গত ছুটিতে শিলু এসেছিল। লম্বা লম্বা চুল পেছনে টেনে রবার ব্যান্ড দিয়ে ঝুঁটি বেঁধে রেখেছে। গলায় একটা ছোট্ট সুতোর তৈরি লকেট, না তাবিজ। বাঁ-হাতে পাঞ্জাবিদের মতন লোহার কড়া। বাঙালি ছেলে বলে মনেই হচ্ছিল না ওকে। আজকাল প্রায় সব ছেলেমেয়েকেই একইরকম দেখতে। সুরমা চেয়ে চেয়ে দেখেন কলেজে, টিভিতে, রাস্তাঘাটে। সেই ঝকের কই হয়ে গেল তাঁর শিলুও।
.
চতুর্থ অধ্যায়। কার ফোন
কাল রাত্রে কে ফোন করেছিল?
কই কেউ তো করেনি?
আমি শুনলুম, ফোন বাজল, তুমি ধরলে, তারপর অনেকক্ষণ ফুসুর ফুসুর হল। কেউ করেনি?
ও সে তো সুরো।
সুরো তো বিকেলে করেছিল। তুমি তো আমাকে বললে এসে।
রাত্রে? কে আবার রাত্রে ফোন করল আমাকে? মনে পড়ছে না তো?
মণিদীপা কি? মিতালি? ডঃ সাহা?
কই ওরা তো ফোন করেনি? কত রাত্রে বলো তো?
খাবার পরে? করেনি?
আমি কী করছিলুম তখন? শুয়ে পড়েছি?
আমি শুয়ে পড়েছি। তুমি ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছ। ফোনের আশায়। আর আমি জেগে আছি। তোমার আশায়। দেরিতে বিছানায় এসে মশারি তুলে ঢুকলে আমার ঘুম ভেঙে যায়। জানোই তো একসঙ্গে শুয়ে পড়া আমি পছন্দ করি। তা ফোনের আশায় যদি
কী যা তা বলছ, ফোনের আশায় মানে? কার ফোন? আমার মনেই পড়ছে না।
মনে করে দ্যাখো। চেষ্টা করো একটু? পারবে।
পারব না। পারব না। আমি পাগল হয়ে যাব এবারে। কেউ ফোন করেনি। তুমি কল্পনা করেছ। আমি আজকের স্পিচটা লিখছিলুম। ফুসুর ফাসুর করছিলুম না। তুমি ঘুমচোখে ভুল শুনেছ। ওটা টেবিলফ্যানের শব্দ।
স্পিচ লিখতে ওঘরে?
আলো জ্বাললে তুমি চ্যাঁচাবে তো।
কিসের স্পিচ?
রবিবার মিটিং আছে টালিগঞ্জের ইনার হুইলের। আমাকে স্পেশাল গেস্ট করেছে– স্পিচ দিতে হবে না? সেইটে লিখছিলুম।
এখনও তোমাকে লিখে বক্তৃতা দিতে হয়? এখন কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নাও? গোড়ায় গোড়ায় তো আমাকে এক্সপ্লয়েট করেছ।
এক্সপ্লয়েট করেছি? তোমাকে? আমি? পরম বিস্ময়ে সুষমার ভুরু কপালে উঠে গেল।
নাকি ঠিক তার উল্টোটা? আমার তো একটুও ভালো লাগত না তোমার হিন্দু জাগরণীর ব্যাপার-স্যাপার। ফ্যাসিস্ট মনে হত।
গেলেই বা কটা দিন? ওই তো নিজের রুচিমাফিক কাজ বেছে নিয়েছ, যত রাজ্যের ভিকিরি আর বেশ্যাদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি। সাধু-সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গ তোমার তো মোটে ভালোই লাগল না।
বালিকা সুরক্ষাশ্রয় বুঝি কেবল ভিকিরি আর বেশ্যা নিয়ে চলে? গরিব মেয়েরা সবাই হয় ভিকিরি নয় বেশ্যা, না?
নয় তো দুটোই। তুমি তো হিন্দুনারী সুরক্ষা সমিতি ভেঙেচুরে তোমার নিজের ম্লেচ্ছ বালিকা আশ্রম গড়ে তুললে, যেখানে সব ধর্মের পতিতা মেয়েদের আড্ডা! আমি যা চেয়েছিলুম, তা কি তুমি করলে? হিন্দুত্ব হেঁটে বাদ দিয়ে কি হিন্দুধর্মের সেবা হয়?
