সুষমার এসব ব্যাপারে উৎসাহ আছে। দুঃখী মেয়েদের কাজে নেমে দেখেছেন সারা পৃথিবীই এখন ওঁর অনেক কাছাকাছি। প্রসেনজিৎ এই জগতে পৌঁছুতে পারেননি। তাঁর অহংকার অন্যত্র। তার ছেলের কোনো নেশা নেই।
শুভ-লোপামুদ্রার কাছে বেড়াতে যেতে সুষমার খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু প্রসেনজিৎকে ফেলে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। নিয়েও যাবার উপায় নেই।
দীক্ষার পরে কেউ কালাপানি পার হয় না। সোজা জবাব প্রসেনজিতের।
প্রসেনজিতের যখন বয়েস শুভর মতোই, ইংলন্ডে এক প্রসিদ্ধ হাসপাতালে চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। পিতার অনুমতিও মিলেছিল। সুষমার বিয়ের পর তখন সবে বছর খানেক হয়েছে। রাজশেখরবাবুর সে কী আহ্লাদ! তিনি ঠিক করলেন নিজেই খরচ দিয়ে সুষমাকেও সঙ্গে পাঠাবেন, যদি শ্বশুর তার খরচ না দিতে চান।
কিন্তু লীলাবতীর মত ছিল না। মুখে আপত্তি করেননি, উৎসাহও দেননি। মনের অসম্মতি বাইরে টের পেতে অসুবিধে হয়নি কারুরই। অতএব প্রসেনজিৎ নিজেই বিদেশে যেতে রাজি হলেন না। লীলাবতাঁকে ছেড়ে তিনি যাবেন কীভাবে? মায়ের এত অসুখ, হঠাৎ যদি কিছু হয়ে যায়? মাকে ছেড়ে যাননি প্রসেনজিৎ। তাঁর বাবাও জোর করেননি। ছেলের বিলেত-টিলেত না যাওয়াই তো ভালো? নিজেরও তো বয়েস হচ্ছে তার।
জীবনের সেই সুবর্ণ সুযোগ, F.R.C.S পড়বার শখ এবং সুবিধে, কত অনায়াসেই ত্যাগ করেছিলেন মাতৃমুগ্ধ প্রসেনজিৎ। সেজন্য তার মনে কোনো আপসোসও দেখেননি সুষমা। আশ্চর্য ঘরকুনো মানুষটা।
প্রসেনজিতের বাবা তেমন দুঃখিত না হলেও, সুষমার বাবা যারপরনাই আশাহত হয়েছিলেন জামাইয়ের এই সিদ্ধান্তে। মাতৃভক্তি ভালো, কিন্তু এটা কী বস্তু? ওঁর মায়ের রোগটা তো ক্রনিক ডায়াবেটিস। এবং সেটা এমন কিছু বিপজ্জনক সীমাতেও পৌঁছে যায়নি। অকারণে এত ভয় পেলে কী চলে? রাজশেখর বুঝেছিলেন, কথা বলে কোনো ফল হবে না। প্রসেনজিৎ নিজে যা স্থির করেছেন, তাই করবেন। উন্নতি জলাঞ্জলি দেবেন।
মায়ের অসুস্থতার কারণে জামাই যখন বিলেত গেল না পড়াশুনো করতে, তখন সুষমার পিসিমা জিগ্যেস করলেন, সুষির শাশুড়ির কী অসুখ করেছে? যার জন্যে ছেলে বিলেত যেতে পারল না!
সুষমার বাবা গম্ভীর মুখে উত্তর দিয়েছিলেন–ওঁর মাথায় ডায়াবেটিস হয়েছে।
এই মাথায় ডায়াবেটিস এখন প্রসেনজিতেরও হয়েছে। ওঁর বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে। এই বয়সে ওঁর প্রস্টেটে নির্ঘাত ক্যানসার ছড়াচ্ছে। এখনও তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, নেহাত দুর্ভাগ্যবশত। একেবারে শেষ অবস্থায় বোঝা যাবে। এবং তখন চিকিৎকার সময় থাকবে না। অথচ এখন ধরা কিছুতেই পড়ছে না রোগটা! ফলে চিকিৎসাও হচ্ছে না। কি সুষমা, কি শুভ, এরা কেউ যে অসুখটাতে বিশ্বাস করতে চায় না, সেটা এদেরই হৃদয়হীনতার কারণে। সুরমা এবং আদিত্য এলে অবশ্য প্রসেনজিৎ খুশিই হন, কেননা ওঁরা ওঁর অসুখ নিয়ে পরিহাস করেন না কখনোই বরং মন দিয়ে শোনেন। বেশ সিরিয়াসলি শরীরের খোঁজখবর নেন আদিত্য। পুরুষমানুষ, তারও তো এই প্রবলেমটা হবেই একদিন। আদিত্য সামান্য ছোট প্রসেনজিতের চেয়ে।
.
