তুই কবি না হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু আমি যে একজন প্রতিভাসম্পন্ন জবরদস্ত কবি, তাতে সন্দেহ নাস্তি! প্রমাণস্বরূপ, – আমি হলে তোর ওই বর্ষাস্নাতা সাগরসৈকতবাসিনী করাচির বর্ণনাটা কীরকম কবিত্বপূর্ণ ভাষায় করতাম, অবধান কর (যদিও বর্ণনাটি ‘আন্দাজিক্যালি’ হবে।) :
ঝরা থেমেছে। উলঙ্গ প্রকৃতির স্থানে স্থানে এখনও জলের রাশ থই থই করচে। দেখে বোধ হচ্ছে যেন একটি তরুণী সবেমাত্র স্নান করে উঠেছে, আর তার ভেজা পাতলা নীলাম্বরী শাড়ি ছাপিয়ে নিটোল উন্মুখ যৌবন ফুটে ফুটে বেরিয়েচে! এখনও ঘুনঘুনে মাছির চেয়েও ছোটো মিহিন জলের কণা ফিনফিন করে ঝরছে। ঠিক যেন কোনো সুন্দরী তার একরাশ কালো কশকশে কেশ তোয়ালে দিয়ে ঝাড়চে, আর তারই সেই ভেজা চুলের ফিনকির ঝাপটা আমাদিগকে এমন ভিজিয়ে দিচ্চে! এখনও রয়ে রয়ে ক্ষীণ বিজুলি চমকে চমকে উঠেছে, ও বুঝি ওই সুন্দরের তড়িতাঙ্গ সঞ্চালনের ললিত-চঞ্চল গতিরেখা! আর ওই যে ক্ষান্ত বর্ষণ-স্নিগ্ধ সন্ধ্যায় মুগ্ধ দু-চারটি গায়ক-পাখির ঈষৎ-ভেসে আসা গুঞ্জন শোনা যাচ্চে, ও বুঝি ওই স্নাতা সুন্দরীর চারু নূপুরের রুনু-ঝুনু কিংবা বলয়-কাঁকনের শিঞ্জিনী! আর ওই যে তার শেফালির বোঁটায়-ছোবানো ফিরোজা রং-এর মলমলের মতো মিহিন শাড়ি আর তাতে ঘন-সবুজ-পাড় দেওয়া, ওতে যেন কে ফাগ ছড়িয়ে দিয়েছে! ও বোধ হয় আবিরও নয় ফাগও নয়, – কোনোও একজন বাদশাজাদা ওই তরুণীর ভালোবাসায় নিরাশ হয়ে ওই দুটি রাতুল চরণতলে নিজেকে বলিদান দিয়েছে আর তারই কলিজার এক ঝলক খুন ফিং দিয়ে উঠে, সুন্দরীর বাসন্তী-বসন অমন করে রক্ত-রঞ্জিত করে তুলেছে, – ওগো, তাই এ সাঁঝ বেলাতে সুন্দরীর মন এত ভারি! –
কেমন লাগল? দেখলি তো, আমি তোর মতো আর ছোটো কবি নই। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয় রে নূরু, যে, কেউ আমায় চিনতে পারলে না! পরে কিন্তু দেশের লোককে পস্তাতে হবে, বলে রাখচি। তুই হয়তো হাসচিস, কিন্তু আমি বলি কী, তার একটা মস্ত কারণ আছে। রবিবাবুকে ইয়োরোপ আর আমেরিকার লোক যে রকম বড়ো আর উঁচু করে দেখে, আমাদের দেশে সে রকম পারে কি? উলটো, যাঁরা তাঁর লেখার এক কানা-কড়িও বোঝেন না, তাঁরাই আবার যত রকমে পারেন তাঁর নিন্দা করেন যেন এইসব সমালোচক রবি-কবির চেয়ে বহুগুণে শ্রেয়, তবে তাঁরা সেটা দেখাতে চান না, আর দেখালেও নাকি দেশে কেউ সমঝদার নেই! এঁরাই কিন্তু মনে মনে রবিবাবুর পায়ে লক্ষ-হাজার বার সালাম না করে থাকতে পারেন না, তবু বাইরে নিন্দে করবেনই। কাজেই এসব লোককে সমালোচক না বলে আমি বলি পরশ্রীকাতর। এর একটা আবার কারণও আছে; আমরা দিন-রাত্তির ওঁকে চোখের সামনে দেখছি, – আর যাঁকে হরদম দেখতে পাওয়া যায়, এমন একটা ব্যক্তি যে সারা দুনিয়ার ‘মশহুর’ একজন লোক হবেন, এ আমরা সইতে পারিনে। তাই, অধিকাংশ কবিই জীবিতকালে শুধু লাঞ্ছনা আর বিড়ম্বনাই ভোগ করেছেন। ধর, আমার লেখা যদি ছাপার অক্ষরে বেরোয়, তবে অনেকেই ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে যাবে। কারণ, আমারও তাদেরই মতো দুটো হাত দুটি পা। কোনো একটা অতিরিক্ত অঙ্গ, অন্তত পেছনে একটা লেজুড়ও নেই, – যার থেকে আমি একটা এরকম অস্বাভাবিক জানোয়ারে পরিণত হতে পারি! – একদিনকার একটা মজা শোন! একটা উচ্চ মাসিক পত্রিকায় আমার লেখা একটা গল্প প্রকাশিত হতে দেখে আমার এক বন্ধু ভয়ানক অবাক হয়ে আর চটে বলেছিলেন –“আরে মিয়াঁ, হঃ! আমি না কইছিলাম যে, এসব কাগজ লইতাম না? এইসব ফাজিল চ্যাংরারা যাহাতে ল্যাহে, হেই কাগজ না আবার মান্ষে পড়ে? আমার চারড্যা ট্যাহা না এক্কেবারে জলে পরলনি!”