তোমাদের হিন্দুনারী সুরক্ষা সমিতি যেমন ছিল তেমনি আছে, আমি কিছুই ভাঙচুর করিনি। কেবল নিজে ওখান থেকে সরে এসেছি–এসে গড়েছি নিজস্ব নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সংঘ। তাতে অনেক হিন্দু নারীও, প্রধানত হিন্দু নারীরাই, আশ্রয় পাচ্ছে। কেননা সংখ্যায় তারা বেশি।
হিন্দু বালিকা আশ্রমটা তুলেই দিলে?
তুলব কেন? ওটার নাম পালটেছি, বালিকা সুরক্ষাশ্রম করেছি। সেকুলার। ভারতীয় সংবিধান মতো চলাটা কি অন্যায়? কোনো ধর্মেরই উল্লেখ রাখিনি। আমি ভালো করে কাগজপত্র চেক করে নিয়েছি, বালিকাশ্রমের শুরুতে যাঁরা অর্থ অনুদান দিয়েছিলেন দেখলাম তারা কেউই হিন্দু কথাটা রাখতেই হবে, এমন কোনো শর্ত দেননি। তোমার এত আপত্তি কিসের? হিন্দুধর্মের কোনো ক্ষতি হয়েছে কি এতে?
আমার আপত্তির কথা হচ্ছে না। তোমারই বা এত হিন্দু শব্দে আপত্তি কেন? হিন্দু নারী, হিন্দু বালিকা, সবই তোমার অপছন্দ।
কেননা নির্যাতিত কেবল হিন্দু নারীরাই হয়না। নিরাশ্রয় শুধু হিন্দু বালিকারাই হয় না। নিজের চোখে সেটা দেখলে আর ওভাবে হিন্দু বলে কপাট বন্ধ করতে পারা যায় না। তুমি হাতে-কলমে কিছু করোনি। শাস্ত্রে সবকিছু লেখা থাকে না। সুষমার মুখে-চোখে বিরক্তি। খবরের কাগজটা নামিয়ে রেখে এবার উঠে পড়লেন সুষমা। সকালের চায়ের আসর এবারে ভঙ্গ হবে। প্রসেনজিৎ বললেন, তুমি খুব বদলে গিয়েছ, সুষি!
বাঃ, বদলাব না? সময়ের তো সেটাই কাজ। না বদলালেই বরং খুব চিন্তার বিষয় হত। জ্যান্ত জিনিস, প্রাণ আছে, বদলাব না? বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে গাছটা, ঘাসটা পর্যন্ত বদলে যায়। আর আমি মানুষ, বদলাব না?
আমি তো বদলাইনি।
কে বলল বদলাওনি? ধুতি-পৈতে পরলেই বুঝি মানুষ অপরিবর্তিত থেকে যায়? রিটায়ার করার পরে তুমিও তো অনেক বদলে গেছে। সারাক্ষণ ঘরে বসে বসে তোমার মাথার মধ্যে মর্চে ধরে যাচ্ছে।
আমার স্ত্রী কেবল বাইরে বাইরে ঘুরে লেকচার দিয়ে মিটিংবাজি করে বেড়াচ্ছেন, আর অসুস্থ আমি ঘরে পড়ে আছি; সেই নিয়ে আহ্লাদে নাচছি না বলেই বুঝি আমার মগজে মর্চে ধরেছে? আর ছেলেটাও হয়েছে তেমনি। এই তোমার প্রশ্রয়েই উচ্ছন্নে গেছে। রুগ্ন বাপকে ফেলে ফুর্তি করবে বলে বিদেশে বসে আছে। বউ নিয়ে যত রাজ্যের অনাচারের মধ্যে ডুবে আছে। ইচ্ছে করে আঁটকুঁড়ো হয়ে রইল। বাঁজা বউ আনল ঘরে। আমার চোদ্দোপুরুষকে জল দিলে না। ছেলের দোষ বললেই বলবে মগজে মর্চে।
কেবলই ছেলে-বউয়ের দোষ না ধরে একটু বরং ওদের ভালো দিকটা ভাবো না। তাহলে মনটাও অনেক ভালো থাকত। ভালোও তো ওদের কম নেই? শুধুই লোককে মন্দ ভাবতে হয়? নিজেরই ওতে শরীর খারাপ করে।