বাইরের আলো-বাতাসের চাপে যে ভিতরের ঠিকানাটা হারিয়ে যেতে পারে, গুঁড়িয়ে যেতে পারে, সেই উদ্বেগে তুমি ওটাকে পুষে রাখো বুকের মধ্যে গভীর এক যন্ত্রণার ইঁদারা খুঁড়ে, যাতে শুধু রক্ত, শুধু অশ্রু, আর তলহীন কামনা। কামনা সঙ্গের, মিলনের, সংযোগের, ভালোবাসার। বাইরের শিলাদিত্যকে দূর থেকে চেয়ে চেয়ে দ্যাখে অন্দরের শিলাদিত্য, আর অবাক হয়ে ভাবে, এইটাই আমি? যত হই চই বেড়ে ওঠে, যত আড্ডা, যত ডিস্কো, যত। লেট নাইট, তত ক্ষীণ হয়ে আসে প্রকৃত যোগাযোগ।
রবিবার
আজ শুভোদাদা ফোন করেছিল। বস্টন থেকে। শুভদাদা চিরকাল হই-চই ভালোবাসে। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ভালোবাসে। আমার ঠিক উলটো। আমি তো আসলে লাজুক। শুভদাদাকে আমি বোধহয় বুঝতে পারি, ওকে বোঝা খুব কঠিন নয়। মেসোমশাই ওকে যত বন্ধ করতে চেয়েছেন শুভদাদা তত বাইরে ছুটেছে। শুভদাদা আমাকে ঠিক বোঝে না। সবটা বোঝে না। ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু সে আমি ওর ছোটভাই বলে। আমি শিলাদিত্য বলে নয়। শুভদাদাকে দোষ দিই না, যে যেমন সে তেমনই। আমি আমার মতন। শুভদাদা শুভদাদার মতন। ওর জীবনটাও তো সোজা সরল নয়। যেরকম ছিলেন ঠাম্মা, সেইরকমই মেসোমশাই। তার মধ্যেই জোর করে শুভদাদা নিজের মতন হয়েছে। মামণি ছাড়া ওকে জোর দেবারও বাড়িতে কেউ ছিল না। মামণিরও নিশ্চয় অনেকটা জোর লেগেছিল।
যে সমাজে শুভদাদা আর আমি, দুটো মানুষই আছি, সেই সমাজ কেবল দাদাকেই চেনে। মেসোমশাই ওরকম অদ্ভুত হওয়া সত্ত্বেও দাদা একদম ঠিক ঠিক মতন বেড়ে উঠেছে। কলকাতায় ইশকুলে পড়েছে, রাস্তায় ক্রিকেট খেলেছে, পার্কে ফুটবল, শীতকালে গলিতে আলো জ্বেলে ব্যাডমিন্টন, সাইকেল নিয়ে মেয়েদের গানের ইশকুলের সামনে চক্কর মেরেছে। শুভদাদা সবই করেছে। আমি এসব কিছুই পারিনি। আমি যা পেরেছি, তা সমাজের চোখেই পড়েনি, পড়লেও তার মাথামুণ্ডু কেউ বোঝেনি।
আর আমার যে হঠাৎ সবকিছুই কেমন গোলমাল হয়ে গিয়েছিল ছোটবেলায়। সেই জটটা তো খুলতেই পারিনি। আমি লাল কালিতে দাগানো একটা দিনের মতন আলাদা হয়ে গিয়েছি, ভিতরে যত নিঃসঙ্গ হয়েছি, তত ঢুকে পড়েছি নিজের ভিতরে নিজে, ততই হুল্লোড় করেছি বন্ধুদের সঙ্গে। যতই হুল্লোড় করেছি ততই বিযুক্ত হয়ে পড়েছি চারিপাশ থেকে, যত বিপন্ন বোধ করেছি, বিচ্ছিন্নতা ততই গ্রাস করেছে আমাকে। আঘাত পেলে প্রত্যাঘাতও কেমন করে করতে হয় কেউ শিখিয়ে দেয়নি আমাকে, আমি তাই আঘাত পেয়ে সরে যেতেই শিখেছি। সরতে সরতে সরতে, জীবনের এক কোনায় পৌঁছে গেছি, এখানে শিল্প ছাড়া আমার প্রকৃত সঙ্গী নেই। এখান থেকে আর সরবার মতন ঠাই নেই। তাই কালশিটে পড়ে গেলেও কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়েই থেকেছি। মাটিতে লুটিয়ে পড়িনি। এবারে সরতে হলে তো অনন্তে ঝাঁপ।
কাকে এসব কথা বলব? এতদিন একা শুভাননাই আমার বন্ধু ছিল–শুভাকে সব কিছু বলতে চাই। বলতে চেষ্টা করি। কিন্তু শুভা শুনতে চায় না। শুভা বুঝতে চায় না। অনিকে বলেছি। এতদিনে।
