস হল। স্বামী ও শাশুড়ির নামে এফ.আই.আর করে এসেছেন, আসার আগে। তাঁরা নাকি আলমারি খুলে, ওঁর নিজস্ব স্ত্রীধন, ওঁর দশ লক্ষ টাকার গয়নাগাঁটি চুরি করেছিলেন, নিজেদের সম্পত্তি বন্ধক থেকে ছাড়াবেন বলে। থানা থেকেই সোজা বাপের বাড়ি। তারপর মায়ের অপূর্ব সেবা। মাকে তো পালঙ্ক থেকে উঠতেই দিচ্ছেন না। বাচ্চারাও দিদিমার মন ভুলিয়ে ফেলেছে–খুবই মিষ্টি তারা। শাশুড়ি ছেলেকে ডেকে জানিয়েছেন, তিনি মনস্থির করেছেন, তাঁর যা কিছু নিজস্ব সম্পত্তি সব দুই দৌহিত্রকে দেবেন। বসত বাড়ির আধখানাও তার মেয়েকে লিখে দেবেন, কেননা তাদের এখন কোনো বসতবাটি নেই।

শুনে উনি মাকে বললেন, কিন্তু আমারও তো এখন ছেলে হয়েছে, তার ঠাকুমার স্ত্রীধনের জিনিস তাকেও কিছু দিও; আর আমি যে গত দশ বছর ধরে তোমাকে পুরো মাইনেটা দিয়ে দিচ্ছি এখন এ বাড়িতে আমার অধিকার হয়তো বোনের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি, সমান সমান নয়। তাছাড়া বোনের বিয়ের সময়ে তোমাদের দেড় লাখ টাকা খরচা হয়েছিল। তখনকার দিনে অনেক টাকা সেটা। আমার বিয়েতে শ্বশুরবাড়ি থেকেই দুলাখ খরচ করেছিল, তোমাদের কিছুই খরচা হয়নি। আমার বউয়েরও তাই একটু অধিকার বেশি তোমার বাড়িতে।

বিতর্কে মা খেপে উঠলেন, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। যাও তোমার শ্বশুরের দেয়া সবকিছু যৌতুক সঙ্গে নিয়ে অন্যত্র উঠে যাও। এ বাড়ি আমার। আমি যাকে খুশি তাকে দেব। জানি না, নিজের জীবৎকালে কেন যে তার স্ত্রীর নামে পৈত্রিক বাড়িটা লিখে দিয়েছিলেন শ্বশুরমশাই। আমার স্বামী তারপরই জিনিসপত্তর নিয়ে আর মণির মাকে নিয়ে বাপ-ঠাকুর্দার ভিটে ছেড়ে লেক রোডে উঠে এসেছেন। ও বাড়িতে যান না। শ্বশুরমশাই নিজেই এটা-ওটা হাতে করে ছেলেকে দেখতে মাঝে মাঝে চলে আসেন। আমার শাশুড়ি-ননদের সঙ্গে স্বামী মুখ দেখাদেখি নেই। পৌত্র তো এল। শ্বশুর এসে আকবরী মোহর দিয়ে নাতির মুখ দেখে গেলেন। শাশুড়ি কিন্তু এলেন না। শেষে উনি আমাকে বললেন, যা হয়েছে হয়েছে। চলো, আমরা এবার একদিন মাকে ছেলে দেখিয়ে আনি। গেলাম শুভকে নিয়ে। মিষ্টি নিয়ে। শাড়ি-ধুতি নিয়ে। মা-বাবার জন্য প্রণামী। শাশুড়ি শুভকে আদর করলেন, কোলে নিলেন। নিজের গলার হারটি পরিয়ে দিয়ে নামিকে যথারীতি আশীর্বাদও করলেন। কিন্তু আমার সঙ্গে একটিও কথা কইলেন না। ছেলের সঙ্গেও না। চোখ বুজে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন একটু পরেই। যেন বড় ক্লান্ত। উনি খুবই লজ্জিত মায়ের আচরণে। কিন্তু করবেনই বা কী? এহেন আচরণের তো কোনো জবাব নেই। সেই থেকে আমরা আর যাই না ভবানীপুরে।

হঠাৎ খবর এল শ্বশুরমশাইয়ের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছেন। শ্বশুরের কোমার খবর পেয়েই আমরা আবার ছুটে গেছি। পাঁচ দিন অজ্ঞান। তারপর সব শেষ। শাশুড়ির তখন তার ছেলেকে খুব দরকার। বাড়িতে ওঁরা দুটি স্ত্রীলোক একা, দুটি নাবালক শিশুসমেত। আমরা আবার যাতায়াত করতে লাগলাম। শ্বশুরের শ্রাদ্ধের পর শাশুড়ি বললেন বাড়িতে ফিরে আসতে। ননদ নিজেও বলল, ফিরে এস বউদি। যা হয়েছে হয়েছে দাদার সঙ্গে। তোমার সঙ্গে তো হয়নি?

ছেলেকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এলাম। শ্বশুরের মৃত্যুর পর থেকেই শাশুড়ির রূপ। আরেক ধাপ বদলাল। আরও শুয়ে পড়লেন। আরও মিছে কথা বলা শুরু করলেন। ভঙ্গি আরও অসহায় হল আর আমার প্রতি একটা নতুন শত্রুতা দেখা দিল। আস্তে আস্তে আমার স্বামীর ওপরেও তার প্রভাব পড়তে শুরু করল।

.

ডায়াবেটিসের রুগি, তাকে মিষ্টি খেতে দিই না, চায়েও চিনি দেওয়া বারণ। মা তো জোর করে চিনি নিয়ে নেন। বাধা দেবে কে? না ননদ না আমি পেরে উঠি তার সঙ্গে। ইতিমধ্যে ননদের শাশুড়ির মৃত্যু হল, নন্দাই এসে স্ত্রী-পুত্রদের নিয়ে গেলেন। আমাদের বাড়ির হাওয়া বদলে গেল, অনেক ফুরফুরে হল। মেয়ে নেই, এখন শাশুড়ি জোর করে বাইরে বেরিয়ে রোজ বিকেলে সামনের ভীমনাগের দোকান থেকে মিষ্টি কিনে খাবেন। হাতে টাকা আছে, হাত-পা চালু আছে, যাবেন না কেন। বারণ করি, শোনেন না। একদিন মা সেজেগুজে দোরগোড়ায় গেছেন, মিষ্টির দোকানে যাবেন বলে, হঠাৎ আমার স্বামী ফিরলেন।

এ কি মা, তুমি রাস্তায়? কোথায় যাচ্ছ?

এই তো বাবা, এই একটু পানের দোকানে যাচ্ছি। ঘরে পান নেই। বউমা তো দুটো পানও সেজে দেয়না, বুড়ো বয়সের নেশা তো? মরণও হয়েছে আমার, নেশা করে মরেছি!–উনি তাড়াতাড়ি মাকে ওপরে নিয়ে এলেন। পান কেন সেজে দিইনি বলে চেঁচালেন। আমি তো অবাক, বললাম, কেন? একডিবে পান মা-র এই তো সাজা রয়েছে? পান দেখে উনি থমকে গেলেন। মাকে কী যে বলবেন, ভেবে পেলেন না। চুপ করে গেলেন।

আরেকদিন, ওঁর আসার সময় হয়ে গেছে, মা আমাকে বললেন, বউমা, ছেলের ফেরার সময় হল, যাও ওপরে গিয়ে, গা ধুয়ে কাপড় পরে, চুল বেঁধে রেডি হয়ে থাকো। ছেলে অফিস থেকে ফিরে এমন হতক্লান্ত বউ দেখুক আমি চাই না। বেশ সুন্দর, ফিটফাট হয়ে থাকো দিকি? শাশুড়ির নির্দেশে আমি তো আহ্লাদে আটখানা হয়ে গা ধুতে ওপরে গেছি–এমন সময় উনি ফিরলেন। আমি তখনও বাথরুমে। মা হঠাৎ শুয়ে পড়েছেন ইতিমধ্যে।

এ কি মা, তুমি একা একা? সুষি কই?

বউমা তো ওপরে। ও তো খেয়েই ওপরে শুতে চলে যায় বাবা! বউমার কি আমার কাছে বসে থাকার সময় আছে? ঘুম থেকে উঠে তো ওর কত কাজ। এখন সাজগোজই করবে কতক্ষণ ধরে। আমি তো সারাদিন একাই পড়ে থাকি। শুনে উনি তো ক্ষিপ্ত। ধুপধাপ ওপরে এলেন। আমি সদ্য স্নান সেরে বেরিয়েছি। বকুনি শুরু হয়ে গেল।রুগ্ন মাকে একা ফেলে রেখে সাজগোজ করছ দিনরাত কার জন্য? লজ্জা করে না সুষি? সারাদিন নীচের ঘরে একা অসুস্থ মানুষটা পড়ে রয়েছেন, আর তুমি এখানে পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছ?

আমি তো ঘরে বোমা পড়ার মতন জব্দ। এ কী? হঠাৎ মণির মা কোথা থেকে এসে খরখর করে বলতে শুরু করল, এই তো সারাদিন বউমা নিচে ছিল। ভাগবত পড়ে শোনাচ্ছেল আমাদেরকে–এক্ষুনি মা বললে, যাও বউমা আমার ছেলে আসবে, সারদিন খেটেখুটে, তুমি একটু পোস্কের-পোচ্ছন্ন হয়ে, গা ধুয়ে, চুল বেঁধে থাকো–তাই তো বউ ওপরে এয়েছে, আর দাদাবাবু এসেই বকতে শুরু করে দিয়েছ? শুনে উনি চুপ করে গেলেন।

সেই পান সাজার দিনের কথাটাও ওঁকে তখন বললাম যে, তখন আসলে মিষ্টি কিনতে যাচ্ছিলেন। রোজই যান। বললে শোনেন না। তারপর যখন সুগার বাড়ে, তখন দিব্যি বলেন, কী জানি কী যে খেতে দেয়? বউমা যা দেয় তাই-ই তো খাই! মা যান কিনা, ভীম নাগের দোকানে গিয়ে জিগ্যেস করলেই জানতে পারবে। উনি আমাকে বিশ্বাস করলেও, পুরোপুরি করেননি। মিষ্টির দোকানেও জিগ্যেস করেছিলেন। তবুও আচরণে দোষ না ধরে বললেন, আহা বেচারি! সারা জীবন বঞ্চিত হয়ে অমন একটু-আধটু ছেলেমানুষি করেই ফেলে মানুষ!

এরকম যে কতবার।

একবার উনি মা-র কাছে বই রাখবার জন্যে একটা আলমারি চাইলেন ওঁর পড়ার ঘরে। শাশুড়ি আমাকে বললেন, এই কাঠের আলমারিটা খোকার জন্যে নিয়ে যেও। সেটা

আমারই বিয়েতে বাবার দেয়া জোড়া আলমারির একটা। এটা থাকত শ্বশুরের ঘরে। আরেকটা আমাদের ঘরে। তখন বাড়িতে মিস্ত্রি লেগেছে, মজুররা খাটছে, আমি মজুরদের আলমারিটা ওঁর পড়ার ঘরে দিয়ে আসতে বলেছি। ওপরে তোলা হবে, আলমারিটা খালি করছি, ভেতরে তেমন কিছু ছিলও না। শাশুড়ি হঠাৎ চেঁচাতে লাগলেন, বউ এত নিজের জিনিস চিনেছে, যে উনি স্বর্গে যাওয়া মাত্র শ্বশুরের জিনিসপত্তর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাপের দেওয়া আলমারিটি নিজের ঘরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে– আমি স্তম্ভিত। চোখ ফেটে জল এসে গেল। এমন সময়ে উনি এসে হাজির। মা-র চেঁচামেচি তখনও চলেছে। তুমুল কাণ্ড। আমাকে কিছু বলতেই হল না।

উনি অবাক!–সে কি মা? তুমি তো নিজেই আমাকে বললে, আমার পড়ার ঘরে এই আলমারিটা তুলে দেবার কথা!

কিন্তু লজ্জা পাবার মানুষই নন মা।–বলেছিলাম। কিন্তু তোমার বাবার জামা-কাপড়গুলো কি ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে বলেছিলাম? যিনি চলে গেছেন তাঁর স্মৃতির প্রতি কি কোনো সম্মানই নেই বাকি আর?

জামাকাপড়গুলো ভাঁজ করে খাটে রাখা। নীচে ট্রাঙ্ক খোলা। ভরা হবে তাতে। উনি দেখলেন। কিন্তু বললেন না। সরে এলেন।

বারবার আমার ওপরে মা-র অদ্ভুত অত্যাচারের উনি সাক্ষী হয়েও, চোখ বুজে থেকেছেন। অসুস্থ অবস্থায় নার্স, আয়াদের বসিয়ে রেখে, মা আমাকে দিয়ে তার পায়খানা পরিষ্কার করাবেন। পেচ্ছাপ হয়ে যাওয়া চাদর কাঁচাবেন। উনি শুনে ধন্য ধন্য করে বলবেন, আহা, মা কেবল সুষমার হাতের সেবাটুকুই গ্রহণ করে তৃপ্তি পান। সুষি, তোমার অপার পুণ্যি হচ্ছে!

এমনি করে করে সুষির অনেক পুণ্যার্জন করা হয়ে গেছে এ জীবনে, এত পুণ্য আর আমার সহ্য হচ্ছে না–এবার একটু-আধটু পাপ করা খুব দরকার হয়ে পড়েছে। মন্দ কপাল আমার, ভাগে সেইটেই পড়ে গেল। শাশুড়িসেবায় সব এনার্জি শেষ, এখন পতিসেবাতে তাই ঘাটতি পড়ে যাচ্ছে।

কি অদ্ভুত মানুষ! এই যে শিলুকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না, ছমাসের ওপর ছেলেটা নিরুদ্দেশ, তা নিয়ে ওঁর বিন্দুমাত্র উদ্বেগ নেই, মনোকষ্ট নেই। কেবল ওই একই কথা মুখে–

-বুড়ো বাপ-মায়ের দায়িত্ব নেবে না, তাই ভেগে পড়েছে। কিসসু হয়নি, দেখবে আমেরিকায় গিয়ে বসে আছে।

মায়া-দয়াও কি নেই? চিন্তা-ভাবনা তো নেই-ই। বাপ-মায়ের দায়িত্ব নেবার জন্যে শ্রাবস্তীর মতন একটা মেয়ে রয়েছে, সেটাও খেয়াল নেই। সুরো শক্ত হয়ে আছে, জামাইবাবু এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু আমি তো বুঝতে পারছি ওদের ভেতরে কী হচ্ছে? উনি কেন বুঝবেন না?

দৃষ্টিটা আত্মকেন্দ্রিক হতে হতে এমনই সংকীর্ণ হয়েছে যে নিজের বাইরে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না, শিলুকে কেন, শুভকেই কি দেখতে পাচ্ছেন? নিজেকে বাদ দিয়ে নিজের সন্তানের কথাও ভাবতে পারছেন না আজকাল। আশ্চর্য অন্ধতা! কী সন্তান-স্নেহই যে এঁকে শেখালেন এঁর মা-জননী!

২. পুত্রেষ্টি

সপ্তম অধ্যায়। পুত্রেষ্টি

পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করত সেকালে। আমরাই বা কি কম করি? ছেলেকে লেখাপড়া শেখানো আজকাল যজ্ঞের মতন! উপযুক্ত পুত্র কিন্তু ফললাভ হয় কীদৃশ?

উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশযাত্রা। এবং সেই যাওয়া হয় অগস্ত্যযাত্রা। মা-বাপকে ছেড়ে তারা দূরে চলে যায়। নিজেদের প্রবল কর্মযজ্ঞে এমনই নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, সেই উচ্চাশায় জলস্তম্ভে মা-বাপ মাতৃভূমি সব ঘুচে মুছে যায়।

এত কষ্ট করে লেখাপড়া শেখানো, মা-বাপের কোনো কাজে লাগে না। এ যেন পুত্র বিসর্জন দেবার মন্ত্রপাঠ! শুভ চলে গেছে। আমেরিকায়। শিলাদিত্যও শুনছি দিল্লিতে চলে গেছে। কেন, এখানে লেখাপড়া হয় না? এখন দিল্লি। পরের ধাপ আমেরিকা। আর ফিরবে না। কোনোদিনই না। এদেশটা ওদের ভালোই লাগে না।

পুত্রসন্তান প্রার্থনা কি এইজন্যে? আমেরিকা! আমেরিকা! আমেরিকা! ওদের ধ্যানজ্ঞান আমেরিকা, ধর্মকর্ম আমেরিকা। সেই স্বপ্নরাজ্যেই চলে গেছে আমার ছেলে-বউ! আর কোনোদিনও ফিরবে না ভবানীপুরের এই গলিতে। সুষমা বলে, কেন? বছর বছর তো আসছে? আরে, বেড়াতে আসা, আর দায়িত্ব নিয়ে বসবাস করা কি এক হল? সুষমা বলে, আজকাল দিল্লি-বম্বেতেও যা, বিলেত-আমেরিকাও তাই। হপ্তায় হপ্তায় তো ফোন করছে। কিছু তেমন হলেই ছুটে আসবে।

ছুটে আসবে না হাতি। নিজেদের ছুটি-ছাটা হিসেব করে তবে তো আসবে? মিঞা-বিবির টাইমিং চাই তো? আমি সর্বদা সক্কলকে বলি, খবরদার শুভমদের ইসকুলে ছেলে পড়িও না। পেট থেকে পড়েই প্রেম করতে শিখে যাবে ওখানে। তার পরেই শিখবে আমেরিকা পলায়নের কৌশল। যদি ছেলেকে জন্মের শোধ নির্বাসনে পাঠিয়ে দিতে চাও, তো ওই ইশকুলে দাও। রেজাল্টের লোভ করতে গিয়ে মূলে হা-ভাত হয়ে যাবে!

.

বউটা আবার বাঁজা। আমাদের দিয়ে তো মেয়ে পছন্দ করায়নি, নিজেই নিজের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে সেই হামা টানার সময় থেকেই। তর সইল না, বিয়ে করে ফেললে ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা শেষ হতে না হতে। তখনো রেজাল্ট বেরোয়নি। দুজনেই ফাস্ট ক্লাস। দুজনেই সোনার মেডেল। দুজনেই ফেলোশিপ। দুজনেই ফুড়ুৎ করে উড়ে পালাল। নাগালের বাইরে একবার চলে গেলে কি আর ধরা যায়? এই সুষমাকেই তো দেখলুম।

মেয়ে সবর্ণ বলব না, বামুন বটে, কিন্তু বারেন্দ্র। আমাদের ভট্টচায্যি বাড়ির উপযুক্ত বউ সে নয়। বাঙালবাড়ির মেয়ে। বাবা উদ্বাস্তু। কিন্তু স্পষ্ট দেখেছি মেয়েটার কপালে একটা আঁচিল–কপালে আঁচিল মানেই সে মেয়ে অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারিণী হবে। কিন্তু আঁচিলটা ডান কপালে। মুখের ডানদিকে আঁচিল, মেয়েদের পক্ষে সুলক্ষণ নয়। কথাটা বললুম শুভমকে ডেকে। সে ছেলেও তেমনি। সে তো হেসেই উড়িয়ে দিলে। উল্টে আমাকেই বলল, বাবা, সামুদ্রিক জ্যোতিষে পুরুষমানুষের কোনো লক্ষণবিচার নেই? তুমি আমাকে দেখে বলো তো আমার কী কী সুলক্ষণ, কী কী দুর্লক্ষণ আছে? এই যে আমার পড়ে গিয়ে ডান কপালে কাটার দাগ, এই দক্ষিণ ললাটে ক্ষতচিহ্ন মানে কি আমার কপাল ফুটো? আমি কি ভাবতেও পারতাম আমার বাবার সঙ্গে এভাবে ঠাট্টা-ইয়ারকি দিয়ে কথা বলছি? আমার মা কখনো তা অ্যালাউ করতেন? কিন্তু সুষমা কিছু বলে না, হাসে।

আশ্চর্য, বাঁজাবউ বললে, সুষমাই খেপে যায়। বলে, ওরা ইচ্ছে করেই, পরিকল্পনা করেই এখন বাচ্চা চায় না–এখন দুজনেই রিসার্চ করছে, ভীষণ ব্যস্ত থাকে, বাচ্চা হলে তাকে দেখবে কে? আমি যদি জোর করি, বলি, কেন তুমি দেখবে–তখন কথা ঘুরিয়ে বলে, বউ বাঁজা, না ছেলে বাঁজা, তা তুমি পরীক্ষা করিয়েছ? এটা আবার কথা?

