সকালবেলা শাশুড়ি আমাকে রুটি-গুড় দিতেন সব কাজের লোকদের সঙ্গে। বাসিরুটি খেতে পারতাম না, ফেলে দিয়েছিলাম। উনি রান্নাঘরের ময়লা ফেলার ঝুড়িতে সেটা আবিষ্কার করে এত রেগে গেলেন, যে তারপর থেকে আমি ব্লাউজে ভরে নিয়ে গিয়ে বাইরে ফেলে দিতাম। কিন্তু স্বামীকে বলতে পারিনি। মা-র প্রতি ওঁর মুগ্ধ ভক্তি দেখে বলতে সাহস হয়নি। মনে হয়েছিল উনি বিশ্বাস করবেন না। আমার ওপরেই বিরক্ত হবেন। ভগবানের দয়ায় আমি বি.এ. পাশ করবার আগে বাচ্চা চাননি উনিই। আমার বয়েসও অল্প ছিল। ওঁর এম.ডি শেষ হয়নি। শাশুড়ি প্রবল অশান্তি শুরু করলেন, বাঁজা বউ। ঠিক এখন লোপাকে নিয়ে ইনি যেমন করছেন। সব ভুলে গেছেন নিজের মায়ের কীর্তির কথা। মা বলতেন, আমার মেয়ের দুই ছেলে হচ্ছে দুই বাহু–তোমাদের মতন হাত-পা কাটা নয় সে, আমার বাঁজা বউ নিয়ে ঘর করার দুর্ভাগ্য ছিল। কিন্তু যখন অন্তঃসত্ত্বা হলাম, শাশুড়ি তখন অনবরত ঠেশ দিতে লাগলেন, হবে তো মেয়ে। মায়ের যেমন যমজ মেয়ে হয়েছিল, তোমারও যমজ মেয়েই হবে দেখো! শ্বশুরমশাই অবশ্য মৃদু আপত্তি করতে থাকলেন, না লীলা, বাঁ কপালে তিল আছে, গলার বাঁ দিকেও তিল আছে, বউমার নির্ঘাৎ প্রথম সন্তান পুত্র হবেই। তুমি দেখে নিও। বাবা আমাকে নিতে এলেন যখন, আমার শ্বশুর তাঁকে বললেন, আপনাদের বাড়িতে স্ত্রীলোক নেই, বউমার যত্ন হবে না, ও বরং এখানেই থাকুক। বাবা বললেন, আমিই তো ওদের শিশু থেকে মানুষ করেছি, আমি স্ত্রীলোকের বাড়া। এই তো প্রথমবার, ওর মনের আরাম হবে হয়তো আমার কাছে থাকলে। ওর বোনও চলে আসবে সেই সময়ে। আপনারা ওর জন্যে ভাবনা করবেন না– বলতে না বলতেই হঠাৎ আমার শাশুড়ি বলে বসলেন, নিয়ে যান, নিয়ে যান, আমাদের কোনোও ভাবনা নেই আপনার মেয়েকে নিয়ে। হবে তো। মায়ের মতনই যমজ মেয়ে,-ও থাকল কি গেল, আমাদের এসে যাবে না– এমন নির্মম বাক্য শুনে আমার শ্বশুরও থ হয়ে গেলেন। কিন্তু কিছুই স্ত্রীকে বলতে পারলেন না। বাবা আমাকে নিয়ে চলে গেলেন। স্বামীকে কখনও বলতে পারিনি, মা-র কথাগুলি। স্বামী তো সেখানে ছিলেন না। তিনি শোনেননি। বিশ্বাস করতেন কি? চার মাস পরে শুভ জন্মাল আরও চারমাস পরে উনি গেলেন আমাদের কলকাতায় নিয়ে আসতে।
কিন্তু গাড়ি ভবানীপুরের বাড়িতে গেল না। আমরা গেলাম বালিগঞ্জে, লেক রোডের ভাড়া বাড়িতে। অচেনা জায়গায়।
কী ব্যাপার।
অনেক কিছু।
আমার ননদ তার বাচ্চা দুটিকে নিয়ে বাপের বাড়িতে এসে রয়েছেন ছমাস হল। স্বামী ও শাশুড়ির নামে এফ.আই.আর করে এসেছেন, আসার আগে। তাঁরা নাকি আলমারি খুলে, ওঁর নিজস্ব স্ত্রীধন, ওঁর দশ লক্ষ টাকার গয়নাগাঁটি চুরি করেছিলেন, নিজেদের সম্পত্তি বন্ধক থেকে ছাড়াবেন বলে। থানা থেকেই সোজা বাপের বাড়ি। তারপর মায়ের অপূর্ব সেবা। মাকে তো পালঙ্ক থেকে উঠতেই দিচ্ছেন না। বাচ্চারাও দিদিমার মন ভুলিয়ে ফেলেছে–খুবই মিষ্টি তারা। শাশুড়ি ছেলেকে ডেকে জানিয়েছেন, তিনি মনস্থির করেছেন, তাঁর যা কিছু নিজস্ব সম্পত্তি সব দুই দৌহিত্রকে দেবেন। বসত বাড়ির আধখানাও তার মেয়েকে লিখে দেবেন, কেননা তাদের এখন কোনো বসতবাটি নেই।
