কিন্তু তাতেও বাদ সাধলেন প্রসেনজিৎ। তোমার ওসব বাইরের কাজ বাইরেই থাকুক, বাড়ির মধ্যে টেনে আনা চলবে না। আজ তোমার আদরের প্রস্টিটুটরা আসবে, কাল তোমার সোহাগের এক্স রুগিরা-ওসব এখানে চলবে না। ভট্টচায্যিবংশের বসতবাটি এটা। তোমার বোধহয় মনে নেই।
সত্যি, মনে ছিল না সুষমার। আটত্রিশ বছর হয়ে গেছে তাঁর এই বাড়িতে। এ বাড়ি প্রসেনজিতের। তার অনুমতি বিনা সুষমা এটা ব্যবহার করতে পারেন না। ঝকঝকে। ফার্নিশড। তিন তিনটে ঘর। এমন ভালো রাস্তায়। সাজানো।
তবে ভাড়া দিয়ে দাও কোনো নতুন ডাক্তারকে?
পাগল? ভাড়া দিই আর সে এখানে মৌরসী পাট্টা গেড়ে বসুক? ভাড়াটেই তো এযুগে মালিক। কেন, তোমার কি ভাত জুটছে না যে ঘরের মধ্যে ভাড়াটে ঢোকাতে চাইছো? তারপর একটু হেসে, নাকি এই বুড়ো ডাক্তারটাকে আর মনে ধরছে না–একটা ছোকরা ডাক্তারের দরকার হয়ে পড়েছে এই বাড়িতে?
চুপ করে যান সুষমা।
এই চিমটি কাটা কথাগুলো তিনি শুনছেন বহুকাল। সেই সতেরো বছরের মেয়ে এ বাড়িতে এসেছিলেন। প্রসেনজিৎ সদ্য এম. বি. বি. এস. করে এম. ডি. করছেন। সাতাশ বছরের ব্রিলিয়ান্ট যুবক–মহেন্দ্ৰনিন্দিত কান্তি, রাজেন্দ্রদর্শন। এমন সুপুরুষ কিশোরী সুষমা তার জীবনে আর দেখেননি।
মা-হারা মেয়ে দুটিকে বুকে করেই মানুষ করেছিলেন রাজশেখরবাবু যদিও তাকেও সরকারি চাকরিতে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। বাইরে বাইরেই মানুষ সুরমা আর সুষমা। যমজ বোন, কিন্তু অবিকল একরকম দেখতে নয়। মুখ-চোখ-চুল গড়ন সব এক–শুধু সুষমার রংটি দুধে-আলতায় ধোয়া, আর সুরমা শুধু গৌরী।
কচি মেয়ে দুটিকে ফেলে ওদের মা চলে গেলেন কদিনের জ্বরে। মফস্সল টাউনে ঠিকমতো চিকিৎসা হয়নি। ওরা তখন পাঁচ বছরের। রাজশেখরবাবু মেয়েদের মানুষ করায় কোনো অবহেলা করেননি। মা-বাপের যত্ন-স্নেহ একাই উজাড় করে দেবার চেষ্টা করেছেন। বদলিতে ঘুরে বেড়ানোর চাকরি বলে আত্মীয়-স্বজনের বলটাও ছিল না হাতের কাছে। যদিও তাঁর দিদি বলেছিলেন মেয়েদের তার কাছে জলপাইগুড়িতে রেখে মানুষ করতে। রাজশেখরের শ্বশুর-শাশুড়িও তখন বেঁচে। তারাও চেয়েছিলেন নাতনিদের ভার নিতে। কিন্তু সন্তান-অন্ত প্রাণ পিতা তিনি নিজেই কিছুতেই ছাড়তে পারেননি ছোট ছোট মেয়েদের।
অবশ্য সুষমা-সুরমা মানুষ হয়েছেন ভালোই–বাবার আদরে-আহ্লাদে নষ্ট হয়ে যাননি। বরং ছোটবেলা থেকেই তারা একই সঙ্গে লেখাপড়া, ঘরকন্নার কাজ শিখেছেন। নিজেদের ভার যেমন নিজেরা নিতে শিখেছেন, তেমনি বাবার দায়িত্বও ভালোবেসে অনায়াসে বহন করেছেন দুই বালিকাতে।
দেখেশুনেই বিয়ে দিয়েছিলেন রাজশেখর। প্রথম যে ভালো সম্বন্ধটি এল, দুই রূপসী মেয়েকেই দেখালেন; বড়লোকের ডাক্তারছেলের সঙ্গে বেশি ফর্সা মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। একটু কম ফর্সা বলে সুরমার বিয়ে হল তার পরের বছর। পাত্র অধ্যাপক। দুই বোনই বিয়ে হয়ে কলকাতাতে সংসার পাততে এলেন। বাবা দূরে থাকলেও ভাগ্যগুণে বোনেরা রইলেন কাছাকাছির মধ্যেই। এখনও আছেন। এটা তাদের মস্ত জোর।
দিদি একটু দেখে নামবেন, এখানটায় একটু কাদা রয়েছে–
মিতালির সতর্কবাণীতে সুষমার খেয়াল হয়। এসে গেছেন সভাগৃহে। ঘড়ি দেখলেন। এখনও দশ মিনিট সময় আছে। তার মধ্যে অ্যাজেনডাটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে হবে। ডাঃ, রাওয়ের প্রতিবেদনটি তো এসে পৌঁছল না, অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
.