আমার যে কোথায় দুঃখু, সুষমা বোঝে না। পরিহাস করে। যত বলি আমার পূর্বপুরুষ জলটুকুও পাবে না সুষমা বলে,

ষাট! কী কথার ছিরি! আমাদের তো শুভ আছে। আমরা জল পাব না কেন? তোমার কি ছেলে হয়নি? তুমি অপুত্রক? তোমার পূর্বপুরুষকে তো শুভই জল দেবে!

আরে, শুভর পরে! শুভর পরে কে দেবে? শুভকেই বা জল দেবে কে?

সুষমা বলে, তোমাকে অত ভাবতে হবে না। যত কুচিন্তা! বলে, আমি বাড়িতে না থাকলে এমনিতেই এক গেলাস জল চাইল বাছু মণির মা রঘু পঞ্চাশবার চেঁচিয়ে তবে তুমি এক গেলাস জল পাও। মরে গেলে কী হবে তাই নিয়ে ভাবো কেন? তাছাড়া শাস্ত্রই যদি মানবে তবে তাতে আছে পুত্রবানদের পুত্র জল দেবে, কিন্তু যাদের কেউ নেই, তাদের তো হিন্দুমতে প্রত্যেকেই জল দেবে। কত জল খাবেন তোমার চোদ্দোপুরুষ?

শুভকে কে জল দেবে? বললেই খেপে উঠে সুষমা উল্টে আমাকে বকে, ছেলে বেঁচে থাকতে তার শ্রাদ্ধের কথা ভাবে, এমন বাবা দেখিনি! অথচ কবছর আগেও সুষমা এভাবে কথা বলত না। ওরা দুবোন ছিল দুরকমের। সুষমা ছিল নীরব, ভীতু, চাপা। সুরমা ছিল স্পষ্টবক্তা। এখন দেখছি সুষমাও তার বোনের মতনই হয়ে যাচ্ছে। আজকাল সুরমার মতনই সুষমাও স্পষ্টকথা বলে। বাইরের পাবলিকের কাছে বক্তৃতা দিতে দিতে ওর সঙ্কোচটুকু কেটে গেছে। আগে কখনও আমার মুখে মুখে কথা বলত না সুষমা।

আমি যে সুষমাকে ছাড়া বাঁচতে পারি না। আমার যে সুষমার বাইরে কোনো জীবন নেই। কোনো পৃথিবী নেই। সেটা সুষমাকে কিছুতেই বোঝাতে পারি না। যতই চেষ্টা করি না কেন, প্রেমে, অভিমানে, রাগে কিছুতেই ওকে ধরে রাখতে পারি না। অথচ ওকে ঘরে না বাঁধতে পারলে আমার শরীর সারবে না। আমার রোগেও উদ্বিগ্ন হয় না আজকাল। উল্টে কেবলই আমাকে বাড়ি থেকে বের করতে চায়। কেবলই বলে, বাড়ি বসে বসে ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছ, তাই রোগ, আর রাগ, এই দুই বাতিক হচ্ছে, ঠিক তোমার মায়ের মতন।

সুষি কথায় কথায় আমাকে এখন বলে, তোমার মায়ের মতন।–আর ওই কথাটা আমার বিশ্বাস ওকে সুরমাই শিখিয়েছে। ওই রোগ আর রাগ। আমার মনে আছে অনেকদিন আগে সুরমা একবার আমাকে বলেছিল, জামাইবাবু, আপনার মায়ের এই রোগ আর রাগ সামলাতেই সুষিটার জীবন কেটে গেল! সুষি এখন আমাকে ওই কথা বলে। তোমার এই রোগ আর রাগ! আবার বলে, রাগটাও নাকি রোগ। রিটায়ারমেন্টের পর অনেক লোকেরই এরকম ডিপ্রেশন হয়। তাই সুষমার চেষ্টা হয়েছে কেবলই আমাকে ব্যস্ত রাখা। ওর ইচ্ছে আমাকে আবার কাজে ঢোকানো। বাড়িতেই চেম্বার বানিয়ে রেখেছিল, আমি প্র্যাকটিস করব বলে। পাগল? দুবেলা বাড়িভর্তি রুগি আসুক, লাইন দিয়ে থাকুক, আমি ওই করি আরকি! আমার তো বলতে নেই বাপ-ঠাকুর্দার দয়ায় অন্নসংস্থানের ব্যবস্থার অভাব নেই।

সুষমার বা এই বুড়ো বয়সে রাস্তায় বেরিয়ে মিটিঙে মিটিঙে চক্কর মেরে বেড়ানোর কী দরকার ছিল? হিন্দু ধর্মের সেবা তো চুলোয় গেছে। হিন্দু শব্দটা ও রাখেনি কোথাও ওর সংগঠনে। কিসের জন্যে স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করলাম, আর কী হয়ে গেল!

মানুষজন, দিনকাল চোখের সামনে সব কেমন আশ্চর্যভাবে পাল্টে যাচ্ছে। অবাক হয়ে দেখি আমার স্ত্রী-পুত্র আমার অসুস্থতাকে মোটে গুরুত্বই দেয় না। অথচ আমার মায়ের অসুস্থতাকে আমরা বাপ-ছেলেতে কতটা গুরুত্ব দিতাম! মায়ের দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা সদাসর্বদা সশঙ্কিত থেকেছি। সুষমাও তা দেখেছে। অথচ আমার বেলায় তার মনোভাব অন্যরকম।

ছেলে তো আরও এককাঠি। শুভ দেশে এলেই কেবল বলবে, বাবা তুমি নিজেকে প্রশ্রয় দিও না, এটা খুব বিপজ্জনক রোগে পরিণত হতে পারে–ট্রাই টু ওভারকাম ইট।

–যেন এখন আমার কোনো বিপজ্জনক রোগ নেই–ঠাকুমার মতন তোমারও কিন্তু হাইপোকনড্রিয়া হচ্ছে, এই থেকে শেষে মেনিক ডিপ্রেসিভ হয়ে যাবার ভয়–আরে ডাক্তার কে? তুই? না আমি? আমার অসুস্থতায় আমার সবচেয়ে আপনজনরাই বিশ্বাস করে না। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? হাউ টু কভিন্স দেম? আই হ্যাভ ওনলি আ ফিউ ডেজ টু গো!

সুষমা হরেক রকম করে চেষ্টা করে আমার রোগটাকে উড়িয়ে দেবার। আমার কথাটা শোনো! কিছু হয়নি গো তোমার! তুমি তো সুস্থ সবল পুরুষমানুষ, কেন রুগি সেজে শুয়ে থাকো বলো তো? চলো আমার সঙ্গে দিল্লি বলে টানাটানি করবে। যখন-তখন সেজেগুজে এসে বলবে, কী করছ? চলো, একটু বাজার করে আসি! আরে, আমার কি শরীরে পোষায়? সুষমা বুঝতেই পারে না। ইদানিং এমন হয়েছে যে ওকে চোখের আড়াল করলেই আমার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। সুষমা সেটা বুঝেও বুঝতে চায় না। স্বামীসেবা ব্যাপারটাকে মোটে গুরুত্বই দিতে চায় না আজকাল, অথচ শাশুড়ির কী অক্লান্ত সেবা করেছে। নার্স থাকতেও, আয়া থাকতেও, নিজের হাতে পায়খানা পরিষ্কার করেছে মায়ের। সুষমার হাতের সেবাটিই মা চাইতেন, তাতেই তার তৃপ্তি ছিল। তাতে সুষমাও কখনও আপত্তি করেনি।

আর এখন? আমি যদি বলি, সুষি, একটু পাশে এসে বসো, মাথায় একটু হাতটা বুলিয়ে দাও, হাতে কাজকর্ম না থাকলে, আসবে, হাত বুলিয়ে দেবে। কিন্তু যদি মিটিং থাকে? মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মণির মাকে, কি বাচ্চুকে ফিট করে দিয়ে ঠিক বেরিয়ে চলে যাবে। মিটিং ক্যানসেল করে আমার কাছে বসে থাকবার পাত্রী নয় সে। অথচ কত অন্যরকম ছিল আগে!

মুখে প্রকাশ করে না বটে, কিন্তু আমি বেশ টের পাই যে, লোকজন এলে, তার মধ্যে থেকে ওকে ডেকে পাঠালে সুষমা বিরক্ত হয়। হয়তো সুরমা এসেছে, ওরা দু-বোনে গল্প করছে নীচে। তখন আমার মাথাব্যথা করল। আমি ডেকে পাঠালাম, ওপরে এসো, আমার মাথাটা টিপে দিয়ে যাও–কিংবা ওর সংগঠনের কর্মীরা এসেছে কোনো আলোচনা চলছে। তখন আমার শরীর খারাপ লাগছে। আমি খবর পাঠালাম, এসো, আমার প্রেশার চেক করে ওষুধ দিয়ে যাও–এসব সময় ও সর্বদাই চলে আসে, মাথাও টিপে দেয়, প্রেশারও চেক করে, ওষুধও দেয়, যা বলেছি সবই করে, মুখে কিছু বলেও না–কিন্তু হাবেভাবে বুঝিয়ে দেয় যে এটা ও খুশি হয়ে করছে না। ওর যে নিজের কাজে বিঘ্ন ঘটছে, সে-ভাবটা একটুও গোপন করে না। আমার মা-বাবা এই সুষমাকে দেখে যাননি। তারা পুণ্যবান মানুষ ছিলেন!

.

অষ্টম অধ্যায়। ক্যালি ফস্

সুষমার আসার কথা না আজকে? রান্নাঘরে চলে এসেছেন আদিত্য। সুরমা চপ গড়ছেন দাঁড়িয়ে। জানলা দিয়ে আলো এসে পড়ছে সুরমার মনোযোগী মুখের ওপরে। আদিত্য দেখেন, কোমরে আঁচল গোঁজা। সুরমা, সুষমা দুই বোনেরই গড়ন খুব সুন্দর। মেদহীন, দীর্ঘাঙ্গী, একমাথা চুল, লাবণ্যে উদ্ভাসিত মুখ বুদ্ধিতে উজ্জ্বল। অবসর নেবার পরে আদিত্য নতুন করে সুরমাকে দেখতে সময় পেয়েছেন। সুরমা আপনমনে গুণগুণ করে গান করছেন। যদি হয় জীবনপূরণ নাই হল মম-রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুরমার শিক্ষয়িত্রী হিসেবে প্রচুর সুনাম। সুরমার গলাটাই পেয়েছে শিলু!

হ্যাঁ, সুষির জন্যই তো মাংসের চপটা বানাচ্ছি। এই এল বলে। তোমার কচুপাতা রেডি তো? সুরমা হেসে স্বামীর দিকে তাকান।

সত্যি, কী একটা বাড়ি! মাংস ঢুকবে না, পেঁয়াজ রসুন ঢুকবে না–সারাটা জীবন সুষিটা কষ্ট করে গেল।

আর ডাক্তার প্রসেনজিৎ ভট্টাচার্য সারাদিন ধুতি পরে খালিগায়ে বসে বসে ভাগবত আর গীতা পড়ছেন, দশবার হাত ধুচ্ছেন, আহ্নিক করছেন–আমি বাবা শুভমকে দোষ দিই না, ছেলেটা পালিয়ে গিয়ে বেঁচেছে। ওকে ধুতি পরানোর জন্য কম চাপ দিচ্ছিল প্রসেনজিৎ? গায়ত্রী না জপ করলে বেড-টি পাবে না! অ্যাবসার্ড!

আদিত্য চামচ করে একটু মাংসের পুর তুলে মুখে পুরলেন।

আরে? ও কি ছোঁক ছোঁক? এক্ষুনি তো চপ তৈরি হয়ে যাবে। ছদ্ম বকুনির সঙ্গে সুরমা প্লেটে করে আরেকটু পুর তুলে দিতে দিতে বলেন,

সত্যি, কী করে পারল যে সুষিটা এতদিন পাগল না হয়ে থাকতে? আমি হলে তো কবেই পালিয়ে যেতাম। ওই শাশুড়ি! ওই শ্বশুর! ওই স্বামী! প্রত্যেকেই এক একজন মহাপুরুষ!

পুরটা সত্যি দারুণ হয়েছে–থ্যাংকিউ। কিন্তু অত নিন্দা কোরো না, নিজে কিনা। দেবতার মতন বর পেয়েছ, তার ওপরে নো শ্বশুর, নো শাশুড়ি, তাই অন্যের বেলায় অত কঠোর কথা–

আহাহা! সাধে কি দেবতার মতন বর? দেবীর মতন বউয়ের জন্যে তো দেবতা হতেই হবে। বুঝলেন রায়মশাই?

অথবা অসুরও তো হতে পারে?

বলতে বলতে ডোরবেল বাজে।

আমি দেখছি–সুরমার আগেই আদিত্য ছুটলেন দরজায়। হইহই করে সুষমা ঢুকলেন।

কই? কচুপাতা কই? হবে না! হবে না। তারপরেই–আরে, কী তৈরি করছিস রে সুরো? এত সুগন্ধ বেরুচ্ছে? ঢুকেই খিদে পেয়ে গেল? কী রাঁধছিস আজ আমার জন্যে? গন্ধে ভুরভুর করছে বাড়িঘর?

তোমার তো বাছা পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ শুঁকলেই খিদে পাবে। যেমন নিরামিষ্যি বাড়িতে রাঁধাবাড়া তোমার!

সত্যি বাবা যে কী দেখে আমার বিয়েটা দিয়েছিলেন?

কেন? দেখতে তো সবই ভালো। জামাইবাবুর মতো সুপুরুষ তুই আর দেখেছিস? আমি দেখিনি। এই সেদিনই তোর জামাইবাবুকে বলছিলুম সেই কথা–পাত্র তো আইডিয়াল! রূপ, বংশ, ধনরত্ন, শিক্ষা, চাকরি, জাতকুল, মায় কোষ্ঠী পর্যন্ত সবই তো মিলেছিল। খুচরো পাগলামির খবরটা তো কেউ সংসার না করলে বুঝবে না। ওটা কোষ্ঠীতে লেখা ছিল না!

সত্যি! এতগুলো বছর কেটে গেল, সেই সতেরো থেকে রওনা হয়ে এই ছাপান্নোয় এসে পৌঁছেছি। তবু মনে আরাম পেলান না। সদাসর্বদা মনটা যেন কান খাড়া করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে! কী হয়-কী হয়! ভয়ে টানটান হয়ে থাকা!

তোমার বোন বলছিল, সে হলে কবেই পালাত! তুমি মহীয়সী, গরীয়সী, পটিয়সী পূর্ণশশী, তাই এখনও প্রসেনজিতের ঘর করছ!

না-না, উনি মানুষটা তো মন্দ নন? আমাকে সত্যি সত্যি প্রাণের সমান ভালোবাসেন। সেটা কিন্তু ভুল নয়।

কেবল নিজের মাকে প্রাণের চাইতেও অনেক বেশি ভালোবাসেন। তাই তো?

সেটা আর কী করা! লীলাবতী-ফিক্সেশনটা ওঁদের বংশগত রোগ, জামাইবাবু! ইটস্ আ ডিজিজ।

ওই যে গেল গেল ভাব, সর্বক্ষণই এই বুঝি-মা-মরে গেল, এই মিথ তোর শাশুড়ি নিজে নিজেই বানিয়েছিল, সুষি।

মহিলা নিজের দিকে অ্যাটেনশন কী করে ড্র করতে হয়, খুব ভালোরকম জানতেন। খুব এফেটিভ হত ওঁর তুকতাক–আদিত্য সোফায় বসতে বসতে বলেন, হায়রে, আমরা যদি তার এককণাও জানতাম! মনে আছে, শুভর বিয়ের দিনে কী কান্ড করলেন?

মনে নেই আবার? সুরমা রান্নাঘর থেকেই যোগ দেন, হঠাৎ তোর শাশুড়ির এমনই শরীর খারাপ করতে লাগল, যে বাড়িসুদ্ধ তারই সেবাশুশ্রূষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল, বর বেরুতে একটু দেরি হয়ে গেল!–ব্যস্! জামাইবাবু বললেন, যাত্রার লগ্ন ওভার! যাত্রা নাকচ। এখন লগ্ন নেই। মাথায় বাজ পড়ল সবার!

ওই তো সাড়ে পাঁচটার সময় বর নিয়ে বেরুবার কথা, আমরা বর বরণ শুরু করতে করতেই সাড়ে পাঁচটা বাজিয়ে ফেললুম–উনি হিসেব কষলেন বেরুতে বেরুতে পৌনে ছটা হয়ে যাবে, ব্যস্ উনি বেঁকে বসলেন Its too late for today বলে। ভাগ্যিস তোরা ছিলি! জামাইবাবু, আপনি জবরদস্তি না করলে সেদিন সত্যি আমার ছেলের বিয়েই ভেস্তে যেত! কী যে পাগলামি আছে ওঁর!

হ্যাঁ, সত্যি, সেদিন ও যদি ঠেলেঠুলে বরযাত্রীদের গাড়িতে না তুলে দিত, চেঁচামেচি না জুড়ে দিত, কেলেঙ্কারি হয়ে যেত। অথচ বিয়ের লগ্ন ঢের দেরি ছিল, রাত দশটার পরে টাইম।

উঃ! শুধু শুধু কী হট্টগোলটাই বাধালেন! আর সেই গোলমালে আমি কী করলাম? মনে আছে তোর সুরো? সেই যে বরকে বরণ করতে গিয়ে? হঠাৎই-সুষমা সুরমা আদিত্য তিনজনের অট্টহাসিতে ঘরের দেয়াল চমকে ওঠে।

মনে আবার নেই? ঘাবড়ে, নার্ভাস হয়ে, ভীতু ভীতু মুখে, ঘোমটা টেনে বরণ-ডালাটি হাতে নিয়ে তুই টুক্ করে পিঁড়ির ওপরে উঠে দাঁড়ালি, আর শুভ রইল মাটিতে। দিব্যি মন দিয়ে বরণ করতে শুরুও করেছিলি, হঠাৎ কে যেন বলল, আরে আরে? ও কী হচ্ছে? বরের মা কেন পিঁড়িতে? বর যে মাটিতেই দাঁড়িয়ে রইল? তারপরে আর তুই বরণ করবি কি, নিজেই হেসে কুটিপাটি!

