মানুষের ভালোবাসার নানা রং–
অনি বলেছে, মায়ার বিস্তার অনেকদূর অবধি–সোজাসুজি রেললাইন বেয়ে গড়িয়ে চলে না আমাদের জীবনে–তুই তো শিল্পী, তোর তো জটিল হবেই জীবনের পথ–তাতে লোকসান কিসের?
বাইরে দামোদর নদ তখন অন্ধকার আকাশের সঙ্গে মিশে গিয়েছে–হঠাৎ একটা রাতপাখি উড়ে গেল, টিটি টিট্টি–অনি গেয়ে উঠেছিল গলা ছেড়েঃ
নদী ভরা ঢেউ
জানে না তো কেউ
কেন মিছে তরী তবু বাও বাও রে
(একবার) চুবানি খেয়ে ভারি
(তুমি) বলো–ওহে কাণ্ডারী
আমায় বাঁচাও বাঁচাও রে–
রবিবার
আমার দামোদর স্মৃতিতে বড় মায়া। দুর্গাপুরেই অনিন্দ্য আমাকে চিনিয়ে দিয়েছিল আমার নিজস্ব প্রকৃতি, আমার আসল মুখচ্ছবি। সেই বিশাল দামোদরের তীরে ছোট্ট বাগান ঘেরা নির্জন বাংলো, গিটার নিয়ে আমরা দুজনে–গিটার, আর বিয়ার, আর গাঁজা, আর গান, গান, গান। সারা রাত। রাত্রি স্থির হয়ে গিয়েছিল। অন্ধকার যেন ঝিকিমিকি ম্লান জ্যোৎস্নায় আরও গাঢ় হয়েছিল এদিকে ওদিকে, জায়গাটা ঠিক দুর্গাপুর ছিল না। একটু বাইরে একটু দূরে একটু জনহীনতায়, যেখানে নিজেকে আবিষ্কার করা তুলনায় সহজ, সেইখানেই অনির কাছে আমায় নবজন্ম হয়েছিল–অথচ কাউকে বলা যায়নি একথা। কাউকে নয়। শুভাকে বলতে গেলাম, ফল হল বিপরীত। দিদিকে বললে কী বুঝত? দিদিকে বলা উচিত ছিল কি?
মঙ্গলবার
বারংবার ভুল করতে করতে একদিন তো মানুষ ঠিক পথটা খুঁজে পায়? বারবারই কি হারিয়ে যাবে বনের মধ্যে পায়ে চলার সেই পথটা, শস্যদানা ছড়িয়ে চিহ্নিত করে রেখে গেলেও ঘরে ফেরার উপায় নেই, পাখিরা এসে খুঁটে খেয়ে নেবে সেই দানাগুলো। পিছন ফিরলে দেখতে পাব সেই পথহীন, আদি অন্তহীন মহারণ্য। সে কি স্মৃতির বন? নাকি বিস্মৃতির? পিছনে তাকিয়ে কি স্বপ্ন দেখা যায়? এমনকী কী দুঃস্বপ্নও? না। তার জন্যে সামনে চলতে হবে। পথ তৈরি করে নিতে হবে। স্বপ্নের রাস্তা। কৈশোরের বকুলগন্ধেরা যে পথ চিনিয়ে দেয়, যৌবনের রক্তাক্ত কাটাবেধা ফনিমনসার ঝোঁপ যে পথ চিনিয়ে দেয়, সে পথে স্বপ্ন নেই। শুধু স্মৃতি। আমার ভুল যেন ফুরোচ্ছে না, আমার সামনে সঠিক পথের চিহ্ন ফুটে উঠছে না কিছুতেই, অথচ দূর থেকে ভেসে আসছে এক অচেনা সুবাস। সে কি পাকা ফলের? সে কি বিষ্টি ভেজা মাঠের? কদম কেশর ঢেকেছে আজ বনতলের ধূলি–শুভার গলায় এই গানটি। মৌমাছিরা কেয়াবনের পথ–আচ্ছা কেয়াফুল কেমন? আমি জীবনে কখনো কেয়াফুল দেখিনি। অথচ মা-র মুখে শুনেছি এই লেকের ধারেই অনেক কেয়াঝোপ ছিল এককালে। গন্ধে ভারী হয়ে থাকত বাতাস। কাছে যেত না কেউ সাপের ভয়ে। ফুল তুলে বিক্রি করত বস্তির দুষ্টু দুরন্ত ছেলেরা। মা-রা কিনতেন, দুআনার একটা ফুল। এখন কি একটা ঝোঁপও বাকি নেই? একেবারে সব মুছে গেছে?
