বাবাকে কখনো মায়ের কোনো অনিচ্ছাকে অসম্মান করতে আমি দেখিনি। এজন্য সুষমারও কোনো অনিচ্ছাকে আমি অবহেলা করতে পারি না। আমার বাবার কাছ থেকে এটাই আমার শিক্ষা যে পত্নীর ইচ্ছাকে, তার পছন্দ-অপছন্দকে সম্মান করতে হয়। ধর্মপত্নীকে আমরা বিবাহের সময়ে কথা দিই, নাতিচরিষ্যামি–তোমাকে অতিক্রম করে যাব না। সে যেমন আমার সংসারে ধ্রুব হবে, আমিও তেমনি তাকে কদাচ অতিক্রম করে যাব না এই প্রতিজ্ঞা আমি রক্ষা করে চলেছি। সুষমাও ধ্রুব হয়ে আছে। আমরা কেউ আমাদের বিবাহ মন্ত্রের শপথ অবজ্ঞা করিনি।
কিন্তু ইদানীং সুষমার আমার প্রতি সেই মনোযোগ নেই, যা আগে ছিল। আমার মাকে, আমার বাবাকে যেভাবে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে সেবা-শুশ্রূষা করেছে, মাঝে মাঝে বৃদ্ধ বয়সের দোষে, মা হয়তো একটুখানি অবুঝপনাও করে ফেলেছেন, তাতেও হাসিমুখে প্রশ্রয় দিয়েছে সুষমা। আমার বেলাতে কিন্তু তার সেই সেবাময়ী রূপটি আমি দেখতে পাচ্ছি না। তখন সুষমা ছিল পুরোপুরি ঘরণী। ঘরকন্নার বাইরে কিছু জানত না।
মায়ের মৃত্যুর পরে ওকে যেই হিন্দু জাগরণী সংঘে ভর্তি করে দিলাম, সেই হল আমার কাল। মায়ের মৃত্যুর পরে এ সংসারে দুটো বদল হল। সুষমা বাইরে বেরিয়ে পড়ল। আর আমি ঘরে ঢুকে পড়লাম। আর তৃতীয় বদলটি আরও জরুরি–সেটা অবশ্য তক্ষুনি হয়নি, আরও পরে শুভ বিয়ে করল। বিয়ে করে ম্লেচ্ছ দেশে চলে গেল। মা বেঁচে থাকলে এসব কখনো হতে দিতেন না।
সুষমাও ঘরে থাকত। শুভও। চিররুগ্না, শয্যাশায়ী মা-র সেই প্রবল ব্যক্তিত্বের জোর ছিল। আমারই বুদ্ধির ভুলে, আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সুষমা বাইরের জীবনে মিশে গেল। আর সুষমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শুভ বাইরের বিশ্বে হারিয়ে গেল।
আর আমি এলুম ঘরে। এই শরীরে কোথায় যাব? থাকবই বা আর কটা দিন? ঠাকুরঘরে সময় কাটাই। নইলে টিভি দেখি। আজকাল বই-টই পড়তে তত ভালো লাগে না। কথামৃত ছাড়া। কী পড়ব? পড়ার মতন আছেটা কী?
রোববার রোববার তাস খেলি। সুষমাই কোথা থেকে তিনজন খেলুড়ে জোগাড় করেছে, তারা দারুণ ব্রিজ খেলে। ওদের ট্যাক্সিভাড়া দিয়ে নিয়ে আসে সুষমা, সারাদিন রাখে, এক পেট খাওয়ায়। আবার পৌঁছে দেবার খরচ দেয়। এবং আমার সন্দেহ ওদের একটা কিছু দক্ষিণাও দেয় আমার সঙ্গে খেলতে আসার জন্যে। এই তিনজন মানুষের সঙ্গে এমনিতে আমার কথা কওয়া উচিত নয়, কথা বলবার মতো প্রসঙ্গ কিছু নেই। বিদ্যায় আভিজাত্যে তারা একটু নিচু শ্রেণীর। কিন্তু হিন্দু জাগরণী সংঘের সদস্য ওরা, একজনের কাপড়ের দোকান আছে, একজন মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ, আর একজন রিটায়ার্ড। পোস্টমাস্টার ছিল কোনো ছোট পোস্টাপিসের। তবে, হ্যাঁ! দারুণ ব্রিজ খেলে তিনজনই–কোথা থেকে যে সুষমা পাকড়াও করল এদের! পারেও বটে সুষি!
সপ্তাহে এই একদিন আমার কিঞ্চিৎ বাধ্যকরী সামাজিকতার অভ্যেস হয়। বাকি সবটা সময় একলা। সুষি আর আমি।
.