তুই আমাকে কীরকম ধমক লাগালি? সুষি, না শিগগির পিঁড়ি থেকে–আর অত হাসতে হবে না

আর শুভও কেমন বকুনি দিল তোকে? যেটা জানো না সেই সব যে কেন করতে যাওয়া? ঠাম্মাকেই বললে পারতে, এসব ঠাম্মার লাইনের ব্যাপার। এদিকে বিধবা বলে যে ঠাম্মা স্ত্রী-আচার কিছুই করতে পারছেন না,

অতএব তড়িঘড়ি শয্যা নিয়ে নিলেন–সেও স্ত্রী-আচারই বটে!

নাগো, শুধু ওইটেই বোলো না, সুরমা স্বামীকে মৃদু ভর্ৎসনা করেন, সেদিন উনি নিজে যদি ছেলেকে ডেকে না বলতেন, যাও বাছা জিতু, ছেলেকে নিয়ে বিয়ে দিতে যাও, আমি ঠিক থাকব, বউমা তো কাছে রইল–তাহলে তুমি যতই লাফাও না কেন, উনি যেতেন না, মাকে নিয়ে মায়ের পাশে বসে থাকতেন, আর বলতেন, আদিত্য বরং বরকর্তা হয়ে যাক! মা নিজে অনুমতি দিলেন বলেই জামাইবাবু সেদিন বর নিয়ে গেলেন।

ওটাই তো খেলা। ইঁদুর-বেড়াল খেলা। পাওয়ার গেম। এই সুতো টানছি, এই সুতো ছাড়ছি–

যাকগে এখন তো নেই। ওসব কথা থাক না—

নেই, কিন্তু ছেলেকে ট্রেনিং দিয়ে গেছেন।

সত্যিই ছেলের মধ্যে দিয়েই লীলাবতী বেঁচে আছেন। বিবাহে অনুমতি দিলেও ওঁর প্রকৃতপক্ষে পছন্দ ছিল না লোপাকে। তার মতন ক্যাটকেটে ফর্সা রং নয়, অতএব সে রূপসীও নয়। এখন তো তার ছেলেই অবিকল মায়ের মনের-প্রাণের কথাগুলো বলেন। প্রসেনজিৎ যেন তার বাবা এবং মায়ের যুগ্ম প্রতিধ্বনি।

শুভম জানত তার গোঁড়া জাত-পাত ঠিকুজি-কুলুজি-গোত্র-কোষ্ঠি-মানা উগ্র হিন্দুত্ববাদী পরিবারে এ বিয়েতে অনুমতি মিলবে না। বাবা লোপামুদ্রাকে গ্রহণ করবেন না। মনে মনে দশ বছর ধরেই সে প্রস্তুত হচ্ছিল, বাবা আপত্তি করলে, তার পরবর্তী ধাপগুলি কী কী হবে, সবই হিসেব কষা ছিল তাদের। যথারীতি বাবা আপত্তি করলেন। কিন্তু চমক বাকি ছিল লীলাবতীর জপের থলিতে। নাতির বেলায় লীলাবতীর মনের ভাব বদলে গেল, তিনি লোপামুদ্রাকে গ্রহণ করলেন। আহা, বামুনের মেয়ে তো? স্ত্রীর দুষ্কলাদপি, বারেন্দ্র তো কী হয়েছে–ওদের সঙ্গে বেশি দহরম-মহরম না করলেই হল। মার মত আছে যখন, তখন আর প্রসেনজিৎ অমত করেন কী করে? বিয়ে ভালোভাবেই হল, ওঁদের একমাত্র সন্তানের বিবাহ ঠিক যেমনভাবে হওয়া উচিত। না, এককড়ি পণও নেননি অহংকারী প্রসেনজিৎ।

.

কিন্তু বিয়ের মাস দুয়েকের মধ্যে শুভম বউকে নিয়ে সাতসমুদ্র পেরিয়ে উড়ে পালাল। গায়ত্রী মন্ত্র জপ না করে জলস্পর্শ না করা, বাড়িতে থাকলে ধুতি পরা, নিয়মিত পৈতে মাজা, বাড়িতে মাংস-রসুন-পেঁয়াজ-বিড়ি-সিগারেট না খাওয়া, এইসব বিচিত্র নিয়মকানুন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিল শুভম্ লোপামুদ্রাকেও। ভালো ছাত্র হলেও সে চিরদিনই খেলাধুলো, হাসিঠাট্টা ভালোবাসে, দায়ে পড়ে ঠাকুরঘরে পা দেয় একমাত্র পরীক্ষার দিন সকালে।

আমেরিকাতে গিয়ে দুজনে মন দিয়ে পড়াশুনো শুরু করে দিল। কিন্তু প্রতিবছরই একবার নিজে আসে, আর একবার বউকে পাঠায়। ছমাস অন্তরই তাই একজনের সঙ্গে দেখা হয়। আর উপহারের তো অন্ত নেই। বাড়ি ভরে গেছে ওদের আনা গ্যাজেটে। সুষমার অবশ্য সেসব ব্যবহার করবার মতো সময় নেই। তিনি বাইরের কাজে ব্যস্ত। কিন্তু ছেলে বউয়ের ভালবাসা সুষমা ছুঁতে পারেন। ওদের দূরে থাকাটা যে ভালবাসার অভাবে নয়, সেটাও বোঝেন। যে-সময়ে ওরা পৃথিবীতে এসেছে, সেই সময়টা বড় নির্মম। বাড়ি থেকে বের হয়ে, সুষমা এই দশ বছরের নতুন দৃষ্টি পেয়েছেন, অনেক কিছু শিখেছেন। ঘরে বন্দি হয়ে থেকে প্রসেনজিৎ যা শিখতে রাজি নন।

এখন ওদের রোজগার ভালো। দুজনেরই গবেষণা এখন যে পর্যায়ে, তাতে খানিকটা হাঁপ ছাড়ার ফুরসৎ আছে। বারবার টিকিট পাঠাতে চাইছে শুভ, বাবা-মাকে কাছে নিয়ে যেতে চায়। বস্টনের প্রত্যন্তের এক গ্রামে, সুন্দর বাগানঘেরা বাড়িতে আছে ওরা, অনেক পাখি আসে সেই বাগানের বড় বড় গাছে, আর প্রচুর ফুল ফোটে, সুবাস ভেসে থাকে বাতাসে। নানাভাবে লোভ দেখায় শুভ। লোপা খুব চমৎকার রান্না করতে শিখেছে। লোপা অপূর্ব গাড়ি চালাচ্ছে। তোমরা এলে নায়াগ্রা ফলস্ দেখাতে নিয়ে যাব। তোমরা এলে ক্রস কান্ট্রি ট্রিপে বেরুতে পারি, বস্টন টু একেবারে সানফ্রানসিকো। সুষমার খুব ইচ্ছা করে। লোপামুদ্রার বাবা-মা গত বছর ঘুরে এলেন। ওঁরা তো উচ্ছ্বসিত।

কিন্তু, না। প্রসেনজিৎ যাবেন না। এ বয়সে ম্লেচ্ছ দেশে যাবার প্রশ্ন নেই। অল্পবয়েসেই যখন গেলেন না! ছেলে তবু বলেই যায়–আরে এসো তো একবার? দেখে তো যাও আমরা কোথায় থাকি, কেমন বাড়িতে থাকি, কী খাই, কোথায় কাজ করি, কারা আমাদের বন্ধু, অবসরে কী করি? তোমাদের জানতে ইচ্ছে করে না?

নো থ্যাংক ইউ। প্রসেনজিতের এক কথা। তোমরাই এসো। দেশে ফিরে এসো। এইখানেই তোমাদের থাকার কথা। এটাই সত্য। এটাই বাস্তব। ওটা স্বপ্ন। স্বপ্নের বাড়িঘর দেখে আমি কী করব?

প্রসেনজিতের নিষেধ মেনে তার ছেলে (বউও। সুষমা তো দেখছেন, এখন এ ব্যাপারে মেয়ে-ছেলেতে আর ফারাক নেই) মদ-সিগারেট খায় না। আমেরিকাতে সকলেই, কি পুরুষ, কি মেয়ে, নির্বিচারে মদ-সিগারেট খায় বলে প্রসেনজিৎ বিশ্বাস করেন। কিন্তু শুভ বলেছে, অনেকেই আছেন যাঁরা মদ ছোঁন না। প্রচুর সংখ্যক অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে ওখানে নিরামিষ খাওয়া শুরু করেছে। এবং শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা ধূমপান করাকে অমার্জিত সমাজবিরোধী আচরণ বলে মনে করেন। শিক্ষিত সমাজে ধূমপান এখন খুবই কমে গেছে। কাজেই শুভরা মদ-সিগারেট খাচ্ছে-কি-খাচ্ছে-না, এটা ওদের কাছে কোনো বড় কথাই নয়। বিশ্বভুবনের এই মরণোন্মুখ হাওয়া-বাতাসটুকুকে যতটুকু বিষমুক্ত রাখা যায়। গাড়ি তো চালাতেই হচ্ছে। যদিও ওদেশে এখন নানারকমের পলিউশান কন্ট্রোলের কায়দা তৈরি হয়েছে।

সুষমার এসব ব্যাপারে উৎসাহ আছে। দুঃখী মেয়েদের কাজে নেমে দেখেছেন সারা পৃথিবীই এখন ওঁর অনেক কাছাকাছি। প্রসেনজিৎ এই জগতে পৌঁছুতে পারেননি। তাঁর অহংকার অন্যত্র। তার ছেলের কোনো নেশা নেই।

শুভ-লোপামুদ্রার কাছে বেড়াতে যেতে সুষমার খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু প্রসেনজিৎকে ফেলে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। নিয়েও যাবার উপায় নেই।

দীক্ষার পরে কেউ কালাপানি পার হয় না। সোজা জবাব প্রসেনজিতের।

প্রসেনজিতের যখন বয়েস শুভর মতোই, ইংলন্ডে এক প্রসিদ্ধ হাসপাতালে চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। পিতার অনুমতিও মিলেছিল। সুষমার বিয়ের পর তখন সবে বছর খানেক হয়েছে। রাজশেখরবাবুর সে কী আহ্লাদ! তিনি ঠিক করলেন নিজেই খরচ দিয়ে সুষমাকেও সঙ্গে পাঠাবেন, যদি শ্বশুর তার খরচ না দিতে চান।

কিন্তু লীলাবতীর মত ছিল না। মুখে আপত্তি করেননি, উৎসাহও দেননি। মনের অসম্মতি বাইরে টের পেতে অসুবিধে হয়নি কারুরই। অতএব প্রসেনজিৎ নিজেই বিদেশে যেতে রাজি হলেন না। লীলাবতাঁকে ছেড়ে তিনি যাবেন কীভাবে? মায়ের এত অসুখ, হঠাৎ যদি কিছু হয়ে যায়? মাকে ছেড়ে যাননি প্রসেনজিৎ। তাঁর বাবাও জোর করেননি। ছেলের বিলেত-টিলেত না যাওয়াই তো ভালো? নিজেরও তো বয়েস হচ্ছে তার।

জীবনের সেই সুবর্ণ সুযোগ, F.R.C.S পড়বার শখ এবং সুবিধে, কত অনায়াসেই ত্যাগ করেছিলেন মাতৃমুগ্ধ প্রসেনজিৎ। সেজন্য তার মনে কোনো আপসোসও দেখেননি সুষমা। আশ্চর্য ঘরকুনো মানুষটা।

প্রসেনজিতের বাবা তেমন দুঃখিত না হলেও, সুষমার বাবা যারপরনাই আশাহত হয়েছিলেন জামাইয়ের এই সিদ্ধান্তে। মাতৃভক্তি ভালো, কিন্তু এটা কী বস্তু? ওঁর মায়ের রোগটা তো ক্রনিক ডায়াবেটিস। এবং সেটা এমন কিছু বিপজ্জনক সীমাতেও পৌঁছে যায়নি। অকারণে এত ভয় পেলে কী চলে? রাজশেখর বুঝেছিলেন, কথা বলে কোনো ফল হবে না। প্রসেনজিৎ নিজে যা স্থির করেছেন, তাই করবেন। উন্নতি জলাঞ্জলি দেবেন।

মায়ের অসুস্থতার কারণে জামাই যখন বিলেত গেল না পড়াশুনো করতে, তখন সুষমার পিসিমা জিগ্যেস করলেন, সুষির শাশুড়ির কী অসুখ করেছে? যার জন্যে ছেলে বিলেত যেতে পারল না!

সুষমার বাবা গম্ভীর মুখে উত্তর দিয়েছিলেন–ওঁর মাথায় ডায়াবেটিস হয়েছে।

এই মাথায় ডায়াবেটিস এখন প্রসেনজিতেরও হয়েছে। ওঁর বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে। এই বয়সে ওঁর প্রস্টেটে নির্ঘাত ক্যানসার ছড়াচ্ছে। এখনও তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, নেহাত দুর্ভাগ্যবশত। একেবারে শেষ অবস্থায় বোঝা যাবে। এবং তখন চিকিৎকার সময় থাকবে না। অথচ এখন ধরা কিছুতেই পড়ছে না রোগটা! ফলে চিকিৎসাও হচ্ছে না। কি সুষমা, কি শুভ, এরা কেউ যে অসুখটাতে বিশ্বাস করতে চায় না, সেটা এদেরই হৃদয়হীনতার কারণে। সুরমা এবং আদিত্য এলে অবশ্য প্রসেনজিৎ খুশিই হন, কেননা ওঁরা ওঁর অসুখ নিয়ে পরিহাস করেন না কখনোই বরং মন দিয়ে শোনেন। বেশ সিরিয়াসলি শরীরের খোঁজখবর নেন আদিত্য। পুরুষমানুষ, তারও তো এই প্রবলেমটা হবেই একদিন। আদিত্য সামান্য ছোট প্রসেনজিতের চেয়ে।

.

খেতে বসে সুষমা বললেন,

পরশুদিন ব্যাঙ্গালোরে যাচ্ছি। উনি তো বেজায় গোলমাল শুরু করে দেবেন, ওঁকে এখনও কিছু বলিনি।

সে কি রে? কখন বলবি?

যাবার সময়ে বলে যাব। তোরা একটু যাস। আমি তিনদিন বাদেই ফিরব। যেতে-আসতেই দুটো দিন নষ্ট–মিটিঙে থাকছি তো মিনিমাম সময়।

তোর এইসব ব্যাপারে প্রসেনজিৎকে সঙ্গে নিতে পারিস না, না? কোনো কাজে টাজে?

সঙ্গে এলে তো নেব? এত বড় ডাক্তার, আমাদের সংগঠনে ওঁর কতকিছু করবার আছে–তা উনি শুধু হিন্দুধমের সেবা করবেন। আমি হিন্দুধর্মের সেবা করি না। আমার সংগঠন সব ধর্মের দুঃখী মেয়ের জায়গা আছে, সব ধর্মের কর্মী আছে।

সত্যি ডাক্তার হয়ে উনি যে কী করে এসব মৌলবাদী কথাবার্তা বলেন, আমি বুঝি না।

এই যে তুমি আলাদা একটা কর্মজীবন গড়ে নিয়েছ, তোমার এই কাজের জগতে প্রসেনজিৎকে তুমি মোটে এন্ট্রি দাওনি–ওটা তোমার একার এরিয়া–এইজন্যেই এতটা অস্থির হয় ও। হিন্দু নারী-টারী করলে তার মধ্যে ওঁরও একটা ধর্মীয় রোল থাকত–কিন্তু তোমার হয়ে গেছে পিওর মানবধর্ম, প্রসেনজিতের ধর্মবিশ্বাসের সেখানে জায়গা নেই–এইটেই ওঁকে এতটা ইনসিকিয়োর করে ফেলেছে, যত জেলাস হচ্ছে, তত পজেসিভ হচ্ছে, যত পজেসিভ, তত অ্যাগ্রেসিভ–যাই বলো সুষি, রূপসী বউকে একা ছেড়ে দিতে কার না বুক ধুকপুক করে?

থামুন তো জামাইবাবু? দেখছেন আপনাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করলেও উনি শরীর খারাপ বলে আসেন না, সল্টলেক নাকি অতিরিক্ত দূরে। তিনি যাবেন আমার সঙ্গে মিটিং অ্যাটেন্ড করতে?

সুরমা দুজনের প্লেটেই টাংরী কাবাব তুলে দিতে দিতে বলেন, সত্যি জানোই তো, উনি চিরকালই আমিটি-আর-তুমিটি। আগে ছিলেন শুধুই মা, এখন হয়েছে শুধুই বউ। বউ যদি অসুখ বলে শুয়ে থাকত। তাহলে উনি নিজে আর শুয়ে পড়তেন না, উঠে পড়ে বউকে তেড়ে যত্ন করতেন।

যা বলেছিস সুরো। উনি অবশ্য কেউ অসুস্থ হলেই সেবা করবেন, তা ভেবো না। দিদি তো অসুস্থতার সঙ্গে মুখ-দেখাদেখি নেই। এমনকী ভাইফেঁটাতেও যান না–বিজয়ায় আমি একাই যাই–যোগাযোগ সবই আমার সঙ্গে–অথচ একমাত্র দিদির ওই তো একটা মাত্র ভাই–

প্রসেনজিতের এটা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাকৃত একাকিত্ব। ও যদি স্বেচ্ছা-নির্বাসনে থাকতে চায়, তুমি কী করবে?

একা তো থাকতে চান না, নির্বাসনে তো আমাকেও সঙ্গী চান–যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দুজনে–

ডেজার্ট আইল্যান্ডে শুধু প্রসেনজিৎ আর সুষমা। না, ডেজার্ট নয়, ড্রিম আইল্যান্ড ইন আ ল্যান্ড অব মিল্ক অ্যান্ড হানি–এইভাবে ভাবো না?

ইয়ারকি কোরো না তো, সুষমার যন্ত্রণাটা বুঝতে পারো না? কিন্তু তোরও দোষ আছে সুষি, কোথায় বেরুচ্ছিস, কখন ফিরবি, এ খবরগুলোতো দিয়ে যাবি কে? সেদিন ফোন করেছি, তোকে চাইলাম, জামাইবাবু বললেন বেরিয়েছিস। কোথায়? জানেন না। কখন ফিরবি? তাও জানেন না। বেশ দুঃখী দুঃখী শোনাল। ন্যাচারালি!

সুষমার ভ্রু কুঁচকে গেল।

এটা কবে?

এই তো, রোববার বিকেলে।

এই রোববার? ৪ঠা? খুব ভালোই জানতেন কোথায় বেরিয়েছি। রোটারি সদনে। একটা ইস্টলেশন মিটিং ছিল। ওঁর নেমন্তন্ন ছিল ওখানে ডিনারে। উনি তো গেলেন না, আমিও মিটিং সেরেই দৌড়ে পালিয়ে এলাম ডিনার না খেয়ে। ওঁর ভয়ে।

তবে যে বললেন, জানেন না?

ওটাই তো পাগলামি।

শুভর খবরও বললেন জানেন না।

সেও ওই। গত চারদিন শুভ যতবার ফোন করেছে, উনি ফোন ধরেননি। কথা বলবেন না। অভিমান হয়েছে।

কিসের অভিমান?

