…
অ্যাই?-আমি এবার বকব। আচ্ছা, ওই যারা তোকে এত ভক্তি করে, তোর সঙ্গে কাজ করে, সেইসব ছেলেমেয়েগুলো যদি তোকে এখন দেখতে পায়? তারা যে দিদি বলতে শ্রদ্ধায় মুচ্ছো যাচ্ছে, সেই দিদি ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছেন,–দেখলে ওরা কী ভাববে তোকে? বল তো?
…
তুই অনেকটা ওপরে উঠে গেছিস সুষিজামাইবাবুর নাগালের মধ্যে তুই নেই, সেইজন্যেই ওঁর এত রাগ! তুই কিচ্ছু বুঝিস না? ইগনোর করতে শেষ। ইগনোর হিম। ইগনোর হিজ ট্যানট্রামস। সব আপনিই ঠিক হয়ে যাবে।
আদিত্য এগিয়ে এসে স্ত্রীর শূন্য চায়ের কাপটা এক হাতে তুলে নিয়ে, ফোনের দিকে অন্য হাত বাড়িয়ে দেন
আমাকে একটু দেবে? সুরমা রিসিভার হাত বদল করেন। আদিত্য শুরু করেনঃ
কী গো সুষমিবাঈ? ক্যা হুয়া? দিলমে দর্দ? মেরে পাস আ যাও, সব কুছ ঠিকঠাক কর দেগা। ফার্স্ট ক্লাস দাওয়াই হ্যায়। আসবে? নাকি ইগনোর হিম করবে? না এলে আমিও কিন্তু ট্যানট্রামস ছুঁড়ব। আমি তোমার জন্যে কাল বিকেলে। ৫টা-৫ মিনিটে। খিড়কির পুকুরের সামনে। মানকচুপাতা মাথায় দিয়ে। অতি অবশ্যই। নো অন্যথা! সেই কথাই তবে রইল? ওকে? সুরমা ফোন টেনে নেন,–ওদিকে সুষমার হাসির শব্দ পেয়ে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
সেই কথাই রইল সুষি। তোর জামাইবাবু মানকচু বনে তোর পথ চেয়ে বসে থাকবেন। চলে আসিস। ঠিক তো? বিকেল বেলায়।
রিসিভার ক্রেডলে নামিয়ে রেখে সুরমা আদিত্যর দিকে হাসিমুখটি ফেরান। দুই চোখে কৃতজ্ঞতা ছলছল। আদিত্য স্ত্রীর সামনে গরম চায়ের পেয়ালাটি নামিয়ে দিয়ে সহাস্য ভুরু নাচান, ভাবখানা–কী? কেমন বলেছি?
.
সুরমা চিরদিন গম্ভীর, স্বল্পবাক্। আদিত্য তাকে ভালোবেসে, ভয় ভয় করে মেনে চলেছেন। সুষমা যেমন ভীরু, কোমল ছিলেন, কড়াকথা বলতেই পারতেন না, একটুতেই কেঁদে ফেলতেন, কেউ অন্যায় করলে ভয়ে প্রতিবাদ করতেন না, সব অত্যাচার মেনে নিতেন, সুরমা ঠিক তার বিপরীত। নিজে যেটা ভালো বুঝবেন সেটাই করবেন। স্বল্পবা, কিন্তু নির্ভয়ে সত্য বলবেন। প্রিয় হোক, বা না হোক, তা নিয়ে ভাববেন না। গুরুজনকেও রেয়াৎ করবেন না। অথচ ব্যক্তিগত অনুভূতির বেলায় চাপা। অপ্রকাশ। আদিত্যর এই মেয়েকে চিনতে দেরি হয়নি।
শ্রাবস্তী অনেকটাই তার মায়ের স্বভাব পেয়েছে। সোজাসুজি স্পষ্ট কথা বলে দেয়। আদিত্য তো বেশ ভয়ে ভয়ে থাকেন–মেয়ে যে কেরিয়ারে গেছে, সেখানে এই খোলাখুলি স্বভাবচরিত্র বড় ধাক্কা খায়। শ্রাবস্তী আই. এ. এস হয়েছে। এখন সে বীরভূমের এস. ডি. ও। এতটা রূপসী হয়নি সে মা-মাসির মতন, যদিও যথেষ্ট শ্রীময়ী, ব্যক্তিত্বময়ী–বাবার মুখশ্রী, বাবার গড়নই মেয়ে পেয়েছে।
