এই সহজিয়া মাহ্বুাবা হয়তো সহজেই বন্ধনের মাঝে মুক্তি দিতে পারত। কিন্তু কেন যে তা হল না, সে একটা মস্ত প্রহেলিকা। আমি এখনও এর কিছুই বুঝতে পারছিনে। এইখানটাতেই নূরুটাতে আজ মাহ্বুবাটাতে যে একটা কোনো গুপ্ত জটিলতা আছে, যেটার খেই আমি আজও পাচ্ছিনে। আর, আমার মতন ওস্তাদ যেখানে হার মানলে সেখানে তোর মতন চুনো-পুঁটির তো কর্মই নয়! তবে এর নিগূঢ় মর্ম আমি বের করবই করব, এই বলে রখলাম তোকে!
আমার বিশ্বাস, মাহ্বুবাটা এই বাঁধন-হারাকে সইতে পারবে না বলে মিথ্যা ভয়ে তাকে মুক্তির নামে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে। অবশ্য এটা আমার আন্দাজ মাত্র। এটা না হওয়াই সম্ভব, কারণ সে মেয়ে যে সহজিয়া, তার তো এ ভয় হওয়ার কারণ নেই! … দেখি, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়!
একা মাহ্বুবার মা বেচারিই রাক্ষুসি হবে কেন, রেবা? এ-রকম রাক্ষুসি মা – যারা জেনে-শুনে মেয়ের সর্বনাশ করে – তোদের সমাজে, হিন্দুর সমাজে এমনকি, আমাদের স্বাধীন সমাজেও তো কিছু আশ্চর্য নয় আর কমও নয়। এই তো সতীত্বনাশ! অবিশ্যি, সতীত্ব বলতে মনের না দেহের বোঝেন এঁরা, তা জানিনে ; কিন্তু আমার কথায় সতীত্ব তো মনে। মনে মনে যাকে স্বামিত্বে বরণ করলে মেয়ে, তা জেনে শুনেও তার কাছ থেকে ছিনিয়ে দুটো মন্ত্র আউড়িয়ে জোর করে এই বোবা মেয়েদের যে কসাই মা-বাপ হত্যা করে! তাহলে প্রকারান্তরে মা-বাপেই মায়ের সর্বনাশ করলে না কি? উলটো আবার সম্প্রদানের সময় মেয়েকে সীতা সাবিত্রী হতে বলা হয়? কী ভণ্ডামি দেখছিস!
তোর শাশুড়ি সম্বন্ধে অভিমান করে যে অভিযোগ করেছিস, তা নেহাত অন্যায় হয়নি তোর পক্ষে। কেননা, সংসারের গিন্নির এরকম ঝাল ছাড়তে হয় মাঝে মাঝে। তবে যখন ঘরের গিন্নিও হয়েছিস লো, তখন ঘর-গেরস্থালির একটু ঝাঁঝ সইতে হবে বই কি! এখনও তোর ‘যৌবন’ বয়েস কিনা (অর্থাৎ ভোগের সময়!) তাই মাঝে মাঝে বিরক্তি আসে। তবে এও সয়ে যাবে। জানিস তো, কাঁচা লঙ্কা গিন্নিদের বড্ড প্রিয়! এ ঝাল না থাকলে সংসার মিষ্টিও লাগে না আর তাতে রুচিও হয় না।
তোর শাশুড়ি বেচারির একেবারে সাদা সরল মন। সারা-মন-প্রাণ তাঁর মায়ের স্নেহে ভেজা। এসব লোক সংসারে থেকেও চিরদিন একটু উদাসীন গোছের। সংসারের বাজে ঝক্কি এঁরা নিমের রস গেলা করেই গেলেন। যেই দেখেন, আর একজনের হাতে সঁপে দিয়ে নিজে একটু আরামে নিশ্বাস ফেলতে পারবেন অমনি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। তাইতো তোর হাতে সব কিছুর ভার সঁপে দিয়ে তিনি নিরিবিলির অত্যন্ত শান্তিতে ডুবতে চাইছেন। ওঁর খেলার সাথি এখন তোর কচি মেয়ে আনারকলি, কেননা, উনিও যে এখন তোর আর একটি নেহাত ঠাণ্ডা