ষষ্ঠ অধ্যায়। জননী জন্মভূমিশ্চ
কী যে অবুঝ হয়েছেন ছেলেমানুষের মতো, কিছুতেই বুঝবেন না। ছোট বাচ্চা যেমন মাকে আঁকড়ায়, তেমনি করে আঁকড়াবেন আমাকে। তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারি না! তোমাকে না দেখতে পেলে শরীর খারাপ হয়ে যায়! তুমি কাছে থাকলেই আমি সুস্থ বোধ করি। এগুলো ব্ল্যাকমেইলিংয়ের টেকনিক সেটাও কী বোঝেন না? নিজে এত বড় চিকিৎসক, মনের অসুখ চিনতে পারছেন না?
অবশ্য কোনোদিনই চিনতে পারেননি। নিজের মায়েরও মনের অসুখ ছিল। সারাটা জীবন মা রুগ্ন হয়ে সারা পরিবারের পরিপূর্ণ মনোযোগ টেনে নিয়ে ভি. আই. পি. হয়ে রইলেন। বিয়ে হয়ে এসে দেখলাম পরমা সুন্দরী শাশুড়ি। নতুন বউয়ের মতোই সাজগোজ করে,শাড়ি গয়নায় মোড়া হয়ে, বধূবরণ করলেন। তা বধূবরণে বিয়ের বেনারসি পরার নিয়ম আছে, কিন্তু শাশুড়ির সাজগোজটা ওই এক বিকেলের জন্যে নয়। প্রত্যহই তিনি আমার সঙ্গে মিলিয়ে ঠিক দুই জায়ের মতন সাজতে লাগলেন। আমার ননদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, সেও এল একইরকম সেজেগুজে। আমি নতুন বউ বলে আমার কোনো বৈশিষ্ট্যই ছিল না। বিয়েবাড়ির হুল্লোড়ের মধ্যেই তিনি পালঙ্কে হঠাৎ শুয়ে পড়লেন। আর বাড়িসুদ্ধ জ্ঞাতিকুটুম্বের মাঝখানে শ্বশুরমশাই গিয়ে তার হাত ধরে মুখের কাছে মুখ নিয়ে লীলাবতী! লীলাবতী! করতে লাগলেন। ছেলেও দৌড়ে গিয়ে মা-র পায়ে হাত বোলাতে লাগলেন, মা! মা! করে অস্থির হয়ে। ননদ পাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগলেন। আমি বুঝতেই পারছি না কী করব। একপাশে চোর হয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। শেষে স্বামীই লুকিয়ে ইঙ্গিত করলেন মা-র মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। সেই শুরু।
সমানেই তিনি মা এবং বউয়ের মধ্যে সেতু-বন্ধনের চেষ্টা করে চলেছেন। এ বাড়িতে তিনিই আমার বন্ধু, আমার শুভার্থী, আমার নিজের লোক। তারই চেষ্টায় আমার কলেজে ভর্তি হওয়া। ইন্টারমিডিয়েট, বি. এ., সবই তার চেষ্টায়। শ্বশুর-শাশুড়ি দুজনেরই অমত ছিল। উনিই পৌঁছে দিয়ে যেতেন। প্রথম প্রথম শ্বশুর আনতে যেতেন। এইভাবে চার বছর অবশ্য চলেনি। আমার স্বামী মাইনে এনে পুরোটা মায়ের হাতে তুলে দিতেন। মা ওঁকে হাতখরচ দিতেন দৈনিক হিসেবে। বিয়ের পরেও তাই। হাতখরচ বাড়াননি। আমাকে কিছু কিনে দেবার ইচ্ছে হলে মা-র কাছ থেকে টাকা চাইতে হত ওঁকে। কৈফিয়ৎ দিতে হত কেন টাকা চাই। দুজনে সিনেমা যেতে হলে মা-র কাছে টাকা নিয়ে, বাবার কাছে অনুমতি নিয়ে তবে যেতে হত। প্রথম প্রথম নিয়ে এলেও, শ্বশুর আর কলেজ থেকে আমাকে আনতে গেলেন না। শাশুড়ি তখন আমাকে তিনদিনে এক টাকা করে দিতেন। বাসে করে বাড়ি ফেরবার ভাড়া। বৃষ্টি পড়লে, কী শরীর খারাপ করলে একদিন রিকশা নেবার উপায় ছিল না। খিদে পেলে কিছু কিনে খাবার টাকা ছিল না। স্বামীকে বললেও উনি নিরুপায়। ওঁর হাতে টাকা নেই। অথচ তখন ইনি মেডিক্যাল কলেজে চাকরি করছেন। বাড়িতে দুটো গাড়ি। একটি উনি নিয়ে যেতেন। একটা থাকত। কিন্তু আমার জন্য যেত না।