থাক–আমার শরীরের কথা আর তোমাকে ভাবতে হবে না। ঢের হয়েছে। তুমি তোমার সংগঠনের কথা ভাবো। কটা বেশ্যার ছেলে ইশকুলে গেল। কটা ভিকিরির মেয়েকে রাস্তা থেকে তুলে আনা গেল। এইসব ভাববা। তোমাকে কি এইজন্যেই ঘরের বাইরে বের করেছিলুম? পাঠিয়েছিলুম তো হিন্দুধর্মের সেবা করতে।
হিন্দুধর্মটা কী বস্তু বলো তো? দীনদুঃখীর সেবায় বুঝি হিন্দুধর্মের ব্যাঘাত ঘটে? দরিদ্রনারায়ণটা কে তবে?
সুষি, আজকাল তুমি বড্ড আমার মুখে মুখে কথা বলতে শিখেছ!
তা শিখেছি! ছাপ্পান্ন বছর বয়েস তো হল! তোমার মায়ের তো কোনো কথারই উত্তর দিয়ে উঠতে পারিনি। একটু থেমে, একটু হেসে বললেন, বলতে পারো, তোমারই ক্রেডিট এটা। আমার মুখের ভাষা তো তুমিই জুগিয়েছ।
প্রসেনজিৎ চুপ করে থেকে বললেন,-বিকেলে আজ কোথাও বেরুচ্ছ?
একটু সুরোর কাছে যেতে হবে।
আদিত্য থাকবে?
থাকতেও পারেন। যাবে তুমি? চলো না–দুজনে মিলে যাই।
আমি? ওরে বাবা! কোথায় পদ্মপুকুর-চক্রবেড়ে, আর কোথায় সেই সল্টলেক। নাঃ, তুমি যাও। আমি থাকি।
চক্ৰবেড়ে-সল্টলেকের প্রবলেমটা কী? যাব তো গাড়িতে। বাইপাস দিয়ে আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব। চলো, বিকেল বিকেল চলে যাই। দুপুরে বরং তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো আজ।
এখন তো সবে সকালবেলা। নটা বাজেনি। বিকেলের কথা বিকেলে ভাবা যাবে।
কী মনে পড়তে সুষমা যেতে যেতে দাঁড়িয়ে যান।
অশোক তোমার সঙ্গে কথা বলেছে কি? ফোন করেছিল?
কোন অশোক?
ভৌমিক? ওদের নার্সিংহোমে ওরা বসতে বলেছিল হপ্তায় একদিন, সকাল হোক কিংবা বিকেলে। তোমার নামটা থাকলে ওদের নার্সিংহোমের মর্যাদা বাড়বে। যা রোজগার হবে সবই তোমার। জায়গার জন্য কিছু চার্জ করবে না। ভেবে দেখতে পারো। হপ্তায় তো মাত্র একটাই দিন। বেড়িয়ে আসবে একটু। এ তোমার নিজের বাড়িতে প্রাত্যহিক দুবেলা চেম্বার করা নয়। এতে স্ট্রেস অনেক কম।
অশোক-গৌরী দুজনেই তো ডাক্তার। ওদের নার্সিংহোমের মধ্যে আবার আমাকে টানা কেন? আমি বাবা কিছুর মধ্যে ঢুকতে পারব না। নার্সিংহোমগুলো আজকাল যত করাশনের ডিপো, নানারকমের ইল্লিগাল কাজকর্ম হয় সেখানে, কিসের সঙ্গে কখন জড়িয়ে পড়ব, কে জানে? না বাবা, ওতে আমি নেই। হঠাৎ কী ভেবে, আমাকে জড়াতে চাইছে? ওদের উদ্দেশ্যটা কী?
কিছুই না। ওরা তোমারই ছাত্রছাত্রী, তোমার সম্মান করে, তোমার সুনামটা যদি ওদের একটু কাজে লাগে। হপ্তায় একদিনেই তোমার রোজগার কিন্তু খুব কম হবে না, ঘরের খরচ নেই, রুগি পাবেই। বসলে ভালোও লাগবে। লোকজনের মুখ দেখবে, কাজকর্মে মনটাও ব্যস্ত থাকবে–এ্যাকটিসটা চালু থাকা সর্বদাই ভালো–
আমাকে ঘর থেকে টেনে বের করে দিতে পারলেই তুমি বাঁচো না? কেন? আমি কি তোমার চক্ষুশূল হয়েছি?
.