যাক, সৈনিক জীবন কেমন লাগছে? ও জীবন আমার মতো নরম চামড়ার লোকের পোষায় না রে ভাই, তোর মতো ভূতো মারহাট্টা ছেলেদেরই এসব কোস্তাকুস্তি সাজে!
তুই শুনে খুব খুশি হবি যে, যে-লোকগুলো তোর মতো এমন ‘ধড়ফড়ে’ ইব্লিশ ছোকরাকে দু-চোখে দেখতে পারত না, তারাও এখন তোকে রীতিমতো ভয়-ভক্তি করে। তবে তাঁরা এটাও বলতে কসুর করেন না যে, তোদের মতো মাথা-খারাপ শয়তান ছোকরাদেরই জন্যে এ বঙ্গবাহিনীর সৃষ্টি।
তারপর একটু খুব গুপ্ত কথা। – বুবু সাহেবা আমায় ক্রমাগত জানাচ্ছেন যে, যদি আমার ওজর-আপত্তি না থাকে, তাহলে শ্রীমতী সোফিয়া খাতুনের (ওরফে তাঁর ননদের) পাণিপীড়ন ব্যাপারটা আমার সঙ্গেই সম্পন্ন করে দেন। ওরকম একটা খোশখবর শুনে আমার খুবই ‘খোশ’ হওয়া উচিত ছিল, কেননা তাহলে রবিয়ল মিয়াঁকে খুব জব্দ করা যেত। তিনি আমার ভগ্নিকে বিয়ে করে আইনমতে আমায় শালা বলবার ন্যায্য অধিকারী সন্দেহ নেই, কিন্তু রাত্তির দিন ভদ্র-অভদ্র লোকের মজলিসে মহ্ফিলে যদি ওই একই তীব্র-মধুর সম্বন্ধটা বারবার শতেকবার জানিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে নিতান্ত নিরীহ প্রাণীরও তাতে আপত্তি করবার কথা। খুব ঘনিষ্ঠ আর সত্যিকার মধুর সম্বন্ধ হলেও লোকে ‘শালা আর শ্বশুর’ এই দুটো সম্বন্ধ স্বীকার করতে স্বতই বিষম খায়, এ একটা ডাহা সত্যি কথা! অতএব আমিও জায়বদ্লি বা Exchange স্বরূপ তাঁর সহোদরার পানিপীড়ন করলে তাঁর বিষদাঁত ভাঙা যাবে নিশ্চয়ই, তবে কিনা সেই সঙ্গে আমারও ‘তিন পাঁচে পঁচাত্তর” দাঁত ভাঙা যাবে। কেননা বিশেষ প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে, আমার ভবিষ্যৎ অঙ্কলক্ষ্মীটি আদৌ গো-বেচারি প্রিয়ভাষিণী নন, বরং তাতে লক্ষ্মীমেয়ের কোনো গুণই বর্তে নাই। সবচেয়ে বেশি ভয়, ইনি আবার ভয়ানক বেশি সুন্দরী, মানে এত বেশি সুন্দরী, যাদের ‘চরণতলে লুটিয়ে পড়িতে চাই’ বা ‘জীবনতলে ডুবিয়া মরিতে চাই’ আর কী! যাদের ঈষৎ আড়চোখো চাউনিতে আমাদের মাথা একেবারে বিগড়ে যায়। যাদের ঠোঁটের কোণে একটু হাসির রেখা দেখে আমরা আনন্দে অস্বাভাবিক রকমের বদন ব্যাদান করে ‘দেহি পদপল্লবমুদারম্’ বলে হুমড়ি খেয়ে পড়ি! – আজকাল ওই ঘোড়া-রোগেই গরিব কাঁচা যুবকগুলো মরছে কিনা! – আর নূরু! লাজের মাথা খেয়ে সত্যি কথা বলতে কী ভাই, অহম্ গরিব নাবালকও ওই রোগেই মরেছে রে ওই রোগেই ম – রে – ছে! জানি না আমার কপালে শেষ পর্যন্ত কী আছে, – মুড়ো ঝ্যাঁটা, না মিষ্টি ঠোনা!