সেদিন আমার মনটা হয়তো ভালো ছিল না, আমি বলেছিলাম কী, দিদি জান? বলেছিলাম,সেই চোরটি যদি বৈকুণ্ঠের ঠাকুরটির কাছে একটু চতুরালি শিখতই, তাহলে তাকে আজ জীবনে এত বড়ো ঠকতে হত না। সে তাহলে সুধাময়ীকেও চাইতো সুধার সাথে। স্বামী আফিমের নেশায় ঝিমোচ্ছিলেন, বোধ হয় বুঝতে পারেননি ভালো করে আমার হেঁয়ালি। বুঝলে আমার ভাগ্যে হয়তো এ দেব-লোক অক্ষয় না হতেও পারত।
স্বামী আফিম খেয়ে এই বৃদ্ধ বয়সে বেঁচে গেছেন, আমারও এক একবার লোভ হয় দিদি, যে, ওই আফিমের অংশ নিয়ে আমিও চিরজনমের মতো বেঁচে যাই? যে লোভটা ওই উৎকট দিকটায় এত করে আকর্ষণ করে আমায় – সেই লোভটাই আবার মিষ্টি কোনো ভবিষ্যতের পানে ইশারা হেনে বলে – ওরে হতভাগি বেঁচে থাক, বেঁচে থাক তুই, সারা জীবনের ক্ষতি তোর এক মুহূর্তের কল্যাণে পুষ্পিত হয়ে উঠবে। তোর প্রতীক্ষার ধন ফিরে পাবি! তোর মৃত্যুক্ষণ হাসির রঙে রেঙে উঠবে! – আমিও তার সাথে সাথে বলি, আমি বাঁচতে চাই, বাঁচতে চাই। – যাকে আমি বাম হস্তের বারণ দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছি, দক্ষিণ হস্তের বরণমালা দিয়ে যদি তার প্রায়শ্চিত্ত না করি, তাহলে আমার আর মুক্তি নেই ইহকালে।
আমার স্বামী আমার রূপকে চেয়েছিলেন রুপার দরে যাচাই করতে। শুনে খুশি হবে যে, এ সওদায় তিনি ঠকেননি। কিন্তু এর জন্য স্বামীকে খোঁচা দিয়ে লাভ নেই। এই তো আমাদের বাংলার – অন্তত শরিফ মুসলমান মেয়েদের – চিরকেলে – একঘেয়ে কাহিনি। আমাদের সমাজের স্ত্রী-শিকারি অর্থাৎ স্বামীরা শব্দভেদী বাণ ছুঁড়ে শিকার করেন আমাদের। তাঁরা আমাদের দেখতে পান না বটে, কিন্তু শুনতে পান। রূপের একটা অভিশাপ আছে, হেরেমের দেয়াল ডিঙাতে তার বিশেষ বেগ পেতে হয় না। প্রভাত-আলোর মতো, ফুলের গন্ধের মতো তার খ্যাতি ঘরে-ঘরে দেশে-দেশে পুরুষের কানে গিয়ে পৌঁছে। কোথাও ভালো শিকার আছে শুনলেই পুরুষ ছোটেন সেখানে, সেই শব্দভেদী বাণের কল্যাণে তাঁদের হয়ে যায় শাপে-বর – কিন্তু এই হতভাগিনিদের বরই হয়ে ওঠে শাপ।
আমার স্বামী শিকার করে করে প্রধান হয়েছেন, হাত তাঁর পাকা, লক্ষ্যও অব্যর্থ। কাজেই আমার রূপের খ্যাতি তাঁর কাছে পৌঁছবার পরেও তিনি চুপ করে বসে থাকবেন – তাঁর বীর চরিত্রে এত বড়ো অপবাদ দিবার সুযোগ তিনি দেননি। ছুঁড়লেন শব্দ লক্ষ করে বাণ, বাণের রৌপ্যফলকে বিঁধে আমার বক্ষের অবস্থা যা-ই হোক, তাঁর মুখে হাসি যে ফুটল তা খাঁটি সোনার। এইখানে শুনে খুশি হবে দিদি, তাঁর দাঁত সব সোনার। খোদার দেওয়া হাড়ের দাঁতের লজ্জা তিনি দূর করেছেন ও-দাঁত খসে পড়তেই। এখন তিনি সোনায় দাঁত বাঁধিয়ে নিয়েছেন। তাঁর গোশত খাওয়া এবং বিবাহ করা দুই শখই অক্ষয় হয়ে গেল! বিজ্ঞানের জয়জয়কার হোক, আমাদের মতো বহু হতভাগিনির স্বামীর যৌবন এই বিজ্ঞানের কৃপায় অটুট হয়ে রইল!
আমার স্বামী জমিদার এ শুনে আমারই জাতের অনেক হতভাগিরই বুক চচ্চড় করবে – সতিনের মতো। কিন্তু আমার কপাল এমনই মন্দ দিদি, যে এই জমিদারির পঙ্খিরাজে চড়েও আমার দিগ্বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা আর জাগল না কোনও দিন।
স্বামী নব নব অলংকারে আমার বন্দনা করেন। কিন্তু প্রসন্ন যে হতে পারি না – এর ওষুধ কি!