শুধু অনিকেই বলতে পেরেছি। শুধু অনিকেই বলা যায়, বলা গেছে। অনিন্দ্য শিল্পী। অনি স্থান, কালের সীমায় বন্দী থাকে না। সমাজের খেরোর খাতার হিসেবকেও গ্রাহ্য করে না। ওর আছে ওর নিজের জগৎ, যে জগতের চাবিটা অনি আমাকেও দিয়েছে। পৃথিবী অনেক দেখেছে অনিন্দ্য, অনেক মানুষ দেখেছে। নিজের বাইরে এসে দাঁড়াতে পারে ও। বাইরে থেকে নিজের দিকে তাকাতে পারে। সেইটেই অনি আমাকে শেখাতে চেয়েছে, সেই চোখটাই খুলে দিতে চেয়েছে। যাতে আমিও নিজের বাইরে এসে দাঁড়াতে পারি, বাইরে থেকে নিজের দিকে চাইতে পারি।–তা নইলে তুই শিল্পী কিসের? অভিনয় শিখবি কী করে? অনি বলেছে, নিজের মধ্যে নিজে ঢুকে থাকতে থাকতে একদিন অন্ধ হয়ে যাবি। বেরিয়ে পড়, বেরিয়ে পড়। বাইরের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ–কত কি ঘটে যাচ্ছে! অনিন্দ্য এইজন্যেই এত সুন্দর ডকুমেন্টারি ফিল্ম তোলে–জীবনকে খুব কাছ থেকে দ্যাখে ও।
ওর কলকাতার বাইজিদের ডকুফিল্মটা কান ফেস্টিভালে দেখানো হচ্ছে- অনিন্দ্য মে-মাসে কানে যাচ্ছে।
শিল্পীর স্বভাবেই অনিন্দ্য নিজেকে বাদ দিয়ে আমার কথাটা বুঝতে চেষ্টা করে। শুভা তো কেবলই নিজেকে জড়িয়ে ফেলে, ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান করে। বুঝতেই চায় না যে এটা ওর-আমার ব্যাপার নয়। এটা শুধু আমারই, একা আমারই যন্ত্রণা।
বুধবার
আমার গান-বাজনা শুভার পছন্দ নয়, সে চায় আমি সোজাসুজি এম. এ.-তে অ্যাকাডেমিক কেরিয়ারে ঢুকে পড়ি। অথবা দিদির মতো আই. এ. এস. হই। শুভা ভর্তি হয়েছে এম. বি. এ পড়তে, জোকাতেই পেয়েছে। কিন্তু আমি চলে যাচ্ছি দিল্লি-এন. এস. ডি. তে চান্স পেয়েছি। আমার স্বপ্ন সফল হচ্ছে–পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুধু একা আমিই স্কলারশিপ পেয়েছি, ইন্টারভিউ ভালো হয়েছিল। নাসিরুদ্দিন ছিলেন। গান বাজনা? হ্যাঁ। এবং থিয়েটারও। মঞ্চ আমার স্বপ্ন। এন. এস. ডি থেকেই চেষ্টা করব যদি টিভিতে কোনো চান্স পাই। শুনেছি ওখান থেকে নানারকম কনট্রাক্টস হয়ে যায়। আজকাল ভি.জে.-র কাজটায় দারুণ গ্ল্যামার। কিন্তু শুভা চায় না আমি ওই ধরনের জীবনে যাই। ওর বিশ্বাস, শো-বিজনেসে আত্মার পরিচর্যা হয় না। আর এম. বি. এ পড়লেই বুঝি হয়? বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনেই তো সবচেয়ে বেশি মনুষ্যত্বের অসম্মান ঘটে। এদেশে, বিদেশে, সব দেশেই। শুভা মানতে চায় না। আমার দিল্লিতে যাওয়া নিয়ে শুভার খুব মন খারাপ। শুভা আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু ওর মতন করে ভালোবাসে। আমার মতন করে নয়। শুভা আমাকে চায়। কিন্তু আমার মতন আমাকে নয়, ওর মনের মতন একটা শিলাদিত্যকে ও গড়ে নিতে চায়। আমার এই নিজস্ব প্রকৃত শিলাদিত্যকে ওর সহ্য হবে না, এটা আমি এখনও বুঝতে পারছি কিন্তু শুভা বুঝতে চাইছে না। বাল্যপ্রেম, প্রথম প্রেম, তার প্রবল মোহ তো ছিন্ন করা সহজ নয়। শুভার মতো বাস্তববাদীর পক্ষেও না।