হয়তো আমি কথাগুলো বেশ গুছিয়ে বলতে পারছিনে, আর পারবও না, কেননা, আমার মনের সে-শান্ত স্থৈর্য নেই। মন শুধু বাইরে বাইরে ছুটে বেড়াচ্চে। তবে এরই মধ্যে আমার বলবার আদত সত্যটুকু খুঁজে বের করে নিয়ো।… হাঁ, আদত মানুষটাকে বুঝতে হলে অবিশ্যি তার এই আচার-ব্যবহারগুলোকেই প্রথমে ঘেঁটে দেখতে হবে। কিন্তু এ ঘেঁটে সব সময় মুক্তি পাওয়া যায় না, অনেক সময় কাদা-ঘাঁটাই সার হয়। যাক, তাহলেও মানুষ মাত্রেরই নানান ভুল-ভ্রান্তি আছে দোষ-গুণ নিয়েই মানুষ। যারা এই সব ‘স্রষ্টার বিদ্রোহী’ তরুণদের গালি দেয়, তারাই বা ‘স্রষ্টার রাজভক্ত’ প্রজা হয়ে সে স্রষ্টা-রাজা সম্বন্ধে কোনো খবরাখবর রাখে কি? আর পাঁচ জনের মতন শুধু চোখ বুঁজে অন্ধবিশ্বাসে অন্ধের মতন হাতড়িয়ে বেড়ানোতেই কি সে অনাদি অনন্ত সত্যকে তারা পাবে? যারা এইরকম বিদ্রোহীদের নাস্তিক ইত্যাদি বলে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তাড়া করে, তারা আস্তিক হয়েই সে পরম পুরুষের কতটুকু খবর রাখে? তাঁর খবর রাখা, তাঁকে ভাবা তো অন্য কথা, তাঁকে – সত্যকে যে অহরহ এই আস্তিকের দল প্রতারণা করচে, এ ভণ্ডামি কি তারা নিজেও বোঝে না? মন্দিরে গিয়ে পূজা করা আর মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়াটাই কি ধর্মের সার সত্য? এগুলো তো বাইরের বিধি। কিন্তু এগুলোকেই কি তারা ভালো করে মেনে চলতে পারে? মন্দিরে গিয়ে দেবতার মুখস্ত মন্ত্র আওড়ায়, কিন্তু মন থাকে তার লোকের সর্বনাশের দিকে! মসজিদে গিয়ে নামাজের ‘নিয়ত’ করেই ভাবে যত সব সংসারের পাপ দুশ্চিন্তা! এই ভণ্ডামি এই প্রতারণাই তো এদের সত্য! অতএব এদের মতো এমনই করে আত্মাকে বিনাশ না করে তাদেরই একজন যদি সত্যকে পাওয়ার জন্যে নিজের নতুন পথ কেটে নেয়, তবে এরা লাটি-সোঁটা নিয়ে যে তাকে তাড়া করবেই – কিন্তু নিবীর্যের মতো! একজন সত্যান্বেষী বিদ্রোহীকে তাড়া করবার মতো শক্তি এ-মিথ্যুক ভণ্ডদের যে বিলকুল নাস্তি! ও কেবল ভীত সারমেয়ের দাঁত-খিঁচুনি মাত্র। এরা যে মিথ্যাকে, প্রতারণাকে কেন্দ্র করেই আত্মাকে ক্রমেই নীচের দিকে ঠেলচে, তা এটা বুঝলেও কিছুতেই স্বীকার করবে না। সত্যকে স্বীকার করবার মতো সাহসই যদি থাকবে, তবে এদের এমন দুর্দশাই বা হবে কেন? মনসুর যখন বিশ্বের ভণ্ড-মিথ্যুকদের মাথায় পা রেখে বলেছিল, – ‘আনাল হক’ – আমিই সত্য – সোহহম, তখন যেসব বক-ধার্মিক তাঁকে মারবার জন্যে হই-হই রই-রই করে ছুটেছিল, এ লোকগুলো যে তাদেরই বংশধর! এ মিথ্যা ধার্মিকের দলই তো সে দিনে ওই মহর্ষি মনসুরের কথা, তাঁর সত্য বুঝতে পারেনি, আজও পারচে না, আর পরেও পারবে না ; এদের এই রকম একটা দল থাকবেই! কিন্তু যারা সত্যকে পেতে চলেছে, যাদের লক্ষ্য সত্য, যারা সত্যের হাতছানি দেখচে তাদের এই সব শক্তিহীন হীনবীর্য লোক কি থামাতে পারে? সত্য যে চির-বিজয়ের মন্দারমালা গলায় পরে শান্ত-সুন্দর হাসি হাসবে।