স্যরি স্যরি, জামাইবাবু, আপনাকে কি সুরো বলেনি কথাটা? আমি ভেবেছি–
শোনো, বউকে ফুলশয্যার রাত্তিরে বেচারা প্রসেনজিৎ কী বলেছিল, সেটা অন্য কারুরই জানবার কথা নয়। তবে যদি আমার বেটার হাফ সেটা জেনেই ফেলে থাকেন, তবে ওয়ার্স হাফেরও সেটা জানায় কোনো অপরাধ নেই।
বাবারে বাবা, অত অভিমানে কাজ নেই। বলছি বলছি শুনুন।
ফুলশয্যার রাত্রে খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আমার বরমশাই আমাকে গম্ভীর গলায় বললেন, সুষমা শোনো। আমার মায়ের স্বাস্থ্য খুব খারাপ। তার আয়ুষ্কাল স্বল্প। আমি তাই কিছুদিন হল সন্ন্যাস গ্রহণ করব স্থির করেছি। বলতে পারো, তার মধ্যে বিবাহ কী করে হল? মায়েরই শেষ ইচ্ছা রক্ষা করতে এই বিবাহ। আমার সঙ্গে তোমার সম্পর্কের মধ্যে তুমি কোনো এক্সপেকটেশন রেখো না। মায়ের সেবা করবার জন্যেই আমি তোমাকে বিয়ে করে এনেছি। হিন্দু ধর্মের প্রথা অনুসারে এই পরিবারে জীবন যাপন করি আমরা। তুমি তো বাইরের মানুষ, তাড়াতাড়ি সব শিখে নাও। আমার মা, আমার বাবা, এঁদের আমি দেবতা জ্ঞানে সেবা করি। এবং তুমিও তাই করবে। এটাই এ সংসারে তোমার কর্তব্য। এই বলে পকেট থেকে একটা এতটা বলতেই দুই বোনে চোখাচোখি করে আরেকবার হেসে ফেলেন, কিশোরীকালের হাসির মতো বাঁধনহীন হাসি।
পকেট থেকে একটা ছোট শিশি বের করে আমাকে তিনটে বড়ি দিলেন, নিজেও তিনটে বড়ি খেলেন–ক্যালি ফস্। খাও, দেহমন শান্ত থাকবে। জামাইবাবু, ফুলশয্যার রাত্রে ক্যালি ফসের মতন প্রচণ্ড পাওয়ারফুল অ্যামব্রোজিয়াক খাবার কথা কি আগে শুনেছেন?
তবে সুখের বিষয়, ক্যালি ফস্ খেয়ে খুব বেশিদিন সন্ন্যাসজীবন যাপন করতে পারেননি তিনি, আমার ভগ্নীর রূপের শিখায় পতঙ্গের মতো–
দূর! কোথায় পতঙ্গ? প্রথম প্রথম বেশ অনেকদিনই ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন। আশ্চর্য মানুষ! শাশুড়ি সব কিছু জেনেশুনেও ছেলেকে কিছু বলতেন না। আমি ছিলাম ভোদা, আর সুরোর তখনও বিয়ে হয়নি।
গুডনেস! সুরো! তোমার জামাইবাবুর এরকম সুকীর্তিটা তুমি গোপন রেখেছিলে? প্রসেনজিৎ তো হার্মিট, আরে, ও তো মহর্ষি প্রসেনযোগী! আমি তো ওঁকে সাষ্টাঙ্গে পেন্নাম ঠুকব–সুষির মতন একটা ডাকসাইটে সুন্দরীকে ঘরে বসিয়ে ক্যালি ফস খাইয়ে,
থামুন তো জামাইবাবু
হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে যান আদিত্য।
এখন সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে কুলাঙ্গার তো বলবেই সে। নিজে বাবা-মা-র যেমন সেবা করেছে, ছেলের কাছেও সেটাই তার এক্সপেকটেশন। নিজে বিলেত না গিয়ে মাতৃপুজো করেছে, আর ছেলে কিনা আমেরিকা পালিয়ে গেল? বউ ঘরে থাকলেই তো সেবা সেবা করে শ্বশুর তাকে অতিষ্ঠ করে তুলত। সবাই সুষমা নয়। বিয়ে টিকত না। শুভ পালিয়েছে ঠিক করেছে। মায়ের দূরবস্থার সে সাক্ষী, বউয়েরও অমনি হোক, চায়নি। কিন্তু প্রসেনজিৎ বুঝবে কেন? সে তার আদরের ছেলেটাকে তো কাছে রাখতে চায়।
.
একমুহূর্তের জন্যে ঘরে যেন বাতাস বন্ধ হয়ে গেল।
কেউ কোনো কথা বলছে না।
হঠাৎ পাখার শব্দটা শোনা যেতে লাগল ঘরর…ঘরর…ঘরর..
