বাবা নূরু!
আমার স্নেহ-আশিস জানবে। মাকে এরই মধ্যে ভুলে গেলে নিমকহারাম ছেলে? আমাকে ভুলেও একটা চিঠি দেওয়া হল না এতদিনের মধ্যে? আমি প্রথমে রেগে চিঠিই দিইনি। যে ছেলে মায়ের নয়, তার ওপর দাবি-দাওয়া কীসের? ওরে, তোরা কী করে মায়ের মন বুঝবি? তা যদি বুঝতিস তবে আর এমন করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করতিস নে আমায়। নাই বা হলাম তোর গর্ভধারিণী জননী আমি, তবু যে আমি কোনোদিন তোকে অন্যের বলে স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি! একটা কথা আছে, ‘পেটে ধরার চেয়ে চোখে-ধরা বেশি লাগে।’ তোরা একথা বুঝতে পারবিনে।
আমি চিঠি লিখতাম না বাবা, তবে রবু সেদিন হাসতে হাসতে বললে, ‘মা-জান, তুমিই ভালো করে নূরুর কথাবার্তায়, গল্পে যোগ দিতে না বলে সে রেগে চলে গিয়েছে।’ দেখেছিস কথার ছিরি? ‘ছিঁচে পানি’ আর মিছে কথা মানুষের গায়ে বড়ো লাগে তাই কথাটা মিথ্যে হলেও আমার জানে এত লাগল – যেমন মায়ের দোষে ছেলে চলে যাবার পর সেই ব্যথাটা মায়ের প্রাণে গিয়ে বাজে! জানি, তুই কক্ষণো সে রকম ভাবতে পারিসনে, তবু এইখানে কয়েকটা কথা জানিয়ে রাখি বাপ, কেননা, ‘হায়াত-মওতে’র কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই! আমার দিন তো এবার ঘনিয়েই আসচে। একদিন এমন ঘুমিয়ে পড়ব যে, তোরা ঘরগুষ্টি মিলে কেঁদেও আর জাগাতে পারবি নে। আহা, খোদা তাই যেন করেন, তোদের কোনো অমঙ্গল যেন আমায় আর দেখে যেতে না হয়। শোকে-শোকে এ বুক ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে। তাই এখন খোদার কাছে চাইছি, যেন তোর হাতের মাটি পেয়ে মরতে পারি। আমার জান তোর ওখানেই পড়ে আছে, কখন ছেলের কী হয়!
দু-এক সময়ে তোর ছেলেমি আর খ্যাপামি দেখে খুবই বিরক্ত হতাম, কিন্তু ওই বিরক্তির মধ্যে যে কত স্নেহ-ভালোবাসা লুকানো থাকত, তোরা ছেলেমানুষ তা বুঝতে পারবিনে। কিন্তু এসব তুচ্ছ কথা কি এখনও তোর প্রাণে জাগে? মায়ে-ছেলেয় যে কত আদর-আবদার হয় বাপ!
অবিশ্যি আমার এও মনে পড়ে যে, তুই যখন অনবরত বকর-বকর করে আমাদের সংসারী লোকের পক্ষে নিতান্তই অস্বাভাবিক কথাগুলো বকে যেতিস আর নিজের ভাবে নিজেই মশগুল হয়ে পড়তিস, তখন আমি হয়তো বিরক্ত হয়ে উঠে অন্য কাজে যেতাম, তোর কিন্তু কথার ফোয়ারায় ফিং ফুটে যেত। তোদের ছেলে-পিলের দলে কী আর আমাদের মতো সেকেলে মরুব্বিদের বসে থাকা মানায়? – রবু বলে কী, এই সবে তোর মনে বড্ড কষ্ট হত। সত্যি কি তাই? রবুর মতো বোকা ছেলে তো আর তুই নোস যে, এইসব মনে করে আমায় কষ্ট দিবি!
তোরা এইসব ছেলে-মেয়েগুলোই তো আমাদের দুশমন। মা-দের যে কত জ্বালায় জ্বলতে হয়, কী চিন্তাতেই যে দিন কাটাতে হয়, তা যদি ছেলেরা বুঝত তা হলে দুনিয়ার মা-রা ছেলেদের খামখেয়ালির জন্য এত কষ্ট পেত না! উঃ, হাড় কালি হয়ে গেল রে, হাড় কালি হয়ে গেল!
