হাঁ, ধর্ম সম্বন্ধে আমার আর একটু বলবার আছে। আমি তো পূর্বেই বলেছি যে, সব ধর্মেরই ভিত্তি চিরন্তন সত্যের পর – যে সত্য সৃষ্টির আদিতে ছিল, এখনও রয়েছে এবং অন্ততেও থাকবে। এই সত্যটাকে যখন মানি, তখন আমাকে যে ধর্মে ইচ্ছা ফেলতে পারিস। আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি খ্রিষ্টান, আমি বৌদ্ধ, আমি ব্রাহ্ম। আমি তো কোনো ধর্মের বাইরের (সাময়িক সত্যরূপ) খোলসটাকে ধরে নেই। গোঁড়া ধার্মিকদের ভুল তো ওইখানেই। ধর্মের আদত সত্যটা না ধরে এঁরা ধরে আছেন যত সব নৈমিত্তিক বিধি-বিধান। এঁরা নিজের ধর্মের উপর এমনই অন্ধ অনুরক্ত যে, কেউ এতটুকু নাড়াচাড়া করতে গেলেও ফোঁস করে ছোবল মারতে ছোটেন। কিন্তু এটুকু বোঝেন না তাঁরা যে, তাঁদের ‘ইমান’ বা বিশ্বাস, তাঁদের ধর্ম কত ছোটো কত নীচ কত হীন যে, তা একটা সামান্য লোকের এতটুকু আঁচড়ের ঘা সইতে পারে না। ধর্ম কি কাচের ঠুনকো গ্লাস যে, একটুতেই ভেঙে যাবে? ধর্ম যে বর্মেরই মতন সহ্যশীল, কিন্তু এ-সব বিড়াল তপস্বীদের কাণ্ড দেখে তো তা কিছুতেই মনে করতে পারিনে। তাঁদের বিশ্বাস তো ওই এতটুকু বা সত্যের জোরও অমনই ক্ষুদ্র, যে, তার সত্যাসত্য নিরূপণের জন্যে তোমায় আলাদা পথে যেতে দেওয়া তো দূরের কথা, তা নিয়ে একটা প্রশ্নও করতে দেবেন না। … এই সব কারণেই, ভাই, আমি এই রকম ভণ্ড আস্তিকদের চেয়ে নাস্তিকদের বেশি ভক্ত, বেশি পক্ষপাতী। তারা সত্যকে পায়নি বলে সোজা সেটা স্বীকার করে ফেলে বলে বেচারাদের হয়েচে ঘাট! অথচ তারা এই সত্যের স্বরূপ বুঝতে, এই সত্যকে চিনতে এবং সত্যকে পেতে দিবা-রাত্তির প্রাণপণ চেষ্টা করচে – এই তো সাধনা – এই তো পূজা, এই তো আরতি। এই জ্ঞান-পুষ্পের নৈবেদ্য চন্দন দিয়ে এরা পূজা করবে আর করচে, তবু দেবতাকে অন্তরে পায়নি বলে মুক্তকণ্ঠে আবার স্বীকারও করচে যে, কই দেবতা? কাকে পূজা করচি? আহা! কী সুন্দর সরল সহজ সত্য! এদের ওপর ভক্তিতে আপনিই যে মাথা নুয়ে পড়ে। এরা যাই হোক, এরা তো মিথ্যুক নয়, এরা বিবেকের বিরুদ্ধে কথা বলে না – এরা যে সত্যবাদী। অতএব এরা সত্যকে পাবেই পাবে ; আজ না হয় কাল পাবে! আর এই বেচারারা অন্ধ বিশ্বাসীর দল? বেচারারা কিছু না পেয়েই পাওয়ার ভান করে চোখ বুঁজে বসে আছে। অথচ এদের শুধোও দেখবে দিব্যি নাকি-কান্না কেঁদে লোকে-দেখানো ভক্তি গদগদ কণ্ঠে বলবে, – ‘আঁ হাঁ হাঁ! – মঁরিঁ মঁরিঁ। ওঁই ওঁই ওঁই দেঁখোঁ তিঁনিঁ!’ মিথ্যার কী জঘন্য অভিনয় ধর্মের নামে – সত্যের নামে! ঘৃণায় আপনিই আমার নাক কুঁচকে আসে। তাই তো আমি বলি যে, এই পথ-হারানোটা পথ খুঁজে পাওয়ারই রূপান্তর। তবে যা-কিছু বুঝবার ভুল। গুরুদেব সত্যি-সত্যিই গেয়েচেন, –
‘ভাগ্যে আমি পথ হারালেম পথের মধ্যখানে!’
