তোমার সরল অট্টহাস্যে এই ঘর একদিন মুখরিত হয়ে উঠেছিল; – গল্পের রহস্যালাপের তোড়ে এই ফাঁকা ঘরকেই তুমি মজলিশের মতো সরগরম করে তুলেছিলে, – সেই ঘর আজও আছে; তবে, তেমনি ফাঁকা! অনাবিল ঝরনাধারার মতো উদ্দাম হাসির ধারায় সে ঘরকে কেউ আর বিকৃত করে না, তাই সে নীরব-নিঝুম এক ধারে পড়ে আছে। আমাদেরও কেউ আর তেমন অনর্থক উৎপাতের জুলুমে তেতো-বিরক্ত করে তোলে না, তেমন-উন্মাদ হট্টগোলে বাড়িকে মাথায় করে তোলে না, তাই আমাদেরও কাজে আর সে প্রাণ সে উৎসাহ নেই! সব যেন মন-মরা! ফাগুন বনের বুকভরা দুষ্টুমির চপলতা যেন অসম্ভাবিত রূপে আসা পৌষের প্রকোপে একেবারে হিম হয়ে গেছে! – এইরকম বিরক্ত হওয়াতেও যে একটা বেশ আনন্দ পাওয়া যেত এ-তো অস্বীকার করতে পাবে না।
আচ্ছা ভাই নূর! তুমি কেন এমন করে আমাদের না বলে কয়ে চলে গেলে? অবিশ্যি, আমাদের বললে হয়তো সহজে সম্মতি দিতাম না, কিন্তু যদি নিতান্তই জোর করতে আর আমরা দেখতাম যে, তোমার ব্যক্তিগত জীবনে একটা সত্যিকার মহৎ কাজ করতে যাচ্ছ, তাহলে আমরা কি এতই ছোটো যে তোমায় বারণ করে রাখতাম? তোমার গৌরবে কি আমাদেরও একটা বড়ো আনন্দ অনুভব করবার নেই?
তোমার ভাইসাহেব সদাসর্বদাই শঙ্কিত থাকতেন, – তুমি কখন কী করে বস এই ভেবে; এই নিয়ে আমি কতদিন তাঁকে ঠাট্টা করেছি, এখন দেখছি, ওঁরই কথা ঠিক হল।
তুমি তোমার প্রাণের অনাবিল সরলতা আর প্রচ্ছন্ন-বেদনা দিয়ে যে সকলকে কত বেশি আপনার করে তুলেছিলে, তা তুমি নিজেও বুঝতে পারনি। তুমি যে অনবরত হাসির আর আনন্দের সবুজ রং ছড়িয়ে প্রাণের বেদনা-অরুণিমার রক্তরাগকে লুকিয়ে রাখতে আর তলিয়ে দিতে চাইতে, এটা আমার কখনও চক্ষু এড়ায়নি। তাই তোমার এই হাসিই অনেক সময় আমায় বড়োই কাঁদিয়েছে। তোমার ওই ঘোর-ঘোর চাউনিতে যে বেদনার আভাস ফুটে উঠত, সে যে সবচেয়ে অরুন্তুদ! – মা-র মতো গম্ভীর লোকও তুমি চলে যাবার পর কত অঝোর নয়নে কেঁদেছেন। তোমার ভাই তো পাথরের মতো হয়ে পড়েছিলেন। খুকি পর্যন্ত কেমন ‘হেদিয়ে’ গিয়েছিল।
তোমার ভাই বেচারা এখনও আক্ষেপ করে বলেন, – ‘হয়তো আমাদের দোষেই নূরু আমাদের ছেড়ে গেল!’ কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করি না। কেননা সেরকম কিছু তো কোনোদিন ঘটেনি। সত্যি বটে, তুমি অতি অল্পতেই রেগে উঠতে, কিন্তু সেটাকে রাগ বললে ভুল বলা হবে। ওটাকে রাগ না বলে সোজা কথায় বলা উচিত খেপে ওঠা; ঠিক যেন ঘাড়ের ঘুমন্ত একটা ভূতের ঝাঁ করে একটা মাথা নাড়া দিয়ে ওঠা, কাজেই ওতে না রেগে আমরা আমোদই পেতাম বেশি। একটা খ্যাপা লোককে খেপিয়ে যে কত আমোদ, তা যারা খ্যাপাতে জানে তারাই বোঝে। তোমার স্কন্ধবাসী ভূত মহাশয়কে খুঁচিয়ে তাতিয়ে তোলা তাই এত বেশি উপভোগের জিনিস ছিল আমাদের। তবে ‘উনি’ যে তোমায় একটা আবছায়া বলে উপহাস করেন, সেইটাই সত্যি না কি?