খেতে বসে সুষমা বললেন,
পরশুদিন ব্যাঙ্গালোরে যাচ্ছি। উনি তো বেজায় গোলমাল শুরু করে দেবেন, ওঁকে এখনও কিছু বলিনি।
সে কি রে? কখন বলবি?
যাবার সময়ে বলে যাব। তোরা একটু যাস। আমি তিনদিন বাদেই ফিরব। যেতে-আসতেই দুটো দিন নষ্ট–মিটিঙে থাকছি তো মিনিমাম সময়।
তোর এইসব ব্যাপারে প্রসেনজিৎকে সঙ্গে নিতে পারিস না, না? কোনো কাজে টাজে?
সঙ্গে এলে তো নেব? এত বড় ডাক্তার, আমাদের সংগঠনে ওঁর কতকিছু করবার আছে–তা উনি শুধু হিন্দুধমের সেবা করবেন। আমি হিন্দুধর্মের সেবা করি না। আমার সংগঠন সব ধর্মের দুঃখী মেয়ের জায়গা আছে, সব ধর্মের কর্মী আছে।
সত্যি ডাক্তার হয়ে উনি যে কী করে এসব মৌলবাদী কথাবার্তা বলেন, আমি বুঝি না।
এই যে তুমি আলাদা একটা কর্মজীবন গড়ে নিয়েছ, তোমার এই কাজের জগতে প্রসেনজিৎকে তুমি মোটে এন্ট্রি দাওনি–ওটা তোমার একার এরিয়া–এইজন্যেই এতটা অস্থির হয় ও। হিন্দু নারী-টারী করলে তার মধ্যে ওঁরও একটা ধর্মীয় রোল থাকত–কিন্তু তোমার হয়ে গেছে পিওর মানবধর্ম, প্রসেনজিতের ধর্মবিশ্বাসের সেখানে জায়গা নেই–এইটেই ওঁকে এতটা ইনসিকিয়োর করে ফেলেছে, যত জেলাস হচ্ছে, তত পজেসিভ হচ্ছে, যত পজেসিভ, তত অ্যাগ্রেসিভ–যাই বলো সুষি, রূপসী বউকে একা ছেড়ে দিতে কার না বুক ধুকপুক করে?
থামুন তো জামাইবাবু? দেখছেন আপনাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করলেও উনি শরীর খারাপ বলে আসেন না, সল্টলেক নাকি অতিরিক্ত দূরে। তিনি যাবেন আমার সঙ্গে মিটিং অ্যাটেন্ড করতে?
সুরমা দুজনের প্লেটেই টাংরী কাবাব তুলে দিতে দিতে বলেন, সত্যি জানোই তো, উনি চিরকালই আমিটি-আর-তুমিটি। আগে ছিলেন শুধুই মা, এখন হয়েছে শুধুই বউ। বউ যদি অসুখ বলে শুয়ে থাকত। তাহলে উনি নিজে আর শুয়ে পড়তেন না, উঠে পড়ে বউকে তেড়ে যত্ন করতেন।
যা বলেছিস সুরো। উনি অবশ্য কেউ অসুস্থ হলেই সেবা করবেন, তা ভেবো না। দিদি তো অসুস্থতার সঙ্গে মুখ-দেখাদেখি নেই। এমনকী ভাইফেঁটাতেও যান না–বিজয়ায় আমি একাই যাই–যোগাযোগ সবই আমার সঙ্গে–অথচ একমাত্র দিদির ওই তো একটা মাত্র ভাই–