.
অষ্টম অধ্যায়। ক্যালি ফস্
সুষমার আসার কথা না আজকে? রান্নাঘরে চলে এসেছেন আদিত্য। সুরমা চপ গড়ছেন দাঁড়িয়ে। জানলা দিয়ে আলো এসে পড়ছে সুরমার মনোযোগী মুখের ওপরে। আদিত্য দেখেন, কোমরে আঁচল গোঁজা। সুরমা, সুষমা দুই বোনেরই গড়ন খুব সুন্দর। মেদহীন, দীর্ঘাঙ্গী, একমাথা চুল, লাবণ্যে উদ্ভাসিত মুখ বুদ্ধিতে উজ্জ্বল। অবসর নেবার পরে আদিত্য নতুন করে সুরমাকে দেখতে সময় পেয়েছেন। সুরমা আপনমনে গুণগুণ করে গান করছেন। যদি হয় জীবনপূরণ নাই হল মম-রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুরমার শিক্ষয়িত্রী হিসেবে প্রচুর সুনাম। সুরমার গলাটাই পেয়েছে শিলু!
হ্যাঁ, সুষির জন্যই তো মাংসের চপটা বানাচ্ছি। এই এল বলে। তোমার কচুপাতা রেডি তো? সুরমা হেসে স্বামীর দিকে তাকান।
সত্যি, কী একটা বাড়ি! মাংস ঢুকবে না, পেঁয়াজ রসুন ঢুকবে না–সারাটা জীবন সুষিটা কষ্ট করে গেল।
আর ডাক্তার প্রসেনজিৎ ভট্টাচার্য সারাদিন ধুতি পরে খালিগায়ে বসে বসে ভাগবত আর গীতা পড়ছেন, দশবার হাত ধুচ্ছেন, আহ্নিক করছেন–আমি বাবা শুভমকে দোষ দিই না, ছেলেটা পালিয়ে গিয়ে বেঁচেছে। ওকে ধুতি পরানোর জন্য কম চাপ দিচ্ছিল প্রসেনজিৎ? গায়ত্রী না জপ করলে বেড-টি পাবে না! অ্যাবসার্ড!
আদিত্য চামচ করে একটু মাংসের পুর তুলে মুখে পুরলেন।
আরে? ও কি ছোঁক ছোঁক? এক্ষুনি তো চপ তৈরি হয়ে যাবে। ছদ্ম বকুনির সঙ্গে সুরমা প্লেটে করে আরেকটু পুর তুলে দিতে দিতে বলেন,
সত্যি, কী করে পারল যে সুষিটা এতদিন পাগল না হয়ে থাকতে? আমি হলে তো কবেই পালিয়ে যেতাম। ওই শাশুড়ি! ওই শ্বশুর! ওই স্বামী! প্রত্যেকেই এক একজন মহাপুরুষ!
পুরটা সত্যি দারুণ হয়েছে–থ্যাংকিউ। কিন্তু অত নিন্দা কোরো না, নিজে কিনা। দেবতার মতন বর পেয়েছ, তার ওপরে নো শ্বশুর, নো শাশুড়ি, তাই অন্যের বেলায় অত কঠোর কথা–
আহাহা! সাধে কি দেবতার মতন বর? দেবীর মতন বউয়ের জন্যে তো দেবতা হতেই হবে। বুঝলেন রায়মশাই?
অথবা অসুরও তো হতে পারে?
বলতে বলতে ডোরবেল বাজে।
আমি দেখছি–সুরমার আগেই আদিত্য ছুটলেন দরজায়। হইহই করে সুষমা ঢুকলেন।
কই? কচুপাতা কই? হবে না! হবে না। তারপরেই–আরে, কী তৈরি করছিস রে সুরো? এত সুগন্ধ বেরুচ্ছে? ঢুকেই খিদে পেয়ে গেল? কী রাঁধছিস আজ আমার জন্যে? গন্ধে ভুরভুর করছে বাড়িঘর?
তোমার তো বাছা পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ শুঁকলেই খিদে পাবে। যেমন নিরামিষ্যি বাড়িতে রাঁধাবাড়া তোমার!
সত্যি বাবা যে কী দেখে আমার বিয়েটা দিয়েছিলেন?
কেন? দেখতে তো সবই ভালো। জামাইবাবুর মতো সুপুরুষ তুই আর দেখেছিস? আমি দেখিনি। এই সেদিনই তোর জামাইবাবুকে বলছিলুম সেই কথা–পাত্র তো আইডিয়াল! রূপ, বংশ, ধনরত্ন, শিক্ষা, চাকরি, জাতকুল, মায় কোষ্ঠী পর্যন্ত সবই তো মিলেছিল। খুচরো পাগলামির খবরটা তো কেউ সংসার না করলে বুঝবে না। ওটা কোষ্ঠীতে লেখা ছিল না!
