এমনি করে করে সুষির অনেক পুণ্যার্জন করা হয়ে গেছে এ জীবনে, এত পুণ্য আর আমার সহ্য হচ্ছে না–এবার একটু-আধটু পাপ করা খুব দরকার হয়ে পড়েছে। মন্দ কপাল আমার, ভাগে সেইটেই পড়ে গেল। শাশুড়িসেবায় সব এনার্জি শেষ, এখন পতিসেবাতে তাই ঘাটতি পড়ে যাচ্ছে।
কি অদ্ভুত মানুষ! এই যে শিলুকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না, ছমাসের ওপর ছেলেটা নিরুদ্দেশ, তা নিয়ে ওঁর বিন্দুমাত্র উদ্বেগ নেই, মনোকষ্ট নেই। কেবল ওই একই কথা মুখে–
-বুড়ো বাপ-মায়ের দায়িত্ব নেবে না, তাই ভেগে পড়েছে। কিসসু হয়নি, দেখবে আমেরিকায় গিয়ে বসে আছে।
মায়া-দয়াও কি নেই? চিন্তা-ভাবনা তো নেই-ই। বাপ-মায়ের দায়িত্ব নেবার জন্যে শ্রাবস্তীর মতন একটা মেয়ে রয়েছে, সেটাও খেয়াল নেই। সুরো শক্ত হয়ে আছে, জামাইবাবু এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু আমি তো বুঝতে পারছি ওদের ভেতরে কী হচ্ছে? উনি কেন বুঝবেন না?
দৃষ্টিটা আত্মকেন্দ্রিক হতে হতে এমনই সংকীর্ণ হয়েছে যে নিজের বাইরে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না, শিলুকে কেন, শুভকেই কি দেখতে পাচ্ছেন? নিজেকে বাদ দিয়ে নিজের সন্তানের কথাও ভাবতে পারছেন না আজকাল। আশ্চর্য অন্ধতা! কী সন্তান-স্নেহই যে এঁকে শেখালেন এঁর মা-জননী!
২. পুত্রেষ্টি
সপ্তম অধ্যায়। পুত্রেষ্টি
পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করত সেকালে। আমরাই বা কি কম করি? ছেলেকে লেখাপড়া শেখানো আজকাল যজ্ঞের মতন! উপযুক্ত পুত্র কিন্তু ফললাভ হয় কীদৃশ?
উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশযাত্রা। এবং সেই যাওয়া হয় অগস্ত্যযাত্রা। মা-বাপকে ছেড়ে তারা দূরে চলে যায়। নিজেদের প্রবল কর্মযজ্ঞে এমনই নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, সেই উচ্চাশায় জলস্তম্ভে মা-বাপ মাতৃভূমি সব ঘুচে মুছে যায়।
এত কষ্ট করে লেখাপড়া শেখানো, মা-বাপের কোনো কাজে লাগে না। এ যেন পুত্র বিসর্জন দেবার মন্ত্রপাঠ! শুভ চলে গেছে। আমেরিকায়। শিলাদিত্যও শুনছি দিল্লিতে চলে গেছে। কেন, এখানে লেখাপড়া হয় না? এখন দিল্লি। পরের ধাপ আমেরিকা। আর ফিরবে না। কোনোদিনই না। এদেশটা ওদের ভালোই লাগে না।
পুত্রসন্তান প্রার্থনা কি এইজন্যে? আমেরিকা! আমেরিকা! আমেরিকা! ওদের ধ্যানজ্ঞান আমেরিকা, ধর্মকর্ম আমেরিকা। সেই স্বপ্নরাজ্যেই চলে গেছে আমার ছেলে-বউ! আর কোনোদিনও ফিরবে না ভবানীপুরের এই গলিতে। সুষমা বলে, কেন? বছর বছর তো আসছে? আরে, বেড়াতে আসা, আর দায়িত্ব নিয়ে বসবাস করা কি এক হল? সুষমা বলে, আজকাল দিল্লি-বম্বেতেও যা, বিলেত-আমেরিকাও তাই। হপ্তায় হপ্তায় তো ফোন করছে। কিছু তেমন হলেই ছুটে আসবে।
ছুটে আসবে না হাতি। নিজেদের ছুটি-ছাটা হিসেব করে তবে তো আসবে? মিঞা-বিবির টাইমিং চাই তো? আমি সর্বদা সক্কলকে বলি, খবরদার শুভমদের ইসকুলে ছেলে পড়িও না। পেট থেকে পড়েই প্রেম করতে শিখে যাবে ওখানে। তার পরেই শিখবে আমেরিকা পলায়নের কৌশল। যদি ছেলেকে জন্মের শোধ নির্বাসনে পাঠিয়ে দিতে চাও, তো ওই ইশকুলে দাও। রেজাল্টের লোভ করতে গিয়ে মূলে হা-ভাত হয়ে যাবে!