অলংকারে কাব্যদেবীর সুষমালক্ষ্মীর দাম বাড়ে, কিন্তু মাটির মানুষের দাম ওতে বাড়ে না কমে – বলে দিতে পার দিদি? হাটে যে বিকাল মাটির দরে, তাকে নিয়ে এ বিদ্রুপ কেন? হায় রে হতভাগিনি নারী, প্রাণের ডালা তার শূন্য রইল বলে দেহের ডালা সাজিয়ে সে হেসে বেড়ায়! অলংকার সুন্দর, কিন্তু ও কঠিন বস্তু দিয়ে প্রাণের পিপাসা মেটে না। তাছাড়া পাষাণের বেদির বুকে থাকতে হয় যাকে পড়ে – তার গায়ে অলংকার বড়ো বাজে দিদি। অলংকার দিয়ে রূপ আমার খুলল কিন্তু মন কিছুতেই খুলল না, তাই বলেন আমার স্বামী।
অদ্ভুত এই মানুষের মন। যে মানুষ, মানুষ খেয়ে খেয়ে এতটা মোটা হল, আজ সেই মানুষই মানুষের একটুখানি করুণার জন্য কত কাঙাল হয়ে উঠেছে! দেখলে দুঃখ হয়! আমার স্বামী জমিদার, এটা আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। জমিদার নামের পেছনে একটা কৌতূহল আছে। রাজার ওঁরা পাড়াগেঁয়ে সংস্করণ, তাই লোকের বিশ্বাস – কত না জানি রূপকথার সৃষ্টি হচ্ছে ওখানে। হয়তো বা হচ্ছেও! আমার স্বামী জমিদার একথা স্মরণ করিয়ে দিতে তিনি ভুলেন না। তাঁর প্রতাপে দেশে যে ইংরেজ বলে এখনও কোনো শাসনকর্তা আছে, একথা ভুলে গেছে তাঁর জমিদারির লোক! আর, টাকাকড়ি? ইচ্ছা করলে আমায় বনবাস দিয়ে স্বর্ণসীতা গড়ে পাশে বসাতে পারেন! কত নারী তাঁকে অত্মদান করে ধন্য হয়ে বেহেশ্তে চলে গেছে হাসতে হাসতে! যাওয়ার বেলায় তাদের এই সালংকার জমিদার-স্বামীর জন্য কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছে এই ভেবে, যে, কোনো মুখপুড়ি আবার তাঁর ঐশ্বর্যের ওপর বসে তার প্রভুত্ব চালাবে! গয়না ও টাকা ছাড়া যে মেয়েলোক আরও কিছু চায়, এই নতুন জিনিসটের সঙ্গে যখন পরিচয় হল তাঁর আমার কৃপায়, তখণ এই হতভাগ্যের দুঃখ দেখে আমার মতো পাষাণীরও চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। বলতে সে পারে না ঠিক প্রকাশ করে কিন্তু তার মুখ দেখে আমার বুঝতে বাকি থাকে না – কী যন্ত্রণাই তার আজ হচ্চে! আজ সে যেন বুঝেছে, জীবনে সবচেয়ে বড়ো পাওয়া যেটা, সেইটে থেকেই সে বঞ্চিত রয়ে গেল! অন্যের ভালোবাসার যে কত দাম, তা বুঝেছে বেচারা – যখন তার জীবন-প্রদীপের তৈল ফুরিয়ে এসেছে। সে আবার চায় যৌবন-ভিক্ষা – হয়তো সমস্ত ঐশ্বর্যের বিনিময়েও, সে তার সারা জীবনের ক্ষতিকে একদিনে আত্মদানে ভুলতে চায়, কিন্তু সবচেয়ে বেশি সে-ই জানে, যে তা আর হয় না! তবু সে আমার পায়ে-পায়ে ঘুরে মরে! আমার রূপ তার গায়ে যে কখন কঠিন হয়ে বাজল জানি না, কিন্তু এ আমার বেশ স্মরণ আছে যে, সে এর জন্য প্রস্তুত ছিল না – এমনই একটা ভাব নিয়ে আমার দিকে পাগলের মতো করে সে একদিন চেয়েই ছিল। মনের জাদুস্পর্শে কোমল না হলে রূপ যে স্ত্রী-শিকারের বাণের রৌপ্য-ফলকের চেয়েও কঠিন হয়ে বাজে এ-শিক্ষা তার সেদিন নতুন হল। রূপা দিয়ে মানুষ যাচাই করেও যে সবচেয়ে বড়ো ঠকা ঠকতে হয়, এ-শিক্ষা হল তার আমায় দিয়ে প্রথম। অলংকার দিয়ে আমার ওজন করতে পারল না বলে – তার ঐশ্বর্যের স্বল্পতা ধরা পড়ল তার চোখে!