আমায় বড়ো বোন বলে ভাবতে, তাই তোমার দুটি হাত ধরে অনুরোধ করছি, লক্ষ্মী ভাইটি আমার, তোমার সব কথা লিখে জানাবে কি? যেসব কথা নিতান্ত আপত্তিকর বা গোপনীয় যেসব কথা আমি আন্দাজেই বুঝে নেব, তোমায় স্পষ্ট করে খুলে লিখতে বলছি নে। মেয়েদের বিশ্বাসঘাতক বলে বদনাম থাকলেও আমি কথা দিচ্ছি যে, তোমার কোনো কথা কাউকে জানাব না। বড়ো বোনের ওপর এতটুকু বিশ্বাস রাখতে পার কি?
এখন আমাদের সোফিয়া মাহ্বুবা সম্বন্ধে দু-একটা কথা তোমায় জানানো দরকার বলে জানাচ্ছি, বিরক্ত হোয়ো না বা রাগ কোরো না। – লক্ষ্মীটির মতো তখন যদি তাকে তোমার অঙ্কলক্ষ্মী করে নিতে, তবে বেচারিদের আজ এত কষ্ট পেতে হত না। তুমি জান, একে বেচারিদের অবস্থা ভালো ছিল না, – বিপদের উপর বিপদ – সেদিন তার বাবাও আবার সাতদিনের জ্বরে মারা গেছেন। এক মামারা ছাড়া তো তাদের খোঁজ-খবর নেবার কেউ ছিল না দুনিয়ায়, তাই তারা এসে সেদিন মাহ্বুবাদের সবকে নিজের ঘরে নিয়ে গেছেন। এত বুঝালাম, অনুরোধ করলাম আমরা, এমনকী পায়ে পর্যন্ত ধরেছি – কিন্তু মাহ্বুবার মা কিছুতেই এখানে আমাদের বাড়িতে থাকতে রাজি হলেন না। থাকবেনই বা কী করে? তুমিই তো ওঁদের এ-দেশ ছাড়ালে! যে অপমান তুমি করেছ ওঁদের, যে আঘাত দিয়েছ ওঁদের বুকে, যেরম প্রতারিত করেছ ওঁদের আশালুব্ধ মনকে, তাতে অবস্থাপন্ন লোক হলে তোমার ওপর এর রীতিমতো প্রতিহিংসা না নিয়ে ছাড়তেন না। তাঁদের অবমাননা-আহত প্রাণের এই যে নীরব কাতরানি, তা যদি সবার বড়ো বিচারক খোদার আরশে গিয়ে পৌঁছে তাহলে তার যে ভীষণ অমঙ্গল-বজ্র তোমার আশে-পাশে ঘুরবে, তা ভেবে আমি শিউরে উঠছি, আর দিন-রাত খোদাতায়ালার কাছে তোমার মঙ্গল কামনা করছি। এই মাহ্বুবার বাবা হঠাৎ মারা গেলেন, এতে আমরা বলব, তাঁর হায়াত ছিল না – কে বাঁচাবে; কিন্তু লোকে বলছে, তোমার হাতের এই অপমানের আঘাতই তাঁকে পাঁজর-ভাঙা করে দিয়েছিল। আর বাস্তবিক, ওঁরা তো কেউ প্রথমে রাজি হননি বা বড়ো ঘরে বিয়ে দিতে আদৌ লালায়িত ছিলেন না, আমিই না হাজার চেষ্টা-চরিত্তির করে সম্ঝিয়ে ওঁদের রাজি করি। তোমার ভাইসাহেব কিন্তু প্রথমেই আমায় ‘বারহ’ মানা করেছিলেন – শেষে একটা গণ্ডগোল হওয়ার ভয়ে, কিন্তু আমি তা শুনিনি। আমি