সে তুই ওঁকেই জিগ্যেস করিস। মায়ের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যে উনি নিজের ডাক্তারী কেরিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে বিলেতে পড়তে না গিয়ে এখানেই রইলেন, মেডিক্যাল কলেজে–আর এতবড় একটা গুরুতর অসুস্থ বাপকে ফেলে, ছেলে কিনা ডলারের লোভে পড়ে রয়েছে আমেরিকায়? কেন, টাকার কি অভাব ছিল ঘরে? না চাকরির? তাই কথা বলবেন না। যেহেতু ছেলে অর্থগৃধু।

কি মুশকিল! ওঁদের সময় আর শুভদের সময় কী এক? আমাদের কত বছর বয়েসে বিয়ে হয়েছিল? আর খুকুর বয়েস এখন কত? সে বীরভূমে এস. ডি. ও হয়ে চলে গেল। গৌতমের সঙ্গে বিয়েটা ঝুলেই রয়েছে। হ্যাঁ, বিয়েটা হবে, করছি, করব, এত তাড়া কিসের? এ কি আমরা ভাবতেও পারতুম?

তুই একটু বোঝা না তোর জামাইবাবুকে। শুধু শুভমের ওপরে এত রাগ। সেদিন বলছেন–এমন কুলাঙ্গার ছেলে না জন্মালেই ভালো হত। ষাট ষাট। কি সর্বনেশে কথা? ভাব দিকিনি?

সুষমার অস্থির গলা–এমন ছেলের বাপ না হলেই খুশি হতাম–বলে কেউ? কী করেছে ছেলে? এমন বাপের কাছে কেনই বা ফিরবে বল ছেলে?

তাও তো তোর ছেলে ডিউটি সবই করে। বছরে নিজে একবার আসে, ফিরে গিয়ে বউকে একবার করে পাঠায়, হপ্তায় দুবার তিনবার করে ফোন করে, বউ এসে সংসারে যা। কিছু দরকার সব কিনে দিয়ে যায়–এখানে এক বাড়িতে বাস করেও ছেলে-বউরা এত করে না রে–দেখি তো চাদ্দিকে? শুভমের সত্যি তুলনা হয় না–বউটাও হয়েছে তেমনি চমৎকার।

বাবাকে খুশি করতে মদ-সিগারেট ছোঁয় না। মাংস-টাংসগুলো অবশ্য খেতে ভালোবাসে–সে তো আমিও বাসি–বউটাকে কেন খাবার কষ্ট দেব শুধু শুধু? সেই নিয়ে রাগ। বিদেশে কেন ছেলের বাড়ির হেঁশেলে রসুন-পেঁয়াজ-মাংস ঢুকেছে!

আমার কাছে খান কী করে তাহলে?

তুই তো ভট্টচার্য-বাড়ির বউ নোস। তাছাড়া আজকাল তো খায়ও না বাড়ির বাইরে। দিনকে দিন গোঁড়া হচ্ছে। আমি রেগেমেগে বললুম, এবার থেকে স্বপাক খাও, সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি–তা খাবেন না, এদিকে তো রামকুঁড়ে। ঠাকুরের হাতের নিরিমিষ্যি রান্নাটি চাই, মাছ রাঁধতে হবে আমাকে।

এতর মধ্যে তুই রোজ–সত্যি! দেখালি বটে!

আমিই মাছটা রেঁধে ফেলি। কতটুকুই বা সময় লাগে? এই যখন কলকাতার বাইরে যাই তখন মাছ বেঁধে ফ্রিজ করে দিয়ে যাই। date লিখে দিই প্রত্যেক কৌটোর ওপরে। খুলে খুলে গরম করে দেয় ঠাকুর। এই কায়দাটা বউমা শিখিয়ে দিয়ে গেছে।

বউমা যে নতুন চাকরি পেয়ে তোকে কাপড় কিনতে পাঁচশো ডলার পাঠালো, সেটা বলেছিস জামাইবাবুকে?

পাগল? হিংসের চোটে মরেই যাবেন না? তোমাকে কেন দিল? আমাকে কেন দিল না? এদিকে তুমি যে ওকে কষ্ট দেবে, যন্ত্রণা দেবে, ও কেনই বা তোমাকে ভালোবাসার উপহার পাঠাবে? উনি এটা বোঝেন না। সবই ওঁর কাছে ডিউটি। শ্বশুরের প্রণামী কই? শ্বশুর তো শাশুড়িরও দেবতা? আরেক ধাপ ওপরে না?

য্যাঃ, কী যে বলিস!

তুই এসে দেখেই যা না, ঠিক বলছি কিনা? যেতেই তো চাস না ওঁর কাছে।

তোর বাড়িতে গিয়ে কি কারুর স্বস্তি আছে সুষি? গেলেই মনে হয় তোকে মুশকিলে ফেলা হল। দুটো কথা বলবি, আর জামাইবাবু চেঁচাবেন, শুনছ? শুনছ? একটু এদিকে শুনে যাও– তোর দোটানা পড়ে যায়। একবার এদিকে, একবার ওদিকে। তোরই বেশি কষ্ট এতে। তার চেয়ে তুই যখন এখানে আসিস, তবু একটু হাত-পা ছড়িয়ে গল্প করতে পারিস-ওখানে ওটা হয় না।

আমি গেলে কিন্তু প্রসেনজিৎ দিব্যি বসে গল্প-টল্প করে, বেদ-বেদান্ত পুরাণ-টুরাণ নিয়ে কত জ্ঞান বিতরণ করে, তখন তো ওগো শুনছ করে না?

তখন তো উনি নিজে অকুপায়েড থাকেন। আমি গেলে বেশিক্ষণ ওঁর সামনে বসে বসে গল্প করতে পারি না, সুষি যে একদম রিল্যাক্স করে না ওঁর সামনে, সব কথা তো বলা যায় না ওঁর কাছে—

উনি একা থাকতে পারেন না, আবার আমি ছাড়া আর কারুর সঙ্গে মিশতে ও পারেন না। শুধু এই জামাইবাবুই একলা এক্সেপশন! আদিত্য এসেছে শুনে খুশি হন। আর যে-কেউ আসুক, উনি বিরক্ত!

আমি এলেও? নাঃ, আমি এলে বিরক্ত হন না জামাইবাবু। তবে আমিই বোর হয়ে যাই।

ইয়ার্কি-ঠাট্টা না করতে পারে, প্রসেনজিটা বড্ডই সিরিয়াস, কিন্তু শালী এলে বিরক্ত হবে এমন জীব এখনো জন্মায়নি। সুরো, প্রসেনজিৎকে তোমরা এত নিন্দে করো না। হ্যাঁ, যখন ওঁর মা বেঁচে ছিলেন তখন বাড়ির অ্যাটমসফিয়ারটাও বড্ড ক্লোজড, বড্ড সাফোকেটিং লাগত–কিন্তু এখন তো–।

সাফোকেটিং? জামাইবাবু, আমার স্বামী অফিস থেকে ফিরছেন, আমি আশায় আশায় বসে আছি, উনি এমন একখানা মুখ করে বাড়ি ঢুকলেন, যেন মড়া পুড়িয়ে এলেন। অবিকল শ্মশানঘাট থেকে এলে মুখের যেমন অবস্থা হয়। তেমনি। চুপচাপ এসে, কথা নেই, হাসি নেই, জুতো খুলে, হাত-পা ধুয়ে, অফিসের কাপড় ছেড়ে, সোজা মায়ের ঘরে চলে গেলেন। আমি যেন নেই।

শুভ যখন ছোট, বাবার কাছে ছুটে যেত, তার দিকে নজর দিতেন না, চোখমুখ উদ্বিগ্ন, টেস্, ঘরে মরণাপন্ন রুগি থাকলে যেমন হয়।–কেন? না, মার যদি কিছু হয়ে যায়? মা এদিকে দিব্যি পান চিবিয়ে, টি.ভি. দেখে, চুরি করে মিষ্টি কিনে এনে খেয়ে, চুলটুল বেঁধে, সেজেগুজে শুয়ে পড়েছেন সন্ধেবেলায়, ছেলেকে দেখাবেন বলে। সে এক নাটক বটে। কী দিনই গেছে।

এইজন্যেই তোদের বাড়িতে লোকজন আসত না

তুইই তো বুদ্ধি করে শেখালি। শুভ জন্মানোর পরে। আত্মীয়-স্বজনদের সব ডাক, ছেলেকে দেখতে আসতে বল। সবাই আসুক। তাদের খাইয়ে-দাইয়ে যত্ন কর, ধরে রাখ, বারবার আসতে বল, দেখবি আত্মীয়-স্বজন তার পক্ষে কথা বলবে, বোকা তো কেউ নয়। হলও তাই। এখন বাড়িতে যে আসে, আমার কাছেই আসে। সেটাই তো ওঁর অপছন্দ। বলেন, বাহাদুরি কেনার জন্যে তুমি লোকের যত্ন-আত্তি করো। কী বলব বল? হিংসে নয়?

এখন তো বেরিয়ে পড়েছিস বাইরের পৃথিবীতে, বৃহত্তর জীবনে, মস্ত বড় কমপিটিশন এখানে জামাইবাবুর পক্ষে

এখনও একই কথা বলেন–বাহাদুরি কেনবার জন্যেই তুমি দুঃখী মেয়েদের উপকার করো। এঁকে তুই কী বলবি? এই মানুষের সঙ্গে ঘর করি।

সাইকোপ্যাথ বলব, আবার কী বলব। বউকে এত হিংসে করতে আমি জন্মে দেখিনি।

কেন করবে না? সুরো তুমি ভেবে দ্যাখো, যা যা সুষি আজ হয়েছে, তার কোনোটাই হওয়া কি অসম্ভব ছিল প্রসেনজিতের পক্ষে? বরং আরও বেশি করেই হতে পারত, বেশি শিক্ষিত সে, কিন্তু পারেনি। যে কোনো কারণেই হোক, ওঁর দ্বারা এই পাবলিক সেলিব্রিটি হয়ে ওঠা সম্ভব হত না কোনোদিনই। চাদ্দিকে বউয়ের এত ভক্ত, এত নামডাক, বউকে সে হিংসে করবে না? কাগজে ছবি, টিভিতে ছবি–

হ্যাঁ, সুষমা ভট্টচার্যকে লোকে রোজ ডাকছে এই স্কুলে প্রাইজ দাও, এই সভায় বক্তৃতা দাও, উত্তম্যান অব দি ইয়ার হয়ে গেল ঝট করে, বালিকা সুরক্ষার অনাথ মেয়েরা প্রাইজ পেয়ে নরোয়ে গেল, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সংঘ-কে নিয়ে ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি হল– সগর্বে সুরমা আদিত্যর কথার পিঠে আরো আরো কথা যোগ করে দেন।

তুই থাম তো সুরো। বরং আমাকে একটা জরুরি কথা ব–গলায় ব্যথা করলে কী ওষুধ খাই? দুদিন ধরে খুব গলাব্যথা করছে—

সে কিরে? জামাইবাবু ঘরে বসে আছেন আর আমাকে জিগ্যেস করছিস কী ওষুধ খাবি?

সর্বনাশ। ওঁকে বললেই তো হয়ে গেল। ক্যানসার দিয়ে শুরু করবেন। প্রথমেই বাড়ি থেকে বেরুনো বন্ধ হয়ে যাবে, যেটুকু নড়াচড়ার স্বাধীনতা অ্যাদ্দিনে পেয়েছি সব যাবে–তারপর পঞ্চাশটা টেস্ট

এ তো আচ্ছা জ্বালা? এই যে তোকে দিনরাত্তির পটের বিবি করে সোনার সিংহাসনে বসিয়ে রেখেছেন চোখের সামনে, ওঁকে তুই সামান্য গলাব্যথার কথাটুকুও বলতে পারিস না? এটা তো কাজের কথা

কাজের কথা, মনের কথা, কোনটেই বা ওঁর কাছে বলা যায়? পাম্প খারাপ, জল। ওঠেনি, ওঁর জন্যে বাথরুমে ড্রামে জল ভরে রাখা হল, উনি একবার জিগ্যেস করলেন না, হঠাৎ ড্রাম কেন? মন খারাপ তো আরোই বুঝতে পারবেন না।

গাড়ি খারাপ হলেও তো তুইই গাড়ি নিয়ে উড়িয়াপাড়ায় যাস–আগে এসব কে করত?

শ্বশুরমশাই করতেন। গণেশকে দিয়ে। আমিও গণেশকে দিয়ে করাই। উনি কোনো খোঁজ রাখেন না।

বিল-টিল। ব্যাঙ্ক-ট্যাঙ্ক?

এখন সেও সব আমার ঘাড়ে। ওই গণেশ।

সামনে বসিয়ে রেখে তোর সঙ্গে কী গল্প করেন জামাইবাবু? সবই ধর্ম আলোচনা?

তাই তো। নয় তো ছেলের নিন্দে। দিদির নিন্দে। আমি শুনি। আমার মনের কথা বলব নাকি ওঁর সঙ্গে বসে বসে? দূর!

শরীর খারাপটাও বলবি না? উনি তো ডাক্তার?

হোকগে ডাক্তার। নিজের শরীর নিয়েই উনি ব্যতিব্যস্ত। কিরে? গলাব্যথার কিছু ওষুধপত্তর তুই কি আমায় দিতে পারবি? না পারবি না?

দাঁড়া, বেলেডোনা থার্টি এনে দিচ্ছি আর গার্গেল কর নুন জলে। এও তোকে বলে দিতে হবে? সত্যি!

বেলেডোনা? হঠাৎ হেসে ফেললেন সুষমা। চোখের দৃষ্টিতে অনেক দূরের ছায়া পড়ল–

আচ্ছা সুরো, তোর মনে আছে ফুলশয্যার রাত্তিরে উনি আমাকে যে প্রেমের বাক্যটি বলেছিলেন? তোকে আমি পরের দিন কাঁদতে কাঁদতে কথাটা বলেছিলাম। সেই যে ক্যালি ফসঃ

বাপরে! সে কি ভোলবার? সেই শুনে তো আমিও ভয়ে কাঁটা। না জানি আমার ফুলশয্যার রাতে আমার বরের মুখে কী না কী শুনব!

দুই বোনের হাসির কলরোলের মধ্যে টেবিলে কফি আর কাবাব, আর গরম গরম মাংসের চপ আর স্যালাড এসে যায়। আদিত্য উঠে দাঁড়ান। চেয়ার ঠেলে।

সুরমা, সুষমা, আই অ্যাম সরি টু রিমাইন্ড য়ু, এই ঘরে আরো একজন আছে। আমাকে একঘরে করে দিয়ে তোমরা সাংকেতিক ভাষাতে আড্ডা মেরে হেসে গড়াচ্ছ, দিস ইজ সিপ্লি নট ডান।

স্যরি স্যরি, জামাইবাবু, আপনাকে কি সুরো বলেনি কথাটা? আমি ভেবেছি–

শোনো, বউকে ফুলশয্যার রাত্তিরে বেচারা প্রসেনজিৎ কী বলেছিল, সেটা অন্য কারুরই জানবার কথা নয়। তবে যদি আমার বেটার হাফ সেটা জেনেই ফেলে থাকেন, তবে ওয়ার্স হাফেরও সেটা জানায় কোনো অপরাধ নেই।

বাবারে বাবা, অত অভিমানে কাজ নেই। বলছি বলছি শুনুন।

ফুলশয্যার রাত্রে খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আমার বরমশাই আমাকে গম্ভীর গলায় বললেন, সুষমা শোনো। আমার মায়ের স্বাস্থ্য খুব খারাপ। তার আয়ুষ্কাল স্বল্প। আমি তাই কিছুদিন হল সন্ন্যাস গ্রহণ করব স্থির করেছি। বলতে পারো, তার মধ্যে বিবাহ কী করে হল? মায়েরই শেষ ইচ্ছা রক্ষা করতে এই বিবাহ। আমার সঙ্গে তোমার সম্পর্কের মধ্যে তুমি কোনো এক্সপেকটেশন রেখো না। মায়ের সেবা করবার জন্যেই আমি তোমাকে বিয়ে করে এনেছি। হিন্দু ধর্মের প্রথা অনুসারে এই পরিবারে জীবন যাপন করি আমরা। তুমি তো বাইরের মানুষ, তাড়াতাড়ি সব শিখে নাও। আমার মা, আমার বাবা, এঁদের আমি দেবতা জ্ঞানে সেবা করি। এবং তুমিও তাই করবে। এটাই এ সংসারে তোমার কর্তব্য। এই বলে পকেট থেকে একটা এতটা বলতেই দুই বোনে চোখাচোখি করে আরেকবার হেসে ফেলেন, কিশোরীকালের হাসির মতো বাঁধনহীন হাসি।

পকেট থেকে একটা ছোট শিশি বের করে আমাকে তিনটে বড়ি দিলেন, নিজেও তিনটে বড়ি খেলেন–ক্যালি ফস্। খাও, দেহমন শান্ত থাকবে। জামাইবাবু, ফুলশয্যার রাত্রে ক্যালি ফসের মতন প্রচণ্ড পাওয়ারফুল অ্যামব্রোজিয়াক খাবার কথা কি আগে শুনেছেন?

তবে সুখের বিষয়, ক্যালি ফস্ খেয়ে খুব বেশিদিন সন্ন্যাসজীবন যাপন করতে পারেননি তিনি, আমার ভগ্নীর রূপের শিখায় পতঙ্গের মতো–

দূর! কোথায় পতঙ্গ? প্রথম প্রথম বেশ অনেকদিনই ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন। আশ্চর্য মানুষ! শাশুড়ি সব কিছু জেনেশুনেও ছেলেকে কিছু বলতেন না। আমি ছিলাম ভোদা, আর সুরোর তখনও বিয়ে হয়নি।

গুডনেস! সুরো! তোমার জামাইবাবুর এরকম সুকীর্তিটা তুমি গোপন রেখেছিলে? প্রসেনজিৎ তো হার্মিট, আরে, ও তো মহর্ষি প্রসেনযোগী! আমি তো ওঁকে সাষ্টাঙ্গে পেন্নাম ঠুকব–সুষির মতন একটা ডাকসাইটে সুন্দরীকে ঘরে বসিয়ে ক্যালি ফস খাইয়ে,

থামুন তো জামাইবাবু

হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে যান আদিত্য।

এখন সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে কুলাঙ্গার তো বলবেই সে। নিজে বাবা-মা-র যেমন সেবা করেছে, ছেলের কাছেও সেটাই তার এক্সপেকটেশন। নিজে বিলেত না গিয়ে মাতৃপুজো করেছে, আর ছেলে কিনা আমেরিকা পালিয়ে গেল? বউ ঘরে থাকলেই তো সেবা সেবা করে শ্বশুর তাকে অতিষ্ঠ করে তুলত। সবাই সুষমা নয়। বিয়ে টিকত না। শুভ পালিয়েছে ঠিক করেছে। মায়ের দূরবস্থার সে সাক্ষী, বউয়েরও অমনি হোক, চায়নি। কিন্তু প্রসেনজিৎ বুঝবে কেন? সে তার আদরের ছেলেটাকে তো কাছে রাখতে চায়।

.

একমুহূর্তের জন্যে ঘরে যেন বাতাস বন্ধ হয়ে গেল।

কেউ কোনো কথা বলছে না।

হঠাৎ পাখার শব্দটা শোনা যেতে লাগল ঘরর…ঘরর…ঘরর..

সুষমা যেন সহজ স্বরেই বলে ওঠেন,–জামাইবাবু শিলুর কোনো খবর পেলেন? অনেকগুলো কাগজে তো বেরিয়ে গেল। এখনও নো রেস্পন্স?

ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সুরমা বেরিয়ে যান, সম্ভবত বেলেডোনা নিয়ে আসতে।

এখনও তো তেমন কিছু-মাঝখানেই অসমাপ্ত বাক্যটি হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন আদিত্য। তারপর আবার বলেন–ছমাস হতে চলল ওরা দিল্লিতে নেই। দিল্লি। মুম্বাই। চেন্নাই। হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর। প্রতিটা মেট্রোপলিটন সিটিতেই বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। চোখে কি আর পড়েনি?