সত্যি! এতগুলো বছর কেটে গেল, সেই সতেরো থেকে রওনা হয়ে এই ছাপান্নোয় এসে পৌঁছেছি। তবু মনে আরাম পেলান না। সদাসর্বদা মনটা যেন কান খাড়া করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে! কী হয়-কী হয়! ভয়ে টানটান হয়ে থাকা!
তোমার বোন বলছিল, সে হলে কবেই পালাত! তুমি মহীয়সী, গরীয়সী, পটিয়সী পূর্ণশশী, তাই এখনও প্রসেনজিতের ঘর করছ!
না-না, উনি মানুষটা তো মন্দ নন? আমাকে সত্যি সত্যি প্রাণের সমান ভালোবাসেন। সেটা কিন্তু ভুল নয়।
কেবল নিজের মাকে প্রাণের চাইতেও অনেক বেশি ভালোবাসেন। তাই তো?
সেটা আর কী করা! লীলাবতী-ফিক্সেশনটা ওঁদের বংশগত রোগ, জামাইবাবু! ইটস্ আ ডিজিজ।
ওই যে গেল গেল ভাব, সর্বক্ষণই এই বুঝি-মা-মরে গেল, এই মিথ তোর শাশুড়ি নিজে নিজেই বানিয়েছিল, সুষি।
মহিলা নিজের দিকে অ্যাটেনশন কী করে ড্র করতে হয়, খুব ভালোরকম জানতেন। খুব এফেটিভ হত ওঁর তুকতাক–আদিত্য সোফায় বসতে বসতে বলেন, হায়রে, আমরা যদি তার এককণাও জানতাম! মনে আছে, শুভর বিয়ের দিনে কী কান্ড করলেন?
মনে নেই আবার? সুরমা রান্নাঘর থেকেই যোগ দেন, হঠাৎ তোর শাশুড়ির এমনই শরীর খারাপ করতে লাগল, যে বাড়িসুদ্ধ তারই সেবাশুশ্রূষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল, বর বেরুতে একটু দেরি হয়ে গেল!–ব্যস্! জামাইবাবু বললেন, যাত্রার লগ্ন ওভার! যাত্রা নাকচ। এখন লগ্ন নেই। মাথায় বাজ পড়ল সবার!
ওই তো সাড়ে পাঁচটার সময় বর নিয়ে বেরুবার কথা, আমরা বর বরণ শুরু করতে করতেই সাড়ে পাঁচটা বাজিয়ে ফেললুম–উনি হিসেব কষলেন বেরুতে বেরুতে পৌনে ছটা হয়ে যাবে, ব্যস্ উনি বেঁকে বসলেন Its too late for today বলে। ভাগ্যিস তোরা ছিলি! জামাইবাবু, আপনি জবরদস্তি না করলে সেদিন সত্যি আমার ছেলের বিয়েই ভেস্তে যেত! কী যে পাগলামি আছে ওঁর!
হ্যাঁ, সত্যি, সেদিন ও যদি ঠেলেঠুলে বরযাত্রীদের গাড়িতে না তুলে দিত, চেঁচামেচি না জুড়ে দিত, কেলেঙ্কারি হয়ে যেত। অথচ বিয়ের লগ্ন ঢের দেরি ছিল, রাত দশটার পরে টাইম।
উঃ! শুধু শুধু কী হট্টগোলটাই বাধালেন! আর সেই গোলমালে আমি কী করলাম? মনে আছে তোর সুরো? সেই যে বরকে বরণ করতে গিয়ে? হঠাৎই-সুষমা সুরমা আদিত্য তিনজনের অট্টহাসিতে ঘরের দেয়াল চমকে ওঠে।
মনে আবার নেই? ঘাবড়ে, নার্ভাস হয়ে, ভীতু ভীতু মুখে, ঘোমটা টেনে বরণ-ডালাটি হাতে নিয়ে তুই টুক্ করে পিঁড়ির ওপরে উঠে দাঁড়ালি, আর শুভ রইল মাটিতে। দিব্যি মন দিয়ে বরণ করতে শুরুও করেছিলি, হঠাৎ কে যেন বলল, আরে আরে? ও কী হচ্ছে? বরের মা কেন পিঁড়িতে? বর যে মাটিতেই দাঁড়িয়ে রইল? তারপরে আর তুই বরণ করবি কি, নিজেই হেসে কুটিপাটি!