অথচ শুভদাদা আর লোপাদির সম্পর্কটা কি সুন্দর টিকে গেল। ওরা বিয়ে করে ফেলল। ওরাও তো স্কুল-ফ্রেন্ডস ছিল। মেসোমশাইয়ের দিক থেকে এত বাধা-বিপত্তি, এত অশান্তি, ঝড়-ঝাঁপটা সহ্য করেও নোপাদি আর শুভদাদা সুন্দর জীবনযাপন করছে বস্টনে। আর কলকাতায় পালা করে আসা-যাওয়া। মেসোমশাইকে খুশি করা তো ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরেরও সাধ্যি নয়, কিন্তু বাকি সবাই খুব খুশি।
শুভার সঙ্গে আমার সেরকম সম্পর্কটা হল না। শুভার স্বভাব অতিরিক্ত বাস্তববাদী,
কেরিয়ার ওর কাছে ঈশ্বরের চেয়েও পবিত্র, তার কাছাকাছি আর কিছু নেই।
এই গানবাজনা থিয়েটারটাই যে আমারও ঈশ্বর, সেটা ও মানতে চায় না। বলে, এটা শুধু হবি, এটা কোনো কেরিয়ারই নয়। এটা এক্সট্রাকারিকুলার। এটা অবসর বিনোদন মাত্র। কীভাবে বোঝাব শুভাকে? ও তো আমাকে ছোট্ট থেকেই দেখছে। বাবা-মা যেটা বোঝেন, সেটা শুভা কেন বুঝবে না? আর বাবা-মা যেটা বোঝেন না, সেটাও তো এতদিনে শুভারই বোঝা উচিত ছিল।
বৃহস্পতিবার
অনি বলেছে শুভাকে এবার মুক্তি দিতে। অনি বলছে দিল্লি যাওয়ার পরে শুভাকে জানাতে যে এ সম্পর্ক চলছে না, শুভা নতুন জীবন খুঁজে নিক। এতে আমারও ভালো হবে। আমাদের বন্ধুত্বটা অটুট থাকে যাতে, অনি বলছে সেই চেষ্টাও করা খুব দরকার, বাল্যকালের বন্ধুত্ব জীবনের মহার্ঘ্য সম্পদ। কিন্তু শুভার ওপরই নির্ভর করবে বন্ধুত্ব রাখা-না-রাখা। আমি সব সময়ই শুভার বন্ধু। শুভা ছাড়া আমার আর কোনো বন্ধু কোথায়? গানের দলের সঙ্গীসাথীরা? হই-হুঁল্লোড়ের সঙ্গীসাথী মানেই কি বন্ধু? ভিকি, সোম, বান্টি, বলবীর, কণিষ্ক কেউই সেভাবে আমার বন্ধু নয়। শুধু অনিন্দ্য।
বৃহস্পতিবার
দিদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। কিন্তু আশ্চর্য! দিদির অনিকে ভালো লাগেনি। দিদির না গৌতমদার?
গৌতমদার মতামতটা দিদিকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। ছোটবেলাতে দিদিই ছিল আমার বন্ধু। গৌতমদা ওর জীবনে আসার পরে দিদি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। আর শুভা দিদির জায়গায় চলে আসছে।
দিদি আর আমি দুজনেই তো বাইরের স্কুলে পড়েছি, পাহাড়ের হোস্টেলে থেকেছি। ছুটতে ছুটতে বাড়িতে এসেছি মা-বাবার কাছে। আমাদের ভাইবোনের সম্পর্কটাই ছিল হাসিখুশির। ছুটির মেজাজের। যখন স্কুল ফুরোল, আমি কলেজে পড়ছি কলকাতা শহরে, তখন আমাদের নতুন করে চেনা হতে লাগল–সেই সময়েই হঠাৎ গৌতমদা ঢুকে এল দিদির জীবনে। এখনও গৌতমদা।
আমি দিল্লিতে চলে যাচ্ছি শুনে দিদিও খুশি নয়। দিদি আই.এ.এস হয়ে গেছে, কোথায় পোস্টিং হবে জানা নেই। কোনো অজ পাড়াগাঁয়ে সম্ভবত। গৌতমদা সোজা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভে চান্স পায়নি। গৌতমদা অ্যালায়েডে পেয়েছে। বোধহয় রেলওয়েতে যাবে। দুজনে থাকবে দুজায়গায়। জানি না ওদের কীরকম প্ল্যান। শুভার ইচ্ছে আমিও দিদির মতো আই.এ.এস. হই। বি.এ.-তে ফার্স্টক্লাস পাইনি, কিন্তু ফিটি এইট পার্সেন্ট ছিল, তাতেই শুভার ধারণা হয়েছে আমি পারব। দিদিরও দৃঢ় বিশ্বাস আমি পারব। বাবার মাথাতেও ঢুকিয়ে দিয়েছে।