সে সময় এমন একটা ধারণা করেছিলাম, যা কখনও মিথ্যা হতে পারে না। তুমি হাজার অস্বীকার করলেও আমি জোর করে বলতে পারি যে, মাহ্বুবাকে দেখে তুমি নিজেও মরেছিলে আর তাকেও মিথ্যা আশায় মুগ্ধ করে তার নারী-জীবনটাই হয়তো ব্যর্থ করে দিলে। অবশ্য তোমাদের মধ্যে স্বাধীনভাবে মেলামেশা এমনকী দেখাশুনা পর্যন্ত ঘটেনি, এ আমি খুব ভালো করে জানি, কিন্তু ওই যে পরের জোয়ান মেয়ের দিকে করুণ-মুগ্ধ দৃষ্টি দিয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকা, তার মনটি অধিকার করতে হাজার রকমের কায়দা-কেরদানি দেখানো, এ-সব কীজন্য হত? এগুলো তো আমাদের চোখ এড়ায়নি! খোদা আমাদেরও দু-দুটো চোখ দিয়েছেন, এক-আধটু বুদ্ধিও দিয়েছেন। আর কেউ বুঝুক আর না বুঝুক, আমি বড্ড বুকভরা স্নেহ দিয়েই তোমাদের এ পূর্বরাগের শরম-রঙিন ভাবটুকু উপভোগ করতাম, কারণ আমি জানতাম দু-দিন বাদে তোমরা স্বামী-স্ত্রী হতে যাচ্ছ, আর তাই আমাদের সমাজে এ পূর্বরাগের প্রশ্রয় নিন্দনীয় হলেও দিয়েছি। নিন্দনীয়ই বা হবে কেন? দুইটি হৃদয় পরস্পরকে ভালো করে চিনে নিয়ে বাসা বাঁধলেই তো তাতে সত্যিকার সুখ-শান্তি নেমে আসে! যেমন আকাশের মুক্ত পাখিরা। দেখেছ তাদের দুটিতে কেমন মিল? তারা কেমন দুজনকে দুজন চিনে নিয়ে মনের সুখে বাসা বাঁধে, ঘরকন্না করে। এ দেখে যার চোখ না জুড়ায়, সে পাষাণ, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ হিংসুক। হৃদয়ের এ অবাধ পরিচয় আর মিলনকে যে নিন্দনীয় বলে, সে বিশ্ব-নিন্দুক। যাক সেসব কথা, কিন্তু তুমি কোন্ সাহসে বাঁশির সুরে একটি কিশোরী হরিণীকে কাছে এনে তাকে জালিমের মতো এমন আঘাত করলে! এইখানেই তোমাকে ছোটো ভাবতে আমার মনে বড্ড লাগে! এর মূলে কি কোনো বেদনা কি কোনো-কিছু নিহিত নাই? ধরো, এতে আমার যে অপমান করেছ তা নয়তো স্নেহের অনুরোধে ক্ষমা করলাম, কিন্তু অন্যে সে অপমান সইবে কেন? তাদের তো তার অধিকার দাওনি! আর তোমার যদি বিয়ে করবার একান্তই ইচ্ছা ছিল না, তবে প্রথমে কী ভেবে – কীসের মোহে পড়ে রাজি হয়েছিলে? আবার রাজি হয়ে, যখন সব ঠিকঠাক – তখনই বা কেন এমন করে চলে গেলে? গরীব হলেও তাঁদের বংশমর্যাদা অনেক উচ্চ, এটা তোমার ভাবা উচিত ছিল।