গ্যাপের কাজকর্মের খবর আমরাও জানি। তুমি যে ওদের সাহায্য পেয়েছ মোনালিসার জন্যে, এটা খুবই ভালো খবর। গুজরাতের অবস্থা দ্যাখো, আর এখানে, আমাদের পশ্চিমবঙ্গে? এইডস হয়েছে শুনেই রুগিকে পরিত্যাগ করে তার মা-বাবা-স্ত্রী নিঃশব্দে পালিয়ে গিয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স থেকেও তাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে, ছোঁয়াচের ভয়ে। সে কি বাঁচে? আরেকজন এইডস রুগিকে হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, জমাদার, কেউই অ্যাটেন্ড করেনি। দিনের পর দিন! সেও মারা গেছে। মেডিক্যাল প্রোফেশনেও এতদূর জ্ঞানের অভাব। বর্ধমানের একজন রুগির কখনো ভবিষ্যতে এইডস হতেও পারে, যেহেতু তার রক্তে এইচ আই ভি পজিটিভ বেরিয়েছে–এই কারণে গ্রামের লোক রাত্রিবেলায় তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। নেবানো না গেলে, পরিবারসুদ্ধ পুড়ে মরত। এই সবই বাস্তব ঘটনা। fact!
পশ্চিমবঙ্গের মতো উদারপন্থী, মুক্তমনা, আধুনিক, প্রগতিবাদী রাজ্যের এই অবস্থা! সচেতনতা সৃষ্টির কাজ কিছুই ছড়ায়নি। এই নিষ্ঠুরতা, অমানুষিকতা সবই অযৌক্তিক মৃত্যুভয়, এবং চরম অজ্ঞতাপ্রসূত। অতএব শিলুবুড়ো, বুঝতেই পারছ, এই রাজ্যেই তোমার আমার প্রচুর দায়িত্ব, প্রচুর কাজ রয়েছে। চিরদিন ওখানেই থেকে তুমি কী করবে? ওখানে তো তবু কাজ হচ্ছে। কর্মী আছে। শিলুবাবু, এখানেই তোমার অনেক জরুরি কাজ পড়ে আছে–you are badly needed here! তুমি যে সেবার কাজে এখন নিযুক্ত রয়েছ, সেই কাজেই তোমার সম্পূর্ণ মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তোমার মনের অবস্থাও বুঝতে পারছি। তোমাদের ভালো হোক, মোনালিসার যন্ত্রণা লাঘব হোক, এই প্রার্থনা করি। এ-রোগে শেষদিকে বড় কষ্ট।
আমার বালিকা সুরক্ষা আশ্রম আর মহিলা নির্যাতন প্রতিরোধ সংঘের বিষয়ে তো জানতেই। এখন আমি সোনাগাছিতে এইডস নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতির সঙ্গে কাজ করছি। এবং জাতীয় এইডস নিয়ন্ত্রণ সমিতি-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতির দায়িত্বে আছি। তুমি এলে আমি অনেক বেশি জোর পাব।
তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, তোমার মা একটা গান খুব গাইতে ভালোবাসেন–আমারও গানটি প্রায়ই মনে পড়ে–অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো/সেই তো তোমার আলো– শিলুবুড়ো, অন্ধকারকে ভয় পেতে নেই–
সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো/সেই তো তোমার ভালো– সেই ভালোটার খোঁজেই ছুটছি আমি, তুই, আমরা সবাই।–এখানে এসে আমাদের সঙ্গে হাত মেলাও।
শুভরা এই গ্রীষ্মে আসছে। ওরা কাজ করতে ব্রাজিল যাবে তার পরে। ওর সঙ্গে তোমার career possibilities discuss করো। ওরা অনেকরকম খবর রাখে।
অনেক আদর নাও। Welcome back! লিসাকে, তোমাকে প্রাণঢালা আশীর্বাদ ইতি।
তোমার সৎসাহসে মুগ্ধ,
মামণি
পুনশ্চ : তোমাকে যেসব ভয়াবহ গল্প বললাম, এইডস রোগীর পরিবারকে একঘরে করার বিষয়ে, তাতে ভয় পেয়ে যেন আমাদের অস্বস্তির কথা ভেবে বাড়ি ফিরতে দ্বিধা কোরো না। তোমার পরিবারকে একটা সুযোগ দাও। এই সর্বনেশে সামাজিক অজ্ঞতা ও অমানবিকতার স্পষ্ট বিরোধিতা করতে, পথনির্দেশ দিতে আমাদের সুযোগ করে দাও।
.
