- বইয়ের নামঃ মায়া রয়ে গেল
- লেখকের নামঃ নবনীতা দেবসেন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. চিঠি লেখা
প্রথম অধ্যায়। চিঠি লেখা
শিলুবাবা,
যেখানেই থাকো, ঈশ্বরের কৃপায় আশা করি ভালো আছ। বুড়ো বাবা-মায়ের ওপর রাগ করে দুরে থেকো না। বাড়ি ফিরে এসো। দিদি যে তোমাকে কত ভালোবাসে, তা কি তুমি সত্যিই জানো না? খুকু আর তুমিও আমাদের প্রাণে আলাদা হতে পারো না। দুজনের সমান অধিকার। এটা তোমাদের দুজনেরই নিজস্ব ঘর। খুকু এখন বীরভূমে। তুমিও আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান একথা ভুলো না, সে তুমি যেমনই হও। আমরা তোমার ও বউমার পথ চেয়ে বসে রইলাম। আমাদের কথা ভেবে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।
—সুরমা, আদিত্য রায়।
রায়-টা কেটে দিলেও হয়। শুধু নাম থাক, সুরমা, আদিত্য।
নাঃ, নামই বা থাকবার কী দরকার? শুধু মা, বাবা বললেই তো হয়। শিলু ঠিকই বুঝবে। না খুকুর বদলে শ্রাবস্তী বলবেন? শ্রাবস্তী এখন বীরভূমে। নাঃ খুকুই ভালো। অনেকবার কেটেকুটে অবশেষে আদিত্য একটা খসড়া খাড়া করলেন। তারপর সুরমার দিকে ফিরলেন।
হয়ে গেছে?
একরকম। ফার্স্ট ড্রাক্ট। দ্যাখো তো এটা চলবে কিনা? প্যাডটা সুদ্ধ সুরমার সামনে মেলে ধরলেন আদিত্য। পড়তে পড়তেই সুরমা উত্তর দেন–
কেন চলবে না? বেশ হয়েছে। তবে অত কথা লেখবার দরকার নেই। খুকু আর তুমি থেকে আলাদা হতে পারো না পর্যন্ত কেটে দাও। নাঃ, অধিকার পর্যন্ত কেটে দাও। কেমন লিগ্যাল টার্মিনোলজির মতন শোনাচ্ছে। বরং বলা যাক, তুমি আর খুকু আমাদের প্রাণ। আবার ওই এটা তোমাদেরই নিজস্ব ঘর।–এরপর লেখো বউমারও। তাহলে একটু বেটার হয়। তাই না।
ক্লান্ত চোখে সুরমা হাসলেন। আর ওই তুমি যেমনই হও অংশটা একদম কেটে দাও। ওটা বড্ড খারাপ শোনাচ্ছে। আর তুমিও আমাদের প্রাণাধিক চলবে না! শুধু তুমি বলো। খুকুর কথা বরং উহ্য থাক এখানে।
আদিত্য প্যাডটি টেনে নিয়ে আবার টেবিলে গিয়ে বসেন। সুরমা উঠে এসে তাঁর পিঠের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছেন। উষ্ণতায় আচ্ছন্ন আদিত্য ভাবলেন, পঞ্চান্নতেও সুরমা কত সুন্দরী! শিলুর বউ হিংসে করবে না? আদিত্য শিলুর বউটিকে অনুকম্পা করলেন মনে মনে। বিয়ে যদিও হয়নি। কিন্তু মনে হয়েছিল ওরা নিজেরা কথা পাকা করে ফেলেছে।
কী যে হল কিছু বোঝা গেল না। সুরমা আপত্তি করেননি, আদিত্যও বাধা দেননি। মেয়েটির চালচলন তাদের পছন্দ ছিল না, হাবভাবে অতিরিক্ত পশ্চিম-ঘেঁষা, পোশাক-পরিচ্ছদে তো বটেই, ভাষাও ইংরিজি, হাতে সর্বদা সিগারেট পুড়ছে। সুরমা-আদিত্যর সামনে শিলু সিগারেট খায় না, কিন্তু লিসা অসঙ্কোচ। লিসার পুরো নাম মোনালিসা গর্গ, পাঞ্জাবি মেয়ে, শিলাদিত্যর সঙ্গেই এন. এস. ডি-তে ছাত্রী। ছুটিতে ওকে শিলু নিয়ে এসেছিল গেলবার।