একটা ফোন করলে পারত।

যদি ফোন করবার মতো অবস্থায় থাকে।

ষাট ষাট কী যে বলেন! আজকালকার ছেলেছোকরারা কত কারণেই তো উধাও হতে পারে। শিলু তো রোম্যানটিক, তায় আর্টিস্টিক টেম্পারমেন্ট, ঠিক কী জন্যে যে এমন চুপচাপ-কাগজে কতবার–তাও–তো খুকু কী বলছে? খবর নিচ্ছিল তো ভেতর থেকে। কিছু শুনল?

খুকু তো বলছে হয়তো দেশের বাইরে, কাঠমাণ্ডু-টা কোথাও গিয়েছে–খবর এখনো পায়নি–

এখানে বন্ধু-টন্ধুরা কিছু জানে না? শিলুর তো গানের দলটা আছে–ওর সেই দারুচিনি দ্বীপ?

হ্যাঁ, সিনামন আইল্যান্ড–তো? সে দলটল আর নেই। শিলু দিল্লি চলে গেল, অনিন্দ্য মুম্বাই চলে গেল। দলও ভেঙে গেল। তবু খুকু খোঁজ করেছিল। দিল্লিতে ফিরে যাবার পরে শিলু কারুর সঙ্গেই কনট্যাক্ট রাখেনি।

সুরো, সেই অনিন্দ্য ছেলেটার বাড়িতে আমরা একবার?

সে তো দুর্গাপুরের ছেলে

মুম্বাইয়ের ঠিকানা

ছেলেগুলোর কাছে যদি

শুভাকে?

নাঃ, জানে না, শুভা খুব ব্যস্ত–ও তো দুহপ্তার মধ্যে আমেরিকা চলে যাচ্ছে।

টেলিফোন বেজে উঠল।

হ্যালো, সুরমা? সুষমা আছে ওখানে?

আছে ধরুন। আপনি ভালো তো? সুষি–জামাইবাবুর ফোন!

.

নবম অধ্যায়। রাতপাখির ডাক

শিলাদিত্যের খাতা। শনিবার

একটা যদি স্থির বিন্দু না থাকে মনের মধ্যে, তাহলে সুস্থ মস্তিষ্কে বেঁচে থাকা যায় না। আমারও নিশ্চয় একটা স্থিরবিন্দু রয়েছে কোথাও, একটা অনির্বাণ শিখা, সেটা কখনো স্তিমিত, কখনো উজ্জ্বল, কিন্তু সর্বদাই জ্বলছে। প্রাণের প্রাণ। নিশ্চয়ই আছে, নইলে তো উন্মাদ হয়ে যাবার সুযোগ পেতুম। চারিদিকে যখন অনেক কথার সমুদ্র বয়ে যায়, ঢেউ আছড়ে পড়ে বিতর্কের, আমার বুকের মধ্যেকার সেই নৈঃশব্দ্য আমি তখনও টের পাই। যা আমাকে ধরে রাখে। ভেসে যেতে দেয় না। ডুবে যেতেও দেয় না। ভাসিয়ে রাখে, ফিরিয়ে আনে। খুব ভিতরদিকে, অনেক গভীরে আমার একটা ঠিকানা আছে, সেই ঠিকানাটা আমি কাউকে জাক্ষ্ম নাতে পেরে উঠি না। অথচ সেই ঠিকানাতে না পৌঁছতে পারলে কেউ তো আমাকে খুঁজেই পাবে না। আমার নাগাল পাবে না। আমার সঙ্গী জুটবে কেমন করে? বন্ধু পাব কী করে? যত সঙ্গী, যত বন্ধু, সবাই তো বারবাড়ির দালানে বসে আছে। সংযোগের চেষ্টা তুমি যতই করো না কেন, সেটা তো সম্পূর্ণতা পায় না তোমারই দোষে। তুমি তো সবটা অনাবৃত করতে পারো না।

বাইরের আলো-বাতাসের চাপে যে ভিতরের ঠিকানাটা হারিয়ে যেতে পারে, গুঁড়িয়ে যেতে পারে, সেই উদ্বেগে তুমি ওটাকে পুষে রাখো বুকের মধ্যে গভীর এক যন্ত্রণার ইঁদারা খুঁড়ে, যাতে শুধু রক্ত, শুধু অশ্রু, আর তলহীন কামনা। কামনা সঙ্গের, মিলনের, সংযোগের, ভালোবাসার। বাইরের শিলাদিত্যকে দূর থেকে চেয়ে চেয়ে দ্যাখে অন্দরের শিলাদিত্য, আর অবাক হয়ে ভাবে, এইটাই আমি? যত হই চই বেড়ে ওঠে, যত আড্ডা, যত ডিস্কো, যত। লেট নাইট, তত ক্ষীণ হয়ে আসে প্রকৃত যোগাযোগ।

রবিবার

আজ শুভোদাদা ফোন করেছিল। বস্টন থেকে। শুভদাদা চিরকাল হই-চই ভালোবাসে। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ভালোবাসে। আমার ঠিক উলটো। আমি তো আসলে লাজুক। শুভদাদাকে আমি বোধহয় বুঝতে পারি, ওকে বোঝা খুব কঠিন নয়। মেসোমশাই ওকে যত বন্ধ করতে চেয়েছেন শুভদাদা তত বাইরে ছুটেছে। শুভদাদা আমাকে ঠিক বোঝে না। সবটা বোঝে না। ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু সে আমি ওর ছোটভাই বলে। আমি শিলাদিত্য বলে নয়। শুভদাদাকে দোষ দিই না, যে যেমন সে তেমনই। আমি আমার মতন। শুভদাদা শুভদাদার মতন। ওর জীবনটাও তো সোজা সরল নয়। যেরকম ছিলেন ঠাম্মা, সেইরকমই মেসোমশাই। তার মধ্যেই জোর করে শুভদাদা নিজের মতন হয়েছে। মামণি ছাড়া ওকে জোর দেবারও বাড়িতে কেউ ছিল না। মামণিরও নিশ্চয় অনেকটা জোর লেগেছিল।

যে সমাজে শুভদাদা আর আমি, দুটো মানুষই আছি, সেই সমাজ কেবল দাদাকেই চেনে। মেসোমশাই ওরকম অদ্ভুত হওয়া সত্ত্বেও দাদা একদম ঠিক ঠিক মতন বেড়ে উঠেছে। কলকাতায় ইশকুলে পড়েছে, রাস্তায় ক্রিকেট খেলেছে, পার্কে ফুটবল, শীতকালে গলিতে আলো জ্বেলে ব্যাডমিন্টন, সাইকেল নিয়ে মেয়েদের গানের ইশকুলের সামনে চক্কর মেরেছে। শুভদাদা সবই করেছে। আমি এসব কিছুই পারিনি। আমি যা পেরেছি, তা সমাজের চোখেই পড়েনি, পড়লেও তার মাথামুণ্ডু কেউ বোঝেনি।

আর আমার যে হঠাৎ সবকিছুই কেমন গোলমাল হয়ে গিয়েছিল ছোটবেলায়। সেই জটটা তো খুলতেই পারিনি। আমি লাল কালিতে দাগানো একটা দিনের মতন আলাদা হয়ে গিয়েছি, ভিতরে যত নিঃসঙ্গ হয়েছি, তত ঢুকে পড়েছি নিজের ভিতরে নিজে, ততই হুল্লোড় করেছি বন্ধুদের সঙ্গে। যতই হুল্লোড় করেছি ততই বিযুক্ত হয়ে পড়েছি চারিপাশ থেকে, যত বিপন্ন বোধ করেছি, বিচ্ছিন্নতা ততই গ্রাস করেছে আমাকে। আঘাত পেলে প্রত্যাঘাতও কেমন করে করতে হয় কেউ শিখিয়ে দেয়নি আমাকে, আমি তাই আঘাত পেয়ে সরে যেতেই শিখেছি। সরতে সরতে সরতে, জীবনের এক কোনায় পৌঁছে গেছি, এখানে শিল্প ছাড়া আমার প্রকৃত সঙ্গী নেই। এখান থেকে আর সরবার মতন ঠাই নেই। তাই কালশিটে পড়ে গেলেও কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়েই থেকেছি। মাটিতে লুটিয়ে পড়িনি। এবারে সরতে হলে তো অনন্তে ঝাঁপ।

কাকে এসব কথা বলব? এতদিন একা শুভাননাই আমার বন্ধু ছিল–শুভাকে সব কিছু বলতে চাই। বলতে চেষ্টা করি। কিন্তু শুভা শুনতে চায় না। শুভা বুঝতে চায় না। অনিকে বলেছি। এতদিনে।

শুধু অনিকেই বলতে পেরেছি। শুধু অনিকেই বলা যায়, বলা গেছে। অনিন্দ্য শিল্পী। অনি স্থান, কালের সীমায় বন্দী থাকে না। সমাজের খেরোর খাতার হিসেবকেও গ্রাহ্য করে না। ওর আছে ওর নিজের জগৎ, যে জগতের চাবিটা অনি আমাকেও দিয়েছে। পৃথিবী অনেক দেখেছে অনিন্দ্য, অনেক মানুষ দেখেছে। নিজের বাইরে এসে দাঁড়াতে পারে ও। বাইরে থেকে নিজের দিকে তাকাতে পারে। সেইটেই অনি আমাকে শেখাতে চেয়েছে, সেই চোখটাই খুলে দিতে চেয়েছে। যাতে আমিও নিজের বাইরে এসে দাঁড়াতে পারি, বাইরে থেকে নিজের দিকে চাইতে পারি।–তা নইলে তুই শিল্পী কিসের? অভিনয় শিখবি কী করে? অনি বলেছে, নিজের মধ্যে নিজে ঢুকে থাকতে থাকতে একদিন অন্ধ হয়ে যাবি। বেরিয়ে পড়, বেরিয়ে পড়। বাইরের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ–কত কি ঘটে যাচ্ছে! অনিন্দ্য এইজন্যেই এত সুন্দর ডকুমেন্টারি ফিল্ম তোলে–জীবনকে খুব কাছ থেকে দ্যাখে ও।

ওর কলকাতার বাইজিদের ডকুফিল্মটা কান ফেস্টিভালে দেখানো হচ্ছে- অনিন্দ্য মে-মাসে কানে যাচ্ছে।

শিল্পীর স্বভাবেই অনিন্দ্য নিজেকে বাদ দিয়ে আমার কথাটা বুঝতে চেষ্টা করে। শুভা তো কেবলই নিজেকে জড়িয়ে ফেলে, ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান করে। বুঝতেই চায় না যে এটা ওর-আমার ব্যাপার নয়। এটা শুধু আমারই, একা আমারই যন্ত্রণা।

বুধবার

আমার গান-বাজনা শুভার পছন্দ নয়, সে চায় আমি সোজাসুজি এম. এ.-তে অ্যাকাডেমিক কেরিয়ারে ঢুকে পড়ি। অথবা দিদির মতো আই. এ. এস. হই। শুভা ভর্তি হয়েছে এম. বি. এ পড়তে, জোকাতেই পেয়েছে। কিন্তু আমি চলে যাচ্ছি দিল্লি-এন. এস. ডি. তে চান্স পেয়েছি। আমার স্বপ্ন সফল হচ্ছে–পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুধু একা আমিই স্কলারশিপ পেয়েছি, ইন্টারভিউ ভালো হয়েছিল। নাসিরুদ্দিন ছিলেন। গান বাজনা? হ্যাঁ। এবং থিয়েটারও। মঞ্চ আমার স্বপ্ন। এন. এস. ডি থেকেই চেষ্টা করব যদি টিভিতে কোনো চান্স পাই। শুনেছি ওখান থেকে নানারকম কনট্রাক্টস হয়ে যায়। আজকাল ভি.জে.-র কাজটায় দারুণ গ্ল্যামার। কিন্তু শুভা চায় না আমি ওই ধরনের জীবনে যাই। ওর বিশ্বাস, শো-বিজনেসে আত্মার পরিচর্যা হয় না। আর এম. বি. এ পড়লেই বুঝি হয়? বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনেই তো সবচেয়ে বেশি মনুষ্যত্বের অসম্মান ঘটে। এদেশে, বিদেশে, সব দেশেই। শুভা মানতে চায় না। আমার দিল্লিতে যাওয়া নিয়ে শুভার খুব মন খারাপ। শুভা আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু ওর মতন করে ভালোবাসে। আমার মতন করে নয়। শুভা আমাকে চায়। কিন্তু আমার মতন আমাকে নয়, ওর মনের মতন একটা শিলাদিত্যকে ও গড়ে নিতে চায়। আমার এই নিজস্ব প্রকৃত শিলাদিত্যকে ওর সহ্য হবে না, এটা আমি এখনও বুঝতে পারছি কিন্তু শুভা বুঝতে চাইছে না। বাল্যপ্রেম, প্রথম প্রেম, তার প্রবল মোহ তো ছিন্ন করা সহজ নয়। শুভার মতো বাস্তববাদীর পক্ষেও না।

অথচ শুভদাদা আর লোপাদির সম্পর্কটা কি সুন্দর টিকে গেল। ওরা বিয়ে করে ফেলল। ওরাও তো স্কুল-ফ্রেন্ডস ছিল। মেসোমশাইয়ের দিক থেকে এত বাধা-বিপত্তি, এত অশান্তি, ঝড়-ঝাঁপটা সহ্য করেও নোপাদি আর শুভদাদা সুন্দর জীবনযাপন করছে বস্টনে। আর কলকাতায় পালা করে আসা-যাওয়া। মেসোমশাইকে খুশি করা তো ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরেরও সাধ্যি নয়, কিন্তু বাকি সবাই খুব খুশি।

শুভার সঙ্গে আমার সেরকম সম্পর্কটা হল না। শুভার স্বভাব অতিরিক্ত বাস্তববাদী,

কেরিয়ার ওর কাছে ঈশ্বরের চেয়েও পবিত্র, তার কাছাকাছি আর কিছু নেই।

এই গানবাজনা থিয়েটারটাই যে আমারও ঈশ্বর, সেটা ও মানতে চায় না। বলে, এটা শুধু হবি, এটা কোনো কেরিয়ারই নয়। এটা এক্সট্রাকারিকুলার। এটা অবসর বিনোদন মাত্র। কীভাবে বোঝাব শুভাকে? ও তো আমাকে ছোট্ট থেকেই দেখছে। বাবা-মা যেটা বোঝেন, সেটা শুভা কেন বুঝবে না? আর বাবা-মা যেটা বোঝেন না, সেটাও তো এতদিনে শুভারই বোঝা উচিত ছিল।

বৃহস্পতিবার

অনি বলেছে শুভাকে এবার মুক্তি দিতে। অনি বলছে দিল্লি যাওয়ার পরে শুভাকে জানাতে যে এ সম্পর্ক চলছে না, শুভা নতুন জীবন খুঁজে নিক। এতে আমারও ভালো হবে। আমাদের বন্ধুত্বটা অটুট থাকে যাতে, অনি বলছে সেই চেষ্টাও করা খুব দরকার, বাল্যকালের বন্ধুত্ব জীবনের মহার্ঘ্য সম্পদ। কিন্তু শুভার ওপরই নির্ভর করবে বন্ধুত্ব রাখা-না-রাখা। আমি সব সময়ই শুভার বন্ধু। শুভা ছাড়া আমার আর কোনো বন্ধু কোথায়? গানের দলের সঙ্গীসাথীরা? হই-হুঁল্লোড়ের সঙ্গীসাথী মানেই কি বন্ধু? ভিকি, সোম, বান্টি, বলবীর, কণিষ্ক কেউই সেভাবে আমার বন্ধু নয়। শুধু অনিন্দ্য।

বৃহস্পতিবার

দিদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। কিন্তু আশ্চর্য! দিদির অনিকে ভালো লাগেনি। দিদির না গৌতমদার?

গৌতমদার মতামতটা দিদিকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। ছোটবেলাতে দিদিই ছিল আমার বন্ধু। গৌতমদা ওর জীবনে আসার পরে দিদি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। আর শুভা দিদির জায়গায় চলে আসছে।

দিদি আর আমি দুজনেই তো বাইরের স্কুলে পড়েছি, পাহাড়ের হোস্টেলে থেকেছি। ছুটতে ছুটতে বাড়িতে এসেছি মা-বাবার কাছে। আমাদের ভাইবোনের সম্পর্কটাই ছিল হাসিখুশির। ছুটির মেজাজের। যখন স্কুল ফুরোল, আমি কলেজে পড়ছি কলকাতা শহরে, তখন আমাদের নতুন করে চেনা হতে লাগল–সেই সময়েই হঠাৎ গৌতমদা ঢুকে এল দিদির জীবনে। এখনও গৌতমদা।

আমি দিল্লিতে চলে যাচ্ছি শুনে দিদিও খুশি নয়। দিদি আই.এ.এস হয়ে গেছে, কোথায় পোস্টিং হবে জানা নেই। কোনো অজ পাড়াগাঁয়ে সম্ভবত। গৌতমদা সোজা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভে চান্স পায়নি। গৌতমদা অ্যালায়েডে পেয়েছে। বোধহয় রেলওয়েতে যাবে। দুজনে থাকবে দুজায়গায়। জানি না ওদের কীরকম প্ল্যান। শুভার ইচ্ছে আমিও দিদির মতো আই.এ.এস. হই। বি.এ.-তে ফার্স্টক্লাস পাইনি, কিন্তু ফিটি এইট পার্সেন্ট ছিল, তাতেই শুভার ধারণা হয়েছে আমি পারব। দিদিরও দৃঢ় বিশ্বাস আমি পারব। বাবার মাথাতেও ঢুকিয়ে দিয়েছে।

একমাত্র মা দেখছি কোনো বিকল্প মতামত দিচ্ছেন না–নিজে গান করেন বলেই বোধহয় আমার গানবাজনা তার আপত্তি নেই, সহানুভূতি আছে।

মঞ্চে অভিনয়ে শুভার মতোই দিদির এবং বাবারও উদ্বেগ যথেষ্ট। তাদের ভাবনা, শো-বিজনেসে যেমন কোনো সিকিউরিটি নেই, তেমনি ডিগনিটিও নেই। এবং নানারকম ডেনজারও এসে পড়ে। যদি সাসিড করো, গুলশনের মতন মাফিয়া এসে পড়বে। যদি না সাসিড করো, তবে তো এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কপিটিশন এমনই তীব্র। অনি বলছে দিল্লিতে থাকাকালীন N_F T_I-তে খবর নিয়ে ফ্যাশন ডিজাইনিং লাইনটাও একটু দেখতে। মডেলিংয়ে অনেক টাকা, গ্ল্যামারও, আমার কাজের সঙ্গেও খাপ খাবে। (চেহারার সঙ্গেও বেখাপ্পা হয়তো হবে না।) আমি ভাবছি বান্টির মাকে বলব। বান্টির মা মুম্বাইতে ফ্যাশন মডেলিংয়ের লাইনে ছিলেন, অনেককে চেনেন। এ বিষয়ে বাবা-মা-দিদি কাউকে কিছুই বলিনি। শুভকে বলতেই তার যা প্রতিক্রিয়া দেখলাম! যেন ফ্যাশনমডেলরা খুনে, কিংবা বেশ্যা। এখনও তো কোনো পদক্ষেপই নিইনি, কেবল পরিকল্পনাটুকু বলতেই, এই! মধ্যবিত্ত মানসিকতা জিনিসটি যে কী, দিনে দিনে টের পাচ্ছি। ঘরে, বাইরে।

শুক্রবার

কত জন্মের পুণ্যফলে অনিন্দ্য এল আমার জীবনে। যে জিনিসটা এতদিন অস্ফুট ছিল, আলো-আঁধারিতে যে-মুখ আমি ঠিক চিনতে পারিনি বলেই আমার এত কষ্ট, আমার নিজস্ব সেই মুখখানি অনির ধরে দেওয়া আয়নায় স্পষ্ট ফুটে উঠল। অনি যদি না আসত আমার জীবনে, জীবন যে কী হতে পারে, আমার তা-ই জানা হত না। এত রং, এত আলো, এত সুর, এতবড় আকাশ, এত বড় পৃথিবী, অনিই তার ঠিকানা জানাল। শিল্পের প্রতি প্রেম যে কী, গানকে ভালোবাসা কী, এতদিন বুঝিনি। আমি শুভকেও ভালোবাসি। কিন্তু অনি, অনি আমার জীবনে একটা ঝড়ের মতো, যে ঝড় শুকনো পাতা সব ঝরিয়ে দেয়। নতুন পাতার আর বর্ষাঋতুর পথ খুলে দেয়। সত্যি আমার নতুন করে জন্ম হয়েছে অনির কল্যাণে।

হ্যাঁ, নতুন জন্মই। শৃঙ্খলমুক্তি। স্ফুরণ। ছেলেবেলার একটা দুর্ঘটনা আমাকে যেভাবে বেঁধে রেখেছিল এতদিন–যন্ত্রণায়, অপমানে, লজ্জায়, অপরাধে, অনি আমাকে তা থেকে মুক্তি দিল। অনি বোঝাল এরকম হয়েই থাকে। এটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। সব ছোট ছেলেদের জীবনেই কিছু না কিছু ঘটনা থাকে–হ্যাঁেস্টেলে তো নিত্য-নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতা। এ নিয়ে আমার এত উদ্বেগের, এত যন্ত্রণার, এত অপরাধী হয়ে থাকার মতো কোনো কারণই নেই। হ্যাঁ, তখন ভালো লেগেছিল, বেশ তো? সেটাও কোনো অপরাধ নয়। কিছু দোষের নেই তাতে। জীবন অনেক বড়। অনেক। যা হয়েছিল, তা যদি আবারও কখনও ঘটে–ঘটতেই পারে–যদি কখনও ঘটেও যায়, তাতে লজ্জার কিংবা অপরাধের কিছু নেই। ভালোবাসা কখনও অপরাধ হতে পারে?