চিঠিঃ তিন
১৭ জানুয়ারি ১৯৯৯
সল্টলেক রায়বাড়ি
শিলুবাবা,
তোমার গলাটি এতদিন পরে চিঠির মধ্যে দিয়ে ভেসে এসে আমাদের প্রাণ ভরিয়ে দিয়েছে। এতদিন কেন চুপ করে ছিলে? তোমার মা খুব ভেঙে পড়েছিলেন ভেতরে ভেতরে। অসুস্থ হলে মাকে জানাবে না, বাবাকে জানাবে না, এটা তোমার কীরকম বুদ্ধি, শিলুবাবা? তোমার বন্ধুকে তুমি প্রাণ ঢেলে সেবা করছ, শুনে আমরা তোমাকে নিয়ে গর্বিত। এমন হৃদয়বান সন্তান পাওয়া ভাগ্যের কথা। ঈশ্বর তোমাকে আরও ভালোবাসার শক্তি দিন। এর চেয়ে বড় শক্তি পৃথিবীতে আর কিছু নেই। তবে জীবন বড় জটিল–তাই এই ভালোবাসাই, যা কিনা সৃষ্টির মূলে, আবার অনাসৃষ্টিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায় কখনও কখনও।
তোমার চিঠি পেয়ে যেমন আনন্দ হল, বলা নিষ্প্রয়োজন, তেমনিই মন গভীরভাবে বিষণ্ণ হয়েছে। তোমার জন্য। তোমার বন্ধু মোনালিসার জন্যে। তোমাদের পুরে প্রজন্মের জন্যে। এবং আমাদের নিজেদের সংবেদনের অভাবের জন্যেও। কিছুই তো বুঝিনি। তাকে তুমি নিয়ে এসেছিলে স্নেহমমতার স্পর্শ দিয়ে রক্ষা করবে বলে, অথচ আমরা ওকে ঠিকমতো অভ্যর্থনাই দিইনি। সেও মনে মনে হয়তো আমাদের গ্রহণ করতে পারেনি। সেজন্য সুরো, এমনকী খুকুর সঙ্গেও তার ভাব হল না। আমরাও সেদিকে গা করিনি, লিসাকে আমাদের তেমন ভালো লাগছিল না। ওরকম মেয়ে আগে তো দেখিনি? নিজের পরিবারে যে নিরাপত্তা সে পায়নি, তুমি চেয়েছিলে সেই অমৃতের স্বাদ তার সঙ্গে ভাগ করে নিতে। কাযর্ত হয়ে গেল বিপরীত। সে তো ভিতরে এলই না, তোমাকেও বের করে নিল তোমার নিরাপত্তার বেষ্টনি থেকে, স্নেহের সুরক্ষার আড়াল থেকে। আমরা তাকে সামান্য আত্মবিশ্বাসটুকু দিতে বিফল হয়েছি, শুধুই বোঝার ভুলে।
আমাদের সারাটা জীবনই এইরকম ভুলে ভরা। মানুষ চায় একরকম আর জীবন তার হাতে তুলে দেয় অন্য এক পাওয়া। এই তো দ্যাখো না, দোষ তো কারুরই ছিল না, অথচ সব কিছুই ভুলভাল হয়ে গেল। ঈশ্বরের কাছে মোনালিসার আরোগ্য প্রার্থনা করি। কত মির্যা ও তো এই পৃথিবীতেই হয়েছে। এইডস্ রিসার্চ যেভাবে চলছে তাতে আমার দৃঢ় ভরসা, নতুন সহস্রাব্দের আগেই এইডস্-এর ওষুধ বের করে ফেলব আমরা। প্রতিষেধক, এবং নিরাময়ের ওষুধ, দুই-ই। আমার বিশ্বাস দুহাজার এক দুটি অমূল্য উপহার হাতে করে উপস্থিত হবে। ক্যানসার-কিওর, আর এইডস্-কিওর।