শিলাদিত্যের খবর এখনও কিছু জানা গেল না। বোঝা যাচ্ছে না ক্ষতির বহর কতখানি। মোনালিসার খবর যা পাওয়া গেছে তারপরে তো আর মনে-প্রাণে কোনো ভরসাই থাকে না। বাবা-মাকে কিছুই বলতে পারা যাচ্ছে না, তাদের জন্যে শ্রাবস্তীর মনে প্রবল দুশ্চিন্তা। ওঁরা। কেউই বাইরে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করছেন না, খুব স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। অথচ শ্রাবস্তী তো জানে। তাদের রক্তের মধ্যে অশান্তির ঢেউ আকাশ ছুঁয়েছে।
গোয়াতে একবার যাওয়া দরকার।
এবং কাঠমাণ্ডুতে।
অবশ্য নেপালে আরও ঢের জায়গা আছে। ছোটখাটো গ্রামেও যথেষ্ট নেশার সামগ্রী মেলে। যেখানে ড্রাগের সাপ্লাই অপ্রতুল নয় সেরকম কোনো জায়গাতেই মোনালিসা থাকবে বলে গৌতমের ধারণা। এবং মোনালিসার সঙ্গে শিলু।
কে জানে কতদূরে ছড়িয়েছে, কত গভীরে নেমেছে সর্বনাশের শেকড়। বাবা-মা-র এতগুলো চিঠি বেরুল এতদিন ধরে এতগুলো কাগজে, একটাও কি চোখে পড়ল না শিলুর? এতটা নিঃশব্দ কেন? নৈঃশব্দ্যই তো ভয়ের।
.
একাদশ অধ্যায়। চিঠি পড়া
চিঠিঃ এক
আমেদাবাদ
১২ জানুয়ারি ১৯৯৯
শ্রীচরণেষু মা গো,
আমি জানি আমার জন্যে ভেবে ভেবে তোমরা কত কষ্টে আছ। কিন্তু সত্যি খবরটা যদি পাও তাহলে বাবা আর তুমি আরও বেশি কষ্ট পাবে, এই দুর্ভাবনায় নীরব থাকাই স্থির করেছিলাম। কিন্তু বারবার কাগজে তোমাদের চিঠি চোখে পড়েছে–তাতে সান্ত্বনা পাই, ওতেই জানছি যে, তোমরা আছে, তোমাদের ভালোবাসার জায়গাটা আমার জন্যে এখনও ঠিক আছে। আমিও ঠিক আছি, মা। কিন্তু আমার জীবনের চালচিত্রটা পালটে গেছে।
দিল্লিতে ফেরার পর থেকেই মোনালিসার শরীরটা খারাপ হয়ে পড়ল। ওকে যখন কলকাতায় নিয়ে যাই, তখনই ওর স্বাস্থ্য গোলমাল করছে। দিদি ঠিকই ধরেছিল ওই সময়টায় আমার জীবনে একটা প্রবল ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। দিদির কাছে তোমরাও এতদিনে নিশ্চয়ই লিসার ড্রাগ অ্যাডিকশনের কথা জেনে থাকবে। দিদির ভয় ভুল ছিল না, মা। লিসা, এবং আমাদের অন্যান্য সঙ্গীসাথীদের কল্যাণে দিল্লিতে এসে আমারও ওই মরণ-নেশাতে হাতে-খড়ি হয়ে গিয়েছিল। তাই কলকাতাতে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিলাম, যদি মুক্তি পেতে পারি।
আরও একটা কারণেও মোনালিসাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। আমাদের পরিবার নিয়ে আমার মনে একটা গভীর তৃপ্তি, আর গর্ববোধ আছে বলে। লিসার মা ওকে বাল্যকালেই ছেড়ে অন্য সংসার পাততে চলে গিয়েছেন। বাবা ব্যবসার ধান্দায় এদেশ-ওদেশ ঘুরে বেড়ান, ব্যবসাও খুব শুভ্রধবল নয়। তার সাঙ্গো-পাঙ্গরাও তেমনি। লিসা আয়া-বাবুর্চির জিম্মাতেই মানুষ হয়েছে। একলা একলাই বড় হয়ে উঠেছে বলতে