তারপর তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছি যে, এ কথাটা কী আমি আর সবাইকে বলতে পারি রে, যে, আমার ছোটো বোন ভালোবাসায় পড়েছে! যতই হোক, আমি তো তার সাহসী দিদি, তবে তখন সে চুপ করে। দেখিস ভাই, তোর পায়ে পড়ি, তুই যেন এ-কথা আবার বলে দিয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দিসনে! এ-পাগলি ছুঁড়িটার যৌবন কিন্তু বয়সের অনেক পেছনে পড়ে ; হয়তো বিশ বছর বয়সে গিয়ে তবে কখনও ওর যুবতির লজ্জা আসবে। তবে বিয়ে হয়ে গেলে আলাদা কথা। কেননা, তখন কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো হবে কিনা।
তোর খেলার সাথি বেচারার দুঃখে আমি এতটুকুও সহানুভূতি দেখাতে পাচ্ছিনে, কেননা তিনি এমন মূক না হয়ে গেলে কি আর তোর আমায় এখন মনে পড়ত রে ছুঁড়ি!
হাঁ, সোফির বিয়েতে যাব বই কি! তা নাহলে ওকে বাগ মানাবে কে? হয়তো বিয়ের সময়ই রেগে দোর দিয়েই বসে থাকবে! ওকে বলে দিস বোন যে, সে বিয়ে যদি নেহাতই না করে, তবে আমার স্কুলের মেয়ে দফতরি করে দেওয়া যাবে। দেখিস সে যেন ঠাট্টা মনে না করে। তা হলেই আমি হাবাৎ আর কি?
আমার বরের ভাবনা নিয়ে তোকে আর ভাবতে হবে না লো, তুই নিজের চরকায় তেল দে! ‘যার বিয়ে তার ধুম নেই পাড়া-পড়শির ঘুম নেই!’ যত দিন না আমার সন্ন্যাসীঠাকুর আসবেন ততদিন আমায় সন্ন্যাসিনীই থাকতে হবে বই কি! সংসার না ডাকলে তো আর সংসারী হতে পারিনে নিজে সেধে! থাক, আরও অনেক বলবার রইল! খুকিকে চুমু দিস। ইতি
তোর সাহসী সই
সাহসিকা
——————
শেঙান
১লা আষাঢ়
দুপুর রাত্তির
শ্রীচরণসরোজেষু!
সাহসিকাদি! বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ পেরিয়ে গেল। ঝড়-ঝঞ্ঝা যত বইবার, বয়ে গেল আমার জীবনের ওপর দিয়ে। কিন্তু বৃষ্টি আজও থামেনি। আজ পয়লা আষাঢ়। আমার জীবনের এ-আষাঢ় বুঝি আর ফুরোবে না। আশীর্বাদ করো দিদি, সত্যিই এ আষাঢ়ের যেন আর শেষ না হয়।
বিয়ের পর আর কাউকে চিঠি দিইনি। আমার এত শ্রদ্ধার মা, দাদাভাই রবিয়ল সাহেব, এত ভালোবাসার ভাবিসাহেবা – সোফি – সকলের মাঝে যেন একটা মস্ত আড়াল পড়ে গেছে। আমি যেন কাউকেই আর ভালো করে দেখতে পাচ্ছিনে। সব মুখ যেন ঝাপসা হয়ে আসছে – আমার মনের মুকুরে দীর্ঘশ্বাসের ধোঁয়া লেগে! আজ আমার মনে হচ্ছে দিদি, যেন তুমি ছাড়া আর আমার আপনার বলতে কেউ নেই। শুধু তুমিই আমার মনে আজও ঝাপসা হয়ে ওঠনি। তাই আজ আমার মনের সকল দ্বন্দ্বগ্লানি কাটিয়ে উঠে তোমার পানে সহজ চোখে চাইতে পারছি। তাই আবার বলছি, সাহসিকাদি, আজ তুমিই, – একমাত্র তুমিই আমার গুরু, আমার বন্ধু, আমার সখী – সব আজ আমি মনের কথা যেন মন খুলে বলতে পারি তোমার কাছে। আজ যেন আমি আত্মপ্রবঞ্চনা না করি!
আর আপনাকে ফাঁকি দিতে পারিনি দিদি! আজ আষাঢ়ের পুঞ্জীভূত মেঘের সাথে সাথে আমারও মন যেন ভেঙে পড়ছে! মনে হচ্ছে, মাটির মতো করে আমায় কেউ চাক, আমিও আষাঢ় মেঘের মতো নিঃশেষে নিজেকে ঝরিয়ে দিই তার বুকে। নিজেকে জমিয়ে জমিয়ে যে-ভার বিপুল করে তুলেছি নিজেরই জীবনে, আজ আমি মুক্তি চাই সে-ভার হতে। বিলিয়ে দেওযার সে-সাধনা কেমন করে আয়ত্ত করি বলে দিতে পার, দিদি?
এই তো দুটো চোখ, ক ফোঁটাই-বা জল ধরে ওতে! তবু মনে হচ্ছে আজ যেন আমি আষাঢ়ের মেঘকেও হার মানিয়ে দিতে পারি কেঁদে কেঁদে।
কত ঝঞ্ঝা, কত বজ্র, কত বিদ্যুতের পরিণতি এই বৃষ্টিধারা, এই চোখের জল!