তৃতীয় অধ্যায়। কচুপাতার টুপি
সুষমার ফোন এসেছিল। তুমি কি থাকবে কাল বিকেলে?
চা ঢালতে ঢালতে সুরমা মুখ তুলে তাকান স্বামীর দিকে
কেন? সুষি আসবে বলল?
বোধহয়। তুমি একটু জেনে নাও। মনটন ভালো মনে হল না।
চিড়েভাজার প্লেট এগিয়ে দিয়ে সুরমা বলেন,
মন ভালো থাকবে কেমন করে? জামাইবাবু যা কাণ্ডকারখানা শুরু করেছেন, সুষির কাজকর্ম সব বন্ধ করে দেবার জোগাড়। সত্যি সত্যিই যদি কোনোদিন, ভগবান না করুন–উনি যদি কখনো কোনো রোগে পড়েই যান–তখনই যে কী করবেন!
তখন প্রসেনজিৎ যাই বলুক, সুষমা বেচারি যে কী করবে! সত্যি মেয়েটার ভাগ্য বটে! কপাল করে এসেছে একখানা!
মানুষ যা যা চায় সুষির কপালে সবই তো জুটেছিল। বাবা তো দেখেশুনেই বিয়ে দিয়েছিলেন। যদি আমি ওর মতন দুধে-আলতায় গোলা হতুম–তাহলে আজ প্রসেনজিতের ঘরে হয়তো আমিই থাকতুম।
ভাগ্যিস! দুধে-আলতায় নয়, আমে-দুধে গোলা রূপসী তুমি! অবশ্য প্রসেনজিতের ঘর করার সুযোগ তোমার চাইলে এখনো হতে পারে। প্রসেনজিতের যা আত্মগত তুরীয় অবস্থা, সে এখন আর সুরো-সুষির মধ্যে তফাত করতে পারবে না। যমজ কন্যা বলে কথা। দুজনেই তন্বী, গৌরী; সুন্দরী, হৃদয়বিদারিনী
হয়েছে হয়েছে। চুপ করো। এদিকে বলছ ওর মনটন ভালো নেই—
কিন্তু আমার মনটন ভালো নেই তো বলিনি-আদিত্য সুরমার হাতটা জড়িয়ে ধরেন।
খালি ঠাট্টা!
আস্তে হাতটা টেনে ছাড়িয়ে নেন সুরমা। আদিত্য হাসতে হাসতে চিড়েভাজা মুখে দেন। তারপর বলেন,
কিন্তু কেন বললে সুষমার কপালে সবই জুটেছিল? সবই মানে কী?
মানে, মেয়ের বিয়ে দেবার সময় বাপ-মায়ে কী কী খোঁজে? সেই সব।
যেমন?
যেমন ধরো, বংশ। তা কোন্নগরের ভট্টাচায্যি। আর কী চাই? জমিদার বংশ, তায় পণ্ডিত। তারপর, শিক্ষা। শ্বশুর ইঞ্জিনিয়ার। পাত্র ডাক্তার। এম. ডি. করছে। আর কী চাও? তিন–স্বাস্থ্য। অটুট যৌবন। ছফুট দুইঞ্চি হাইট। মনের ভেতরটা তো দেখা যায়নি? চার, রূপ–অনিন্দ্যসুন্দর, রূপবান পুরুষ। এত সুন্দর পুরুষ আমি তো আর দেখিনি সুষির বিয়ের আগে!