তুই আমাকে কীরকম ধমক লাগালি? সুষি, না শিগগির পিঁড়ি থেকে–আর অত হাসতে হবে না
আর শুভও কেমন বকুনি দিল তোকে? যেটা জানো না সেই সব যে কেন করতে যাওয়া? ঠাম্মাকেই বললে পারতে, এসব ঠাম্মার লাইনের ব্যাপার। এদিকে বিধবা বলে যে ঠাম্মা স্ত্রী-আচার কিছুই করতে পারছেন না,
অতএব তড়িঘড়ি শয্যা নিয়ে নিলেন–সেও স্ত্রী-আচারই বটে!
নাগো, শুধু ওইটেই বোলো না, সুরমা স্বামীকে মৃদু ভর্ৎসনা করেন, সেদিন উনি নিজে যদি ছেলেকে ডেকে না বলতেন, যাও বাছা জিতু, ছেলেকে নিয়ে বিয়ে দিতে যাও, আমি ঠিক থাকব, বউমা তো কাছে রইল–তাহলে তুমি যতই লাফাও না কেন, উনি যেতেন না, মাকে নিয়ে মায়ের পাশে বসে থাকতেন, আর বলতেন, আদিত্য বরং বরকর্তা হয়ে যাক! মা নিজে অনুমতি দিলেন বলেই জামাইবাবু সেদিন বর নিয়ে গেলেন।
ওটাই তো খেলা। ইঁদুর-বেড়াল খেলা। পাওয়ার গেম। এই সুতো টানছি, এই সুতো ছাড়ছি–
যাকগে এখন তো নেই। ওসব কথা থাক না—
নেই, কিন্তু ছেলেকে ট্রেনিং দিয়ে গেছেন।
সত্যিই ছেলের মধ্যে দিয়েই লীলাবতী বেঁচে আছেন। বিবাহে অনুমতি দিলেও ওঁর প্রকৃতপক্ষে পছন্দ ছিল না লোপাকে। তার মতন ক্যাটকেটে ফর্সা রং নয়, অতএব সে রূপসীও নয়। এখন তো তার ছেলেই অবিকল মায়ের মনের-প্রাণের কথাগুলো বলেন। প্রসেনজিৎ যেন তার বাবা এবং মায়ের যুগ্ম প্রতিধ্বনি।
শুভম জানত তার গোঁড়া জাত-পাত ঠিকুজি-কুলুজি-গোত্র-কোষ্ঠি-মানা উগ্র হিন্দুত্ববাদী পরিবারে এ বিয়েতে অনুমতি মিলবে না। বাবা লোপামুদ্রাকে গ্রহণ করবেন না। মনে মনে দশ বছর ধরেই সে প্রস্তুত হচ্ছিল, বাবা আপত্তি করলে, তার পরবর্তী ধাপগুলি কী কী হবে, সবই হিসেব কষা ছিল তাদের। যথারীতি বাবা আপত্তি করলেন। কিন্তু চমক বাকি ছিল লীলাবতীর জপের থলিতে। নাতির বেলায় লীলাবতীর মনের ভাব বদলে গেল, তিনি লোপামুদ্রাকে গ্রহণ করলেন। আহা, বামুনের মেয়ে তো? স্ত্রীর দুষ্কলাদপি, বারেন্দ্র তো কী হয়েছে–ওদের সঙ্গে বেশি দহরম-মহরম না করলেই হল। মার মত আছে যখন, তখন আর প্রসেনজিৎ অমত করেন কী করে? বিয়ে ভালোভাবেই হল, ওঁদের একমাত্র সন্তানের বিবাহ ঠিক যেমনভাবে হওয়া উচিত। না, এককড়ি পণও নেননি অহংকারী প্রসেনজিৎ।
.