হঠাৎ শুভার সঙ্গে যে কী হয়ে গেল!
শুক্রবার
এক একটা দিন হঠাৎ ঝলসে ওঠে, আর জীবনটাকে উলটেপালটে বদলে দিয়ে যায়। ওলট পালটটা ঘটে যায় সমাজের ভেতরে, বাইরে থেকে দেখে কেউ টের পাবে না। একেই কি বয়স বাড়া বলে? বয়েস তো শুনেছি রোজ ঘুমের মধ্যে টুক টুক করে বাড়ে। আমি তো দেখতে পাচ্ছি মানুষের বয়স রোজ অল্প অল্প করে বাড়ে না। হঠাৎ হঠাৎ একটা ঘা খেয়ে বেড়ে যায়। একটা ঘটনায়। একটা সংবাদে। একটা দৃশ্য দেখে। বয়সে বাড়াটা যে কীরকম, আমি ইদানিং খুব তাড়াতাড়িও দুবার টের পেয়েছি। সেদিন অনিন্দ্যর সঙ্গে দুর্গাপুরে গিয়ে, আর পরশুদিন যখন অনিন্দ্যর সঙ্গে কথাবার্তার কথা, দুর্গাপুরের গল্প সব শুভার কাছে করলাম।
শুভার সেই মুখ, সেই চাবুক-খাওয়া মুখখানা আমার বয়েস দশ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে। কত কম চিনি আমরা পরস্পরকে। কী এমন ছিল আমার কথায়? কী ছিল এত সাংঘাতিক, এত মর্মভেদী? আমি চেয়েছিলাম শুভকে আমার আনন্দ-যন্ত্রণার অংশ দিতে–তব অধর এঁকেছি সুধাবিষে মিশে মম সুখদুখ ভাঙিয়া–সুধা-বিষে না মিশলে কেমন করে হবে। চুম্বন?
আমি ভাবতেই পারিনি শুভা এতে আঘাত পাবে। দৌড়ে পালিয়ে গেল, আমি লোকে কি ভাববে ভেবে পিছু পিছু দৌড়লাম না। কাল ফোন করেছি। মাসিমা বললেন, শুভা শুয়ে আছে, ঘুমোচ্ছে, শরীর ভালো নেই। আজ ফোন করেছি, মাসিমা বললেন, শুভা বাড়ি নেই, বেরিয়েছে। বুঝতে পারছি না শুভা অ্যাভয়েড করবার জন্য মাসিমাকে এইরকম নির্দেশ দিয়ে রেখেছে কিনা। কী হল শুভার? কী ভাবছে ও? শুভার আচরণে আমার নিজেকে গর্হিত অপরাধের আসামী বলে মনে হচ্ছে। অথচ আমার অপরাধটা কী?
কলকাতা
রবিবার
প্রিয় শুভা,
জানি তোর শরীর ভালো নেই। কিন্তু আমাকে তো আজ চলে যেতেই হচ্ছে। যাবার আগে অনেক চেষ্টা করলাম, তোর সঙ্গে দেখা হল না। তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যা।
তুই বোধহয় অনিন্দ্যর ব্যাপারটা খুবই ভুল বুঝেছিস। আমাকে কি তুই কিছুই চিনিসনি শুভা?
মাথা ঠান্ডা কর। শুধু শুধু কষ্ট পাস না। সত্যিই তোর ভুল হচ্ছে। একদিন ঠিক বুঝতে পারবি। আমি ফিরতে ফিরতে তুই তো জোকা-রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হয়ে যাবি, যা বুঝতে পারছি। Good Luck দিল্লি পৌঁছেই ই-মেল করব। আমার হোস্টেলের ঠিকানা মা-র কাছে আছে। ভালো থাকিস। Lots of Love,
তোর
শিলাদিত্য
.
দশম অধ্যায়। পরোটা আলুচচ্চড়ি
এই নতুন কর্মজীবন, নতুন দায়িত্ব, কোথায় শুরু হবে আনন্দের মধ্যে, তা নয়, চরম উদ্বেগে, চরম সর্বনাশের দুর্ভাবনা নিয়ে শ্রাবস্তীর কর্মজীবনে পদক্ষেপ।