গ্রীষ্মে দু-মাস ছুটি থাকে। সেই দুটো মাসেই কী যে হল, সংসারটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
দু-ভাইবোনের ভাব সমাজে আলোচনার বিষয় ছিল। দিদির সঙ্গে শিলুর ঝগড়াও হতে দেখেনি কেউ। কিন্তু সেই শিলু, দিদির নাম শুনলে যেন ক্ষেপে উঠছিল। শ্রাবস্তীর দোষ, দিল্লিতে সে মোনালিসা গর্গের নামে কী সব নিন্দে শুনে এসেছিল, সেগুলো সব শিলুকে জানিয়েছিল। দিল্লিতে প্রচুর বন্ধু হয়েছে শ্রাবস্তীর–আই. এ. এস. ট্রেনিংয়ে গিয়ে। মোনালিসা গর্গকে চেনেনা এমন অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে দিল্লিতে বোধহয় নেই। একবার তাকে দেখলে মনে না রাখা কঠিন। শিলাদিত্য কথাগুলো শুনে দিদির ওপরেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। কথাগুলো কি তা কিন্তু শ্রাবন্তী তাদের জানায়নি। আজ অবধি সুরমা জানেন না, কী নিয়ে ভাইবোনে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। ঝগড়ার পর শ্রাবস্তী বলল, যদি মোনালিসা গর্গ এ বাড়িতে থাকে আমি তাহলে অন্য জায়গায় গিয়ে থাকব। এ বাড়িতে ওরকম অসভ্যতা চলবে না।
কীরকম অসভ্যতা?
শ্রাবস্তী জবাব দেয়নি।
রাত্রে শিলুর ঘরে ওরা ড্রিংকস্ আনত, ওদের পার্টি চলত অনেক রাত অবধি। ছাদের ঘরে কী হচ্ছে, তাতে মাথা ঘামাতেন না আদিত্য। শিলু বাজনা বাজায়, গান করে, তার ঘরে হইচই-তে ছোটবেলা থেকে বাড়িসুদ্ধ অভ্যস্ত–গিটারের ঝঙ্কার, সিনথেসাইজারের বিচিত্র শব্দরূপ, সমবেত গলার প্রাণোচ্ছল গান, এতে খুকুরও তো যথেষ্ট উৎসাহ ছিল। এবার আকস্মিক হলটা কি? খুকু যেন হঠাৎ খঙ্গহস্ত হয়ে উঠল ওই মোনালিসার ওপরে। এমন মূর্তি তার কখনও দেখেননি আদিত্য-সুরমা! কিছুতেই মিশতে দেব না ওদের দুজনকে–ওকে বাড়িতে রাখলে আমি এখানে থাকব না!
এ কী অদ্ভুত ঈর্ষা? কিন্তু শিলুর তো অনেকগুলি বান্ধবী আছে–প্রেমিকাও ছিল, শুভা। খুকুকে তো এমন কাণ্ড করতে দেখা যায়নি? তা যতই খুকুর অপছন্দ হোক, তাই বলে সুরমা তো শিলুর বান্ধবীকে তাড়াতে পারেন না? কটা দিনই তো মাত্র। একটু ধৈর্য ধরো–
বলে খুকুকে বোঝাতে গিয়েছিলেন। খ্যাপা পাগলের মতো কেঁদে ফেলে, রাগারাগি করে, খুকুটা সত্যি সত্যি চলে গেল। সে মেয়ে আই. এ. এস হয়ে গেছে, দিব্যি এম. এল. এ হোস্টেলে থাকতে লাগল। আর শিলাদিত্য সেই যে দিল্লিতে ফিরে গেল, আর বাড়ি আসেনি।
বাড়ি আসেনি, চিঠি লেখেনি, ফোন করেনি, এন. এস. ডি-তেও নেই। ছিল, কিছুদিন পর্যন্ত। নাকি ক্লাসও করেছিল। তারপর উধাও। দিল্লিতেও কেউ জানে না সে কোথায়। সঙ্গে সঙ্গে মোনালিসাও উধাও হয়েছে। দুজনে মিলেই ইলোপ করেছে।