মেজাজের লক্ষ্মী মেয়ে আর সেইজন্যই তো তুই তাঁর লক্ষ্মী-মা। আহা, ওঁর এ-শান্তিতে বাধা দিসনে বোন! এ তপশ্চারিণীর নীরব পূত তপোবনে গিয়ে গোলমাল করে আর তাঁর শান্তি ভাঙিসনে। জানি ওঁর দুঃখ অনেক, আর তাইতেই তো তিনি এখন শান্তির ছায়া খুঁজছেন। বাড়িতে থেকেও এসব লোকের অস্তিত্ব বোঝা যায় না, কিন্তু বাড়ির সমস্ত শান্তিটুকুকে ঘিরে রয়েছেন এঁরাই, বিহগ-মাতার ডানার মতো করে।
এঁরা যখন চলে যান, তখনই বুঝতে পারি যে, কী এক শূন্যতায় সারা সংসার ভরে উঠেছে।
হাঁরে, ভালো কথা! তুই এ চিঠিতে খুকির কথা লিখিসনি যে বড্ড? প্রথমে এটা আমার চোখে পড়েনি, কিন্তু শেষে জানতে পেরে হাজারবার তন্ন-তন্ন করে তোর চিঠি খুঁজেও আমার ‘আনারকলি’ মা-র নাম-গন্ধও পেলাম না, আমার এতে কান্না পেয়ে গেল রাগে! আচ্ছা ভোলা মেয়ে তুই যা হোক লো! বোধ হয় মেয়েটাকে চিরদিন এমনই অনহেলাই করবি, না? জানি, তুই তোর হাজার কাজের ওজর করবি! চুলোয় যাক তোর কাজ, এমন আনারকলির মতোই এতটুকু ফুটফুটে মেয়ে, – হায়, তাকে কখনও তোকে বুক ভরে সোহাগ করতে দেখলাম না। এ আমাদের বুকে বড়ো লাগে বোন! অমন মা হতে গিয়েছিলি কেন লো তবে মুখপুড়ি? ‘মা’ আসবার আগেই হয়তো এই মা-কাঙালি ‘মেয়ে’ এসে পৌঁচেছে। কিন্তু এখনও কি তোর মাঝে ‘মা’ জাগল না? না, হাতের কাছে পেয়েই এত অনহেলা? দেখ, তোর নাড়ির মাঝে যে মা এখনও সুপ্ত। খুকির বাবা রবিয়ল সাহের পুরুষ হলেও তাঁর মাঝে সেই মা কী স্নেহময়ী মূর্তিতে জাগ্রত! কিন্তু এই ছেলের জাত কী নিমকহারাম, সে যা পায় তাকে ছেড়ে দিয়ে যেটা পায় না সেইটাকেই পাবার জন্যে হাঁকুচ-পাঁকুচ করে। বাপের এত স্নেহ পেয়েও তাই সে যে বেশি করেই তোর কোলের – মায়ের কোলের কাঙাল, তা তো আমি নিজেই দেখেচি।
সত্যি ভাই, এ কচি মেয়েটাকে পেলে আমি যেন এখন বেঁচে যাই। আমি ওকে এখনই চাইতাম, কিন্তু দুষ্টু তুই হয়তো একটা বদমায়েশি বিদ্রুপ করে বসবি বলে থেমে গেলাম। খুকি বড়ো হলে কিন্তু আমার কাছে এসে থাকবে আর লেখাপড়া শিখবে বলে কথা দিয়েছিস, মনে থাকে যেন।
সোফিটার অত্যাচারে তুই নাজেহাল হয়ে গিয়েছিস শুনে আমি আর হেসে বাঁচিনে। আচ্ছা, জব্দ, না? ও জন্ম হতেই বড্ড বেশি আদর-সোহাগ পেয়ে মানুষ হয়েছে কিনা, তাই এত দুরন্ত! তা নাহলে তোদের হারেমের আইবুড়ো থুবড়ো মেয়ে কি বলতে পারত ‘আমি বিয়ে করব না, থুবড়ো থাকব’? ও এখনও একেবারে ছেলেমানুষ। তবে বিয়ে হওয়ার পর বরের হাতে পড়ে হয়তো বাগ মানলেও মানতে পারে। ওর আদত ইচ্ছে কী জানিস? ও নূরুটাকে বিয়ে করতে চায়। আমায় একদিন কানে কানে বলে ফেলে আমার হাসি দেখে সে কী ভাই রাগ আর লজ্জা তার! কেঁদে-কেটে তো একাকার – অথচ খামখাই! আমি আর হেসে বাঁচিনে।