তোর মত কী? কী বলিস – দেবো নাকি চোখ-মুখ বন্ধ করে বিয়েটা…? (আঃ একটু ঢোক গিলে নিলুম রে!)
বাড়িতে বাস্তবিকই সকলে বড্ড মুষড়ে পড়েছেন তোর এই চলে যাওয়াতে। আমাদের গ্রামটায় প্রবাদের মতো হয়ে গিয়েছিল যে, তোর আর আমার মতো এমন সোনার চাঁদ ছেলে আর এমন অকৃত্রিম বন্ধুত্ব লোকে নাকি আর কখনও দেখেনি। এক সঙ্গে খাওয়া, এক সঙ্গে পড়তে যাওয়া, এক সঙ্গে বাড়ি আসা, ওঃ, সে কথাগুলো জানাতে হলে এমন ভাষায় জানাতে হয়, যে ভাষা আমার আদৌ আয়ত্ত নয়। ওরকম ‘সতত সঞ্চরমান নবজলধরপটলসংযোগে’ বা ‘ক্ষিত্যপ্তেজো পটাক দুম্’ ভাষা আমার একেবারেই মনঃপূত নয়। পড়তে যেন হাঁপানি আসে আর কাছে অভিধান খুলে রাখতে হয়! অবিশ্যি, আমার এ মতে যে অন্য সকলের সায় দিতে হবে, তারও কোনো মানে নেই। আমারও এ বিকট রচনাভঙ্গি নিশ্চয়ই অনেকেরই বিরক্তিজনক, এমনকী অনেকে একে ‘ফাজলামি’ বা ‘বাঁদরামি’ বলেও অভিহিত করতে পারেন, কিন্তু আমার এ হালকা ভাবের কথা – হালকা ভাষাতেই বলা আমি উচিত বিবেচনা করি। তার ওপর, চিঠির ভাষা এর চেয়ে গুরুগম্ভীর করলে সেও একটা হাসির বিষয় হবে বই তো নয়! – যাক, কী বলছিলাম? এখন যখন আমি একা তাঁদের বাড়ি যাই, তখন বুবু সাহেবা আর কিছুতেই কান্না চেপে রাখতে পারেন না। তাঁর যে শুধু ওই কথাটাই মনে পড়ে, এমনি ছুটিতে আমরা দুজনে বরাবর একসঙ্গে বাড়ি এসেছি। তারপর যত দিন থাকতাম, ততদিন বাড়িটাকে কীরকম মাথায় করেই না রাখতাম?…
হাঁ, আমাদিগকে যে লোক ‘মোল্লা, দোপেঁয়াজা’ বলে ঠাট্টা করত, তুই চলে যাওয়ার পর কিন্তু সব আমায় স্রেফ ‘একপেঁয়াজা মোল্লা বলছে।
যাক ওসব ছাইপাঁশ কথা – নূরু, কত কথাই না মনে হয় ভাই, কিন্তু বড়ো কষ্টে হাসি দিয়ে তোরই মতো তা ঢাকতে চেষ্টা করি!…আবার কি আমাদের দেখা হবে?
পড়াশুনায় আমার আর তেমন উৎকট ঝোঁক নেই। আর কিছুতে মন বসে না। যাই, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ইতি –
কলেজ-ক্লান্ত
মনুয়র
সালার
৬ই ফাল্গুন
নিরাপদ্দীর্ঘজীবেষু,
ভাই নূরুল হুদা, আমার শত স্নেহাশিস জানবে। অনেকদিন চিঠি দিতে পারিনি বলে তুমি তোমার ভাইসাহেবের পত্রে অনুযোগ করে বেশ একটু খোঁচা দিয়েছ। কী করি ভাই, সংসারের সব ঝক্কি এখন আমার ওপর। তুমি তো সব জান, আম্মাজান কিছু দেখেন না। আগে বরং দু-এক সময় তিনি বিষয়-আশয়ের ভালো-মন্দ সম্বন্ধে দুটো উপদেশ দিতেন। এখন তাও বন্ধ। দিন-রাত নমাজ-রোজা নিয়ে নিজের ঘরটিতে আবদ্ধ, আর বাইরে এলেই ওঁর ওপর খুকির তখন ইজারা দখল!
