হিন্দু জাগরণী সংঘের সদস্যরা যতটা সংস্কৃত জানে তত ইংরিজি জানে না, সুষমা কনভেন্টে পড়া মেয়ে। রূপসী। অভিজাত আচরণ। ইংরিজিতে কিছু বলবার দরকার হলেই ওরা সুষমাকে ডাকতে লাগল। সেসব বক্তৃতা অবশ্য লিখে দিতে লাগলাম আমিও।–শাস্ত্র থেকে কোটেশান দিয়ে বক্তৃতা লেখা সুষমার সাধ্য নেই। তখনও ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু এখন তো সুষমা সরে যেতে শুরু করেছে। হিন্দু শব্দটাকেই হেঁটে ফেলেছে তার কাজকর্ম। থেকে। এখন তার শাস্ত্রবাক্য লাগে না।
সুষমার যে ভেতরে ভেতরে এত উচ্চাশা ছিল, এত জেদ, তা কে জানত। হিন্দু জাগরণী সংঘের কাজকর্ম থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে সম্পূর্ণ ছড়িয়ে নিয়ে সুষমা কী সব নিজস্ব নারী সংগঠন তৈরি করে ফেলেছে, তারই কাজে হিল্লি-দিল্লিও করছে মন্দ নয়। আজ সোনিয়া গান্ধী তো কাল মানেকা গান্ধী। কিছু না কিছু লেগেই আছে। এই টি.ভি.-র খবরে সুষমা ভটচায্যি দেখা যাচ্ছে, এই খবরের কাগজে পড়ছি সুষমা ভটচা লেকচার দিচ্ছে। মানবাধিকার কমিশনেও কী যেন হয়েছে সে, কাগজে পড়লাম। সে বলেনি!
অনিলের মুখে শুনলাম আর সুষমা হিন্দু জাগরণী সংঘের সদস্যই নেই মোটে। যেজন্য ওকে বাড়ি থেকে বের করলাম সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দিয়েছে সুষমা। আমাকে কিছু বলেওনি। আসলে ওর কাজকর্মের বিষয়ে কিছু বলতে চায় না সুষি আজকাল। নিজের জন্যে ক্রমে ওর একটা আলাদা জগৎ, একটা আলাদা জীবন গড়ে তুলেছে। সেখানে আমার ঠাই নেই।
মা বেঁচে থাকলে এসব কিচ্ছুটি চলত না। মা চলে গিয়েই এই সংসারের সর্বনাশ হয়ে গেল। মা ছিলেন বংশের কল্যাণস্বরূপিনী স্বয়ং মা লক্ষ্মী। আজ মা থাকলে শুভও কি এরকম করতে পারত?
সুষমার দোষেই আমার অমন ছেলে বিগড়ে গেল। শুভ আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যটা রাখলে না। আমাকে গ্রাহ্যই করলে না। পূত্রবধূ নির্বাচনে আমার কোনো ভূমিকাই ছিল না। আমার সঙ্গে তার তো যোগই ছিল না বিশেষ। সারাদিনই ইশকুল, টিউটোরিয়াল হোম, আর বন্ধু-বান্ধব নিয়ে কাটাত। সুষমার তো সায় ছিলই, আমার মা-রও নাতির বেলায় অন্যরকম হাবভাব দেখলাম। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বাড়িতে আসছে, হইচই করছে, সুষমা সমানে তাদের জলখাবার বানিয়ে দিচ্ছে এসব আমার বেলাতে ছিল না। মার শরীর খারাপ হলে বাড়িতে কোনো গোলমালই চলত না। বাড়ি ফিরে ঠাকুর্দার কাছে বসতাম, শাস্ত্রপাঠে অবসর সময় কাটত। যতটুকু ইশকুলে-কলেজে কেটেছে, পড়াশুনোতেই কেটেছে। বাকি সময় বাড়িতে। মা-র কাছে। ঠাকুর্দার কাছে। বন্ধু-বান্ধব হয়নি। বন্ধুত্বের অভ্যাসও হয়নি।