পঞ্চম অধ্যায়। সামুদ্রিক শাস্ত্র
মানুষ কী ভাবে, আর কী হয়। কোন বিষয়টা ঠিক? শুধু তো রূপ দেখেই নয়।
বাবা অনেক কিছুই মিলিয়েছিলেন। জন্ম পত্রিকা তো বটেই। বিবাহে প্রধানত দেখতে হবে পাঁচটা জিনিস। ঘরে বউ আনতে হলে জানতে হবে, তার অকালবৈধব্য আছে কিনা, অকালমৃত্যু আছে কিনা, দারিদ্রদোষ আছে কিনা, চরিত্রদোষ আছে কিনা, অনপত্যদোষ আছে কিনা। এই পাঁচটার যে কোনো একটা যদি থাকে, তাহলে সে সম্বন্ধ খারিজ করে দিতে হবে।
আমাদের ক্ষেত্রে বাবা নিজে আমাদের কোষ্ঠী বিচার করিয়েছিলেন। রাজযোটক মিল। পরম সুলক্ষণা বউ। শুধু কোষ্ঠী মিলিয়েই হয়নি বাবার। একটামাত্র ছেলে, তার বউ বলে কথা। আবার সামুদ্রিক জ্যোতিষ মতে বধূর লক্ষণগুলো মিলিয়েছিলেন–যা যা মেলানো সম্ভব। সব তো মেলানো সম্ভব নয়? যে নারীর বাহু রেখাযুক্ত, অধরোষ্ঠ সরলরেখা, মুখে তিলচিহ্ন আছে, তার বৈধব্যযোগ। কপালটি যার প্রলম্বিত, সে হবে শ্বশুরঘাতিনী। উদর প্রলম্বিত হলে দেবরঘাতিনী। অবশ্য বাবার পুত্রবধূর ক্ষেত্রে শেষোক্ত আশঙ্কা অমূলক, যেহেতু তার দেবরই নেই। কিন্তু বাবা সুষমার হাত ধরে আঙুলগুলি নেড়েচেড়ে দেখেছিলেন–আদর করতে নয়, হাতের আঙুলের মধ্যে ফাঁক থাকা দুর্লক্ষণ। চামড়া কর্কশ হওয়া, নাকের ডগায় তিল থাকা এসবই দুর্লক্ষণ। যে নারীর বাঁ-কপালে, বাঁ-হাতে, বাঁকানে, বাঁ-গলায়, বা-ঠোঁটের বাঁ-দিকে তিলচিহ্ন আছে সে নারী অতীব সৌভাগ্যবতী। বিশেষ করে বাঁ-কানে কি বাঁ-কপালে, বা গলার বাঁ-দিকে তিলচিহ্ন থাকলে তার প্রথম গর্ভে পুত্রসন্তান আসেই। এই সব চিহ্নগুলি মিলিয়ে বাবা দেখেছিলেন সুষমার আঙুলের মধ্যে ফাঁক নেই। ঠোঁটের বাঁ-দিকে তিল আছে, গলার বাঁ-দিকেও তিল আছে। সর্বসুলক্ষণা বধূ। সৌভাগ্যবতী পুত্রবতী হবে। একে সুন্দরী তায় সর্ব সুলক্ষণা, বাবা তো মত দিয়েই এলেন। সুষমাকে আমি প্রথম দেখলাম শুভদৃষ্টিতে। মা দেখলেন একেবারে বউ বরণের সময়ে। আজকাল এসব মানা হয় না বটে, কিন্তু আমাদের বংশে ঐতিহ্যের মূল্য খুব বেশি।
বাবা ছিলেন হিন্দু মহাসভার কর্মী। আমার পক্ষে সরকারি চাকরি করে এরকম রাজনৈতিক দলের কর্মী হওয়া মুশকিল। তাছাড়া আমি মুখচোরা মানুষজনের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতেও পারি না। রাজনীতির মঞ্চ আমার নয়। অনিল যখন বলল, বউদিকে মেম্বার করে দিন না কেন। এক টাকার তো মামলা, আমার মনে হল চমৎকার! সুষমাকেই সদস্য করে দিলাম হিন্দু জাগরণী সংঘের। জোর করে পাঠালাম দু-একটা মিটিঙে। একটা মেয়েদের ইশকুলে আলোচনা সভাতে অংশও নিল সুষমা। তখনও কি বুঝেছি ওর মধ্যে নেতৃত্বের মালমশলা দেখতে পাবে পার্টি?