তারপর তোমার ভাইসাহেবের কথা আর বোলো না। দিনে-রাত্তিরে ‘কমসে কম’ পঁচিশ কাপ চা গিলচেন আর বই নিয়ে, না হয় এসরাজ নিয়ে মশগুল আছেন। ওইসব বলতে গেলেই আমি হই ‘পাড়া-কুঁদুলি, রণচণ্ডী, চামুণ্ডা’ আর আরও কত কী! আমার মতো এই রকম আর গোটা কতক সহধর্মিণী জুটলেই নাকি স্বামীস্বত্বে স্বত্ববান বাংলার তাবৎ পুরুষপালই জব্দ হয়ে যাবেন। কপাল আমার! তা যদি হয়, তাহলে বুঝি যে একটা মস্ত ভালো করা গেল। এ দেশের মহিলারা যখন সহধর্মিণীর ঠিক মানে বুঝতে পারবেন, স্বামীর দোষকে উপেক্ষা না করে তার তীব্র প্রতিবাদ করে স্বামীকে সৎপথে আনতে চেষ্টা করবেন, তখনই ঠিক স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধ হবে। স্বামীকে আশকারা দিয়ে পাপের পথে যেতে দেয় যে স্ত্রী, সে আর যাই হোক, সহধর্মিণী নয়। যাক ওসব কথা, এখন আমার ইতিহাসটা শোনো, আর বলো আমি কী করে কোন্ দিক সামলাই। –সাংসারিক কোনো কথা পাড়তে গেলেই তোমার ভাইসাহেবের ভয়ানক মাথা দপ দপ করে, আর যে কাজেই (য) দু-তিন কাপ টাটকা চায়ের জোগাড় করতে হয়! চা-টা যদি একটু ভালো হল, তবে আর যায় কোথা? একেবারে দিল-দরিয়া মেজাজ! আরাম-কেদারায় সটান শুয়ে পড়েন, আর যা বলব তাতেই ‘হুঁ’। তোমার সদাশিব কথাটা ভয়ানকভাবে খেটেছে ওঁর ওপর। কিন্তু ভাই, এতে তো আর সংসার চলে না। বিষয়-আশয় জমিদারি সব ম্যানেজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজে ভাং-খাওয়া বাবাজির মতো বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকলে কি সব ঠিক থাকে, না কাজেরই তেমনি শৃঙ্খলা হয়? মাথার উপর মুরুব্বি থাকাতে যতদিন যা করেছেন সেজেছে। আমি তো হদ্দ হলাম বলে বলে। কতই আর প্যাঁচা-খ্যাঁচরা করব মানুষকে। একটু বুঝিয়ে বলতে গেলেই মুখটি চুন করে আস্তে আস্তে সেখান হতে সরে পড়া হয়। সেদিনের মতোই একেবারে গুম। সন্ধে নাগাদ আর টিকিটির পর্যন্ত দেখা নাই। আমি তো নাচার হয়ে পড়েছি ওঁকে নিয়ে। পড়তেন জাহাঁবাজ মেয়ের হাতে, তবে বুঝতেন, কত ধানে কত চাল। তুমি যতদিন ছিলে, ততদিন যা এক আধটু কাজকর্ম দেখতেন। তুমি যাওয়ার পর থেকেই উনি এরকম উদাসীনের মতো হয়ে পড়েছেন। – আর তুমিই যে অমন করে চলে যাবে, তা কে জানত ভাই? – আজ আমি সন্তানের জননী, সংসারের নানান ঝঞ্ঝাট আমারই মাথায়, কাজেই চিন্তা করবার অবসর খুব কমই পাই; তবুও ওই হাজার কাজেরই হাজার ফাঁকে তোমার সেই শিশুর মতো সরল শান্ত মুখটি মনে পড়ে আমায় এত কষ্ট দেয় যে, সে আর কী বলব! আজ চিঠি লিখতে বসে কত কথাই না মনে পড়ছে। –
