প্রসেনজিতের এটা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাকৃত একাকিত্ব। ও যদি স্বেচ্ছা-নির্বাসনে থাকতে চায়, তুমি কী করবে?
একা তো থাকতে চান না, নির্বাসনে তো আমাকেও সঙ্গী চান–যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দুজনে–
ডেজার্ট আইল্যান্ডে শুধু প্রসেনজিৎ আর সুষমা। না, ডেজার্ট নয়, ড্রিম আইল্যান্ড ইন আ ল্যান্ড অব মিল্ক অ্যান্ড হানি–এইভাবে ভাবো না?
ইয়ারকি কোরো না তো, সুষমার যন্ত্রণাটা বুঝতে পারো না? কিন্তু তোরও দোষ আছে সুষি, কোথায় বেরুচ্ছিস, কখন ফিরবি, এ খবরগুলোতো দিয়ে যাবি কে? সেদিন ফোন করেছি, তোকে চাইলাম, জামাইবাবু বললেন বেরিয়েছিস। কোথায়? জানেন না। কখন ফিরবি? তাও জানেন না। বেশ দুঃখী দুঃখী শোনাল। ন্যাচারালি!
সুষমার ভ্রু কুঁচকে গেল।
এটা কবে?
এই তো, রোববার বিকেলে।
এই রোববার? ৪ঠা? খুব ভালোই জানতেন কোথায় বেরিয়েছি। রোটারি সদনে। একটা ইস্টলেশন মিটিং ছিল। ওঁর নেমন্তন্ন ছিল ওখানে ডিনারে। উনি তো গেলেন না, আমিও মিটিং সেরেই দৌড়ে পালিয়ে এলাম ডিনার না খেয়ে। ওঁর ভয়ে।
তবে যে বললেন, জানেন না?
ওটাই তো পাগলামি।
শুভর খবরও বললেন জানেন না।
সেও ওই। গত চারদিন শুভ যতবার ফোন করেছে, উনি ফোন ধরেননি। কথা বলবেন না। অভিমান হয়েছে।
কিসের অভিমান?
সে তুই ওঁকেই জিগ্যেস করিস। মায়ের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যে উনি নিজের ডাক্তারী কেরিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে বিলেতে পড়তে না গিয়ে এখানেই রইলেন, মেডিক্যাল কলেজে–আর এতবড় একটা গুরুতর অসুস্থ বাপকে ফেলে, ছেলে কিনা ডলারের লোভে পড়ে রয়েছে আমেরিকায়? কেন, টাকার কি অভাব ছিল ঘরে? না চাকরির? তাই কথা বলবেন না। যেহেতু ছেলে অর্থগৃধু।
কি মুশকিল! ওঁদের সময় আর শুভদের সময় কী এক? আমাদের কত বছর বয়েসে বিয়ে হয়েছিল? আর খুকুর বয়েস এখন কত? সে বীরভূমে এস. ডি. ও হয়ে চলে গেল। গৌতমের সঙ্গে বিয়েটা ঝুলেই রয়েছে। হ্যাঁ, বিয়েটা হবে, করছি, করব, এত তাড়া কিসের? এ কি আমরা ভাবতেও পারতুম?
তুই একটু বোঝা না তোর জামাইবাবুকে। শুধু শুভমের ওপরে এত রাগ। সেদিন বলছেন–এমন কুলাঙ্গার ছেলে না জন্মালেই ভালো হত। ষাট ষাট। কি সর্বনেশে কথা? ভাব দিকিনি?
সুষমার অস্থির গলা–এমন ছেলের বাপ না হলেই খুশি হতাম–বলে কেউ? কী করেছে ছেলে? এমন বাপের কাছে কেনই বা ফিরবে বল ছেলে?