মানুষের ভালোবাসার নানা রং–

অনি বলেছে, মায়ার বিস্তার অনেকদূর অবধি–সোজাসুজি রেললাইন বেয়ে গড়িয়ে চলে না আমাদের জীবনে–তুই তো শিল্পী, তোর তো জটিল হবেই জীবনের পথ–তাতে লোকসান কিসের?

বাইরে দামোদর নদ তখন অন্ধকার আকাশের সঙ্গে মিশে গিয়েছে–হঠাৎ একটা রাতপাখি উড়ে গেল, টিটি টিট্টি–অনি গেয়ে উঠেছিল গলা ছেড়েঃ

নদী ভরা ঢেউ
জানে না তো কেউ
কেন মিছে তরী তবু বাও বাও রে
(একবার) চুবানি খেয়ে ভারি
(তুমি) বলো–ওহে কাণ্ডারী
আমায় বাঁচাও বাঁচাও রে–

রবিবার

আমার দামোদর স্মৃতিতে বড় মায়া। দুর্গাপুরেই অনিন্দ্য আমাকে চিনিয়ে দিয়েছিল আমার নিজস্ব প্রকৃতি, আমার আসল মুখচ্ছবি। সেই বিশাল দামোদরের তীরে ছোট্ট বাগান ঘেরা নির্জন বাংলো, গিটার নিয়ে আমরা দুজনে–গিটার, আর বিয়ার, আর গাঁজা, আর গান, গান, গান। সারা রাত। রাত্রি স্থির হয়ে গিয়েছিল। অন্ধকার যেন ঝিকিমিকি ম্লান জ্যোৎস্নায় আরও গাঢ় হয়েছিল এদিকে ওদিকে, জায়গাটা ঠিক দুর্গাপুর ছিল না। একটু বাইরে একটু দূরে একটু জনহীনতায়, যেখানে নিজেকে আবিষ্কার করা তুলনায় সহজ, সেইখানেই অনির কাছে আমায় নবজন্ম হয়েছিল–অথচ কাউকে বলা যায়নি একথা। কাউকে নয়। শুভাকে বলতে গেলাম, ফল হল বিপরীত। দিদিকে বললে কী বুঝত? দিদিকে বলা উচিত ছিল কি?

মঙ্গলবার

বারংবার ভুল করতে করতে একদিন তো মানুষ ঠিক পথটা খুঁজে পায়? বারবারই কি হারিয়ে যাবে বনের মধ্যে পায়ে চলার সেই পথটা, শস্যদানা ছড়িয়ে চিহ্নিত করে রেখে গেলেও ঘরে ফেরার উপায় নেই, পাখিরা এসে খুঁটে খেয়ে নেবে সেই দানাগুলো। পিছন ফিরলে দেখতে পাব সেই পথহীন, আদি অন্তহীন মহারণ্য। সে কি স্মৃতির বন? নাকি বিস্মৃতির? পিছনে তাকিয়ে কি স্বপ্ন দেখা যায়? এমনকী কী দুঃস্বপ্নও? না। তার জন্যে সামনে চলতে হবে। পথ তৈরি করে নিতে হবে। স্বপ্নের রাস্তা। কৈশোরের বকুলগন্ধেরা যে পথ চিনিয়ে দেয়, যৌবনের রক্তাক্ত কাটাবেধা ফনিমনসার ঝোঁপ যে পথ চিনিয়ে দেয়, সে পথে স্বপ্ন নেই। শুধু স্মৃতি। আমার ভুল যেন ফুরোচ্ছে না, আমার সামনে সঠিক পথের চিহ্ন ফুটে উঠছে না কিছুতেই, অথচ দূর থেকে ভেসে আসছে এক অচেনা সুবাস। সে কি পাকা ফলের? সে কি বিষ্টি ভেজা মাঠের? কদম কেশর ঢেকেছে আজ বনতলের ধূলি–শুভার গলায় এই গানটি। মৌমাছিরা কেয়াবনের পথ–আচ্ছা কেয়াফুল কেমন? আমি জীবনে কখনো কেয়াফুল দেখিনি। অথচ মা-র মুখে শুনেছি এই লেকের ধারেই অনেক কেয়াঝোপ ছিল এককালে। গন্ধে ভারী হয়ে থাকত বাতাস। কাছে যেত না কেউ সাপের ভয়ে। ফুল তুলে বিক্রি করত বস্তির দুষ্টু দুরন্ত ছেলেরা। মা-রা কিনতেন, দুআনার একটা ফুল। এখন কি একটা ঝোঁপও বাকি নেই? একেবারে সব মুছে গেছে?

হঠাৎ শুভার সঙ্গে যে কী হয়ে গেল!

শুক্রবার

এক একটা দিন হঠাৎ ঝলসে ওঠে, আর জীবনটাকে উলটেপালটে বদলে দিয়ে যায়। ওলট পালটটা ঘটে যায় সমাজের ভেতরে, বাইরে থেকে দেখে কেউ টের পাবে না। একেই কি বয়স বাড়া বলে? বয়েস তো শুনেছি রোজ ঘুমের মধ্যে টুক টুক করে বাড়ে। আমি তো দেখতে পাচ্ছি মানুষের বয়স রোজ অল্প অল্প করে বাড়ে না। হঠাৎ হঠাৎ একটা ঘা খেয়ে বেড়ে যায়। একটা ঘটনায়। একটা সংবাদে। একটা দৃশ্য দেখে। বয়সে বাড়াটা যে কীরকম, আমি ইদানিং খুব তাড়াতাড়িও দুবার টের পেয়েছি। সেদিন অনিন্দ্যর সঙ্গে দুর্গাপুরে গিয়ে, আর পরশুদিন যখন অনিন্দ্যর সঙ্গে কথাবার্তার কথা, দুর্গাপুরের গল্প সব শুভার কাছে করলাম।

শুভার সেই মুখ, সেই চাবুক-খাওয়া মুখখানা আমার বয়েস দশ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে। কত কম চিনি আমরা পরস্পরকে। কী এমন ছিল আমার কথায়? কী ছিল এত সাংঘাতিক, এত মর্মভেদী? আমি চেয়েছিলাম শুভকে আমার আনন্দ-যন্ত্রণার অংশ দিতে–তব অধর এঁকেছি সুধাবিষে মিশে মম সুখদুখ ভাঙিয়া–সুধা-বিষে না মিশলে কেমন করে হবে। চুম্বন?

আমি ভাবতেই পারিনি শুভা এতে আঘাত পাবে। দৌড়ে পালিয়ে গেল, আমি লোকে কি ভাববে ভেবে পিছু পিছু দৌড়লাম না। কাল ফোন করেছি। মাসিমা বললেন, শুভা শুয়ে আছে, ঘুমোচ্ছে, শরীর ভালো নেই। আজ ফোন করেছি, মাসিমা বললেন, শুভা বাড়ি নেই, বেরিয়েছে। বুঝতে পারছি না শুভা অ্যাভয়েড করবার জন্য মাসিমাকে এইরকম নির্দেশ দিয়ে রেখেছে কিনা। কী হল শুভার? কী ভাবছে ও? শুভার আচরণে আমার নিজেকে গর্হিত অপরাধের আসামী বলে মনে হচ্ছে। অথচ আমার অপরাধটা কী?

কলকাতা
রবিবার

প্রিয় শুভা,
জানি তোর শরীর ভালো নেই। কিন্তু আমাকে তো আজ চলে যেতেই হচ্ছে। যাবার আগে অনেক চেষ্টা করলাম, তোর সঙ্গে দেখা হল না। তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যা।
তুই বোধহয় অনিন্দ্যর ব্যাপারটা খুবই ভুল বুঝেছিস। আমাকে কি তুই কিছুই চিনিসনি শুভা?
মাথা ঠান্ডা কর। শুধু শুধু কষ্ট পাস না। সত্যিই তোর ভুল হচ্ছে। একদিন ঠিক বুঝতে পারবি। আমি ফিরতে ফিরতে তুই তো জোকা-রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হয়ে যাবি, যা বুঝতে পারছি। Good Luck দিল্লি পৌঁছেই ই-মেল করব। আমার হোস্টেলের ঠিকানা মা-র কাছে আছে। ভালো থাকিস। Lots of Love,
তোর
শিলাদিত্য

.

দশম অধ্যায়। পরোটা আলুচচ্চড়ি

এই নতুন কর্মজীবন, নতুন দায়িত্ব, কোথায় শুরু হবে আনন্দের মধ্যে, তা নয়, চরম উদ্বেগে, চরম সর্বনাশের দুর্ভাবনা নিয়ে শ্রাবস্তীর কর্মজীবনে পদক্ষেপ।

শিলাদিত্য গরমের ছুটিতে এসেছিল। ফিরে গিয়ে বছরটা কমপ্লিট করেছে, কিন্তু, কোর্স কমপ্লিট করেনি। এ বছর জুন মাসে কলকাতায় আসেনি, দিল্লিতেও নেই। অগস্টে আর ফিরে যায়নি ক্লাসে। পুজো হয়ে গেছে, দেওয়ালি হয়ে গেল, ক্রিসমাসের ছুটি চলে গেল। শিলাদিত্য এন.এস.ডি.-তে ফেরেনি, কলকাতাতেও না। শ্রাবস্তী চণ্ডীগড়ে খোঁজ নিয়েছিল। মোনালিসার বাবাও জানেন না মেয়ে কোথায়, কি শিলু কোথায়। অথবা জানলেও বললেন না। তবে তাঁর সঙ্গে কথা বলে শ্রাবস্তীর মনে হয়েছে, তিনি জেনেশুনেও খবরটা বলছেন না। তাতে শ্রাবস্তীর উদ্বেগ কিঞ্চিৎ কমেছে। অবশ্য মেয়ের যেমন চরিত্র তাতে মেয়ের জন্য উদ্বেগ না-করার অভ্যেস হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয় মোনালিসার বাবার পক্ষে। কিন্তু শিলাদিত্যর স্বভাব তো সেরকম নয়। তবে বাড়িতে উদ্বেগ বেড়েই চলেছে।

ভাই আমার ওপরে এত বিরক্ত কেন হল? ভয় পেয়ে আমি ওকে সবই খুলে বলেছিলাম। লিসার সব কথা। তাতে আমার ওপর খেপে যাওয়ায় কী হয়েছে শিলুর? আমি ওকে সতর্ক করে দেব না তো দেবে কে? প্রেমে পড়লে কি মানুষ সবটা দেখতে পায়? দৃষ্টি কি স্বচ্ছ থাকে? কী যে বোঝাল ওকে মোনালিসা নামের দুষ্টু মেয়েটা! যে সর্বনাশের ভয় পেয়েছিলাম সেই সর্বনাশই মনে হয় হয়েছে।

.

বাবা-মাকে মোনালিসার কথা বলা হয়নি। গৌতম বারণ করল। গৌতম বলল, এই উড়নচণ্ডে ছাত্রসমাজের চেহারার সঙ্গে ওদের পরিচয় নেই–বিশেষ এই ইংরিজি গানবাজনা থিয়েটার-ফিল্ম-ফ্যাশনের বিচিত্র জগতের সঙ্গে। ওঁরা বুঝবেন না। আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বেন। শিলুর জন্য ভয় পাবেন। তার চেয়ে এটা ওঁদের না জানাই মঙ্গল। জেনেই বা কী লাভ? শিলাদিত্য ওঁদের কিছুই জানায়নি, হঠাৎ উধাও হয়ে গেল মোনাসিলা গর্গের সঙ্গে। গৌতম প্রচুর চেষ্টা করছে। খোঁজ নিয়েছে। জেলে নেই। হাসপাতালে নেই। মৃত্যুসংবাদও নেই। অতএব তারা আছে নিশ্চয় কোথাও। গৌতম, শ্রাবস্তী দুজনেরই ধারণা গোয়াতে কিংবা কাঠমাণ্ডুতে ওদের খোঁজ মিলবে। কোনো হিপি আশ্রমে। এ সম্ভাবনাটুকুও শ্রাবস্তীর মা-বাবাকে জানাতে রাজি নয় গৌতম–ওর ধারণা ছেলে হিপিদের সঙ্গে থাকতে পারে, এটা শুনলেই ওঁরা ভেঙে পড়বেন।

শ্রাবস্তীর অবশ্য ধারণা অন্য। শ্রাবস্তী অবাক হয়ে ভাবে, এতদিন দেখেও গৌতম ওর মা-বাবাকে চিনল না। যেমন এতদিন ওকে দেখেও গৌতমের মা-বাবা চিনলেন না। শ্রাবস্তীকে। পদে পদে তার প্রমাণ পায় শ্রাবস্তী। যেমন সেদিন গৌতমের মামা-মামি এসেছেন। জামসেদপুর থেকে। ওর মা শ্রাবস্তীকে ডেকে ওঁদের সামনে আদর করে বললেন, এসো তো শ্রাবস্তী, পরোটাগুলো বেলে দেবে একটু আমার সঙ্গে। (আরে আমি পারি নাকি পরোটা বেলতে!) শ্রাবস্তী গেল তার পিছু পিছু রান্নাঘরে, গিয়ে বলল,-মাসিমা, আমি কিন্তু পরোটা বেলতে জানি না। আলুচচ্চড়ি বানিয়ে দিতে পারি বরং। উত্তরে গৌতমের মা বললেন, জানি না বললে তো হবে না। ঘরের বউ, পরোটা বেলতে পারবে না? সে কি হয়? শুধু জজ ম্যাজিস্ট্রেট হলেই তো মেয়েদের চলবে না, রান্নাঘরটাও সামলাতে হবে।

কথাটা খুব ভুল নয়–সুরমাও কখনও যে এধরনের কথা বলেন না তা না। কিন্তু তার বলার সুরটা আলাদা। তাতে এই অনুশাসনের স্বর শোনেনি শ্রাবস্তী। সব কাজকর্ম শিখে রাখা ভালো, সুরমা শিলুকেও তো রান্নাঘরে ডাকেন। ব্রেকফাস্ট করে দিতে পারেও শিলু। গৌতম রান্নাঘরে ঢোকে না।

ওদের বাড়িতে শ্রাবস্তীর প্রধান ভূমিকা ঘরের বউ হয়ে রান্নাবান্না, ঘরকন্না করার। তার আই. এ. এস. হয়ে রাজ্যশাসন করাটা যেন এলেবেলে শৌখিনতা মাত্র। গৌতম যে অ্যালায়েড সার্ভিসেস পেল সেটাতেও তারা শ্রাবস্তীর প্রতি কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ। যেন সে একটা বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করে ফেলেছে তাদের ছেলের চেয়ে দুপা এগিয়ে গিয়ে। অথচ বি. এ.-র রেজাল্টেও ফারাক ছিল। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল কেবল একজনই, শ্রাবস্তী। তখন ওঁদের এই মনোভাবটা বোঝা যায়নি, গৌতম তার বন্ধুর সাফল্যে এতই গর্বিত হয়েছিল। আই. এ. এস. পাওয়াতেও গৌতমের মনে ক্ষোভ নেই, খুশিই আছে। কিন্তু মা-বাবার মতে মত দিয়ে চলা স্বভাব গৌতমের। শ্রাবস্তীর ও-বাড়িতে জিন্স পরার অনুমতি নেই। গৌতমও বলল মেনেই নিতে, এটা তো ছোট ব্যাপার। গৌতমের বোন ঋতা কিন্তু জোর করে জিন্স পরে। গৌতমের মা শ্রাবস্তীকে সালোয়ার কামিজ পরতেও বারণ করেছিলেন। ওর বাবা নাকি পছন্দ করেন না। কিন্তু ঋতাই ঝগড়া করে (গৌতম নয়!) সেই অনুমতিটা আদায় করেছে শ্রাবস্তীর জন্য। শ্রাবস্তীকে জিও পরতে বলে সে বলে, পরলেই মেনে নেবে ঠিক। ওদের অন্যায় আব্দার শুনো না। তুমি তোমার মতো থাকবে। শ্রাবস্তীই বরং গৌতমের কথা শুনেছে, ঋতার কথা না শুনে। সেটা কি ঠিক করেছে? সারা জীবনের জন্য কি এই সিদ্ধান্ত রাখা যাবে? গৌতমের সব কথা শোনার? ও যদি অ্যালায়েড না পেত আই. এ. এস হয়ে যেত, তাহলে ওকে অগ্রাহ্য করা ঢের সহজ হত। এখন শ্রাবস্তীকে অনেক সতর্ক হয়ে বুঝেসুজে চলতে হয়, পাছে গৌতমের মনে আঘাত লাগে?

গৌতমনের পরিবারের সঙ্গে শ্রাবস্তীর মিল নেই বিশেষ। ওঁরা তুচ্ছতাকে খুব বড় মূল্য দেন। এখানে প্রসেনজিতের কথা মনে পড়ে যায় শ্রাবস্তীর। অথচ ঠিক বিপরীত মেরুতে আছেন ওঁরা–গৌতমের বাবা বহুকালের নিবেদিত প্রাণ সি.পি.এম কর্মী। গোঁড়ামি যে কত রকমের হতে পারে! রক্ষণশীলতার নানা মুখ, নানা মুখোশ। ঐশ্বর্যের মতো দারিদ্রেরও একটা অহংকার থাকে সময়ে সময়ে। সে দম্ভ আরও ভয়ানক হতে পারে। শ্রাবস্তী সেটা বোঝে না। তা নয়। কিন্তু ওঁরা যে গৌতমের বাবা-মা!