আমি যখন প্রথম এ ঘরের বউ হয়ে আসি, তখন ঘরটা কি-জানি কেন বড্ড ফাঁকা-ফাঁকা বলে বোধ হত। ঘরে আর কেউ ছেলে-মানুষ ছিল না যে কথা কয়ে বাঁচি। আমাদের সোফি আর পাশের বাড়ির মাহ্বুবা তখনও নেহাত ছেলেমানুষ, আর সহজে আমার কাছও ঘেঁষত না। কে নাকি তাহাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, আমি মেমসাহেব!সে কত কষ্টে তাহাদের ভয় ভাঙাতে হয়েছিল।…তারপর কিছুদিন পরে হঠাৎ একদিন তোমার ভাইসাহেব তোমায় আবিষ্কার করে ধরে আনলেন। তুমি নাকি তখন স্কুলে যাওয়ার চেয়ে মিশন, সেবাশ্রম প্রভৃতিতেই ঘুরে বেড়াতে। টোটো সন্ন্যাসী বা দরবেশগোছের কিছু হবে বলে, মাথায় লম্বা চুলও রেখেছিলে; মাঝে মাঝে আবার গেরুয়া বসন পরতে। এইসব অনেক-কিছু কারণে তোমার ভাইসাহেব তোমাকে একজন মহাপ্রাণ মহাপুরুষের মতোই সমীহ করলেও আমি একদিন বলেছিলাম যে, এসব হচ্ছে আজকালকাল ছোকরাদের উৎকট বাজে ঝোঁক আর অন্তঃসারশূন্য পাগলামি। তবে লম্বা চুল রাখবার একটা গূঢ় কারণ ছিল, – সে হচ্ছে, তুমি একজন ‘মোখ্ফি’ কবি; আর কবি হলেই লম্বা চুল রাখতে হবে। অবশ্য এ আমি তোমার লুকানো কবিতার খাতা দেখে বলছি তা মনে কোরো না। – তবে তুমি বলতে পার যে, তোমার উদাসীন হবার যথেষ্ট কারণ ছিল। তোমার বাপ-মা সবাই মারা পড়লেন, সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়ার সমস্ত স্নেহ-বন্ধনই কালের আঘাতে ছিন্ন হয়ে গেল। কিন্তু সত্য বলতে গেলে এসবের পেছনে কি আর একটা নিগূঢ় বেদনা লুকানো ছিল না, ভাই? আগেও আমার ছোটো ভাই মনুর কাছে শুনেছিলাম। তোমাতে আর মনুতে যে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল তাও ওরই মুখে শুনেছিলাম। তবে সে তোমার যেসব গুণের কথা বলত, তাতে স্বতই লোকের মনে হবার কথা যে, এ ধরনের জীবের বহরমপুরই উপযুক্ত স্থান। কয়েকবার বিপন্নকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে তুলেছিলে, এমন কথা শুনেও আমি বলেছিলাম, ওসব রক্তগরম তরুণদের খামখেয়ালি ফ্যাশন। ওর সঙ্গে একটা উৎকট যশোলিপ্সাও যে আছে, তাও আমি অসংকোচে বলতাম। কিন্তু যেদিন তোমার ভাইসাহেব আর আমার ছোটো ভাইটির সাথে আমাদের ঘরে অসংকোচে নিতান্ত আপন জনের মতো এসে তুমি দাঁড়ালে, তখন বাস্তবিকই এক পলকে আমার ওসব মন্দ ধারণাগুলো একেবারে কেটে গেল। তোমার ওই নির্বিকার ঔদাস্যের ভাসা ভাসা করুণ কোমল দৃষ্টি আর শিশুর মন, অনাড়ম্বর সহজ সরল ব্যবহার দেখে আপনি তোমার ওপর একটা মায়া জন্মে গেল। আর যারা নিজেদের প্রতি এরকম উদাসীন, তাদের প্রতি মায়া না হয়েই যে পারে না। তাই সেদিন আমার বাপ-মা-মরা অনাথ ছোটো ভাইটির সাথে তোমাকেও আমার আরও একটি ছোটো ভাই বলে ডেকে নিলাম।…