সুরমা-আদিত্যর সংসারে মুক্ত বাতাসে মানুষ হওয়া শ্রাবস্তীর গৌতমের বাড়িতে দম আটকে আসে। রাজনীতিতে বামপন্থী হলেই যে তারা সংসারে মুক্ত মন নিয়ে আসেন না, সেটা এখানে স্পষ্ট। গৌতম তো এ-বাড়িরই মানুষ! শ্রাবস্তীর মাঝে মাঝে ভয় করে। হঠাৎ করে সুষমার কথা মনে পড়ে যায়।
.
মোনালিসা গর্গের খবরে গৌতম অতিরিক্ত বিচলিত হয়ে পড়েছিল কি? বেশি ভয় পেয়েছিল? ভয়, না বিতৃষ্ণা? নাঃ, ওটা বিচলিত হবার মতোই খবর। তারপর অনিন্দ্যর ব্যাপারটা। গৌতমের মুখে অনিন্দ্যর কথাটা শুনতে ভালো লাগেনি শ্রাবস্তীর। যেমন শ্রাবস্তীর মুখে মোনালিসার কাহিনী শুনতে শিলাদিত্যর ভালো লাগেনি। (শিলু আমায় নিজেই কেন বলল না অনিন্দ্যর কথাটা? বললে কী ক্ষতি ছিল?)
শুভার সঙ্গে এতদিনের এত সুন্দর সম্পর্কটা ছিন্ন করে দিল্লি গেল কেন শিলু? শুভা থাকলে তো মোনালিসা ঢুকতে পারত না শিলুর জীবনে।
মোনালিসা জুয়া খেলতে বসেছে জীবনটাকে নিয়ে। যে কোনো এক্সপেরিমেন্টের জন্যে প্রস্তুত সে। নৈতিকতার ধার ধারে না। লৌকিকতা, চক্ষুলজ্জা–এসব শব্দ তার অভিধানে নেই। অঢেল পয়সা, আর অসীম স্বাধীনতা, এই দুই সর্বনেশে বারুদের স্কুপের ওপরে বাসা বেঁধেছে ওই মেয়ে। এককালের মিস চণ্ডীগড়–ফেমিনার কভার গার্ল–আছে শাণিত রূপ, প্লাবিত যৌবন। শিলাদিত্য গিয়ে পড়ল শেষে এই মেয়েরই পাল্লায়। এত মানুষ থাকতে দিল্লি শহরে, সেই রীমা ভীমানির ধনী সোশ্যালাইটদের উড়নচণ্ডী আড্ডাতেই ধরে নিয়ে গেল শিলুকে, লিসা রীমা ভীমানির মেয়ের বন্ধু। সে মেয়েটিও দিল্লিতে সুপরিচিত। ধনীদের জন্য বিউটিপার্লার চালায় সে একটি–প্রচণ্ড বিখ্যাত মেয়ে সে। ওদের একটা বার আছে–সেখানে হঠাৎ একটি মেয়ে খুন হয়ে গেছে অল্প কিছুদিন আগে। তবুও বার চলছে–এত রাজনৈতিক ক্ষমতা ওই রীমা ভীমানির। ওসব সঙ্গ শিলুর পক্ষে মস্ত ক্ষতিকর। শিলু বুঝছে না।
.
