ছেলেকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এলাম। শ্বশুরের মৃত্যুর পর থেকেই শাশুড়ির রূপ। আরেক ধাপ বদলাল। আরও শুয়ে পড়লেন। আরও মিছে কথা বলা শুরু করলেন। ভঙ্গি আরও অসহায় হল আর আমার প্রতি একটা নতুন শত্রুতা দেখা দিল। আস্তে আস্তে আমার স্বামীর ওপরেও তার প্রভাব পড়তে শুরু করল।
.
ডায়াবেটিসের রুগি, তাকে মিষ্টি খেতে দিই না, চায়েও চিনি দেওয়া বারণ। মা তো জোর করে চিনি নিয়ে নেন। বাধা দেবে কে? না ননদ না আমি পেরে উঠি তার সঙ্গে। ইতিমধ্যে ননদের শাশুড়ির মৃত্যু হল, নন্দাই এসে স্ত্রী-পুত্রদের নিয়ে গেলেন। আমাদের বাড়ির হাওয়া বদলে গেল, অনেক ফুরফুরে হল। মেয়ে নেই, এখন শাশুড়ি জোর করে বাইরে বেরিয়ে রোজ বিকেলে সামনের ভীমনাগের দোকান থেকে মিষ্টি কিনে খাবেন। হাতে টাকা আছে, হাত-পা চালু আছে, যাবেন না কেন। বারণ করি, শোনেন না। একদিন মা সেজেগুজে দোরগোড়ায় গেছেন, মিষ্টির দোকানে যাবেন বলে, হঠাৎ আমার স্বামী ফিরলেন।
এ কি মা, তুমি রাস্তায়? কোথায় যাচ্ছ?
এই তো বাবা, এই একটু পানের দোকানে যাচ্ছি। ঘরে পান নেই। বউমা তো দুটো পানও সেজে দেয়না, বুড়ো বয়সের নেশা তো? মরণও হয়েছে আমার, নেশা করে মরেছি!–উনি তাড়াতাড়ি মাকে ওপরে নিয়ে এলেন। পান কেন সেজে দিইনি বলে চেঁচালেন। আমি তো অবাক, বললাম, কেন? একডিবে পান মা-র এই তো সাজা রয়েছে? পান দেখে উনি থমকে গেলেন। মাকে কী যে বলবেন, ভেবে পেলেন না। চুপ করে গেলেন।
আরেকদিন, ওঁর আসার সময় হয়ে গেছে, মা আমাকে বললেন, বউমা, ছেলের ফেরার সময় হল, যাও ওপরে গিয়ে, গা ধুয়ে কাপড় পরে, চুল বেঁধে রেডি হয়ে থাকো। ছেলে অফিস থেকে ফিরে এমন হতক্লান্ত বউ দেখুক আমি চাই না। বেশ সুন্দর, ফিটফাট হয়ে থাকো দিকি? শাশুড়ির নির্দেশে আমি তো আহ্লাদে আটখানা হয়ে গা ধুতে ওপরে গেছি–এমন সময় উনি ফিরলেন। আমি তখনও বাথরুমে। মা হঠাৎ শুয়ে পড়েছেন ইতিমধ্যে।
এ কি মা, তুমি একা একা? সুষি কই?
বউমা তো ওপরে। ও তো খেয়েই ওপরে শুতে চলে যায় বাবা! বউমার কি আমার কাছে বসে থাকার সময় আছে? ঘুম থেকে উঠে তো ওর কত কাজ। এখন সাজগোজই করবে কতক্ষণ ধরে। আমি তো সারাদিন একাই পড়ে থাকি। শুনে উনি তো ক্ষিপ্ত। ধুপধাপ ওপরে এলেন। আমি সদ্য স্নান সেরে বেরিয়েছি। বকুনি শুরু হয়ে গেল।রুগ্ন মাকে একা ফেলে রেখে সাজগোজ করছ দিনরাত কার জন্য? লজ্জা করে না সুষি? সারাদিন নীচের ঘরে একা অসুস্থ মানুষটা পড়ে রয়েছেন, আর তুমি এখানে পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছ?
