অথচ ইলোপ করার কোনোই প্রয়োজন ছিল না। মোনালিসা গর্গের মা-বাবার যদিও ডিভোর্স হয়ে গেছে, তার মা যদিও আবার বিয়ে করেছেন, দুজনেই কিন্তু মেয়ের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অঢেল ধনবর্ষা ঝরিয়ে যাচ্ছেন। পূর্ণবয়স্ক ছেলে-মেয়ে তারা, বিয়ে করে লিসা নিজের বাড়িতেই থাকতে পারত। শ্রাবস্তী খবর এনেছিল, এখান থেকে ফিরে গিয়ে শিলু আর হোস্টেলে যায়নি, লিসার সঙ্গেই ছিল। হঠাৎ কেন উধাও হয়ে গেল সেখান থেকে দুজনে? পালানোর কী ছিল? কার কাছ থেকে?
সুরমা-আদিত্য তো এখানে, কলকাতায়। শ্রাবস্তীও বীরভূমে। মোনালিসার মা দ্বিতীয় বিয়ের পর কানাডায় সেটলড। বাবার ব্যবসা চণ্ডীগড়ে। তিনি অবশ্য সাতরাজ্য ঘুরে বেড়ান। দিল্লির বাড়িতে মোনালিসা একাই রাজত্ব করে দাসদাসী, বন্ধুবান্ধব, সাঙ্গপাঙ্গো নিয়ে। শিলুর তো অসুবিধে হবার কথা ছিল না।
তবে হঠাৎ ইলোপ করা কেন? এ তো ওলড় ফ্যাশানের কাজ। অতিরিক্ত রোমান্টিকতাদুষ্ট–অনাবশ্যক পলায়ন।
প্রসেনজিতের ছেলে হলেও বা হয়তো তার এমন একটা ধাক্কার প্রয়োজন হতো পিতার ধর্মজ্ঞানের দড়িদড়া থেকে মুক্তি পেতে।
কিন্তু আদিত্য? সুরমা? এ বাড়িতে তো একত্রে বসবাস করেই গেল দুজনে বিয়ে না হতেই। সে মেয়ে কি নিজের ঘরে শুত? রোজ সকালে চা দিতে গিয়ে সুরমা দেখতেন শিলুর খাটেই দুজনে ঘুমোচ্ছে। কোনো লজ্জা-সঙ্কোচের বালাই নেই।
নতুন প্রজন্ম এরই নাম।
এমন আ-ঢাকা হয়ে গেলেই সুখ হয়?
সুখ বড় বালাই। না থেকেও থাকে। আবার থেকেও থাকে না।
প্রসেনজিতকে দ্যাখো। আর সুষিকে।
একজনের সব থেকেও সুখ নেই।
আরেকজনের সুখ কিছুতেই কেড়ে নেওয়া যাচ্ছে না। রাজশেখরবাবুর মেয়েরা দুঃখী হতেই শেখেনি। কি সুষমা, কি সুরমা। আনন্দ তাদের শ্বাসবায়ু।
অন্তত তাই তো ভেবেছিলেন সুরমা এতদিন। কিন্তু শিলুটা সব গোলমাল করে দিল। সাত-মাস খবর নেই–দিল্লি থেকে চলে গেছে। আর এখান থেকে গেছে তো আরও আগে। বছর পার হতে চলল–শিলু একটিবারও যোগাযোগ করেনি। না মা-বাবার সঙ্গে; না দিদির সঙ্গে। খবরের কাগজে এতদিন বিজ্ঞাপন দেননি। পুলিশে খোঁজ দিয়ে রেখেছেন। শ্রাবস্তী প্রচুর তল্লাশি চালাচ্ছে। কিন্তু শিলুর খোঁজ পাচ্ছে না পুলিশ। মোনালিসারও নয়। যেন উবে গেছে দুজনে।
.
মোনালিসারও সুরমাকে পছন্দ হয়নি। আদিত্য বেশ বুঝতে পেরেছিলেন। পছন্দ হবে কেন? সুরমার পাশে মোনালিসাকে মলিন, কাঠখোট্টা দীনহীন দেখাত, তার উগ্র যৌবন, সাহেবী রং, কটা চোখ, কাটা কাটা নাক-চোখ নিয়েও।
শ্রাবস্তীর সঙ্গে ভাবও করল না। করবে কি? শ্রাবস্তী কথা বললে সেখানে মোনালিসাকে তো বাজ পড়ে ঝরে পড়া শুকনো গাছের মতন লাগত। ভিতর তো ফাঁকা। ওই মেয়ে অভিনেত্রী হবে, শিল্পী হবে? এখানে তো সৌজন্যের অভিনয়টুকুও করেনি। গোমড়ামুখে খাবারটেবিলে এসে বসত। সর্বক্ষণ ছাদের ঘরে দরজা বন্ধ করে দুজনের আড্ডা। শ্রাবস্তীও তো অল্পবয়সি মেয়ে। তার সঙ্গেও তো মেলামেশা করবে? তা নয়, শ্রাবস্তীর ধারে কাছে যেত না।
অন্য সময় শিলু এলেই ভাইবোনে জোর আড্ডা হয়। শিলু আবাল্য দিদিভক্ত, দুজনে কখনো কনসার্টে, কখনো থিয়েটারে, কখনো বা ব্ল্যাকে টিকিট কেটেও শাহরুখ খানকে দেখতে ছুটত। এবারে সেই ভাইবোনে কী আশ্চর্য ভাবে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল লিসার কল্যাণে।
এবার শিলুর সময় ছিল না কোনোই। তার ওপরে খুকুর ওই কী সব কথাবার্তা!
