কি সুরমা চা হল? এইটে কীরকম হয়েছে দেখে যাও। নিউ, ইমন্ড অ্যান্ড অ্যাব্রিজড় ভার্শন!
কাগজটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দেন আদিত্য।
.
দ্বিতীয় অধ্যায়। যেতে নাহি দিব
সুষি, প্লিজ এখন বেরিয়ো না, আমার আজ মাথাটা ভীষণ ধরে আছে।
সুষমার ভুরুটা কুঁচকে উঠল। কপালে টিপটা এঁটে নিয়ে ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক লাগাতে থাকেন। লিপস্টিক লাগিয়ে ঠোঁট দুটো টিপে ঘষে নেন। চশমাটা পরে ভালো করে এদিক-ওদিক থেকে মুখটা দেখে নেন, তারপর আরেকবার সরু চিরুনিটা চালান সরু সিঁথির দু-পাশে। নিজের নুনমরিচ ছড়ানো চুলটা দেখতে বেশ লাগে আজকাল। চিরুনিতে সিঁদুর নিয়ে সিঁথিতে টানছেন। প্রসেনজিৎ আবার বলে ওঠেন, কথা বলছি, শুনছ না? বেরিয়ো না। আমার মাথা ধরেছে। সুষি প্লিজ। চশমার ওপাশ দিয়ে তাকালেন সুষমা। প্রসেনজিৎ শুয়ে আছেন তাকিয়া ঠেস দিয়ে। বিশাল মেহগনি কাঠের পালঙ্ক। প্রসেনজিতের হাতে জরিজড়ানো গড়গড়ার নল থাকলে খুব মানাত। কিন্তু ওর কোনো নেশা নেই, শুধু পান। মাঝে সিঁথি। চুল একটু পাতলা হয়ে এসেছে। কিন্তু গোঁফটা খুব ঘন। প্রতাপবান। চুল অনেকটাই সাদা, কিন্তু এখনো বেশ কিছু কালো চুল রয়েছে পেছন দিকটায়। গোঁফ কিন্তু অনেকদিনই পুরো সাদা। আগে আগে কত যত্ন করে কলপ লাগাতেন প্রসেনজিৎ। এখন ছেড়ে দিয়েছেন। প্রসেনজিতের পাশের খাটের ওপরে চারখানা খবরের কাগজ, দুটো ইংরিজি, দুটো বাংলা। আরও একটা। বাংলা কাগজ আসে। সেটা এখনও নীচে।
মাথা ধরল কেন? পেটটা পরিষ্কার আছে তো? ইসবগুল খেয়েছিলে?
তারপরেই ডাক, মণির মা! মণির মা!
থাক, আর ওকে ডাকতে হবে না। কিন্তু মণির মা এসে গেছে।–দাদাবাবুকে কি ইসবগুলের শরবৎ দিয়েছিলে?
কেন? দোবো না কেন?
ও আবার কি? বলো, হ্যাঁ দিয়েছি।
চা দিইচি, জলখাবার দিইচি, ফল দিইচি, বেলের পানা দিয়েছি, ইশগ্লুল দিইচি, সেই সক্কাল থেকেই তো দাদাবাবুর চলতেচে!
বাঃ, কথার কি ছিরি! আশ্চর্য! যাও নিজের কাজে যাও এবার। বড়ো বুড়ো হয়ে গেছ সত্যি!
কাজই তো কচ্ছিলুম। তুমি ডেকে আনলে তাই। বুড়ো হব না তো কি হুঁড়ি হব? বলি বয়সটা কত হল, সে খেয়াল আচে?
কী কাজ কচ্ছিলে?
পান সাজতিচি।
সাজো গে যাও। ভালো করে ধুয়ে নিয়েছ তো পটাশ পারমাঙ্গানেট দিয়ে?
ওই বেগনে ওষুধে তো? হ্যাঁ গো হ্যাঁ।
মণির মা চলে যেতেই প্রসেনজিৎ বললেন, পটাশিয়ান পারমাঙ্গানেটে বিশ্রি আঁশটে গন্ধ করে। ওতে কেন পান ধোও?
এবার সুষমা হেসে ফেলেন।
তুমি তো জর্দার সুগন্ধেই সব কুগন্ধ ঢেকে নেবে। কঁচা কাঁচা পাতাগুলো যে খাবে কে জানে কী বীজাণু আছে? তার ওপর পেস্টিসাইড থাকতে পারে। সতর্ক হওয়া ভালো। স্যালাড আর পানের বেলায় বিশেষ করে। তুমিই তো আমাকে এটা শিখিয়েছ! নিজে ডাক্তার–আর আমাকে জিগ্যেস করছ?