আমি তো ঘরে বোমা পড়ার মতন জব্দ। এ কী? হঠাৎ মণির মা কোথা থেকে এসে খরখর করে বলতে শুরু করল, এই তো সারাদিন বউমা নিচে ছিল। ভাগবত পড়ে শোনাচ্ছেল আমাদেরকে–এক্ষুনি মা বললে, যাও বউমা আমার ছেলে আসবে, সারদিন খেটেখুটে, তুমি একটু পোস্কের-পোচ্ছন্ন হয়ে, গা ধুয়ে, চুল বেঁধে থাকো–তাই তো বউ ওপরে এয়েছে, আর দাদাবাবু এসেই বকতে শুরু করে দিয়েছ? শুনে উনি চুপ করে গেলেন।
সেই পান সাজার দিনের কথাটাও ওঁকে তখন বললাম যে, তখন আসলে মিষ্টি কিনতে যাচ্ছিলেন। রোজই যান। বললে শোনেন না। তারপর যখন সুগার বাড়ে, তখন দিব্যি বলেন, কী জানি কী যে খেতে দেয়? বউমা যা দেয় তাই-ই তো খাই! মা যান কিনা, ভীম নাগের দোকানে গিয়ে জিগ্যেস করলেই জানতে পারবে। উনি আমাকে বিশ্বাস করলেও, পুরোপুরি করেননি। মিষ্টির দোকানেও জিগ্যেস করেছিলেন। তবুও আচরণে দোষ না ধরে বললেন, আহা বেচারি! সারা জীবন বঞ্চিত হয়ে অমন একটু-আধটু ছেলেমানুষি করেই ফেলে মানুষ!
এরকম যে কতবার।
একবার উনি মা-র কাছে বই রাখবার জন্যে একটা আলমারি চাইলেন ওঁর পড়ার ঘরে। শাশুড়ি আমাকে বললেন, এই কাঠের আলমারিটা খোকার জন্যে নিয়ে যেও। সেটা
আমারই বিয়েতে বাবার দেয়া জোড়া আলমারির একটা। এটা থাকত শ্বশুরের ঘরে। আরেকটা আমাদের ঘরে। তখন বাড়িতে মিস্ত্রি লেগেছে, মজুররা খাটছে, আমি মজুরদের আলমারিটা ওঁর পড়ার ঘরে দিয়ে আসতে বলেছি। ওপরে তোলা হবে, আলমারিটা খালি করছি, ভেতরে তেমন কিছু ছিলও না। শাশুড়ি হঠাৎ চেঁচাতে লাগলেন, বউ এত নিজের জিনিস চিনেছে, যে উনি স্বর্গে যাওয়া মাত্র শ্বশুরের জিনিসপত্তর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাপের দেওয়া আলমারিটি নিজের ঘরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে– আমি স্তম্ভিত। চোখ ফেটে জল এসে গেল। এমন সময়ে উনি এসে হাজির। মা-র চেঁচামেচি তখনও চলেছে। তুমুল কাণ্ড। আমাকে কিছু বলতেই হল না।
উনি অবাক!–সে কি মা? তুমি তো নিজেই আমাকে বললে, আমার পড়ার ঘরে এই আলমারিটা তুলে দেবার কথা!
কিন্তু লজ্জা পাবার মানুষই নন মা।–বলেছিলাম। কিন্তু তোমার বাবার জামা-কাপড়গুলো কি ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে বলেছিলাম? যিনি চলে গেছেন তাঁর স্মৃতির প্রতি কি কোনো সম্মানই নেই বাকি আর?
জামাকাপড়গুলো ভাঁজ করে খাটে রাখা। নীচে ট্রাঙ্ক খোলা। ভরা হবে তাতে। উনি দেখলেন। কিন্তু বললেন না। সরে এলেন।
বারবার আমার ওপরে মা-র অদ্ভুত অত্যাচারের উনি সাক্ষী হয়েও, চোখ বুজে থেকেছেন। অসুস্থ অবস্থায় নার্স, আয়াদের বসিয়ে রেখে, মা আমাকে দিয়ে তার পায়খানা পরিষ্কার করাবেন। পেচ্ছাপ হয়ে যাওয়া চাদর কাঁচাবেন। উনি শুনে ধন্য ধন্য করে বলবেন, আহা, মা কেবল সুষমার হাতের সেবাটুকুই গ্রহণ করে তৃপ্তি পান। সুষি, তোমার অপার পুণ্যি হচ্ছে!