সুরমা চেয়ারের পিঠ ছেড়ে একটু সরে দাঁড়ান। ভুরু কুঁচকে যায়। চোখে পড়বে না? ইংরিজিতে বলতে হবে? কী ভাষায় এই বেদনার কথা বলা যাবে ইংরিজি কাগজে? সুরমা দ্বিতীয় খসড়াটি হাতে তুলে নিলেন।
শিলুবাবা,
যেখানেই থাক ঈশ্বরকৃপায় আশা করি ভালো আছ। বুড়ো বাবা-মায়ের ওপরে রাগ করে দূরে থাকতে নাই। বাড়ি ফিরে এস। তোমার দিদি তোমাকে কত ভালোবাসে তা কি তুমি জান না? দিদির মন খুব খারাপ। তুমি আমাদের প্রাণ। এ বাড়ি তোমাদের দুজনেরই নিজের ঘর। এবং লিসারও। খুকু এখন বীরভূমে। তুমি যে আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান, একথা ভুলো না। আমরা তোমার ও লিসার পথ চেয়ে বসে রয়েছি। আমাদের কথা ভেবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে এসো। টাকা লাগলে জানাও।
—শুভার্থী মা, বাবা।
মা-বাবাই তো? নাকি সুরমা-আদিত্য লিখব? বউমা না লিখে লিসাই বললাম।
ভালো করেছ। কিন্তু ইংরিজি কাগজে তো এটা দেওয়া যাবে না!
নাঃ। ইংরিজিতে নোটিশ লিখতে হবে।
নোটিশ?
না, মানে এইরকম চিঠি। আদিত্য কিঞ্চিত অপ্রস্তুত।
ইংরিজি বললেই কেমন যেন নোটিশ নোটিশ মনে হয়না গো? সুরমা হেসে ফেলেন। আদিত্য মুগ্ধ হয়ে দেখেন। তারপর কলম কামড়ে আবার ভাবনা শুরু। এবার ইংরিজিতে।
সুরমা জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ান। আশ্চর্য একটা সময়। ঘোর বর্ষা নেমেছে। অথচ কৃষ্ণচূড়া গাছটা ফুলে ফুলে ভরা। গাছের তলার রাস্তাটা ভিজে লাল ফুলে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। এখন আদিত্যকে তাহলে ইংরিজিতে লিখতে হবে পথ চেয়ে আছি–লিখতে হবে–বুড়ো বাবা-মায়ের ওপর রাগ করে দূরে থাকতে নেই। প্রাণাধিক-এর ইংরিজি কী হবে? নাঃ, ইংরিজিতে মনের কথা কিছুই বলা যাবে না শিলুকে। কেবল বিজ্ঞাপনই দেওয়া যাবে। ওই যে বললেন, নোটিশ। সেটুকুই হবে। সুরমা দীর্ঘনিঃশ্বাসটা চাপতে পারলেন না। শিলুবাবা, ফিরে আয়–এর ইংরিজি কী?
.
আদিত্য বললেন, নাও, পড়ো।
তুমিই পড়ে শোনাও না।
শোনাব? পড়ছি তাহলে। শোনো।
আদিত্য একটু গলা ঝেড়ে নিয়ে শুরু করলেন
Shilu, dearest,
Please come back, we are missing you every moment. There is no reason for Lisa to feel unwanted here in your own home. Do not misunderstand Didi, she loves you, you know it in your bones, She is posted in Birbhum, and is missing you terribly. Please excuse her if she has hurt your feelings. We all make mistakes, but never doubt our intentions. Please forgive us and come home. Lets know if you need money.
—Ma, Baba
বেশি বড় হয়ে গেল। না গো? এটা ঠিক আছে? আসলে আমি
উদ্বিগ্ন, অনিশ্চিত গলায় কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যান। কাগজ নামিয়ে রেখে মাথা তুলে সুরমার মুখে প্রশ্নভরা চোখ রাখেন আদিত্য। অনেকবার কেটেকুটে এই খসড়াটা প্রস্তুত করেছেন। সুরমা ঘরের উল্টোদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে মোড়া পেতে বসে জানলা দিয়ে বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে শুনছেন।
হয়েছে?
সুরমা হাসি হাসি চোখে তাকালেন।
বেশ হয়েছে। শেষটাতে দুটো কথা যোগ করা যায়?
কেন যাবে না, কি লিখব বলো?
ওই If you need money-র পরে বরং লেখো, We are counting days for your return, আরও লেখো, Love and blessings,, ওই সবশেষে ঠিক মা-বাবার আগে।
সত্যি সুরমা। তুমি না হলে হয়? এই সুন্দর টাটা মায়ের হাতের না হলে হত কখনো? বাবাদের বড় কাঠখোট্টা, কেজো ভাষা!
মোটেই কাঠখোট্টা কেজো ভাষা হয়নি ওটার। হৃদ্প্লাবন বইয়ে না দিলেই বুঝি কাঠখোট্টা? আসলে ইংরিজি ভাষার গুণেই আমাদের আবেগকে সংযত ভদ্র করে দেয়। বাংলা, ঠিক তার উলটোটি। আহ্লাদে গদগদ ভাষা!
সুরমা উঠে পড়লেন।
কোথায় চললে?
রান্নাঘরে, রুটি করতে।
তার আগে একটু চা হবে না?
অতি অবশ্যই। কিন্তু এখন কটা বেজেছে?
চা খাবার ঢের সময় আছে। ডিনার খেতে এখন অনেক দেরি।
কোথায় কোথায় পাঠাবে চিঠিটা?
দেখি। ওই যে নামগুলো বললুম? আগে এটা টাইপ করতে হবে, তারপর আট-দশটা কপি করে প্রত্যেকটা কাগজের ঠিকানায় পাঠাতে হবে।
ও বাবা! একসঙ্গে আট-দশটা? সে অনেক খরচার ব্যাপার! একেই এত বড় সুদীর্ঘ চিঠি! একটু ছোট করো।
তাহলে কী সাজেস্ট করছ?
ওই তো। এক এক সপ্তাহে বরং এক একটা কাগজে দিয়ে দ্যাখো।
ওতে চোখে পড়বে না। ও যে কোন কাগজটা দেখবে–মাত্র একবারই বেরুলে, ব্যস–
শুধু রবিবারে রবিবারে বিজ্ঞাপনটা দিও। প্রতি রবিবারে, বিভিন্ন কাগজে বেরুতে থাকুক। একবার না একবার নজরে পড়বেই। প্রত্যেক সপ্তাহে ধরেই রাখো, শিলুর জন্য এই একটা বড় খরচ। কী বলো?
মন্দ বলোনি। রোববার রোববার। চিঠিটাকে বরং সংক্ষিপ্ত করা যাক। সংখ্যায় বেশিবার বেরুনোটা তার চেয়ে জরুরি।
তা ঠিক।
সুরমা রান্নাঘরে চলে গেলেন। আদিত্য আবার নতুন করে ঝুঁকে পড়লেন প্যাডের ওপরে। আরেকটা খসড়া চাই। ছোট চিঠি। কোন লাইনগুলো অতিরিক্ত? কোন কথাগুলো না বললেও চলবে? কী কী না বললেই নয়? Shilu, dearest; নাঃ–ঠিক শোনাচ্ছে না।
Shilu Baba,
We are sorry, Please come bask home and try to excuse our faults. We are getting old and silly but we love you, Didi is missing you terribly, She is posted in Birbhum. Please bring Lisa, this is her home as well. Let us know if you need money. Countings days, waiting for you, with love as ever, Ma & Baba.