সুষমা যেন সহজ স্বরেই বলে ওঠেন,–জামাইবাবু শিলুর কোনো খবর পেলেন? অনেকগুলো কাগজে তো বেরিয়ে গেল। এখনও নো রেস্পন্স?
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সুরমা বেরিয়ে যান, সম্ভবত বেলেডোনা নিয়ে আসতে।
এখনও তো তেমন কিছু-মাঝখানেই অসমাপ্ত বাক্যটি হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন আদিত্য। তারপর আবার বলেন–ছমাস হতে চলল ওরা দিল্লিতে নেই। দিল্লি। মুম্বাই। চেন্নাই। হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর। প্রতিটা মেট্রোপলিটন সিটিতেই বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। চোখে কি আর পড়েনি?
একটা ফোন করলে পারত।
যদি ফোন করবার মতো অবস্থায় থাকে।
ষাট ষাট কী যে বলেন! আজকালকার ছেলেছোকরারা কত কারণেই তো উধাও হতে পারে। শিলু তো রোম্যানটিক, তায় আর্টিস্টিক টেম্পারমেন্ট, ঠিক কী জন্যে যে এমন চুপচাপ-কাগজে কতবার–তাও–তো খুকু কী বলছে? খবর নিচ্ছিল তো ভেতর থেকে। কিছু শুনল?
খুকু তো বলছে হয়তো দেশের বাইরে, কাঠমাণ্ডু-টা কোথাও গিয়েছে–খবর এখনো পায়নি–
এখানে বন্ধু-টন্ধুরা কিছু জানে না? শিলুর তো গানের দলটা আছে–ওর সেই দারুচিনি দ্বীপ?
হ্যাঁ, সিনামন আইল্যান্ড–তো? সে দলটল আর নেই। শিলু দিল্লি চলে গেল, অনিন্দ্য মুম্বাই চলে গেল। দলও ভেঙে গেল। তবু খুকু খোঁজ করেছিল। দিল্লিতে ফিরে যাবার পরে শিলু কারুর সঙ্গেই কনট্যাক্ট রাখেনি।
সুরো, সেই অনিন্দ্য ছেলেটার বাড়িতে আমরা একবার?
সে তো দুর্গাপুরের ছেলে
মুম্বাইয়ের ঠিকানা
ছেলেগুলোর কাছে যদি
শুভাকে?
নাঃ, জানে না, শুভা খুব ব্যস্ত–ও তো দুহপ্তার মধ্যে আমেরিকা চলে যাচ্ছে।
টেলিফোন বেজে উঠল।
হ্যালো, সুরমা? সুষমা আছে ওখানে?
আছে ধরুন। আপনি ভালো তো? সুষি–জামাইবাবুর ফোন!
.
নবম অধ্যায়। রাতপাখির ডাক
শিলাদিত্যের খাতা। শনিবার
একটা যদি স্থির বিন্দু না থাকে মনের মধ্যে, তাহলে সুস্থ মস্তিষ্কে বেঁচে থাকা যায় না। আমারও নিশ্চয় একটা স্থিরবিন্দু রয়েছে কোথাও, একটা অনির্বাণ শিখা, সেটা কখনো স্তিমিত, কখনো উজ্জ্বল, কিন্তু সর্বদাই জ্বলছে। প্রাণের প্রাণ। নিশ্চয়ই আছে, নইলে তো উন্মাদ হয়ে যাবার সুযোগ পেতুম। চারিদিকে যখন অনেক কথার সমুদ্র বয়ে যায়, ঢেউ আছড়ে পড়ে বিতর্কের, আমার বুকের মধ্যেকার সেই নৈঃশব্দ্য আমি তখনও টের পাই। যা আমাকে ধরে রাখে। ভেসে যেতে দেয় না। ডুবে যেতেও দেয় না। ভাসিয়ে রাখে, ফিরিয়ে আনে। খুব ভিতরদিকে, অনেক গভীরে আমার একটা ঠিকানা আছে, সেই ঠিকানাটা আমি কাউকে জাক্ষ্ম নাতে পেরে উঠি না। অথচ সেই ঠিকানাতে না পৌঁছতে পারলে কেউ তো আমাকে খুঁজেই পাবে না। আমার নাগাল পাবে না। আমার সঙ্গী জুটবে কেমন করে? বন্ধু পাব কী করে? যত সঙ্গী, যত বন্ধু, সবাই তো বারবাড়ির দালানে বসে আছে। সংযোগের চেষ্টা তুমি যতই করো না কেন, সেটা তো সম্পূর্ণতা পায় না তোমারই দোষে। তুমি তো সবটা অনাবৃত করতে পারো না।