সুরমা-আদিত্যর সংসারে মুক্ত বাতাসে মানুষ হওয়া শ্রাবস্তীর গৌতমের বাড়িতে দম আটকে আসে। রাজনীতিতে বামপন্থী হলেই যে তারা সংসারে মুক্ত মন নিয়ে আসেন না, সেটা এখানে স্পষ্ট। গৌতম তো এ-বাড়িরই মানুষ! শ্রাবস্তীর মাঝে মাঝে ভয় করে। হঠাৎ করে সুষমার কথা মনে পড়ে যায়।

.

মোনালিসা গর্গের খবরে গৌতম অতিরিক্ত বিচলিত হয়ে পড়েছিল কি? বেশি ভয় পেয়েছিল? ভয়, না বিতৃষ্ণা? নাঃ, ওটা বিচলিত হবার মতোই খবর। তারপর অনিন্দ্যর ব্যাপারটা। গৌতমের মুখে অনিন্দ্যর কথাটা শুনতে ভালো লাগেনি শ্রাবস্তীর। যেমন শ্রাবস্তীর মুখে মোনালিসার কাহিনী শুনতে শিলাদিত্যর ভালো লাগেনি। (শিলু আমায় নিজেই কেন বলল না অনিন্দ্যর কথাটা? বললে কী ক্ষতি ছিল?)

শুভার সঙ্গে এতদিনের এত সুন্দর সম্পর্কটা ছিন্ন করে দিল্লি গেল কেন শিলু? শুভা থাকলে তো মোনালিসা ঢুকতে পারত না শিলুর জীবনে।

মোনালিসা জুয়া খেলতে বসেছে জীবনটাকে নিয়ে। যে কোনো এক্সপেরিমেন্টের জন্যে প্রস্তুত সে। নৈতিকতার ধার ধারে না। লৌকিকতা, চক্ষুলজ্জা–এসব শব্দ তার অভিধানে নেই। অঢেল পয়সা, আর অসীম স্বাধীনতা, এই দুই সর্বনেশে বারুদের স্কুপের ওপরে বাসা বেঁধেছে ওই মেয়ে। এককালের মিস চণ্ডীগড়–ফেমিনার কভার গার্ল–আছে শাণিত রূপ, প্লাবিত যৌবন। শিলাদিত্য গিয়ে পড়ল শেষে এই মেয়েরই পাল্লায়। এত মানুষ থাকতে দিল্লি শহরে, সেই রীমা ভীমানির ধনী সোশ্যালাইটদের উড়নচণ্ডী আড্ডাতেই ধরে নিয়ে গেল শিলুকে, লিসা রীমা ভীমানির মেয়ের বন্ধু। সে মেয়েটিও দিল্লিতে সুপরিচিত। ধনীদের জন্য বিউটিপার্লার চালায় সে একটি–প্রচণ্ড বিখ্যাত মেয়ে সে। ওদের একটা বার আছে–সেখানে হঠাৎ একটি মেয়ে খুন হয়ে গেছে অল্প কিছুদিন আগে। তবুও বার চলছে–এত রাজনৈতিক ক্ষমতা ওই রীমা ভীমানির। ওসব সঙ্গ শিলুর পক্ষে মস্ত ক্ষতিকর। শিলু বুঝছে না।

.

মোনালিসা গর্গকে কখনো শ্রাবস্তীদের বাড়িতে মানায়? সুরমা-আদিত্য রীতিমতো সন্ত্রস্ত তার হাবভাবে, চালচলনে। শ্রাবস্তী অস্থির, উদ্বিগ্ন হয়েছিল–ওই মেয়ের মধ্যে একটা অচেনা, জটিল জীবনের সংকেত পেয়েছিল সে। গৌতম খবর নিতে শুরু করল, অচিরাৎ খবর মিলে গেল। মেয়ে তো নাম করা। সোশ্যাল ওয়ার্ক করে মানুষ দেখে দেখে সুষমার এমনই হয়েছে, মোনালিসাকে দেখেই তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় জেগে উঠেছিল। তিনি গোপনে শ্রাবস্তীকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, এ মেয়েটাকে তো ড্রাগ অ্যাবিউজার বলে মনে হচ্ছে–একে বাড়িতে রাখা একদম চলবে না–শিলুর সঙ্গে একে মিশতেই দেয়া ঠিক নয়–সুষমা সুরমাকে আসল কথাটা বাদ দিয়ে বলেছিলেন, মেয়েটাকে বাজে মেয়ে মনে হচ্ছে সুরো, ওকে বাড়িতে না রাখাই ভালো।

এটা বলা সহজ, কিন্তু করা অত সহজ নয়। শ্রাবস্তী কী করবে? মা-বাবার কাছে ড্রাগ শব্দ উচ্চারণ করলেই তো তারা মূর্ছা যাবেন। এ ব্যাপারে গৌতম ঠিক। বাবা-মা ওই একটি জিনিসকে ভয় পান। ড্রাগ। শিলুকে মোনালিসার থেকে বিচ্ছিন্ন করতেই হবে। চরম সর্বনাশ থেকে যেমন করে হোক বাঁচাতে হবেই শিলুকে-শ্রাবস্তী আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। মোনালিসার কথা সব খুলে বলেছিল শিলুকে। শিলু জানত সবই। অবাক হল না। বিরক্ত হল।

নানা অজুহাতে, নানা চেষ্টায়, শ্রাবস্তীর ঐকান্তিক প্রয়াসেও মোনালিসাকে কিছুতেই যখন নড়ানো গেল না, আত্মমগ্ন শিলাদিত্য কোনো ইঙ্গিতই ধরতে চাইল না, তখন অক্ষমতার ক্ষোভে অস্থির হয়ে শ্রাবস্তী নিজেই বাড়ি ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল। ভাবল এবার শিলাদিত্যর চোখ ফুটবে। কিন্তু জ্ঞানগম্যি যে আর হবার নয়। যে সর্বনাশের ভয় পাচ্ছিল শ্রাবস্তী সেই সর্বনাশ যে হয়েই গিয়েছে তা কি তখনও টের পেয়েছিল সে? নাকি টের পেয়েও বিশ্বাস করতে চায়নি?

গৌতম বলেছিল, একা লিসাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই তোমার ব্রাদারটিও ওই লাইনেই আছেন।

কথার সুরটা শ্রাবস্তীর খুব খারাপ লেগেছিল। শ্রাবস্তী বিশ্বাসও করেনি। ক্রমশ শ্রাবস্তীর ধারণা হচ্ছে গৌতম শিলুকে পছন্দ করে না। তার পোশাক-আশাক, তার পপ-ব্যান্ড সিনামন আইল্যান্ড, তাদের গানবাজনা, কোনো কিছুই যেন গৌতমের মনঃপুত নয়। ওরা যে ম্যাক্সমুলর ভবনে অনুষ্ঠান করে কাগজে কাগজে অত প্রশংসা কুড়ল, গৌতম তাকেও বলেছিল-ওঃ! রেভ রিভিয়ু!–ওসব রাখো তো? যত রাজ্যের বড়লোকের ছেলেরা দল করেছে, পুরো মিডিয়া ওদের হাতের মুঠোয়।

শ্রাবস্তীর কানে ভালো শোনায়নি কথাগুলো! কেমন একটা অস্বস্তি হয়েছিল, গৌতম কি শিলুকে–? ওকে কি একটু ঈর্ষাই করে গৌতম? কেন, শ্রাবস্তীর তো ঠিক উলটোই মনে হল। শ্রাবস্তীর বরং মনে হয়েছিল ছেলেগুলোর সত্যি ট্যালেন্ট আছে। অনিন্দ্যর কোরিও গ্রাফি, শিলুর লেখা গান-ভিকির পারকাশ্যান–কিন্তু অনিন্দ্য মুম্বাই চলে গেল মেধা পাটকরের ওপরে ডকুমেন্টরি করতে, আর শিলাদিত্য চলে গেল দিল্লি, দারুচিনি দ্বীপও ডুবে গেল।

শিলু যখন এসেছিল, বাকি ছেলেগুলোও এসে কদিন বাড়িতে জড়ো হয়ে হই হই করেছিল বটে, কিন্তু তারপর তো খেল্ খতম। দলের ছেলেগুলো সকলেই অল্পবিস্তর গাঁজাখোর। কিন্তু গাঁজা নিয়ে তো ভাবনা নয় শ্রাবস্তীর। তার ভাবনা অন্যত্র। আরও অনেক গভীরতর ক্ষতির সম্ভাবনা যেখানে।

শিলাদিত্যের খবর এখনও কিছু জানা গেল না। বোঝা যাচ্ছে না ক্ষতির বহর কতখানি। মোনালিসার খবর যা পাওয়া গেছে তারপরে তো আর মনে-প্রাণে কোনো ভরসাই থাকে না। বাবা-মাকে কিছুই বলতে পারা যাচ্ছে না, তাদের জন্যে শ্রাবস্তীর মনে প্রবল দুশ্চিন্তা। ওঁরা। কেউই বাইরে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করছেন না, খুব স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। অথচ শ্রাবস্তী তো জানে। তাদের রক্তের মধ্যে অশান্তির ঢেউ আকাশ ছুঁয়েছে।

গোয়াতে একবার যাওয়া দরকার।

এবং কাঠমাণ্ডুতে।

অবশ্য নেপালে আরও ঢের জায়গা আছে। ছোটখাটো গ্রামেও যথেষ্ট নেশার সামগ্রী মেলে। যেখানে ড্রাগের সাপ্লাই অপ্রতুল নয় সেরকম কোনো জায়গাতেই মোনালিসা থাকবে বলে গৌতমের ধারণা। এবং মোনালিসার সঙ্গে শিলু।

কে জানে কতদূরে ছড়িয়েছে, কত গভীরে নেমেছে সর্বনাশের শেকড়। বাবা-মা-র এতগুলো চিঠি বেরুল এতদিন ধরে এতগুলো কাগজে, একটাও কি চোখে পড়ল না শিলুর? এতটা নিঃশব্দ কেন? নৈঃশব্দ্যই তো ভয়ের।

.

একাদশ অধ্যায়। চিঠি পড়া

চিঠিঃ এক

আমেদাবাদ
১২ জানুয়ারি ১৯৯৯

শ্রীচরণেষু মা গো,

আমি জানি আমার জন্যে ভেবে ভেবে তোমরা কত কষ্টে আছ। কিন্তু সত্যি খবরটা যদি পাও তাহলে বাবা আর তুমি আরও বেশি কষ্ট পাবে, এই দুর্ভাবনায় নীরব থাকাই স্থির করেছিলাম। কিন্তু বারবার কাগজে তোমাদের চিঠি চোখে পড়েছে–তাতে সান্ত্বনা পাই, ওতেই জানছি যে, তোমরা আছে, তোমাদের ভালোবাসার জায়গাটা আমার জন্যে এখনও ঠিক আছে। আমিও ঠিক আছি, মা। কিন্তু আমার জীবনের চালচিত্রটা পালটে গেছে।

দিল্লিতে ফেরার পর থেকেই মোনালিসার শরীরটা খারাপ হয়ে পড়ল। ওকে যখন কলকাতায় নিয়ে যাই, তখনই ওর স্বাস্থ্য গোলমাল করছে। দিদি ঠিকই ধরেছিল ওই সময়টায় আমার জীবনে একটা প্রবল ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। দিদির কাছে তোমরাও এতদিনে নিশ্চয়ই লিসার ড্রাগ অ্যাডিকশনের কথা জেনে থাকবে। দিদির ভয় ভুল ছিল না, মা। লিসা, এবং আমাদের অন্যান্য সঙ্গীসাথীদের কল্যাণে দিল্লিতে এসে আমারও ওই মরণ-নেশাতে হাতে-খড়ি হয়ে গিয়েছিল। তাই কলকাতাতে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিলাম, যদি মুক্তি পেতে পারি।

আরও একটা কারণেও মোনালিসাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। আমাদের পরিবার নিয়ে আমার মনে একটা গভীর তৃপ্তি, আর গর্ববোধ আছে বলে। লিসার মা ওকে বাল্যকালেই ছেড়ে অন্য সংসার পাততে চলে গিয়েছেন। বাবা ব্যবসার ধান্দায় এদেশ-ওদেশ ঘুরে বেড়ান, ব্যবসাও খুব শুভ্রধবল নয়। তার সাঙ্গো-পাঙ্গরাও তেমনি। লিসা আয়া-বাবুর্চির জিম্মাতেই মানুষ হয়েছে। একলা একলাই বড় হয়ে উঠেছে বলতে পারো। হাতে প্রচুর অর্থ এবং স্নেহের কোঠায় শূন্য। জীবনটাকে নিয়ে যেমন খুশি খেলাধুলো করেছে। নিজেকেও একটা খেলনার মতোই টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলেছে। আমি চেয়েছিলাম সেই ভাঙা টুকরোগুলোকে জোড়া লাগাতে। ভেবেছিলাম, তোমার কাছে, বাবার কাছে, দিদির কাছে লিসাকে একবার নিয়ে ফেলতে পারলে, ওর বিভ্রান্তি ঘুচে যাবে। মানুষকে বিশ্বাস করতে ওর যে প্রবল ভীতি, সেটা কেটে যাবে।

কিন্তু বাড়িতে যাবার পরে কিছু আর ঠিকঠাক হল না। যা সব কাণ্ডকারখানা হতে লাগল, তাতে আমার পরিকল্পনা বাস্প হয়ে উবে গেল। দোষ আমারই মা। আমিও তখন ঠিক আমাতে ছিলাম না। নিজের মধ্যে জোরটা ছিল না বলেই বোধ হয় কাউকেই কিছু বোঝাতে পারিনি।

লিসাকেও বোঝাতে পারিনি কিছু, দিদিকেও নয়। ওরা তাই মোটে কাছাকাছিই এল না। তোমাকেও বোঝাতে পারিনি আমি কী চাই–তাই লিসা তোমার কাছেও গেল না।

তুমিও মা, ওকে কাছে টানলে না, একটু যেন ভয়ে ভয়ে দূরে দূ রেই রইলে। লিসারই দুর্ভাগ্য, তোমাদের মতো মা-বাবা, দিদির মতো দিদির কাছে গিয়েও লিসা তোমাদের কাছাকাছি যেতে পারল না। দূরত্বের বেড়া ডিঙোতে পারল না–সরিয়ে রাখল নিজেকে। আমিও সেতুবন্ধনের চেষ্টা ঠিকমতন করতে পারিনি। আমারও সময়টা তখন ঠিকঠাক ছিল না মা। নতুন নেশার গোপন উত্তেজনার আর গভীর অপরাধবোধের তুমুল বিষে মেশানো অন্ধকার সময় ছিল সেটা আমার।

ফলে যা হবার নয়, তাই হল। সবই উলটোপালটা হয়ে গেল। দিদি বাড়ি থেকে চলে গেল তাতে অপমানিত হয়ে লিসাও ফিরে গেল দিল্লি। আমি না পারি একে দুষতে, না ওকে। ফলে নেশার মাত্রা বেড়ে গেল। তোমাদের চিঠি লিখব কোন মুখে? ফোনে বলব কী? দিল্লি থেকেই আমার নিস্তব্ধতার শুরু। আমার সান্ত্বনা, দিদি আছে। তোমাদের কাছে দিদি থাকবে।

তোমার হয়তো মনে পড়বে, কলকাতাতে থাকতেই লিসার জ্বর হচ্ছিল। পেটের গোলমাল হচ্ছিল। দিল্লিতে এসেও সেটা চলতে লাগল। আজ পেটের অসুখের জ্বর, তো কাল সর্দিকাশির জ্বর। মুখের মধ্যে পর্যন্ত এমন ঘা, যে কিছুই খেতে পারে না। তবু কিছুতেই কিছু কথা শুনবে না। ডাক্তার দেখাবে না। কলকাতা থেকে এসে আমি আর হোস্টেলে যাইনি, লিসাদের মস্ত বাড়ি পঞ্চশীল পার্কে। লিসার সঙ্গে আমিও সেখানেই ছিলাম। কিন্তু সিলার স্বাস্থ্য হঠাৎ এমন ভেঙে পড়তে লাগল, যে আর ক্লাসেই যেতে পারছিল না। দ্রুত ওজন কমতে লাগল। গায়ে ব্যথা। কাশিতে দমবন্ধ। ডাক্তার ধরে আনা হল। বহুবিধ রক্ত পরীক্ষা করে, শেষ পর্যন্ত জানা গেল, ওর রক্তে শুধু এইচ. আই. ভি. পজিটিভই নয়, লিসার শরীরে এইডসের লক্ষণ পূর্ণমাত্রায় প্রকাশ পেয়েছে। অনেকদিন আগেই ওর রক্ত এইচ.আই.ভি. পজিটিভ হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। চেক করা হয়নি।

ওকে নিয়ে আমেদাবাদে এসেছি। এখানে গ্যাপ (GAAP) নামে গুজরাত এইডস অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম হয়েছে, তারা চমৎকার কাজ করছে। ওরাই লিসার শুশ্রূষার, চিকিৎসার সুব্যবস্থা করে দিয়েছে। চণ্ডীগড়ে ওর বাবাকে বারবার খবর দিয়েছি। উনি চেক পাঠিয়ে দিয়েছেন। দেখতে আম্মু সেননি। নিষ্ঠুরতার, নির্মমতার এমন নগ্ন চেহারা আমি এর আগে দেখিনি। দিল্লির বন্ধুরাও যখন লিসার অসুস্থতার কারণ শুনল, কেউই আর ধারে কাছে রইল না। অথচ ওর বাড়িটা ভর্তি হয়ে থাকত শুধু লিসার বন্ধুর দঙ্গলে। শুধু আমার বন্ধু অনিন্দ্য দুবার এসেছে মুম্বাই থেকে। শুধু অনিই যোগাযোগ রাখে। লিসার পাশে পাশে আমি রয়েছি এই ছমাস। এই অসুখে ছমাস সময় যে কত দ্রুত কেটে যায়! ওকে দেখলে তুমি আর চিনতে পারবে না মা। ওর ওজন এখন আটাশ কেজি। লিসার শুশ্রূষার জন্যে ভাবনা কোরো না, মোনালিসা যতদিন বাঁচবে, ওর পাশে আমি থাকব।

গত পরশু লিসার মা এসেছেন। বারো-তেরো বছর পরে মা-মেয়েতে দেখা–এই প্রথম, এই শেষ। এই দেখাটুকুই যদি আরও ছসাত বছর আগে হত! মাগো, অহংকার অভিমান, লজ্জা, সংকোচ, ভয়–কত রকমের মিথ্যের পাঁচিল তুলেই আমরা নিজেদের ক্রমশ নিঃসঙ্গ করে ফেলি! ফুরিয়ে ফেলি। ওর মাকে দেখেছি। তাই সাহস করে আজ এই চিঠি। নিউমোনিয়া হয়েছে লিসার। এই অসুখের মধ্যে নিউমোনিয়া হলে, তার কোনো চিকিৎসা নেই। শেষ সম্বল শুধু ভালোবাসা। সেইটে দেবার জন্যেই আমারও এইখানে থেকে যাওয়া। একটাই তো জীবন? একদিন ছেড়ে যেতেই হবে এই মাটি; তার আগে যতগুলি জীবনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি, ততই আমি ভাগ্যবান।

আমি আমেদাবাদেই থাকব। এন.এস.ডি. তে তো আর ফেরা হবে না। এখানে অনেক দুঃখী মানুষ মা। এই গ্যাপ প্রতিষ্ঠানটিতেই আমি স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছি। এদের সকলের আমাকে দরকার আছে।

আর আমারও একদিন এদের দরকার হবে, মা। ইলাইজা টেস্টে আমিও হয়েছি এইচ.আই.ভি. পজিটিভ। হ্যাঁ। এই একই ভবিষ্যৎ আমার জন্যেও অপেক্ষা করে আছে। যদিও এখন ঠিক আছি। যা বলছি মা, সব সত্যি কথা–তোমাকে নির্ভার করতে, সত্যিই বলা উচিত। ভয় পেও না মা। শক্ত হও। কালই তো গাড়ি চাপা পড়ে মারা যেতে পারে একজন বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলেও। জগতে কেউই চিরঞ্জীবী হতে আসিনি। তুমি একা নও মা। পৃথিবী জুড়ে আরও অনেক ছেলেমেয়ের মায়ের তোমারই মতো মর্মান্তিক অবস্থা, মনে রেখো। এই অসুখের সংক্রমণ অতি সীমিত। তাই সাবধান থাকাও সহজ। ত্রুটি আমারই। অসতর্কতা। একটি মাত্র মুহূর্তের বিভ্রমও চিরদিনের মতো বদলে নিয়ে যায় আমাদের জীবন। এই ইঞ্জেকশনের ছুঁচ যে কতজনের যমদণ্ড হয়েছে।

মাগো, আমার কিন্তু শরীরটরির সব স্বাভাবিক। অসুস্থতার কোনো লক্ষণ নেই। শুধু মোনালিসার সঙ্গে থাকি বলেই আমারও রুটিন ইলাইজা টেস্ট করিয়েছিলেন ডাক্তার মহিলাটি। তাই ধরা পড়ল। এমনিতে আমি কর্মক্ষম, সুস্থ আছি। রোগের বীজাণু এখনও সক্রিয় হয়নি। নাও তো হতে পারে? সর্বদা হয় না কিন্তু!