এখন দিনরাত খোদার কাছে মুনাজাত করছি, কখন তোকে আবার এ যমের মুখ থেকে সহি সালামতে ফিরিয়ে আনেন। কী পাগলামিই না করলি, একবার ভেবে দেখ দেখি।
খুব ভালো করে থাকিস! খাবার-দাবার খুব কষ্ট হচ্ছে বোধ হয় সেখানে ? আমাদের পোড়া মুখে যে আহার রুচে না! খেতে গেলেই মনে হয়, – আহা, ছেলে আমার কোন্ বিদেশে হয়তো না খেয়ে না দেয়ে পড়ে আছে, আর আমি হতভাগি মা হয়ে ঘরে বসে বসে রাজভোগ গিলছি। অমনি চোখের জলে হাতের ভাত ভেসে যায়!
জলদি চিঠি দিস আর সেখানকার সব কথা জানাস।
বাকি সব রবুর চিঠিতে জানবি। আর লিখতে পারচিনে। তারা কেউ তোর চিঠি পড়ে আমায় শুনায় না। নিজে কী যে ছাই-পাঁশ লেখে দু-দিন ধরে, তাও জানায় না। আমার হাত কাঁপে, তবু নিজেই লিখলাম চিঠিটা। কী করি বাবা, মন যে বালাই, কিছুতেই মানে না। তাছাড়া আমিও মুরুক্ষুর মেয়ে নই! আমার বাপজি (আল্লাহ্ তাঁকে জিন্নত থেকে নসিব করুন) মৌলবি-মৌলানা লোক ছিলেন, তাঁর পায়ের এতটুকু ধুলো পেলে তোরা বত্তিয়ে যেতিস! … ইতি
শুভাকাঙ্ক্ষিণী
তোর মা
বাঁধনহারা – পরিচ্ছেদ ০৩
[গ]
বাঁকুড়া
২৬এ জানুয়ারি
(বিকেলবেলা)
অথ নরম গরম পত্রমিদম কার্যনঞ্চাগে বিশেষ! বাঙালি পলটনের তালপাতার সিপাই শ্রীল শ্রীযুক্ত নূরুল হুদা বরাবরেষু।…
বুঝলি নূরু! তোর চিঠি নিয়ে কিন্তু আমাদের বোর্ডিং-এর কাব্যিরোগাক্রান্ত যাবতীয় ছোকরাদের মধ্যে একটা বিভ্রাট রকমের আলোচনা চলেছে। এঁদের সবাই ঠাউরেছেন, তুই একটা প্রকাণ্ড ‘হবু-কবি’ বা কবি-কিশলয়! তোর যে ভবিষ্যৎ দস্তুরমতো ‘ফর্সা’ এবং ক্রমে তুই-ই যে রবিবাবুর ‘নোবেল প্রাইজ’ কেড়ে না নিস, অন্তত তাঁর নাম রাখতে পারবি, এ সিদ্ধান্তে সকলের একবাক্যে সম্মতিসূচক ভোট দিয়েছেন। তবে আমার ধারণা একটু বিভিন্ন রকমের। ভবিষ্যতে তুই কবিরূপে সাহিত্য-মাঠে গজিয়ে উঠবি কিনা, তার এখনও নিশ্চয়তা নেই, – কিন্তু ‘কপি’ হয়েই আছিস। কেননা কবির চেয়ে কপির উপাদানই তোর মধ্যে বেশি! – আর, ছোকরাদের ওই হইচই-এর সম্বন্ধে আমার বিশেষ তেমন বক্তব্য নেই, তবে এইমাত্র বললেই যথেষ্ট হবে যে, উপরে হইহই ব্যাপার! রইরই কাণ্ড!! জর্মানির পরাজয়!!! লেখা থাকলেও ভিতরে সেই – ফসিউল্লার গোলাব-নির্যাস, চারি আনা শিশি। নয়তো সিলেট চুন!
তাই বলে মনে করিসনে যেন যে, দেঁতো ‘ক্রিটিকের মতো ছোবলে’ তোকে আমি জখম করে দিচ্ছি। আমিও আবার হুজুগে-সমালোচকদের হল্লায় সায় দিয়ে বলছি, কপালের দোষে নিতান্তই যদি তুই সাহিত্য-রথী না হোস, তবে অন্তত সাহিত্য-কোচোয়ান বা গাড়োয়ান হবিই হবি। আর ওই আগেই বলেছি, কবিবর না হোস, কপিবর তো হবিই!