শিলাদিত্য গরমের ছুটিতে এসেছিল। ফিরে গিয়ে বছরটা কমপ্লিট করেছে, কিন্তু, কোর্স কমপ্লিট করেনি। এ বছর জুন মাসে কলকাতায় আসেনি, দিল্লিতেও নেই। অগস্টে আর ফিরে যায়নি ক্লাসে। পুজো হয়ে গেছে, দেওয়ালি হয়ে গেল, ক্রিসমাসের ছুটি চলে গেল। শিলাদিত্য এন.এস.ডি.-তে ফেরেনি, কলকাতাতেও না। শ্রাবস্তী চণ্ডীগড়ে খোঁজ নিয়েছিল। মোনালিসার বাবাও জানেন না মেয়ে কোথায়, কি শিলু কোথায়। অথবা জানলেও বললেন না। তবে তাঁর সঙ্গে কথা বলে শ্রাবস্তীর মনে হয়েছে, তিনি জেনেশুনেও খবরটা বলছেন না। তাতে শ্রাবস্তীর উদ্বেগ কিঞ্চিৎ কমেছে। অবশ্য মেয়ের যেমন চরিত্র তাতে মেয়ের জন্য উদ্বেগ না-করার অভ্যেস হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয় মোনালিসার বাবার পক্ষে। কিন্তু শিলাদিত্যর স্বভাব তো সেরকম নয়। তবে বাড়িতে উদ্বেগ বেড়েই চলেছে।
ভাই আমার ওপরে এত বিরক্ত কেন হল? ভয় পেয়ে আমি ওকে সবই খুলে বলেছিলাম। লিসার সব কথা। তাতে আমার ওপর খেপে যাওয়ায় কী হয়েছে শিলুর? আমি ওকে সতর্ক করে দেব না তো দেবে কে? প্রেমে পড়লে কি মানুষ সবটা দেখতে পায়? দৃষ্টি কি স্বচ্ছ থাকে? কী যে বোঝাল ওকে মোনালিসা নামের দুষ্টু মেয়েটা! যে সর্বনাশের ভয় পেয়েছিলাম সেই সর্বনাশই মনে হয় হয়েছে।
.
বাবা-মাকে মোনালিসার কথা বলা হয়নি। গৌতম বারণ করল। গৌতম বলল, এই উড়নচণ্ডে ছাত্রসমাজের চেহারার সঙ্গে ওদের পরিচয় নেই–বিশেষ এই ইংরিজি গানবাজনা থিয়েটার-ফিল্ম-ফ্যাশনের বিচিত্র জগতের সঙ্গে। ওঁরা বুঝবেন না। আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বেন। শিলুর জন্য ভয় পাবেন। তার চেয়ে এটা ওঁদের না জানাই মঙ্গল। জেনেই বা কী লাভ? শিলাদিত্য ওঁদের কিছুই জানায়নি, হঠাৎ উধাও হয়ে গেল মোনাসিলা গর্গের সঙ্গে। গৌতম প্রচুর চেষ্টা করছে। খোঁজ নিয়েছে। জেলে নেই। হাসপাতালে নেই। মৃত্যুসংবাদও নেই। অতএব তারা আছে নিশ্চয় কোথাও। গৌতম, শ্রাবস্তী দুজনেরই ধারণা গোয়াতে কিংবা কাঠমাণ্ডুতে ওদের খোঁজ মিলবে। কোনো হিপি আশ্রমে। এ সম্ভাবনাটুকুও শ্রাবস্তীর মা-বাবাকে জানাতে রাজি নয় গৌতম–ওর ধারণা ছেলে হিপিদের সঙ্গে থাকতে পারে, এটা শুনলেই ওঁরা ভেঙে পড়বেন।
শ্রাবস্তীর অবশ্য ধারণা অন্য। শ্রাবস্তী অবাক হয়ে ভাবে, এতদিন দেখেও গৌতম ওর মা-বাবাকে চিনল না। যেমন এতদিন ওকে দেখেও গৌতমের মা-বাবা চিনলেন না। শ্রাবস্তীকে। পদে পদে তার প্রমাণ পায় শ্রাবস্তী। যেমন সেদিন গৌতমের মামা-মামি এসেছেন। জামসেদপুর থেকে। ওর মা শ্রাবস্তীকে ডেকে ওঁদের সামনে আদর করে বললেন, এসো তো শ্রাবস্তী, পরোটাগুলো বেলে দেবে একটু আমার সঙ্গে। (আরে আমি পারি নাকি পরোটা বেলতে!) শ্রাবস্তী গেল তার পিছু পিছু রান্নাঘরে, গিয়ে বলল,-মাসিমা, আমি কিন্তু পরোটা বেলতে জানি না। আলুচচ্চড়ি বানিয়ে দিতে পারি বরং। উত্তরে গৌতমের মা বললেন, জানি না বললে তো হবে না। ঘরের বউ, পরোটা বেলতে পারবে না? সে কি হয়? শুধু জজ ম্যাজিস্ট্রেট হলেই তো মেয়েদের চলবে না, রান্নাঘরটাও সামলাতে হবে।
