ওকে নিয়ে আমেদাবাদে এসেছি। এখানে গ্যাপ (GAAP) নামে গুজরাত এইডস অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম হয়েছে, তারা চমৎকার কাজ করছে। ওরাই লিসার শুশ্রূষার, চিকিৎসার সুব্যবস্থা করে দিয়েছে। চণ্ডীগড়ে ওর বাবাকে বারবার খবর দিয়েছি। উনি চেক পাঠিয়ে দিয়েছেন। দেখতে আম্মু সেননি। নিষ্ঠুরতার, নির্মমতার এমন নগ্ন চেহারা আমি এর আগে দেখিনি। দিল্লির বন্ধুরাও যখন লিসার অসুস্থতার কারণ শুনল, কেউই আর ধারে কাছে রইল না। অথচ ওর বাড়িটা ভর্তি হয়ে থাকত শুধু লিসার বন্ধুর দঙ্গলে। শুধু আমার বন্ধু অনিন্দ্য দুবার এসেছে মুম্বাই থেকে। শুধু অনিই যোগাযোগ রাখে। লিসার পাশে পাশে আমি রয়েছি এই ছমাস। এই অসুখে ছমাস সময় যে কত দ্রুত কেটে যায়! ওকে দেখলে তুমি আর চিনতে পারবে না মা। ওর ওজন এখন আটাশ কেজি। লিসার শুশ্রূষার জন্যে ভাবনা কোরো না, মোনালিসা যতদিন বাঁচবে, ওর পাশে আমি থাকব।
গত পরশু লিসার মা এসেছেন। বারো-তেরো বছর পরে মা-মেয়েতে দেখা–এই প্রথম, এই শেষ। এই দেখাটুকুই যদি আরও ছসাত বছর আগে হত! মাগো, অহংকার অভিমান, লজ্জা, সংকোচ, ভয়–কত রকমের মিথ্যের পাঁচিল তুলেই আমরা নিজেদের ক্রমশ নিঃসঙ্গ করে ফেলি! ফুরিয়ে ফেলি। ওর মাকে দেখেছি। তাই সাহস করে আজ এই চিঠি। নিউমোনিয়া হয়েছে লিসার। এই অসুখের মধ্যে নিউমোনিয়া হলে, তার কোনো চিকিৎসা নেই। শেষ সম্বল শুধু ভালোবাসা। সেইটে দেবার জন্যেই আমারও এইখানে থেকে যাওয়া। একটাই তো জীবন? একদিন ছেড়ে যেতেই হবে এই মাটি; তার আগে যতগুলি জীবনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি, ততই আমি ভাগ্যবান।
আমি আমেদাবাদেই থাকব। এন.এস.ডি. তে তো আর ফেরা হবে না। এখানে অনেক দুঃখী মানুষ মা। এই গ্যাপ প্রতিষ্ঠানটিতেই আমি স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছি। এদের সকলের আমাকে দরকার আছে।
আর আমারও একদিন এদের দরকার হবে, মা। ইলাইজা টেস্টে আমিও হয়েছি এইচ.আই.ভি. পজিটিভ। হ্যাঁ। এই একই ভবিষ্যৎ আমার জন্যেও অপেক্ষা করে আছে। যদিও এখন ঠিক আছি। যা বলছি মা, সব সত্যি কথা–তোমাকে নির্ভার করতে, সত্যিই বলা উচিত। ভয় পেও না মা। শক্ত হও। কালই তো গাড়ি চাপা পড়ে মারা যেতে পারে একজন বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলেও। জগতে কেউই চিরঞ্জীবী হতে আসিনি। তুমি একা নও মা। পৃথিবী জুড়ে আরও অনেক ছেলেমেয়ের মায়ের তোমারই মতো মর্মান্তিক অবস্থা, মনে রেখো। এই অসুখের সংক্রমণ অতি সীমিত। তাই সাবধান থাকাও সহজ। ত্রুটি আমারই। অসতর্কতা। একটি মাত্র মুহূর্তের বিভ্রমও চিরদিনের মতো বদলে নিয়ে যায় আমাদের জীবন। এই ইঞ্জেকশনের ছুঁচ যে কতজনের যমদণ্ড হয়েছে।
মাগো, আমার কিন্তু শরীরটরির সব স্বাভাবিক। অসুস্থতার কোনো লক্ষণ নেই। শুধু মোনালিসার সঙ্গে থাকি বলেই আমারও রুটিন ইলাইজা টেস্ট করিয়েছিলেন ডাক্তার মহিলাটি। তাই ধরা পড়ল। এমনিতে আমি কর্মক্ষম, সুস্থ আছি। রোগের বীজাণু এখনও সক্রিয় হয়নি। নাও তো হতে পারে? সর্বদা হয় না কিন্তু!