এখনও আমার কোনো বন্ধু নেই। চাকরি থেকে যখন অবসর নিলাম, একটা ফেয়ারওয়েল পার্টি দেওয়া হয় সকলকে। আমার বেলায় সেটা কেবল নামমাত্র হয়েছিল। সেদিনকার মিটিঙে ছিল কেবল একমুঠো লোক, যারা যারা সেদিন মেডিক্যাল কলেজে এসেছিল, তারাও সকলে। ছিল না, আমি নজর করেছিলাম। সুষমাকে বলতেই সে অম্লানবদনে বলল, আসবে কেন, তারা তো কেউ তোমার বন্ধু নয়, কোলিগ মাত্র। তুমি তো একজনের সঙ্গেও বন্ধুত্ব পাতাওনি।
বন্ধুত্ব কেমন করে পাতায়? যতদিন মা ছিলেন, ব্যাপারটা আলাদা ছিল। মা-ই ছিলেন আমাদের বাড়ির দীপশিখা। মা-ই ছিলেন আমাদের জীবনযাত্রার সর্বময়ী কত্রী, কেন্দ্রস্বরূপা, মাকে ঘিরেই বেঁচে থাকতাম আমরা সকলে। ঠাকুর্দা, বাবা, আমি। ঠাকুমাকে দেখিনি। মা-ই ছিলেন সংসারের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী। ঠাকুর্দা, বাবা দুজনেই মাকে কাবলি আঙুরের মতন তুলোর বাক্সে বসিয়ে রেখেছেন,–সারা জীবনই মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য বাড়িতে শান্তি-স্বস্ত্যয়ন হয়েছে। মা-র আয়ুষ্কাল কম, এই কোষ্ঠিবিচার ছিল বলে, আমার বাবা অতি সাবধানে, ভয়ে ভয়ে রাখতেন মাকে। আমিও তাই রেখেছি। মা-র যাতে মনে উত্তেজনা না হয়, মা-র যাতে মনে কষ্ট না হয়। মা-র যাতে শরীরে স্ট্রেন না হয়। সবসময় সেইদিকে নজর রাখতেন বাবা।
অথচ বাবা নিজেই চলে গেলেন আগেভাগে। তার যে এতটা প্রেশার ছিল, হার্টের অবস্থা এত খারাপ, বাবা আমাদের তো জানতেই দেননি। মা পাছে ভয় পান, সেটা ভেবেই বোধহয়। সেবার সুযোগটুকুও বাবা দিলেন না আমাদের। কদিনের মধ্যে সব শেষ।
তা ঈশ্বরের দয়ায় মা চুয়াত্তর বছর পর্যন্ত আমাদের মধ্যে ছিলেন। মা-র মহাপ্রয়াণের পরেই আমার অবসর গ্রহণের দিন এসে পড়ল। একটি ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই আরেকটি।
.
মায়ের ষোলো বছর বয়সে আমার জন্ম। বাবার আদরে মাকে সবসময় রঙিন শাড়িতে অলঙ্কারে সেজেগুজে থাকতে হত। আমার বিয়ে ঠিক হবার পর মা যখন বললেন এবার থেকে সাদা শাড়ি পরবেন, বাবা ঘোষণা করলেন, আমার চোখের সামনে নয়। বিধবা হবার পরে তুমি তোমার যা খুশি কোরো। বউমাকে আর শাশুড়িকে একই রকম কাপড়-গয়না এনে দিতেন বাবা। সুষমা পরমা সুন্দরী। কিন্তু সেই বয়সেও আমার মায়েরও ছিল মা দুর্গার মতো রূপ। লালপাড় হলুদ ডুরে জড়িয়ে শাশুড়ি-বউ পান সাজতে বসলে, ঠিক মনে হত, দুটি বোন।
সুষমা কনভেন্ট থেকে পাশ করে সবে আই. এ-তে ভর্তি হয়েছিল, তখন বিয়ে হয়ে কলকাতায় চলে এল। ওর বাবা যখন ওকে এখানে কলেজে ভর্তি করতে অনুমতি চাইলেন, মায়ের তাতে মত ছিল না। ঘরে বউকে পথে বের করলেই বিপদ। তায় এমন রূপের ডালি বউমা। কিন্তু সুষমা প্রত্যেক রাত্রে পড়তে চাইত। শেষকালে, আমিও ভাবলাম ও তো ঠিকই বলছে। স্ত্রীর শিক্ষিত হওয়ারই প্রয়োজন। হিন্দুধর্মের সেবায় শিক্ষিত নারীর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। বাবাকে বললাম, বাবাও অনুমতি দিয়ে দিলেন। কী ভেবে জানি না মা বাবার মতটা ফেরালেন না। কেননা, মা জোর করে না বললে, বাবাও ঠিক না বলতেন!