.
বউটা আবার বাঁজা। আমাদের দিয়ে তো মেয়ে পছন্দ করায়নি, নিজেই নিজের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে সেই হামা টানার সময় থেকেই। তর সইল না, বিয়ে করে ফেললে ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা শেষ হতে না হতে। তখনো রেজাল্ট বেরোয়নি। দুজনেই ফাস্ট ক্লাস। দুজনেই সোনার মেডেল। দুজনেই ফেলোশিপ। দুজনেই ফুড়ুৎ করে উড়ে পালাল। নাগালের বাইরে একবার চলে গেলে কি আর ধরা যায়? এই সুষমাকেই তো দেখলুম।
মেয়ে সবর্ণ বলব না, বামুন বটে, কিন্তু বারেন্দ্র। আমাদের ভট্টচায্যি বাড়ির উপযুক্ত বউ সে নয়। বাঙালবাড়ির মেয়ে। বাবা উদ্বাস্তু। কিন্তু স্পষ্ট দেখেছি মেয়েটার কপালে একটা আঁচিল–কপালে আঁচিল মানেই সে মেয়ে অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারিণী হবে। কিন্তু আঁচিলটা ডান কপালে। মুখের ডানদিকে আঁচিল, মেয়েদের পক্ষে সুলক্ষণ নয়। কথাটা বললুম শুভমকে ডেকে। সে ছেলেও তেমনি। সে তো হেসেই উড়িয়ে দিলে। উল্টে আমাকেই বলল, বাবা, সামুদ্রিক জ্যোতিষে পুরুষমানুষের কোনো লক্ষণবিচার নেই? তুমি আমাকে দেখে বলো তো আমার কী কী সুলক্ষণ, কী কী দুর্লক্ষণ আছে? এই যে আমার পড়ে গিয়ে ডান কপালে কাটার দাগ, এই দক্ষিণ ললাটে ক্ষতচিহ্ন মানে কি আমার কপাল ফুটো? আমি কি ভাবতেও পারতাম আমার বাবার সঙ্গে এভাবে ঠাট্টা-ইয়ারকি দিয়ে কথা বলছি? আমার মা কখনো তা অ্যালাউ করতেন? কিন্তু সুষমা কিছু বলে না, হাসে।
আশ্চর্য, বাঁজাবউ বললে, সুষমাই খেপে যায়। বলে, ওরা ইচ্ছে করেই, পরিকল্পনা করেই এখন বাচ্চা চায় না–এখন দুজনেই রিসার্চ করছে, ভীষণ ব্যস্ত থাকে, বাচ্চা হলে তাকে দেখবে কে? আমি যদি জোর করি, বলি, কেন তুমি দেখবে–তখন কথা ঘুরিয়ে বলে, বউ বাঁজা, না ছেলে বাঁজা, তা তুমি পরীক্ষা করিয়েছ? এটা আবার কথা?
আমার যে কোথায় দুঃখু, সুষমা বোঝে না। পরিহাস করে। যত বলি আমার পূর্বপুরুষ জলটুকুও পাবে না সুষমা বলে,
ষাট! কী কথার ছিরি! আমাদের তো শুভ আছে। আমরা জল পাব না কেন? তোমার কি ছেলে হয়নি? তুমি অপুত্রক? তোমার পূর্বপুরুষকে তো শুভই জল দেবে!
আরে, শুভর পরে! শুভর পরে কে দেবে? শুভকেই বা জল দেবে কে?