দিদি যেন লিসার ওপরে রাগ করে না। ও খুব অন্যায় করেছে ঠিকই, দিদি ঠিক-ঠিকই ভয়গুলো পেয়েছিল। কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে। দিদিকে বোলো, এই সময় কারুর ওপরে রাগ পুষে রাখতে নেই, ক্ষমা করে দিতে হয়। এমনকী লিসাকেও। দোষ তো আমারও। কেউ তো আমাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নেশা ধরিয়ে দেয়নি। আমারও বুদ্ধির ভুল হয়েছিল মা। দাম তো দিতেই হবে। মাগো–দিদি, তুমি, বাবা আমার ভালোবাসা নিও। মামণিকেও জানিও। এই চিঠি ওঁকেও দেখিও। মেসোমশাই, শুভদাদা, লোপাদি সবাই ভালো তো? তোমরা ভালো থেকো, মা।
তোমার
শিলু।
পুনশ্চ : লিসাকে তোমরা বাড়িতে নিয়ে যেতে বারবার ডেকেছ বলে কাগজে তোমাদের চিঠি পড়ে, লিসার চোখে জল। সে খুবই কৃতজ্ঞ। এইটুকু মমতা ওর কাছে অনেকখানি। এখন বোধহয় অল্প অল্প চেনা হচ্ছে তোমাদের। যখনই হোক, যেটুকুই হোক, সেইটুকুই লাভ। আর ভাবনা কোরো না। এই তো খবর পেলে। এবার সামলে ওঠো দুঃসংবাদটা। তুমি তো কঠিন হতে পারো। বাবাকে একটু বুঝিয়ো। দিদিকেও বোলো বাবাকে বোঝাতে। আমার জন্য ভেব না। তুমি তো ঈশ্বরবিশ্বাসী।
.
চিঠিঃ দুই
১৭/২সি জাস্টিস চন্দ্রমাধব স্ট্রিট
কলকাতা-২০
১৭ জানুয়ারি ৯৯
আমার আদরের শিলাইবুড়ো,
এতদিন দেরি করতে হয় রে? তোমার চিঠির জন্যে বসে বসে তোমার বাবা-মায়ের প্রাণ সত্যি সত্যি বুঝি ঠোঁটের কাছে উঠে এসেছিল। আমি তো ভয় পেতে শুরু করেছিলাম ওঁদের জন্যে–চাপা মানুষ–কেউই হাহাকার করছেন না, দুজনেরই ভয়, ইনি দুর্বল হলে উনি বুঝি ভেঙে পড়বেন। তাই দুজনেই অতিরিক্ত স্বাভাবিক আছেন। আর ভেতরে ভেতরে পুড়ে ছাই হচ্ছেন। আর তোমার ওপরে আমার এতক্ষণ যে রাগটাই হচ্ছিল! তুমি কি সত্যি সত্যি সন্ন্যাসী হয়ে গেলে? পূর্বাশ্রমের কথা বুঝি আর মনে নেই? যাই হোক না কেন, তুমি তো জানো আমরা তোমার সঙ্গে সর্বদা আছি। সদাসর্বদা।
তোমরা এই ভয়ের দিনে, এই বিপদের দিনেই যদি আমাদের কথা না মনে পড়ে, তবে কবে আমাদের কথা ভাববে? তুমি তো জানো আমি কাদের নিয়ে কাজ করি। আমার সঙ্গেও একটু যোগাযোগ করলে না? তবু ভগবান তোমাকে তো সুবুদ্ধি দিয়েছেন শেষ পর্যন্ত, সেই মস্ত দয়া। এবার দেরি না করে অবিলম্বে তোমার শরীরের খবর আমাকে ডিটেইলসে জানাবে। তোমার ফোন নম্বর কী?