ইয়ার্কি-ঠাট্টা না করতে পারে, প্রসেনজিটা বড্ডই সিরিয়াস, কিন্তু শালী এলে বিরক্ত হবে এমন জীব এখনো জন্মায়নি। সুরো, প্রসেনজিৎকে তোমরা এত নিন্দে করো না। হ্যাঁ, যখন ওঁর মা বেঁচে ছিলেন তখন বাড়ির অ্যাটমসফিয়ারটাও বড্ড ক্লোজড, বড্ড সাফোকেটিং লাগত–কিন্তু এখন তো–।
সাফোকেটিং? জামাইবাবু, আমার স্বামী অফিস থেকে ফিরছেন, আমি আশায় আশায় বসে আছি, উনি এমন একখানা মুখ করে বাড়ি ঢুকলেন, যেন মড়া পুড়িয়ে এলেন। অবিকল শ্মশানঘাট থেকে এলে মুখের যেমন অবস্থা হয়। তেমনি। চুপচাপ এসে, কথা নেই, হাসি নেই, জুতো খুলে, হাত-পা ধুয়ে, অফিসের কাপড় ছেড়ে, সোজা মায়ের ঘরে চলে গেলেন। আমি যেন নেই।
শুভ যখন ছোট, বাবার কাছে ছুটে যেত, তার দিকে নজর দিতেন না, চোখমুখ উদ্বিগ্ন, টেস্, ঘরে মরণাপন্ন রুগি থাকলে যেমন হয়।–কেন? না, মার যদি কিছু হয়ে যায়? মা এদিকে দিব্যি পান চিবিয়ে, টি.ভি. দেখে, চুরি করে মিষ্টি কিনে এনে খেয়ে, চুলটুল বেঁধে, সেজেগুজে শুয়ে পড়েছেন সন্ধেবেলায়, ছেলেকে দেখাবেন বলে। সে এক নাটক বটে। কী দিনই গেছে।
এইজন্যেই তোদের বাড়িতে লোকজন আসত না
তুইই তো বুদ্ধি করে শেখালি। শুভ জন্মানোর পরে। আত্মীয়-স্বজনদের সব ডাক, ছেলেকে দেখতে আসতে বল। সবাই আসুক। তাদের খাইয়ে-দাইয়ে যত্ন কর, ধরে রাখ, বারবার আসতে বল, দেখবি আত্মীয়-স্বজন তার পক্ষে কথা বলবে, বোকা তো কেউ নয়। হলও তাই। এখন বাড়িতে যে আসে, আমার কাছেই আসে। সেটাই তো ওঁর অপছন্দ। বলেন, বাহাদুরি কেনার জন্যে তুমি লোকের যত্ন-আত্তি করো। কী বলব বল? হিংসে নয়?
এখন তো বেরিয়ে পড়েছিস বাইরের পৃথিবীতে, বৃহত্তর জীবনে, মস্ত বড় কমপিটিশন এখানে জামাইবাবুর পক্ষে
এখনও একই কথা বলেন–বাহাদুরি কেনবার জন্যেই তুমি দুঃখী মেয়েদের উপকার করো। এঁকে তুই কী বলবি? এই মানুষের সঙ্গে ঘর করি।
সাইকোপ্যাথ বলব, আবার কী বলব। বউকে এত হিংসে করতে আমি জন্মে দেখিনি।
কেন করবে না? সুরো তুমি ভেবে দ্যাখো, যা যা সুষি আজ হয়েছে, তার কোনোটাই হওয়া কি অসম্ভব ছিল প্রসেনজিতের পক্ষে? বরং আরও বেশি করেই হতে পারত, বেশি শিক্ষিত সে, কিন্তু পারেনি। যে কোনো কারণেই হোক, ওঁর দ্বারা এই পাবলিক সেলিব্রিটি হয়ে ওঠা সম্ভব হত না কোনোদিনই। চাদ্দিকে বউয়ের এত ভক্ত, এত নামডাক, বউকে সে হিংসে করবে না? কাগজে ছবি, টিভিতে ছবি–
হ্যাঁ, সুষমা ভট্টচার্যকে লোকে রোজ ডাকছে এই স্কুলে প্রাইজ দাও, এই সভায় বক্তৃতা দাও, উত্তম্যান অব দি ইয়ার হয়ে গেল ঝট করে, বালিকা সুরক্ষার অনাথ মেয়েরা প্রাইজ পেয়ে নরোয়ে গেল, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সংঘ-কে নিয়ে ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি হল– সগর্বে সুরমা আদিত্যর কথার পিঠে আরো আরো কথা যোগ করে দেন।
তুই থাম তো সুরো। বরং আমাকে একটা জরুরি কথা ব–গলায় ব্যথা করলে কী ওষুধ খাই? দুদিন ধরে খুব গলাব্যথা করছে—
সে কিরে? জামাইবাবু ঘরে বসে আছেন আর আমাকে জিগ্যেস করছিস কী ওষুধ খাবি?