কথাটা খুব ভুল নয়–সুরমাও কখনও যে এধরনের কথা বলেন না তা না। কিন্তু তার বলার সুরটা আলাদা। তাতে এই অনুশাসনের স্বর শোনেনি শ্রাবস্তী। সব কাজকর্ম শিখে রাখা ভালো, সুরমা শিলুকেও তো রান্নাঘরে ডাকেন। ব্রেকফাস্ট করে দিতে পারেও শিলু। গৌতম রান্নাঘরে ঢোকে না।
ওদের বাড়িতে শ্রাবস্তীর প্রধান ভূমিকা ঘরের বউ হয়ে রান্নাবান্না, ঘরকন্না করার। তার আই. এ. এস. হয়ে রাজ্যশাসন করাটা যেন এলেবেলে শৌখিনতা মাত্র। গৌতম যে অ্যালায়েড সার্ভিসেস পেল সেটাতেও তারা শ্রাবস্তীর প্রতি কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ। যেন সে একটা বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করে ফেলেছে তাদের ছেলের চেয়ে দুপা এগিয়ে গিয়ে। অথচ বি. এ.-র রেজাল্টেও ফারাক ছিল। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল কেবল একজনই, শ্রাবস্তী। তখন ওঁদের এই মনোভাবটা বোঝা যায়নি, গৌতম তার বন্ধুর সাফল্যে এতই গর্বিত হয়েছিল। আই. এ. এস. পাওয়াতেও গৌতমের মনে ক্ষোভ নেই, খুশিই আছে। কিন্তু মা-বাবার মতে মত দিয়ে চলা স্বভাব গৌতমের। শ্রাবস্তীর ও-বাড়িতে জিন্স পরার অনুমতি নেই। গৌতমও বলল মেনেই নিতে, এটা তো ছোট ব্যাপার। গৌতমের বোন ঋতা কিন্তু জোর করে জিন্স পরে। গৌতমের মা শ্রাবস্তীকে সালোয়ার কামিজ পরতেও বারণ করেছিলেন। ওর বাবা নাকি পছন্দ করেন না। কিন্তু ঋতাই ঝগড়া করে (গৌতম নয়!) সেই অনুমতিটা আদায় করেছে শ্রাবস্তীর জন্য। শ্রাবস্তীকে জিও পরতে বলে সে বলে, পরলেই মেনে নেবে ঠিক। ওদের অন্যায় আব্দার শুনো না। তুমি তোমার মতো থাকবে। শ্রাবস্তীই বরং গৌতমের কথা শুনেছে, ঋতার কথা না শুনে। সেটা কি ঠিক করেছে? সারা জীবনের জন্য কি এই সিদ্ধান্ত রাখা যাবে? গৌতমের সব কথা শোনার? ও যদি অ্যালায়েড না পেত আই. এ. এস হয়ে যেত, তাহলে ওকে অগ্রাহ্য করা ঢের সহজ হত। এখন শ্রাবস্তীকে অনেক সতর্ক হয়ে বুঝেসুজে চলতে হয়, পাছে গৌতমের মনে আঘাত লাগে?
গৌতমনের পরিবারের সঙ্গে শ্রাবস্তীর মিল নেই বিশেষ। ওঁরা তুচ্ছতাকে খুব বড় মূল্য দেন। এখানে প্রসেনজিতের কথা মনে পড়ে যায় শ্রাবস্তীর। অথচ ঠিক বিপরীত মেরুতে আছেন ওঁরা–গৌতমের বাবা বহুকালের নিবেদিত প্রাণ সি.পি.এম কর্মী। গোঁড়ামি যে কত রকমের হতে পারে! রক্ষণশীলতার নানা মুখ, নানা মুখোশ। ঐশ্বর্যের মতো দারিদ্রেরও একটা অহংকার থাকে সময়ে সময়ে। সে দম্ভ আরও ভয়ানক হতে পারে। শ্রাবস্তী সেটা বোঝে না। তা নয়। কিন্তু ওঁরা যে গৌতমের বাবা-মা!