তুমি হয়তো মনে করছ, আমি পাগল হয়েছি। তাও যদি হতে পারতাম তাহলে নিজেকে ভোলার একটু অবসর মিলত। অবসরের চেয়েও বড়ো কথা দিদি, এই স্ত্রী জাতির বড়ো কর্তব্যটা থেকে রেহাই মিলত একটু! তুমি হয়তো অসন্তুষ্ট হচ্ছ এইবার, কিন্তু দশ আঙুলের ক্ষুদ্র মুষ্টির চাপে এক মুঠো ফুলের দুর্দশা দেখেছ? শুকিয়ে মরতে আমি রাজি আছি দিদি, কিন্তু এমন করে কর্তব্যের মুঠিতলে পিষ্ট হয়ে মরে নাম কিনবার সাধ আমার নেই। নারীজীবনের ফুলহার নাকি বিধাতা প্রেমের গলায় দিবার জন্যই গেঁথেছিলেন, কবিরা তাই বলেন ; কিন্তু তাকে মুঠি-তলে পিষবার আদেশ যে শাস্ত্রকার দিয়েছিলেন, তাঁকে যদি এই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মরবার সময় শ্রদ্ধা করতে না-ই পারি – সেটা কি এতই দোষের!
বাঁচবার সাধ আমার ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু এমন করে জাঁতা-পেষা হয়ে মরবার প্রবৃত্তিও নেই আমার। মরতেই যদি হয় দিদি, তাহলে সে-সময় কাছে আমার চাওয়ার ধনকে না-ই পাই, অন্তত আমার চারপাশের দুয়ার-জানালাগুলো যেন খোলা থাকে। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেওয়ার মতো বায়ুর যেন সেদিন অভাব না হয়, এই ধরণি-মা-র মুখের পানে চেয়ে প্রাণ ভরে কেঁদে নেওয়ার মতো অবকাশ যেন সেদিন পাই দিদি, এইটুকু প্রার্থনা করো – শুধু আমার জন্যে নয় – আমারই মতো বাংলার সকল কুলবধূর জন্য!
দেখেছ, নিজের দুঃখটাকে ফেনাচ্ছি এতক্ষণ ধরে ; সুখের তলানিটার পরিমাপ করতে যেন ভুলেই গেছি। আমার জীবনের পাত্র উপচে যেটা পড়ছে নিরন্তর – সেইটাই দেখলাম শুধু নীচে জমা হয়ে রইল যা তা দেখবার সৌভাগ্য আমার হল না – এ যে শুধু তুমিই ভাবছ তা নয় – আমিও ভেবেছি বহুদিন, আজও ভাবি। কিন্তু দিদি, তলানিটাকে যখন দেখি একটা চোখে যতটুকু জল ধরে তার চেয়েও কম, তখন সেটার ক্ষতিপূরণ করতে এই পোড়া চোখের জল ছাড়া আর কী থাকতে পারে – বলতে পারো?
আমার স্বামী দেবতা মানুষ। অর্থাৎ দেবতার যেমন ঐশ্বর্যের অভাব নাই আবার লোভেরও ঘাটতি দেখিনে তেমনই। তাঁর সম্বন্ধে অপবাদ আমি দেব না, দিলে তোমরা ক্ষমা করবে না। ঐশ্বর্যে তাঁর আকর্ষণ যত বেশিই থাক, অমৃতে তাঁর অরুচি নেই এবং ওটার জন্য আবদার হয়তো একটু অতিরিক্ত রকমেরই করেন। আহা বেচারা! দেখে দয়া হয়! ছেলেবেলায় পড়েছিলাম, – সমুদ্র মন্থন চলেছে, ভালো ভালো জিনিস সব দেবতারা ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিচ্ছেন, বেচারা দানব-দৈত্যের দল বানরের পিঠে ভাগ করার সময় বেড়ালের মুখ যেমন হয়েছিল তেমনই মুখ করে দাঁড়িয়ে, – ক্রমে উঠলেন লক্ষ্মী, সুধার ভাঁড় হাতে নিয়ে এবং তাঁকে অধিকার করে বসলেন বৈকুণ্ঠের ঠাকুরটি। এতক্ষণ যদিই বা সয়েছিল – এই বার দেবতা দানব কারুরই সইল না! লাগল একটা গণ্ডগোল – এবং এই গন্ডগোলের অবকাশে বৈকুণ্ঠের চতুর ঠাকুরটি লক্ষ্মীঠাকুরণকে নিয়ে একবারে পগার পার! দ্বন্দ্ব যখন মিটল তখন সুধার অংশ হয়তো সব দেবতাই পেলেন, কিন্তু জিতে গেলেন যে ঠাকুরটি তিনি যে সুধাসমেত সুধাময়ীকে পেলেন – এ ব্যথা আমরা ভুললেও দেবতারা ভুললে না। তা আমার স্বামী দেবতাকে দেখেই অনুভব করছি। উনি যা বলেন, তার মানে ওই রকমেরই কতকটা। ওঁর মাঝে আবার একটা দুষ্ট দানবও প্রবেশ করেছে – জানিনে কোন পথ দিয়ে। ওঁর মাঝের দেবতা যখন অমৃতের জন্য অভিযোগ করেন নিরুদ্দেশ ঠাকুরটির উদ্দেশে, তখন দৈত্যটাও মুষ্টি পাকায় ক্রুদ্ধ রোষে, বোধ হয় বলে, পেতাম একবার এই হাতের কাছে! আমার স্বামী রসিক মানুষ, এই কথাটা তিনিও একদিন আমায় বলেছিলেন – আফিমের নেশার ঝোঁকে। অবশ্য, তাঁর বলার ধরনটা ছিল অন্য ধরনের, মোদ্দা মানে তার ওই এক যে, সুধায় তিনি বঞ্চিত হলেন, তাঁর সুধাময়ীকে চোরে নিয়ে গেল!