শুনে উনি মাকে বললেন, কিন্তু আমারও তো এখন ছেলে হয়েছে, তার ঠাকুমার স্ত্রীধনের জিনিস তাকেও কিছু দিও; আর আমি যে গত দশ বছর ধরে তোমাকে পুরো মাইনেটা দিয়ে দিচ্ছি এখন এ বাড়িতে আমার অধিকার হয়তো বোনের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি, সমান সমান নয়। তাছাড়া বোনের বিয়ের সময়ে তোমাদের দেড় লাখ টাকা খরচা হয়েছিল। তখনকার দিনে অনেক টাকা সেটা। আমার বিয়েতে শ্বশুরবাড়ি থেকেই দুলাখ খরচ করেছিল, তোমাদের কিছুই খরচা হয়নি। আমার বউয়েরও তাই একটু অধিকার বেশি তোমার বাড়িতে।
বিতর্কে মা খেপে উঠলেন, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। যাও তোমার শ্বশুরের দেয়া সবকিছু যৌতুক সঙ্গে নিয়ে অন্যত্র উঠে যাও। এ বাড়ি আমার। আমি যাকে খুশি তাকে দেব। জানি না, নিজের জীবৎকালে কেন যে তার স্ত্রীর নামে পৈত্রিক বাড়িটা লিখে দিয়েছিলেন শ্বশুরমশাই। আমার স্বামী তারপরই জিনিসপত্তর নিয়ে আর মণির মাকে নিয়ে বাপ-ঠাকুর্দার ভিটে ছেড়ে লেক রোডে উঠে এসেছেন। ও বাড়িতে যান না। শ্বশুরমশাই নিজেই এটা-ওটা হাতে করে ছেলেকে দেখতে মাঝে মাঝে চলে আসেন। আমার শাশুড়ি-ননদের সঙ্গে স্বামী মুখ দেখাদেখি নেই। পৌত্র তো এল। শ্বশুর এসে আকবরী মোহর দিয়ে নাতির মুখ দেখে গেলেন। শাশুড়ি কিন্তু এলেন না। শেষে উনি আমাকে বললেন, যা হয়েছে হয়েছে। চলো, আমরা এবার একদিন মাকে ছেলে দেখিয়ে আনি। গেলাম শুভকে নিয়ে। মিষ্টি নিয়ে। শাড়ি-ধুতি নিয়ে। মা-বাবার জন্য প্রণামী। শাশুড়ি শুভকে আদর করলেন, কোলে নিলেন। নিজের গলার হারটি পরিয়ে দিয়ে নামিকে যথারীতি আশীর্বাদও করলেন। কিন্তু আমার সঙ্গে একটিও কথা কইলেন না। ছেলের সঙ্গেও না। চোখ বুজে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন একটু পরেই। যেন বড় ক্লান্ত। উনি খুবই লজ্জিত মায়ের আচরণে। কিন্তু করবেনই বা কী? এহেন আচরণের তো কোনো জবাব নেই। সেই থেকে আমরা আর যাই না ভবানীপুরে।
হঠাৎ খবর এল শ্বশুরমশাইয়ের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছেন। শ্বশুরের কোমার খবর পেয়েই আমরা আবার ছুটে গেছি। পাঁচ দিন অজ্ঞান। তারপর সব শেষ। শাশুড়ির তখন তার ছেলেকে খুব দরকার। বাড়িতে ওঁরা দুটি স্ত্রীলোক একা, দুটি নাবালক শিশুসমেত। আমরা আবার যাতায়াত করতে লাগলাম। শ্বশুরের শ্রাদ্ধের পর শাশুড়ি বললেন বাড়িতে ফিরে আসতে। ননদ নিজেও বলল, ফিরে এস বউদি। যা হয়েছে হয়েছে দাদার সঙ্গে। তোমার সঙ্গে তো হয়নি?