কিন্তু বিয়ের মাস দুয়েকের মধ্যে শুভম বউকে নিয়ে সাতসমুদ্র পেরিয়ে উড়ে পালাল। গায়ত্রী মন্ত্র জপ না করে জলস্পর্শ না করা, বাড়িতে থাকলে ধুতি পরা, নিয়মিত পৈতে মাজা, বাড়িতে মাংস-রসুন-পেঁয়াজ-বিড়ি-সিগারেট না খাওয়া, এইসব বিচিত্র নিয়মকানুন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিল শুভম্ লোপামুদ্রাকেও। ভালো ছাত্র হলেও সে চিরদিনই খেলাধুলো, হাসিঠাট্টা ভালোবাসে, দায়ে পড়ে ঠাকুরঘরে পা দেয় একমাত্র পরীক্ষার দিন সকালে।
আমেরিকাতে গিয়ে দুজনে মন দিয়ে পড়াশুনো শুরু করে দিল। কিন্তু প্রতিবছরই একবার নিজে আসে, আর একবার বউকে পাঠায়। ছমাস অন্তরই তাই একজনের সঙ্গে দেখা হয়। আর উপহারের তো অন্ত নেই। বাড়ি ভরে গেছে ওদের আনা গ্যাজেটে। সুষমার অবশ্য সেসব ব্যবহার করবার মতো সময় নেই। তিনি বাইরের কাজে ব্যস্ত। কিন্তু ছেলে বউয়ের ভালবাসা সুষমা ছুঁতে পারেন। ওদের দূরে থাকাটা যে ভালবাসার অভাবে নয়, সেটাও বোঝেন। যে-সময়ে ওরা পৃথিবীতে এসেছে, সেই সময়টা বড় নির্মম। বাড়ি থেকে বের হয়ে, সুষমা এই দশ বছরের নতুন দৃষ্টি পেয়েছেন, অনেক কিছু শিখেছেন। ঘরে বন্দি হয়ে থেকে প্রসেনজিৎ যা শিখতে রাজি নন।
এখন ওদের রোজগার ভালো। দুজনেরই গবেষণা এখন যে পর্যায়ে, তাতে খানিকটা হাঁপ ছাড়ার ফুরসৎ আছে। বারবার টিকিট পাঠাতে চাইছে শুভ, বাবা-মাকে কাছে নিয়ে যেতে চায়। বস্টনের প্রত্যন্তের এক গ্রামে, সুন্দর বাগানঘেরা বাড়িতে আছে ওরা, অনেক পাখি আসে সেই বাগানের বড় বড় গাছে, আর প্রচুর ফুল ফোটে, সুবাস ভেসে থাকে বাতাসে। নানাভাবে লোভ দেখায় শুভ। লোপা খুব চমৎকার রান্না করতে শিখেছে। লোপা অপূর্ব গাড়ি চালাচ্ছে। তোমরা এলে নায়াগ্রা ফলস্ দেখাতে নিয়ে যাব। তোমরা এলে ক্রস কান্ট্রি ট্রিপে বেরুতে পারি, বস্টন টু একেবারে সানফ্রানসিকো। সুষমার খুব ইচ্ছা করে। লোপামুদ্রার বাবা-মা গত বছর ঘুরে এলেন। ওঁরা তো উচ্ছ্বসিত।
কিন্তু, না। প্রসেনজিৎ যাবেন না। এ বয়সে ম্লেচ্ছ দেশে যাবার প্রশ্ন নেই। অল্পবয়েসেই যখন গেলেন না! ছেলে তবু বলেই যায়–আরে এসো তো একবার? দেখে তো যাও আমরা কোথায় থাকি, কেমন বাড়িতে থাকি, কী খাই, কোথায় কাজ করি, কারা আমাদের বন্ধু, অবসরে কী করি? তোমাদের জানতে ইচ্ছে করে না?
নো থ্যাংক ইউ। প্রসেনজিতের এক কথা। তোমরাই এসো। দেশে ফিরে এসো। এইখানেই তোমাদের থাকার কথা। এটাই সত্য। এটাই বাস্তব। ওটা স্বপ্ন। স্বপ্নের বাড়িঘর দেখে আমি কী করব?
প্রসেনজিতের নিষেধ মেনে তার ছেলে (বউও। সুষমা তো দেখছেন, এখন এ ব্যাপারে মেয়ে-ছেলেতে আর ফারাক নেই) মদ-সিগারেট খায় না। আমেরিকাতে সকলেই, কি পুরুষ, কি মেয়ে, নির্বিচারে মদ-সিগারেট খায় বলে প্রসেনজিৎ বিশ্বাস করেন। কিন্তু শুভ বলেছে, অনেকেই আছেন যাঁরা মদ ছোঁন না। প্রচুর সংখ্যক অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে ওখানে নিরামিষ খাওয়া শুরু করেছে। এবং শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা ধূমপান করাকে অমার্জিত সমাজবিরোধী আচরণ বলে মনে করেন। শিক্ষিত সমাজে ধূমপান এখন খুবই কমে গেছে। কাজেই শুভরা মদ-সিগারেট খাচ্ছে-কি-খাচ্ছে-না, এটা ওদের কাছে কোনো বড় কথাই নয়। বিশ্বভুবনের এই মরণোন্মুখ হাওয়া-বাতাসটুকুকে যতটুকু বিষমুক্ত রাখা যায়। গাড়ি তো চালাতেই হচ্ছে। যদিও ওদেশে এখন নানারকমের পলিউশান কন্ট্রোলের কায়দা তৈরি হয়েছে।