সুষমা বলে, তোমাকে অত ভাবতে হবে না। যত কুচিন্তা! বলে, আমি বাড়িতে না থাকলে এমনিতেই এক গেলাস জল চাইল বাছু মণির মা রঘু পঞ্চাশবার চেঁচিয়ে তবে তুমি এক গেলাস জল পাও। মরে গেলে কী হবে তাই নিয়ে ভাবো কেন? তাছাড়া শাস্ত্রই যদি মানবে তবে তাতে আছে পুত্রবানদের পুত্র জল দেবে, কিন্তু যাদের কেউ নেই, তাদের তো হিন্দুমতে প্রত্যেকেই জল দেবে। কত জল খাবেন তোমার চোদ্দোপুরুষ?
শুভকে কে জল দেবে? বললেই খেপে উঠে সুষমা উল্টে আমাকে বকে, ছেলে বেঁচে থাকতে তার শ্রাদ্ধের কথা ভাবে, এমন বাবা দেখিনি! অথচ কবছর আগেও সুষমা এভাবে কথা বলত না। ওরা দুবোন ছিল দুরকমের। সুষমা ছিল নীরব, ভীতু, চাপা। সুরমা ছিল স্পষ্টবক্তা। এখন দেখছি সুষমাও তার বোনের মতনই হয়ে যাচ্ছে। আজকাল সুরমার মতনই সুষমাও স্পষ্টকথা বলে। বাইরের পাবলিকের কাছে বক্তৃতা দিতে দিতে ওর সঙ্কোচটুকু কেটে গেছে। আগে কখনও আমার মুখে মুখে কথা বলত না সুষমা।
আমি যে সুষমাকে ছাড়া বাঁচতে পারি না। আমার যে সুষমার বাইরে কোনো জীবন নেই। কোনো পৃথিবী নেই। সেটা সুষমাকে কিছুতেই বোঝাতে পারি না। যতই চেষ্টা করি না কেন, প্রেমে, অভিমানে, রাগে কিছুতেই ওকে ধরে রাখতে পারি না। অথচ ওকে ঘরে না বাঁধতে পারলে আমার শরীর সারবে না। আমার রোগেও উদ্বিগ্ন হয় না আজকাল। উল্টে কেবলই আমাকে বাড়ি থেকে বের করতে চায়। কেবলই বলে, বাড়ি বসে বসে ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছ, তাই রোগ, আর রাগ, এই দুই বাতিক হচ্ছে, ঠিক তোমার মায়ের মতন।
সুষি কথায় কথায় আমাকে এখন বলে, তোমার মায়ের মতন।–আর ওই কথাটা আমার বিশ্বাস ওকে সুরমাই শিখিয়েছে। ওই রোগ আর রাগ। আমার মনে আছে অনেকদিন আগে সুরমা একবার আমাকে বলেছিল, জামাইবাবু, আপনার মায়ের এই রোগ আর রাগ সামলাতেই সুষিটার জীবন কেটে গেল! সুষি এখন আমাকে ওই কথা বলে। তোমার এই রোগ আর রাগ! আবার বলে, রাগটাও নাকি রোগ। রিটায়ারমেন্টের পর অনেক লোকেরই এরকম ডিপ্রেশন হয়। তাই সুষমার চেষ্টা হয়েছে কেবলই আমাকে ব্যস্ত রাখা। ওর ইচ্ছে আমাকে আবার কাজে ঢোকানো। বাড়িতেই চেম্বার বানিয়ে রেখেছিল, আমি প্র্যাকটিস করব বলে। পাগল? দুবেলা বাড়িভর্তি রুগি আসুক, লাইন দিয়ে থাকুক, আমি ওই করি আরকি! আমার তো বলতে নেই বাপ-ঠাকুর্দার দয়ায় অন্নসংস্থানের ব্যবস্থার অভাব নেই।
সুষমার বা এই বুড়ো বয়সে রাস্তায় বেরিয়ে মিটিঙে মিটিঙে চক্কর মেরে বেড়ানোর কী দরকার ছিল? হিন্দু ধর্মের সেবা তো চুলোয় গেছে। হিন্দু শব্দটা ও রাখেনি কোথাও ওর সংগঠনে। কিসের জন্যে স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করলাম, আর কী হয়ে গেল!