তাও তো তোর ছেলে ডিউটি সবই করে। বছরে নিজে একবার আসে, ফিরে গিয়ে বউকে একবার করে পাঠায়, হপ্তায় দুবার তিনবার করে ফোন করে, বউ এসে সংসারে যা। কিছু দরকার সব কিনে দিয়ে যায়–এখানে এক বাড়িতে বাস করেও ছেলে-বউরা এত করে না রে–দেখি তো চাদ্দিকে? শুভমের সত্যি তুলনা হয় না–বউটাও হয়েছে তেমনি চমৎকার।
বাবাকে খুশি করতে মদ-সিগারেট ছোঁয় না। মাংস-টাংসগুলো অবশ্য খেতে ভালোবাসে–সে তো আমিও বাসি–বউটাকে কেন খাবার কষ্ট দেব শুধু শুধু? সেই নিয়ে রাগ। বিদেশে কেন ছেলের বাড়ির হেঁশেলে রসুন-পেঁয়াজ-মাংস ঢুকেছে!
আমার কাছে খান কী করে তাহলে?
তুই তো ভট্টচার্য-বাড়ির বউ নোস। তাছাড়া আজকাল তো খায়ও না বাড়ির বাইরে। দিনকে দিন গোঁড়া হচ্ছে। আমি রেগেমেগে বললুম, এবার থেকে স্বপাক খাও, সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি–তা খাবেন না, এদিকে তো রামকুঁড়ে। ঠাকুরের হাতের নিরিমিষ্যি রান্নাটি চাই, মাছ রাঁধতে হবে আমাকে।
এতর মধ্যে তুই রোজ–সত্যি! দেখালি বটে!
আমিই মাছটা রেঁধে ফেলি। কতটুকুই বা সময় লাগে? এই যখন কলকাতার বাইরে যাই তখন মাছ বেঁধে ফ্রিজ করে দিয়ে যাই। date লিখে দিই প্রত্যেক কৌটোর ওপরে। খুলে খুলে গরম করে দেয় ঠাকুর। এই কায়দাটা বউমা শিখিয়ে দিয়ে গেছে।
বউমা যে নতুন চাকরি পেয়ে তোকে কাপড় কিনতে পাঁচশো ডলার পাঠালো, সেটা বলেছিস জামাইবাবুকে?
পাগল? হিংসের চোটে মরেই যাবেন না? তোমাকে কেন দিল? আমাকে কেন দিল না? এদিকে তুমি যে ওকে কষ্ট দেবে, যন্ত্রণা দেবে, ও কেনই বা তোমাকে ভালোবাসার উপহার পাঠাবে? উনি এটা বোঝেন না। সবই ওঁর কাছে ডিউটি। শ্বশুরের প্রণামী কই? শ্বশুর তো শাশুড়িরও দেবতা? আরেক ধাপ ওপরে না?
য্যাঃ, কী যে বলিস!
তুই এসে দেখেই যা না, ঠিক বলছি কিনা? যেতেই তো চাস না ওঁর কাছে।
তোর বাড়িতে গিয়ে কি কারুর স্বস্তি আছে সুষি? গেলেই মনে হয় তোকে মুশকিলে ফেলা হল। দুটো কথা বলবি, আর জামাইবাবু চেঁচাবেন, শুনছ? শুনছ? একটু এদিকে শুনে যাও– তোর দোটানা পড়ে যায়। একবার এদিকে, একবার ওদিকে। তোরই বেশি কষ্ট এতে। তার চেয়ে তুই যখন এখানে আসিস, তবু একটু হাত-পা ছড়িয়ে গল্প করতে পারিস-ওখানে ওটা হয় না।
আমি গেলে কিন্তু প্রসেনজিৎ দিব্যি বসে গল্প-টল্প করে, বেদ-বেদান্ত পুরাণ-টুরাণ নিয়ে কত জ্ঞান বিতরণ করে, তখন তো ওগো শুনছ করে না?
তখন তো উনি নিজে অকুপায়েড থাকেন। আমি গেলে বেশিক্ষণ ওঁর সামনে বসে বসে গল্প করতে পারি না, সুষি যে একদম রিল্যাক্স করে না ওঁর সামনে, সব কথা তো বলা যায় না ওঁর কাছে—
উনি একা থাকতে পারেন না, আবার আমি ছাড়া আর কারুর সঙ্গে মিশতে ও পারেন না। শুধু এই জামাইবাবুই একলা এক্সেপশন! আদিত্য এসেছে শুনে খুশি হন। আর যে-কেউ আসুক, উনি বিরক্ত!
আমি এলেও? নাঃ, আমি এলে বিরক্ত হন না জামাইবাবু। তবে আমিই বোর হয়ে যাই।