কোটি কোটি নমস্কার করছি এই মহাঋষির শ্রীচরণারবিন্দে এইখানে! যাক, এসব আলোচনা আপাতত এইখানেই ধামা-চাপা দিলাম। এই কেঁচো উস্কাতে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়ার ভয়েই বোন আমি মনে করি এসব আলোচনা আর করব না ; কিন্তু স্বভাব যায় না মলে! বাপ-মায়ে বুঝেই যে আমার সাহসিকা নাম দিয়েছিলেন, তা আমিও আজ যেন বুঝতে পারচি। তোর চিঠি পেয়ে আমার মনে যে ভাবের উচ্ছ্বাস বা সৃষ্টির বেদনা জেগেছিল, তার দরুণই হয়তো এত কথা লিখে ফেললাম। যতক্ষণ এই ভাবাবেগ আছে ততক্ষণই লিখতে পারব, তারপর আর নয়। তাই ‘এই বেলা নে ঘরে ছেয়ে’ কথাটার উপদেশ স্মরণ করেই যত পারচি লিখে চলেছি।
আমার বাচ্চা-সই মাহ্বুবা সম্বন্ধে যে ভয় করেছিস তুই, তার কোনো কারণ নেই। আমি তাকে খুব ভালো করেই বুঝেছিলাম যে-কয়দিন ছিলাম তার সঙ্গে। সে সহজিয়া। সেহজেই ওই খ্যাপাটাকে ভালোবেসেছিল, আর এমনই সহজ হয়েই সে তাকে চির-জনম ভালোবাসবে। তার বুকে যদি কখনও যৌবনের জল-তরঙ্গ ওঠে, তবে সে খুব ক্ষণস্থায়ী। যে সহজিয়া অতি সহজেই তার প্রিয়তমকে ভালোবাসতে পারে, তার মতো সুখী দুনিয়ায় আর কেউ নেই রে বোন। তার শান্তি তার আনন্দ অনাবিল, পূত, অনবদ্য, – একেবারে শিশির-ধোয়া শিউলির মতো! সে তার সমস্ত কিছু নৈবেদ্যের ডালি সাজিয়ে সেই যে এক মুহূর্তেই তার পীতমের পায়ে শেষ একরেখা দীর্ঘশ্বাস আর আধ-ফোঁটা নয়ন-জলের অঞ্জলি অঞ্জলি করে ঢেলে দিয়েচে তার পরে তার আর কোনো দুঃখই নেই! সে জেনেছে যে, সে সব পেয়েছে। সে জেনেছে যে, সে প্রাণ ভরে দিয়েছে আর সে দান দেবতাও বুক পেতে নিয়েছেন। সে জানে – খুব সহজভাবেই জানে – তার এত বুক-ভরা পবিত্র ফুলের দান, তার এমন সহজ পূজা ব্যর্থ হওয়ার নয়। সহজভাবে দিতে জানলে যে অতি-বড়ো পাষাণ-দেবতাও সেখানে গলে যান, নিজেকে রিক্ত করে সমস্ত কিছু ওই সহজ পূজারিকে দান করে ফেলেন। গুরুদেবের ‘কে নিবি গো কিনে আমায় কে নিবি গো কিনে’ শীর্ষক কবিতাটা পড়েছিস তো? তাতে তিনি দিন-রাত তাঁর পসরা হেঁকে হেঁকে বেড়াচ্চেন, – ওগো আমায় কে কিনে নেবে? কত লোকই এল, – রাজা এল, বীর এল, সুন্দরী এল, কিন্তু হায়, সকলেই ‘ধীরে ধীরে ফিরে গেল বন-ছায়ার দেশে।’ সকলেরই ‘মুখের হাসি ফুরিয়ে গেল নয়ন জলে শেষে!’ কিন্তু ধুলো নিয়ে খেলা-নিরত একটি ছোট্ট ন্যাংটা শিশু যখন তুড়ুং করে লাফিয়ে উঠে তার কচি ছোট্ট দুটি হাত ভরিয়ে ধুলো-বালি নিয়ে বললে – ‘আমি তোমায় অমনি নেব কিনে!’ তখন কবিও তাঁর পসরা ওইখানে ওই সহজিয়ার সহজ চাওয়ার কাছে বিনামূল্যে বিকিয়ে দিয়ে মুক্তি পেলেন। আমাদেরও নয়নপাতা তখন এই সহজের আনন্দে আপনিই ভিজে ওঠে! এমনি সহজ করে চাওয়া চাই, এমনি সহজ হয়ে দেওয়া চাই রে বোন, আর তবেই যে পায় সেও বুক ভরে নেয়, যে দেয় তারও বুক ভরে যায়!… এই সহজ আনন্দে তার সমস্ত কিছু দিতে পেরেছে বলেই তো মাহ্বুবা আজ ছোট্ট মেয়ে হয়েও নিখিল সন্ন্যাসিনীর চেয়েও বড়ো। তাই সে বৈরাগিনীও হল না, সন্ন্যাসিনীও হল না ; ক্রুদ্ধা জননি যখন তাকে এক বুড়ো বরের হাতে সঁপে দিলে, তখনও সে সহজেই তাতে সম্মতি দিল। এই সহজিয়ার কিন্তু এতে কোনো দুঃখই নেই, সে যে জানে যে, তার যা দেওয়ার তা অনেক আগেই যে নিবেদিত হয়ে গিয়েছে । অর্ঘ্য নিবেদিত হয়ে যাওয়ার পর শূন্য সাজি বা থালাটা যে ইচ্ছা নিয়ে যাক, তাতে আর আসে যায় না। … এই সহজিয়া পূজারিনির দল যে আমাদের ঘরে-ঘরে রয়েছে বোন, তবে আমাদের চোখ নেই, – আমরা দেখেও দেখি না এই নীরব পূজারিনিদের। এই সহজিয়া তপস্বিনীদের পায়ে আমি তাই হাজার হাজার সালাম করচি এইখানে! আমাদের বুকে কিন্তু এই মূক মৌন সহজিয়াদের ব্যথাটাই চোখে পড়ে, আর বুকে বেদনার মতোই এসে বাজে। বাস্তবিক বোন, কী করে এই হতভাগিনি (না, ভাগ্যবতী?)-দের বুক এমন সহজ সুখের নেশায় ভরে যায়? এমন সর্বস্বহারা হয়েও কী করে এত জান-ঠান্ডা –করা তৃপ্তির হাসি হাসে? আমরা তা হাজার চেষ্টা করেও বুঝতে পারব না ; কেননা, আগে যে অমনি সহজ হতে হবে ও বুঝতে হবে। … সেই জন্যেই বলেছিলাম যে, মাহ্বুবার জন্যে কোনো চিন্তা করিসনে। সে আনন্দকে পেয়েছে, সে কল্যাণকে পেয়েছে, – সে মুক্তিও পেয়েছে এইখানে। কিন্তু সে এত বড়ো বড়ো কথা হয়তো বুঝবেও না। আমরা যেটা বুঝি চেষ্টা-চরিত্তির করে সে সেটা সহজেই বুঝে নিয়েচে, এইখানেই তো সহজিয়ারা সহজ আনন্দে মুক্ত।