ব্যাগটা তুলে নিয়ে সুষমা কব্জির দিকে তাকান। তারপর দেওয়ালঘড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে প্রসেনজিতের চোখও যায় সামনে দেওয়ালঘড়িতে। তিনি বলে ওঠেন, এত করে বলছি, যেও না। তবু যাচ্ছ? বলছি মাথাটা ধরেছে, একটু বোসো না বাবা মাথার কাছটায়। তোমার বাইরে এত কী কাজ?
কী করে বসি বল তো? আজকে যে অ্যাডভাইজারি কমিটির মিটিং ঠিক এগারোটার সময়। তুমি ততক্ষণ চানটা সেরে নাও। লাঞ্চের পর বরং আমি আর থাকব না। বাড়িতে চলে আসব। কেমন?
সুষমার গলা কিঞ্চিত বিপন্ন।
গাড়ি নিয়ে যাচ্ছ?
নাঃ। ওরা গাড়ি পাঠাবে।
বলতে বলতেই গেটে বেল বেজে ওঠে। ওই এসে গেল তোমার জয়রথ।
জয়রথই বটে! সুষমা ব্যাগটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে যান।
বাচ্চু! রঘু! মণির মা! কে আছিস?
বাচ্চু, রঘু, মণির মা তিনজনেই এসে পড়ে প্রসেনজিতের হুঙ্কারে।
টাইগার বামটা কোথায়? মালিশ করে দে মাথাতে একটু
বাচ্চু, মণির মা, রঘু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপর বাচ্চু যায় টাইগার বাম আনতে ড্রয়ারের দিকে। বাকি দুজন পালায়। পড়ার চশমা পরে নিয়ে প্রসেনজিৎ একটা কাগজ তুলে ধরেন চোখের সামনে। বাচ্চু টাইগার বামের ডিবে হাতে করে এসে দাঁড়াল। বাবু চশমা না খুললে কপালে মালিশ করবে কী করে? কিন্তু কথাটা বলবেই বা কী করে! মলমের কৌটো বাচ্চুর মুঠোয়। বাচ্চু দাঁড়িয়েই থাকে। প্রসেনজিৎ কাগজ পড়েন। কান খাড়া থাকে, কখন নীচে গাড়ি স্টার্ট করার শব্দ হবে।
.
এই যে মিতালি। ওদিকের সবাই এসে গেছেন?
ব্যাঙ্গালোরের প্লেন লেট দিদি। ডঃ এস. বি রাও এসে পৌঁছতে পারেননি এখনও। বাকিরা এসে গেছেন।
গাড়িতে পা দিতে দিতে সুষমা জিগ্যেস করেন, গেস্টহাউসে ওদের কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো? এই নতুন গেস্টহাউসটা তো এবারই প্রথম ট্রাই করলাম আমরা।
না, না, এখানে সবকিছুই সুবিধের দিদি–একটাই শুধু মুশকিল, বাড়ির সামনের রাস্তায় বড্ড জল জমে যায়। কালকের বৃষ্টিতে বেশ জল দাঁড়িয়ে গেছে। তবে ওদের অসুবিধে হয়নি, টাটা সুমোটা গেছে তো–বেশ উঁচু আছে।
মিতালির বাকি কথাগুলো সুষমার আর কান আসছে না। প্রসেনজিৎ প্রচণ্ড গোলমাল বাধিয়েছেন রিটায়ার করার পর থেকে। বাড়িতে বসে বসে টি. ভি. দেখে, আর কাগজ পড়ে সময় কাটাচ্ছেন। কিছুতেই চেম্বারে বসবেন না। এতদিনের দীর্ঘ ডাক্তারির অভ্যাস ছিল। প্র্যাকটিস করলে সময় কাটে, ব্যস্ত থাকেন। মাথাটাও একটু পরিষ্কার থাকে। আর সুষমাও বাঁচেন। কিন্তু প্রসেনজিৎ প্র্যাকটিস করবেন না। রিটায়ার করবার আগেই সুষমা যত্ন করে নীচের তলায় তিনটে ঘর জুড়ে চমৎকার চেম্বার সাজিয়ে দিয়েছিলেন। সেসব কোনো কাজে লাগেনি। শূন্য পড়ে আছে। সমস্ত পরিশ্রম জলে গেল এবং খরচাপাতিও কম হয়নি। তাই সুষমা ভাবলেন ওঁদেন সংগঠনের কাজে লাগাবেন জায়গাটা। একটা ডাক্তারি পরীক্ষার কেন্দ্র খোলা যেতে পারে। বালিকা সুরক্ষা সমিতি ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সংঘ থেকে ক্রমশ সুষমার কাজে এসে পড়েছে যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য নিয়ে জাতীয় এড়স নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যেও। কত জরুরি কাজে যে লাগানো যেতে পারে এই সাজানো ঘর কটিকে।