মোনালিসা গর্গকে কখনো শ্রাবস্তীদের বাড়িতে মানায়? সুরমা-আদিত্য রীতিমতো সন্ত্রস্ত তার হাবভাবে, চালচলনে। শ্রাবস্তী অস্থির, উদ্বিগ্ন হয়েছিল–ওই মেয়ের মধ্যে একটা অচেনা, জটিল জীবনের সংকেত পেয়েছিল সে। গৌতম খবর নিতে শুরু করল, অচিরাৎ খবর মিলে গেল। মেয়ে তো নাম করা। সোশ্যাল ওয়ার্ক করে মানুষ দেখে দেখে সুষমার এমনই হয়েছে, মোনালিসাকে দেখেই তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় জেগে উঠেছিল। তিনি গোপনে শ্রাবস্তীকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, এ মেয়েটাকে তো ড্রাগ অ্যাবিউজার বলে মনে হচ্ছে–একে বাড়িতে রাখা একদম চলবে না–শিলুর সঙ্গে একে মিশতেই দেয়া ঠিক নয়–সুষমা সুরমাকে আসল কথাটা বাদ দিয়ে বলেছিলেন, মেয়েটাকে বাজে মেয়ে মনে হচ্ছে সুরো, ওকে বাড়িতে না রাখাই ভালো।
এটা বলা সহজ, কিন্তু করা অত সহজ নয়। শ্রাবস্তী কী করবে? মা-বাবার কাছে ড্রাগ শব্দ উচ্চারণ করলেই তো তারা মূর্ছা যাবেন। এ ব্যাপারে গৌতম ঠিক। বাবা-মা ওই একটি জিনিসকে ভয় পান। ড্রাগ। শিলুকে মোনালিসার থেকে বিচ্ছিন্ন করতেই হবে। চরম সর্বনাশ থেকে যেমন করে হোক বাঁচাতে হবেই শিলুকে-শ্রাবস্তী আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। মোনালিসার কথা সব খুলে বলেছিল শিলুকে। শিলু জানত সবই। অবাক হল না। বিরক্ত হল।
নানা অজুহাতে, নানা চেষ্টায়, শ্রাবস্তীর ঐকান্তিক প্রয়াসেও মোনালিসাকে কিছুতেই যখন নড়ানো গেল না, আত্মমগ্ন শিলাদিত্য কোনো ইঙ্গিতই ধরতে চাইল না, তখন অক্ষমতার ক্ষোভে অস্থির হয়ে শ্রাবস্তী নিজেই বাড়ি ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল। ভাবল এবার শিলাদিত্যর চোখ ফুটবে। কিন্তু জ্ঞানগম্যি যে আর হবার নয়। যে সর্বনাশের ভয় পাচ্ছিল শ্রাবস্তী সেই সর্বনাশ যে হয়েই গিয়েছে তা কি তখনও টের পেয়েছিল সে? নাকি টের পেয়েও বিশ্বাস করতে চায়নি?
গৌতম বলেছিল, একা লিসাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই তোমার ব্রাদারটিও ওই লাইনেই আছেন।
কথার সুরটা শ্রাবস্তীর খুব খারাপ লেগেছিল। শ্রাবস্তী বিশ্বাসও করেনি। ক্রমশ শ্রাবস্তীর ধারণা হচ্ছে গৌতম শিলুকে পছন্দ করে না। তার পোশাক-আশাক, তার পপ-ব্যান্ড সিনামন আইল্যান্ড, তাদের গানবাজনা, কোনো কিছুই যেন গৌতমের মনঃপুত নয়। ওরা যে ম্যাক্সমুলর ভবনে অনুষ্ঠান করে কাগজে কাগজে অত প্রশংসা কুড়ল, গৌতম তাকেও বলেছিল-ওঃ! রেভ রিভিয়ু!–ওসব রাখো তো? যত রাজ্যের বড়লোকের ছেলেরা দল করেছে, পুরো মিডিয়া ওদের হাতের মুঠোয়।
শ্রাবস্তীর কানে ভালো শোনায়নি কথাগুলো! কেমন একটা অস্বস্তি হয়েছিল, গৌতম কি শিলুকে–? ওকে কি একটু ঈর্ষাই করে গৌতম? কেন, শ্রাবস্তীর তো ঠিক উলটোই মনে হল। শ্রাবস্তীর বরং মনে হয়েছিল ছেলেগুলোর সত্যি ট্যালেন্ট আছে। অনিন্দ্যর কোরিও গ্রাফি, শিলুর লেখা গান-ভিকির পারকাশ্যান–কিন্তু অনিন্দ্য মুম্বাই চলে গেল মেধা পাটকরের ওপরে ডকুমেন্টরি করতে, আর শিলাদিত্য চলে গেল দিল্লি, দারুচিনি দ্বীপও ডুবে গেল।
শিলু যখন এসেছিল, বাকি ছেলেগুলোও এসে কদিন বাড়িতে জড়ো হয়ে হই হই করেছিল বটে, কিন্তু তারপর তো খেল্ খতম। দলের ছেলেগুলো সকলেই অল্পবিস্তর গাঁজাখোর। কিন্তু গাঁজা নিয়ে তো ভাবনা নয় শ্রাবস্তীর। তার ভাবনা অন্যত্র। আরও অনেক গভীরতর ক্ষতির সম্ভাবনা যেখানে।