দিদি যেন লিসার ওপরে রাগ করে না। ও খুব অন্যায় করেছে ঠিকই, দিদি ঠিক-ঠিকই ভয়গুলো পেয়েছিল। কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে। দিদিকে বোলো, এই সময় কারুর ওপরে রাগ পুষে রাখতে নেই, ক্ষমা করে দিতে হয়। এমনকী লিসাকেও। দোষ তো আমারও। কেউ তো আমাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নেশা ধরিয়ে দেয়নি। আমারও বুদ্ধির ভুল হয়েছিল মা। দাম তো দিতেই হবে। মাগো–দিদি, তুমি, বাবা আমার ভালোবাসা নিও। মামণিকেও জানিও। এই চিঠি ওঁকেও দেখিও। মেসোমশাই, শুভদাদা, লোপাদি সবাই ভালো তো? তোমরা ভালো থেকো, মা।

তোমার
শিলু।

পুনশ্চ : লিসাকে তোমরা বাড়িতে নিয়ে যেতে বারবার ডেকেছ বলে কাগজে তোমাদের চিঠি পড়ে, লিসার চোখে জল। সে খুবই কৃতজ্ঞ। এইটুকু মমতা ওর কাছে অনেকখানি। এখন বোধহয় অল্প অল্প চেনা হচ্ছে তোমাদের। যখনই হোক, যেটুকুই হোক, সেইটুকুই লাভ। আর ভাবনা কোরো না। এই তো খবর পেলে। এবার সামলে ওঠো দুঃসংবাদটা। তুমি তো কঠিন হতে পারো। বাবাকে একটু বুঝিয়ো। দিদিকেও বোলো বাবাকে বোঝাতে। আমার জন্য ভেব না। তুমি তো ঈশ্বরবিশ্বাসী।

.

চিঠিঃ দুই

১৭/২সি জাস্টিস চন্দ্রমাধব স্ট্রিট
কলকাতা-২০
১৭ জানুয়ারি ৯৯

আমার আদরের শিলাইবুড়ো,

এতদিন দেরি করতে হয় রে? তোমার চিঠির জন্যে বসে বসে তোমার বাবা-মায়ের প্রাণ সত্যি সত্যি বুঝি ঠোঁটের কাছে উঠে এসেছিল। আমি তো ভয় পেতে শুরু করেছিলাম ওঁদের জন্যে–চাপা মানুষ–কেউই হাহাকার করছেন না, দুজনেরই ভয়, ইনি দুর্বল হলে উনি বুঝি ভেঙে পড়বেন। তাই দুজনেই অতিরিক্ত স্বাভাবিক আছেন। আর ভেতরে ভেতরে পুড়ে ছাই হচ্ছেন। আর তোমার ওপরে আমার এতক্ষণ যে রাগটাই হচ্ছিল! তুমি কি সত্যি সত্যি সন্ন্যাসী হয়ে গেলে? পূর্বাশ্রমের কথা বুঝি আর মনে নেই? যাই হোক না কেন, তুমি তো জানো আমরা তোমার সঙ্গে সর্বদা আছি। সদাসর্বদা।

তোমরা এই ভয়ের দিনে, এই বিপদের দিনেই যদি আমাদের কথা না মনে পড়ে, তবে কবে আমাদের কথা ভাববে? তুমি তো জানো আমি কাদের নিয়ে কাজ করি। আমার সঙ্গেও একটু যোগাযোগ করলে না? তবু ভগবান তোমাকে তো সুবুদ্ধি দিয়েছেন শেষ পর্যন্ত, সেই মস্ত দয়া। এবার দেরি না করে অবিলম্বে তোমার শরীরের খবর আমাকে ডিটেইলসে জানাবে। তোমার ফোন নম্বর কী?

গ্যাপের কাজকর্মের খবর আমরাও জানি। তুমি যে ওদের সাহায্য পেয়েছ মোনালিসার জন্যে, এটা খুবই ভালো খবর। গুজরাতের অবস্থা দ্যাখো, আর এখানে, আমাদের পশ্চিমবঙ্গে? এইডস হয়েছে শুনেই রুগিকে পরিত্যাগ করে তার মা-বাবা-স্ত্রী নিঃশব্দে পালিয়ে গিয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স থেকেও তাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে, ছোঁয়াচের ভয়ে। সে কি বাঁচে? আরেকজন এইডস রুগিকে হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, জমাদার, কেউই অ্যাটেন্ড করেনি। দিনের পর দিন! সেও মারা গেছে। মেডিক্যাল প্রোফেশনেও এতদূর জ্ঞানের অভাব। বর্ধমানের একজন রুগির কখনো ভবিষ্যতে এইডস হতেও পারে, যেহেতু তার রক্তে এইচ আই ভি পজিটিভ বেরিয়েছে–এই কারণে গ্রামের লোক রাত্রিবেলায় তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। নেবানো না গেলে, পরিবারসুদ্ধ পুড়ে মরত। এই সবই বাস্তব ঘটনা। fact!

পশ্চিমবঙ্গের মতো উদারপন্থী, মুক্তমনা, আধুনিক, প্রগতিবাদী রাজ্যের এই অবস্থা! সচেতনতা সৃষ্টির কাজ কিছুই ছড়ায়নি। এই নিষ্ঠুরতা, অমানুষিকতা সবই অযৌক্তিক মৃত্যুভয়, এবং চরম অজ্ঞতাপ্রসূত। অতএব শিলুবুড়ো, বুঝতেই পারছ, এই রাজ্যেই তোমার আমার প্রচুর দায়িত্ব, প্রচুর কাজ রয়েছে। চিরদিন ওখানেই থেকে তুমি কী করবে? ওখানে তো তবু কাজ হচ্ছে। কর্মী আছে। শিলুবাবু, এখানেই তোমার অনেক জরুরি কাজ পড়ে আছে–you are badly needed here! তুমি যে সেবার কাজে এখন নিযুক্ত রয়েছ, সেই কাজেই তোমার সম্পূর্ণ মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তোমার মনের অবস্থাও বুঝতে পারছি। তোমাদের ভালো হোক, মোনালিসার যন্ত্রণা লাঘব হোক, এই প্রার্থনা করি। এ-রোগে শেষদিকে বড় কষ্ট।

আমার বালিকা সুরক্ষা আশ্রম আর মহিলা নির্যাতন প্রতিরোধ সংঘের বিষয়ে তো জানতেই। এখন আমি সোনাগাছিতে এইডস নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতির সঙ্গে কাজ করছি। এবং জাতীয় এইডস নিয়ন্ত্রণ সমিতি-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতির দায়িত্বে আছি। তুমি এলে আমি অনেক বেশি জোর পাব।

তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, তোমার মা একটা গান খুব গাইতে ভালোবাসেন–আমারও গানটি প্রায়ই মনে পড়ে–অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো/সেই তো তোমার আলো– শিলুবুড়ো, অন্ধকারকে ভয় পেতে নেই–

সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো/সেই তো তোমার ভালো– সেই ভালোটার খোঁজেই ছুটছি আমি, তুই, আমরা সবাই।–এখানে এসে আমাদের সঙ্গে হাত মেলাও।

শুভরা এই গ্রীষ্মে আসছে। ওরা কাজ করতে ব্রাজিল যাবে তার পরে। ওর সঙ্গে তোমার career possibilities discuss করো। ওরা অনেকরকম খবর রাখে।

অনেক আদর নাও। Welcome back! লিসাকে, তোমাকে প্রাণঢালা আশীর্বাদ ইতি।

তোমার সৎসাহসে মুগ্ধ,
মামণি

পুনশ্চ : তোমাকে যেসব ভয়াবহ গল্প বললাম, এইডস রোগীর পরিবারকে একঘরে করার বিষয়ে, তাতে ভয় পেয়ে যেন আমাদের অস্বস্তির কথা ভেবে বাড়ি ফিরতে দ্বিধা কোরো না। তোমার পরিবারকে একটা সুযোগ দাও। এই সর্বনেশে সামাজিক অজ্ঞতা ও অমানবিকতার স্পষ্ট বিরোধিতা করতে, পথনির্দেশ দিতে আমাদের সুযোগ করে দাও।

.

চিঠিঃ তিন

১৭ জানুয়ারি ১৯৯৯
সল্টলেক রায়বাড়ি

শিলুবাবা,

তোমার গলাটি এতদিন পরে চিঠির মধ্যে দিয়ে ভেসে এসে আমাদের প্রাণ ভরিয়ে দিয়েছে। এতদিন কেন চুপ করে ছিলে? তোমার মা খুব ভেঙে পড়েছিলেন ভেতরে ভেতরে। অসুস্থ হলে মাকে জানাবে না, বাবাকে জানাবে না, এটা তোমার কীরকম বুদ্ধি, শিলুবাবা? তোমার বন্ধুকে তুমি প্রাণ ঢেলে সেবা করছ, শুনে আমরা তোমাকে নিয়ে গর্বিত। এমন হৃদয়বান সন্তান পাওয়া ভাগ্যের কথা। ঈশ্বর তোমাকে আরও ভালোবাসার শক্তি দিন। এর চেয়ে বড় শক্তি পৃথিবীতে আর কিছু নেই। তবে জীবন বড় জটিল–তাই এই ভালোবাসাই, যা কিনা সৃষ্টির মূলে, আবার অনাসৃষ্টিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায় কখনও কখনও।

তোমার চিঠি পেয়ে যেমন আনন্দ হল, বলা নিষ্প্রয়োজন, তেমনিই মন গভীরভাবে বিষণ্ণ হয়েছে। তোমার জন্য। তোমার বন্ধু মোনালিসার জন্যে। তোমাদের পুরে প্রজন্মের জন্যে। এবং আমাদের নিজেদের সংবেদনের অভাবের জন্যেও। কিছুই তো বুঝিনি। তাকে তুমি নিয়ে এসেছিলে স্নেহমমতার স্পর্শ দিয়ে রক্ষা করবে বলে, অথচ আমরা ওকে ঠিকমতো অভ্যর্থনাই দিইনি। সেও মনে মনে হয়তো আমাদের গ্রহণ করতে পারেনি। সেজন্য সুরো, এমনকী খুকুর সঙ্গেও তার ভাব হল না। আমরাও সেদিকে গা করিনি, লিসাকে আমাদের তেমন ভালো লাগছিল না। ওরকম মেয়ে আগে তো দেখিনি? নিজের পরিবারে যে নিরাপত্তা সে পায়নি, তুমি চেয়েছিলে সেই অমৃতের স্বাদ তার সঙ্গে ভাগ করে নিতে। কাযর্ত হয়ে গেল বিপরীত। সে তো ভিতরে এলই না, তোমাকেও বের করে নিল তোমার নিরাপত্তার বেষ্টনি থেকে, স্নেহের সুরক্ষার আড়াল থেকে। আমরা তাকে সামান্য আত্মবিশ্বাসটুকু দিতে বিফল হয়েছি, শুধুই বোঝার ভুলে।

আমাদের সারাটা জীবনই এইরকম ভুলে ভরা। মানুষ চায় একরকম আর জীবন তার হাতে তুলে দেয় অন্য এক পাওয়া। এই তো দ্যাখো না, দোষ তো কারুরই ছিল না, অথচ সব কিছুই ভুলভাল হয়ে গেল। ঈশ্বরের কাছে মোনালিসার আরোগ্য প্রার্থনা করি। কত মির‍্যা ও তো এই পৃথিবীতেই হয়েছে। এইডস্ রিসার্চ যেভাবে চলছে তাতে আমার দৃঢ় ভরসা, নতুন সহস্রাব্দের আগেই এইডস্-এর ওষুধ বের করে ফেলব আমরা। প্রতিষেধক, এবং নিরাময়ের ওষুধ, দুই-ই। আমার বিশ্বাস দুহাজার এক দুটি অমূল্য উপহার হাতে করে উপস্থিত হবে। ক্যানসার-কিওর, আর এইডস্-কিওর।

শিলুবাবা, তুমি ভয় পেয়ো না, সময় তোমার স্বপক্ষে আছে। ভাগ্যে থাকলে লিসাকে আমরা হয়তো ধরে রাখতে পারব। তোমার মা এবং আমি আবার বলছি, লিসা আমাদের সংসারে স্বাগত। অসুস্থ লিসাকে আমরা যত্ন করবার দায়িত্ব নিতে রাজি আছি। কাগজে প্রকাশিত চিঠির বাক্য থেকে পিছু হটছি না। দুজনেই এসো। আমরা অবসরপ্রাপ্ত, আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় রয়েছে মনোযোগ দেবার মতন। চিঠিতে আমরা বলেছিলাম এটা লিসারও বাড়ি। এখনও তাই বলছি।

তুমি ঠিকই বলেছ। একটা মাত্র জীবন আমাদের। বড়ই শীগগির ফুরিয়ে যায়। তার মধ্যে যে কটি প্রাণের সঙ্গে সংযোগ সাধন করতে পারি, সেটুকুই লাভ। বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে লাভ-ক্ষতির হিসেবগুলো সব পালটে যাচ্ছে। যা বুঝলাম। এই মৃত্যুশাসিত জীবনে ক্ষতি শুধু একটাই। অপ্রেমে। বিচ্ছেদে। ঘৃণায়। মৃত্যু তো আসবেই, তুমি ঠিকই বলেছ। তাকে ভয় পাওয়া অর্থহীন। ভয় যন্ত্রণাকে। দেহের চেয়েও, মনের যন্ত্রণাকে। তুমি অপরের মুখ চেয়ে, সেই যন্ত্রণা লাঘবের কাজে নিজেকে নিয়োগ করেছ। তোমার মানুষ-জন্ম সার্থক হয়েছে, নিজেকে তুমি আর্তের সেবায় উৎসর্গ করেছ। We are proud of you, my son! এবার লিসার শুশ্রূষার কাজে তুমি আমাদেরও সঙ্গে নাও। মনে রেখো তুমি একাকী নও, তোমরা দুজনে নিঃসঙ্গ নও। We have all the time in the world to look after you two-15773115 7/5 at আমার প্রচুর অবকাশ। কোন কাজে যে লাগব, তাই ভেবে পাই না।

শিলুবাবা, পালিয়ে থেকে লাভ নেই। যা ঘটে গিয়েছে, তা নির্মম বটে, কিন্তু সেটাই বাস্তব। যত কঠোরই হোক সত্যকে তো মেনে নিতেই হবে আমাদের। এখন দেখা দরকার, সেই কঠোর বাস্তব, সেই মর্মান্তিক সত্য থেকে কতটা প্রাণরস নিংড়ে নেওয়া যায়। প্রাণের সম্ভাবনা অশেষ। ইটচাপা পড়া ঘাস দেখেছ? সাদা রং হয়ে যায়, কিন্তু বেঁচে থাকে। ভালোবাসার সম্ভাবনাও অশেষ। মনের বল হারিও না। মনে বল রেখো।

খুকু ছুটি নিচ্ছে তোমার কাছে যাবে বলে। বিশেষত মোনালিসার কাছেই। তার কাছে আমাদের যে গর্হিত অপরাধ হয়ে গেছে, যদি তার আংশিক প্রায়শ্চিত্তও এখন করা সম্ভব হয়! Its never too late. শিলুবাবা, Life has infinite possibilities তাই খুকু যাচ্ছে তোমাদের সঙ্গে করে এখানে নিয়ে আসতে। ওকে ফিরিয়ে দিও না। মোনালিসাকেও প্রস্তুত করো। ওর মা-কে বুঝিয়ে বলো। মনে মনে তৈরি থেকো, অনেক সমস্যা, অনেক অপমানের, বহু লাঞ্ছনার মধ্যে এসে পড়বে। তবুও ফিরে এসো, যদিও জানি ফিরে এসেও জীবন সহজ হবে না। কঠিন দুরূহ পথ পরিক্রমার জন্য প্রস্তুত হয়েই এসো। আমরাও থাকব তোমাদের সঙ্গে। আছি। ভরসা রেখো।

মা চিঠি দেবেন দুয়েকদিনের মধ্যেই। তোমার মায়ের মতো নিশ্চয় আরো অজস্র মা বলছেন, ঠাকুর আমার ছেলের রোগটা আমাকে দিয়ে দাও, ছেলেকে সুস্থ করে দাও–সুরমার মতো ঠান্ডা মাথা মেয়েও শেষে লোকনাথ বাবাকে এহেন অন্যায়, মরীয়া অনুরোধ-উপরোধ করছে দেখে চিঠি উত্তরটা আমিই দিয়ে দেওয়া স্থির করলুম। এই চিঠির মনের ভাষাটা কিন্তু আমাদের দুজনেরই। আরও একটা কথা! এতদিন বাদে চিঠি যদি দিলে, সেটা একলা মায়ের নামে? বাবা বাদ? তোমার মা চিঠি পেয়ে খুব যে নিশ্চিন্ত হয়েছেন তা বলতে পারি না। কিন্তু সুষমা, খুকু, এরা দুজনে তোমার মাকে বোঝাচ্ছে যে আরও কত খারাপ খবর হতে পারত। হয়নি, সে শুধু ভগবৎকৃপায়।

মায়ের ও আমার স্নেহাশীর্বাদ নিও। মোনালিসাকেও জানিও। বাড়ি ফেরার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নাও। ইতি।

তোমার বাবা চিরশুভার্থী
শ্ৰী আদিত্য রায়।

Exit mobile version