একমাত্র মা দেখছি কোনো বিকল্প মতামত দিচ্ছেন না–নিজে গান করেন বলেই বোধহয় আমার গানবাজনা তার আপত্তি নেই, সহানুভূতি আছে।
মঞ্চে অভিনয়ে শুভার মতোই দিদির এবং বাবারও উদ্বেগ যথেষ্ট। তাদের ভাবনা, শো-বিজনেসে যেমন কোনো সিকিউরিটি নেই, তেমনি ডিগনিটিও নেই। এবং নানারকম ডেনজারও এসে পড়ে। যদি সাসিড করো, গুলশনের মতন মাফিয়া এসে পড়বে। যদি না সাসিড করো, তবে তো এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কপিটিশন এমনই তীব্র। অনি বলছে দিল্লিতে থাকাকালীন N_F T_I-তে খবর নিয়ে ফ্যাশন ডিজাইনিং লাইনটাও একটু দেখতে। মডেলিংয়ে অনেক টাকা, গ্ল্যামারও, আমার কাজের সঙ্গেও খাপ খাবে। (চেহারার সঙ্গেও বেখাপ্পা হয়তো হবে না।) আমি ভাবছি বান্টির মাকে বলব। বান্টির মা মুম্বাইতে ফ্যাশন মডেলিংয়ের লাইনে ছিলেন, অনেককে চেনেন। এ বিষয়ে বাবা-মা-দিদি কাউকে কিছুই বলিনি। শুভকে বলতেই তার যা প্রতিক্রিয়া দেখলাম! যেন ফ্যাশনমডেলরা খুনে, কিংবা বেশ্যা। এখনও তো কোনো পদক্ষেপই নিইনি, কেবল পরিকল্পনাটুকু বলতেই, এই! মধ্যবিত্ত মানসিকতা জিনিসটি যে কী, দিনে দিনে টের পাচ্ছি। ঘরে, বাইরে।
শুক্রবার
কত জন্মের পুণ্যফলে অনিন্দ্য এল আমার জীবনে। যে জিনিসটা এতদিন অস্ফুট ছিল, আলো-আঁধারিতে যে-মুখ আমি ঠিক চিনতে পারিনি বলেই আমার এত কষ্ট, আমার নিজস্ব সেই মুখখানি অনির ধরে দেওয়া আয়নায় স্পষ্ট ফুটে উঠল। অনি যদি না আসত আমার জীবনে, জীবন যে কী হতে পারে, আমার তা-ই জানা হত না। এত রং, এত আলো, এত সুর, এতবড় আকাশ, এত বড় পৃথিবী, অনিই তার ঠিকানা জানাল। শিল্পের প্রতি প্রেম যে কী, গানকে ভালোবাসা কী, এতদিন বুঝিনি। আমি শুভকেও ভালোবাসি। কিন্তু অনি, অনি আমার জীবনে একটা ঝড়ের মতো, যে ঝড় শুকনো পাতা সব ঝরিয়ে দেয়। নতুন পাতার আর বর্ষাঋতুর পথ খুলে দেয়। সত্যি আমার নতুন করে জন্ম হয়েছে অনির কল্যাণে।
হ্যাঁ, নতুন জন্মই। শৃঙ্খলমুক্তি। স্ফুরণ। ছেলেবেলার একটা দুর্ঘটনা আমাকে যেভাবে বেঁধে রেখেছিল এতদিন–যন্ত্রণায়, অপমানে, লজ্জায়, অপরাধে, অনি আমাকে তা থেকে মুক্তি দিল। অনি বোঝাল এরকম হয়েই থাকে। এটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। সব ছোট ছেলেদের জীবনেই কিছু না কিছু ঘটনা থাকে–হ্যাঁেস্টেলে তো নিত্য-নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতা। এ নিয়ে আমার এত উদ্বেগের, এত যন্ত্রণার, এত অপরাধী হয়ে থাকার মতো কোনো কারণই নেই। হ্যাঁ, তখন ভালো লেগেছিল, বেশ তো? সেটাও কোনো অপরাধ নয়। কিছু দোষের নেই তাতে। জীবন অনেক বড়। অনেক। যা হয়েছিল, তা যদি আবারও কখনও ঘটে–ঘটতেই পারে–যদি কখনও ঘটেও যায়, তাতে লজ্জার কিংবা অপরাধের কিছু নেই। ভালোবাসা কখনও অপরাধ হতে পারে?