খুকু, তুই শিলুকে কী বলেছিলি লিসার নামে? যার ফল এমন তীব্র বিষময়? কী বলেছিলি তুই? কেন চলে গেলি তুই বাড়ি ছেড়ে? কী ভূত ঢুকেছিল তোর মাথায়? তুই তো ঠান্ডা মেয়ে।
সুরমার এসব প্রশ্নগুলি করা হয়নি, কেননা খুকুও আসছে না ছুটিতে। তাই আদিত্য আর সুরমাই একবার গেলেন বীরভূমে। সেখানে মেয়ের প্রতিপত্তি–এস. ডি. ও সাহেবের খানদানি কাণ্ডকারখানা দেখে আনন্দের সুরটা নষ্ট করতে চাননি। বলবার হলে খুকু নিজে বলত। যা বলল তার মানে নেই। সর্বনাশী মেয়েটার পাল্লায় পড়ে এবার শিলু শেষ হয়ে যাবে! যাবে মানে? গেছেই তো! শিলু তো নেই। শিলু কোথায়? খুকুরে, শিলু কই? শিলু?
আছে তো কোথাও। ঠিক সারফেস করবে। টাকাকড়ি ফুরোলেই ফিরবে।
কিন্তু ফুরোবে কেন? লিসার তো অঢেল ঐশ্বর্য।
চাকরি-বাকরি না করলে অঢেল ঐশ্বর্যেও ঢিলে পড়ে, মা! ওরা করছে না তো কিছু।
সুরমার ধারণা খুকু জানে শিলু কোথায়। খুকুকে তেমন বিচলিত লাগছে না। সত্যি সত্যি শিলু হারিয়ে গেলে খুকু অমন শান্ত থাকত না। কিন্তু বলছেও তো না আমাদের কিছু! দেখছে আমরা এত ছটফট করছি। এত কষ্ট পাচ্ছি। শিলুও কি বুঝছে না? শিলুর মতো নরম স্বভাবের ছেলে কেমন করে এতদিন রইল চুপচাপ? ও খুব ভালো জানে ওর বাবার ওকে চক্ষে হারাই স্বভাব। সুরমা বরং সংযত। আদিত্যের তুলনায় তিনি কঠিন বেশি। শিলুটা নিজেও তার বাবার মতোই। ভেতরে ভেতরে খুব নরম। সেই নরম শিলু এত কঠোর হল কেমন করে? একটা চিঠি নেই। ফোন নেই। কোনো যোগাযোগ নেই। মা-বাবা মরে গেছে না বেঁচে আছে তাও জানতে চায়নি। কী এমন অপরাধ করেছিলাম আমরা? খুকুর ওপর রাগ করে তুই আমাদেরও পরিত্যাগ করলি শিলু?
.
দ্বিতীয় খসড়াটা লিখতে লিখতে আদিত্যর কী মনে হল, হঠাৎ মুখ তুলে বললেন, বাংলা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে কিই-বা হবে? শিলু কি আর ওখানে বসে বসে বাংলা কাগজ পড়ে? ওরা তো কিনবে ইংরিজি কাগজ-ইন্ডিয়ান এক্সেপ্রেস, টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া, হিন্দুস্থান টাইমস্, হিন্দু, ডেকান হেরাল্ড–এই সবে বিজ্ঞাপন দেবার মানে হয়। বড় জোর কলকাতার এশিয়ান এজ, দি টেলিগ্রাফ, স্টেটসম্যান। বাংলা কাগজ ওদের নজরে আসবেই না। বাংলাদেশে কি আর ওরা আছে? লিসা শহুরে মেয়ে–মুম্বাই-দিল্লি-চেন্নাই-ব্যাঙ্গালোরের মধ্যেই থাকবে। বড় জোর হায়দ্রাবাদ কি চণ্ডীগড়। নাঃ, বাংলা বিজ্ঞাপনে কেবল আত্মীয়-বন্ধুদেরই নজর কাড়া হবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।