পারো। হাতে প্রচুর অর্থ এবং স্নেহের কোঠায় শূন্য। জীবনটাকে নিয়ে যেমন খুশি খেলাধুলো করেছে। নিজেকেও একটা খেলনার মতোই টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলেছে। আমি চেয়েছিলাম সেই ভাঙা টুকরোগুলোকে জোড়া লাগাতে। ভেবেছিলাম, তোমার কাছে, বাবার কাছে, দিদির কাছে লিসাকে একবার নিয়ে ফেলতে পারলে, ওর বিভ্রান্তি ঘুচে যাবে। মানুষকে বিশ্বাস করতে ওর যে প্রবল ভীতি, সেটা কেটে যাবে।
কিন্তু বাড়িতে যাবার পরে কিছু আর ঠিকঠাক হল না। যা সব কাণ্ডকারখানা হতে লাগল, তাতে আমার পরিকল্পনা বাস্প হয়ে উবে গেল। দোষ আমারই মা। আমিও তখন ঠিক আমাতে ছিলাম না। নিজের মধ্যে জোরটা ছিল না বলেই বোধ হয় কাউকেই কিছু বোঝাতে পারিনি।
লিসাকেও বোঝাতে পারিনি কিছু, দিদিকেও নয়। ওরা তাই মোটে কাছাকাছিই এল না। তোমাকেও বোঝাতে পারিনি আমি কী চাই–তাই লিসা তোমার কাছেও গেল না।
তুমিও মা, ওকে কাছে টানলে না, একটু যেন ভয়ে ভয়ে দূরে দূ রেই রইলে। লিসারই দুর্ভাগ্য, তোমাদের মতো মা-বাবা, দিদির মতো দিদির কাছে গিয়েও লিসা তোমাদের কাছাকাছি যেতে পারল না। দূরত্বের বেড়া ডিঙোতে পারল না–সরিয়ে রাখল নিজেকে। আমিও সেতুবন্ধনের চেষ্টা ঠিকমতন করতে পারিনি। আমারও সময়টা তখন ঠিকঠাক ছিল না মা। নতুন নেশার গোপন উত্তেজনার আর গভীর অপরাধবোধের তুমুল বিষে মেশানো অন্ধকার সময় ছিল সেটা আমার।
ফলে যা হবার নয়, তাই হল। সবই উলটোপালটা হয়ে গেল। দিদি বাড়ি থেকে চলে গেল তাতে অপমানিত হয়ে লিসাও ফিরে গেল দিল্লি। আমি না পারি একে দুষতে, না ওকে। ফলে নেশার মাত্রা বেড়ে গেল। তোমাদের চিঠি লিখব কোন মুখে? ফোনে বলব কী? দিল্লি থেকেই আমার নিস্তব্ধতার শুরু। আমার সান্ত্বনা, দিদি আছে। তোমাদের কাছে দিদি থাকবে।
তোমার হয়তো মনে পড়বে, কলকাতাতে থাকতেই লিসার জ্বর হচ্ছিল। পেটের গোলমাল হচ্ছিল। দিল্লিতে এসেও সেটা চলতে লাগল। আজ পেটের অসুখের জ্বর, তো কাল সর্দিকাশির জ্বর। মুখের মধ্যে পর্যন্ত এমন ঘা, যে কিছুই খেতে পারে না। তবু কিছুতেই কিছু কথা শুনবে না। ডাক্তার দেখাবে না। কলকাতা থেকে এসে আমি আর হোস্টেলে যাইনি, লিসাদের মস্ত বাড়ি পঞ্চশীল পার্কে। লিসার সঙ্গে আমিও সেখানেই ছিলাম। কিন্তু সিলার স্বাস্থ্য হঠাৎ এমন ভেঙে পড়তে লাগল, যে আর ক্লাসেই যেতে পারছিল না। দ্রুত ওজন কমতে লাগল। গায়ে ব্যথা। কাশিতে দমবন্ধ। ডাক্তার ধরে আনা হল। বহুবিধ রক্ত পরীক্ষা করে, শেষ পর্যন্ত জানা গেল, ওর রক্তে শুধু এইচ. আই. ভি. পজিটিভই নয়, লিসার শরীরে এইডসের লক্ষণ পূর্ণমাত্রায় প্রকাশ পেয়েছে। অনেকদিন আগেই ওর রক্ত এইচ.আই.ভি. পজিটিভ হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। চেক করা হয়নি।