মানুষজন, দিনকাল চোখের সামনে সব কেমন আশ্চর্যভাবে পাল্টে যাচ্ছে। অবাক হয়ে দেখি আমার স্ত্রী-পুত্র আমার অসুস্থতাকে মোটে গুরুত্বই দেয় না। অথচ আমার মায়ের অসুস্থতাকে আমরা বাপ-ছেলেতে কতটা গুরুত্ব দিতাম! মায়ের দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা সদাসর্বদা সশঙ্কিত থেকেছি। সুষমাও তা দেখেছে। অথচ আমার বেলায় তার মনোভাব অন্যরকম।
ছেলে তো আরও এককাঠি। শুভ দেশে এলেই কেবল বলবে, বাবা তুমি নিজেকে প্রশ্রয় দিও না, এটা খুব বিপজ্জনক রোগে পরিণত হতে পারে–ট্রাই টু ওভারকাম ইট।
–যেন এখন আমার কোনো বিপজ্জনক রোগ নেই–ঠাকুমার মতন তোমারও কিন্তু হাইপোকনড্রিয়া হচ্ছে, এই থেকে শেষে মেনিক ডিপ্রেসিভ হয়ে যাবার ভয়–আরে ডাক্তার কে? তুই? না আমি? আমার অসুস্থতায় আমার সবচেয়ে আপনজনরাই বিশ্বাস করে না। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? হাউ টু কভিন্স দেম? আই হ্যাভ ওনলি আ ফিউ ডেজ টু গো!
সুষমা হরেক রকম করে চেষ্টা করে আমার রোগটাকে উড়িয়ে দেবার। আমার কথাটা শোনো! কিছু হয়নি গো তোমার! তুমি তো সুস্থ সবল পুরুষমানুষ, কেন রুগি সেজে শুয়ে থাকো বলো তো? চলো আমার সঙ্গে দিল্লি বলে টানাটানি করবে। যখন-তখন সেজেগুজে এসে বলবে, কী করছ? চলো, একটু বাজার করে আসি! আরে, আমার কি শরীরে পোষায়? সুষমা বুঝতেই পারে না। ইদানিং এমন হয়েছে যে ওকে চোখের আড়াল করলেই আমার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। সুষমা সেটা বুঝেও বুঝতে চায় না। স্বামীসেবা ব্যাপারটাকে মোটে গুরুত্বই দিতে চায় না আজকাল, অথচ শাশুড়ির কী অক্লান্ত সেবা করেছে। নার্স থাকতেও, আয়া থাকতেও, নিজের হাতে পায়খানা পরিষ্কার করেছে মায়ের। সুষমার হাতের সেবাটিই মা চাইতেন, তাতেই তার তৃপ্তি ছিল। তাতে সুষমাও কখনও আপত্তি করেনি।
আর এখন? আমি যদি বলি, সুষি, একটু পাশে এসে বসো, মাথায় একটু হাতটা বুলিয়ে দাও, হাতে কাজকর্ম না থাকলে, আসবে, হাত বুলিয়ে দেবে। কিন্তু যদি মিটিং থাকে? মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মণির মাকে, কি বাচ্চুকে ফিট করে দিয়ে ঠিক বেরিয়ে চলে যাবে। মিটিং ক্যানসেল করে আমার কাছে বসে থাকবার পাত্রী নয় সে। অথচ কত অন্যরকম ছিল আগে!
মুখে প্রকাশ করে না বটে, কিন্তু আমি বেশ টের পাই যে, লোকজন এলে, তার মধ্যে থেকে ওকে ডেকে পাঠালে সুষমা বিরক্ত হয়। হয়তো সুরমা এসেছে, ওরা দু-বোনে গল্প করছে নীচে। তখন আমার মাথাব্যথা করল। আমি ডেকে পাঠালাম, ওপরে এসো, আমার মাথাটা টিপে দিয়ে যাও–কিংবা ওর সংগঠনের কর্মীরা এসেছে কোনো আলোচনা চলছে। তখন আমার শরীর খারাপ লাগছে। আমি খবর পাঠালাম, এসো, আমার প্রেশার চেক করে ওষুধ দিয়ে যাও–এসব সময় ও সর্বদাই চলে আসে, মাথাও টিপে দেয়, প্রেশারও চেক করে, ওষুধও দেয়, যা বলেছি সবই করে, মুখে কিছু বলেও না–কিন্তু হাবেভাবে বুঝিয়ে দেয় যে এটা ও খুশি হয়ে করছে না। ওর যে নিজের কাজে বিঘ্ন ঘটছে, সে-ভাবটা একটুও গোপন করে না। আমার মা-বাবা এই সুষমাকে দেখে যাননি। তারা পুণ্যবান মানুষ ছিলেন!