মায়ের রূপটি পুরোপুরি পেয়েছে শিলাদিত্য। কিন্তু স্বভাবটা তার নিজস্ব। সুরমা অবশ্য বলেন মাসির মতো স্বভাব। ভীতু, নরম, কোমলপ্রাণ ছেলে সে ছোট থেকেই। চেহারাটি দেবদূতের মতো। স্বভাবের সঙ্গে মিল আছে। ছোটবেলায় ওকে মেয়ে মনে করত সকলে। এখন লম্বা হয়ে গেছে অনেকখানি, ছফুটের কাছাকাছি। কিন্তু এখনও যেন মেয়েদের মতোই কোমল তার মুখচ্ছবি, ভাবুক, দীর্ঘপ চোখ।
শিলাদিত্য গান গায়। তার মায়ের মতোই সুর আছে তারও ভিতরে। গিটার বাজিয়ে ইংরিজি গান গায় সে। অনেক গান তার নিজেরই লেখা। তানপুরা নিয়ে মায়ের মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়। শিলু কবিতাও লেখে। সেও ইংরিজি ভাষাতে। আদিত্যর তাতে আপত্তি নেই। সর্বভারতীয় পাঠক পাবে; সারা পৃথিবীর পাঠক। ইংরিজিও তো একটা ভারতীয় ভাষাই। লিখলে সারা পৃথিবীর জন্যেই লেখা উচিত। যদি হাতে সে ক্ষমতা থাকে। আজকাল তো ওতেই নামডাক!
সুরমার কিন্তু তাতে মন খুঁত খুঁত। বাঙালি ছেলে বাংলায় কবিতা লিখবে না? কবিতা কখনও অন্যের ভাষাতে লেখা যায় নাকি? প্রাণের ভাষাতে ছাড়া? ইংরিজিটাই যে শিলুর প্রাণের ভাষা, আদিত্যর কাছে সেটা স্পষ্ট, কিন্তু সুরমার এটা মেনে নিতে প্রাণ চায় না। শিলুর বাংলা ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল–চমৎকার বাংলা লিখত ছেলেটা। মা-র কাছে এসে আদর কাড়বার সময়ে তো শিলু ইংরিজি বলে না? দিব্যি পষ্ট বাংলাই বলে। তবে কেন লেখে না?
.
বাঙালি ছেলেমেয়েরা যখন সাহেব বিয়ে করে, তখনও সুরমার ঠিক এই ভাবনা হয়। ওরা ইংরিজিতে প্রেমের কথা বলে কেমন করে? কবিতা লেখাও তো প্রেম করাই।
কিন্তু সুরমার মনের এই কথাগুলি মনেই থাকে। শিলু কি জানে, তার ইংরিজিতে কবিতা লেখাটা মায়ের পছন্দ নয়? বোঝে কি? শিলুও তো চাপা। সেও বলবে না। তার মনের মধ্যে কী কী কথা আছে, সেটা তাকে লক্ষ্য করে বুঝে নিতে হয় সুরমাকে।
শ্রাবস্তী রাশভারী বটে, কিন্তু স্পষ্টবক্তা। শিলাদিত্যর স্পষ্ট নয় কিছুই। যদিও সে। নরম। তার ভাষা ইঙ্গিতের। একটুখানি ধরিয়ে দেবে মাত্র। তোমাকে বাকিটা বুঝে নিতে হবে। আদিত্যর সে ধৈর্য নেই। তিনি চেষ্টাও করেন না। সুরমা চেষ্টা করেন। তবে আগে যতটা করতেন এখন ততটা পারেন না। ছেলে বাইরে বাইরে ঘোরে, দূরে দূরে থাকে, এখন তো শহরেই নেই। দিল্লিতে National School of Drama-তে ভর্তি হয়েছে। অভিনয় শিক্ষা করছে। শিল্পী স্বভাব তার, ছবিও আঁকে। সুন্দর সুন্দর পোস্টার বানায়। তার ইচ্ছে অভিনয় করবার। আদিত্য বাধা দেননি। যদিও এটা তার মনোমতো হয়নি। নিজের মনের ভাষাকে সে মুখে প্রকাশ না করুক, অন্যের মনের ভাষাকে সে প্রাণ দিতে পারবে বলেই শিলাদিত্যর বিশ্বাস।