সর্বনাশ। ওঁকে বললেই তো হয়ে গেল। ক্যানসার দিয়ে শুরু করবেন। প্রথমেই বাড়ি থেকে বেরুনো বন্ধ হয়ে যাবে, যেটুকু নড়াচড়ার স্বাধীনতা অ্যাদ্দিনে পেয়েছি সব যাবে–তারপর পঞ্চাশটা টেস্ট
এ তো আচ্ছা জ্বালা? এই যে তোকে দিনরাত্তির পটের বিবি করে সোনার সিংহাসনে বসিয়ে রেখেছেন চোখের সামনে, ওঁকে তুই সামান্য গলাব্যথার কথাটুকুও বলতে পারিস না? এটা তো কাজের কথা
কাজের কথা, মনের কথা, কোনটেই বা ওঁর কাছে বলা যায়? পাম্প খারাপ, জল। ওঠেনি, ওঁর জন্যে বাথরুমে ড্রামে জল ভরে রাখা হল, উনি একবার জিগ্যেস করলেন না, হঠাৎ ড্রাম কেন? মন খারাপ তো আরোই বুঝতে পারবেন না।
গাড়ি খারাপ হলেও তো তুইই গাড়ি নিয়ে উড়িয়াপাড়ায় যাস–আগে এসব কে করত?
শ্বশুরমশাই করতেন। গণেশকে দিয়ে। আমিও গণেশকে দিয়ে করাই। উনি কোনো খোঁজ রাখেন না।
বিল-টিল। ব্যাঙ্ক-ট্যাঙ্ক?
এখন সেও সব আমার ঘাড়ে। ওই গণেশ।
সামনে বসিয়ে রেখে তোর সঙ্গে কী গল্প করেন জামাইবাবু? সবই ধর্ম আলোচনা?
তাই তো। নয় তো ছেলের নিন্দে। দিদির নিন্দে। আমি শুনি। আমার মনের কথা বলব নাকি ওঁর সঙ্গে বসে বসে? দূর!
শরীর খারাপটাও বলবি না? উনি তো ডাক্তার?
হোকগে ডাক্তার। নিজের শরীর নিয়েই উনি ব্যতিব্যস্ত। কিরে? গলাব্যথার কিছু ওষুধপত্তর তুই কি আমায় দিতে পারবি? না পারবি না?
দাঁড়া, বেলেডোনা থার্টি এনে দিচ্ছি আর গার্গেল কর নুন জলে। এও তোকে বলে দিতে হবে? সত্যি!
বেলেডোনা? হঠাৎ হেসে ফেললেন সুষমা। চোখের দৃষ্টিতে অনেক দূরের ছায়া পড়ল–
আচ্ছা সুরো, তোর মনে আছে ফুলশয্যার রাত্তিরে উনি আমাকে যে প্রেমের বাক্যটি বলেছিলেন? তোকে আমি পরের দিন কাঁদতে কাঁদতে কথাটা বলেছিলাম। সেই যে ক্যালি ফসঃ
বাপরে! সে কি ভোলবার? সেই শুনে তো আমিও ভয়ে কাঁটা। না জানি আমার ফুলশয্যার রাতে আমার বরের মুখে কী না কী শুনব!
দুই বোনের হাসির কলরোলের মধ্যে টেবিলে কফি আর কাবাব, আর গরম গরম মাংসের চপ আর স্যালাড এসে যায়। আদিত্য উঠে দাঁড়ান। চেয়ার ঠেলে।
সুরমা, সুষমা, আই অ্যাম সরি টু রিমাইন্ড য়ু, এই ঘরে আরো একজন আছে। আমাকে একঘরে করে দিয়ে তোমরা সাংকেতিক ভাষাতে আড্ডা মেরে হেসে গড়াচ্ছ, দিস ইজ সিপ্লি নট ডান।