… তাছাড়া, বিদ্রোহী হওয়াও তো একটা মস্ত শক্তির কথা। লক্ষ লক্ষ লোক যে জিনিসটাকে সত্য বলে ধরে রেখে দিয়েচে, চিরদিন তারা যেপথ ধরে চলেছে তাকে মিথ্যা বলে ভুল বলে তাদের মুখের সামনে বুক ফুলিয়ে যে দাঁড়াতে পারে, তার সত্য নিশ্চয়ই এই গতানুগতিক পথের পথিকদের চেয়ে বড়ো। এই বিদ্রোহীর মনে এমন কোনো শক্তি মাথা তুলে প্রদীপ্ত চাওয়া চাইছে যার সংকেতে সে যুগ-যুগান্তরের সমাজ, ধর্ম, শৃঙ্খলা, সব-কিছুকে গা-ধাক্কা দিয়ে নিজের জন্যে আলাদা পথ তৈরি করে নিচ্ছে! কই, হাজারের মধ্যে আর নয়শো নিরানব্বই জন তো এমন করে দাঁড়াতে পারে না? তুমি কী বল, এই নয়শো’ নিরানব্বই জনই তা হলে সত্যকে পেয়ে বসে আছে? যে মরণকে ধ্বংসকে পরোয়া না করে না-চলার পথ দিয়ে চলে, কত বড়ো দুর্জয় সাহস তার? আর সত্যের শক্তি অন্তরে না থাকলে তো সাহস আসে না। … তাছাড়া, প্রত্যেকের আত্মারও তো এক-একটা স্বতন্ত্র গতি আছে। আর সকলের মতো একজন গড্ডলিকা-প্রবাহে যদি না চলে, তা বলে কি তার পথ ভুল? বিশেষ করে বিদ্রোহী হওয়ার যেমন শক্তি থাকা চাই, তেমনই অধিকারও থাকা চাই। কই, আমি তো বিদ্রোহী হতে পারিনে, তুমি তো হতে পার না ; আমাদের মাঝে যে সে বিপুল সহ্য-শক্তি নেই। … বিদ্রোহটা তো অভিমান আর ক্রোধেরই রূপান্তর। ছেলে যদি রেগে বাপকে বাপ না বলে, বা মা-কে মা না বলে, কিংবা বলে যে এরা তার বাপ-মা নয়, তাহলে কি সত্যি-সত্যিই তার পিতার পিতৃত্ব, মাতার মাতৃত্ব মিথ্যা হয়ে যায়? যে ক্ষুব্ধ অভিমান তার বুকে জাগে, তার শেষ হলেই মায়ের খ্যাপা ছেলে ফের মায়ের কোলেই কেঁদে লুটিয়ে পড়ে! কিন্তু এই যে অভিমান, এই যে আক্রোশের অস্বীকার, তা দিয়ে হয় কী? – না, সে তার বাপ-মাকে আরও বড়ো করে চেনে, বড়ো করে পায়। এই রকম করে হঠাৎ একদিন চিরন্তনী মাকেও হয়তো তার পক্ষে পাওয়া বিচিত্র নয়। তাছাড়া তার যে অধিকার আছে এই অভিমান করবার, এই বিদ্রোহী হওয়ার, কেননা, সে তার মায়ের স্নেহটাকে এত নিবিড় করে পেয়েছে যা দিয়ে সে জানে যে, তার সমস্ত বিদ্রোহ সমস্ত অপরাধ মা ক্ষমা করবেনই। যে স্নেহে যে ভালোবাসায় অভিমান জাগতে পারে, রাগ জন্মাতে পারে, সে স্নেহ-ভালোবাসা কত বড়ো কত উচ্চ একবার ভাব দেখি ! এতে মা-র অপমান না হয়ে তাঁকে যে আরও বড়ো করে দেওয়া হয় রে! তাই মা ঝোঁক-নেওয়া খ্যাপা ছেলের ঝোঁক নেওয়া দেখে ছেলের হাতের মার খেয়েও গভীর স্নেহে চেয়ে চেয়ে হাসেন! এ-দৃশ্য বলে বোঝাবার নয়! ছেলের হাতের এ-মার খাওয়াতে যে মায়ের কত আনন্দ কত মাধুরী তা তো বাইরের লোকে বুঝতে পারে না। তারা মনে করে, কী বদমায়েশ দুরন্ত ছেলে বাবা! কিন্তু যে ছেলে মায়ের এত স্নেহ পায়নি, এমন অধিকার পায়নি, সে মাকে মারা তো দূরের কথা, তাঁর কাছে ভালো করে কাছ ঘেঁসে একটা আবদারও করতে পারে না! … তাই প্রথমেই বলেছিলাম যে, এই বাঁধন-হারা নূরু যেন বিশ্ব-মাতার বড়ো স্নেহের দুলাল – ঠিক ‘কোল-পোঁছা’ ছেলের মতন আবদেরে একজিদ্দে একরোখা – আর তোদের কথায় বিদ্রোহী! অনেক ছেলে মরে মরে যাওয়ার পর যে এই খ্যাপাই মায়ের মড়াচে ঝোঁকদার ছেলে! দেখবি, এ-শিশু আবার হাসতে-হাসতে মায়ের স্তন্য-ক্ষীর পান করচে আর আপন মনেই খেলচে!… মা যখন তাঁর দুষ্টু ছেলেকে স্নান করবার সময় সাবান দিয়ে তোয়ালে দিয়ে ঘসে ঘসে পরিষ্কার করেন, তখন তার কান্না আর রাগ দেখেছিস তো? সে তখন হাতে-দাঁতে মায়ের চুল ছিঁড়তে থাকে, কিল-চাপড় বর্ষণ করতে থাকে আর চেঁচিয়া আকাশ ফাটিয়ে ফেলে। মা কিন্তু হাসতে হাসতে তাঁর কাজ করে যান। তাকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে নীলাম্বরী ধুতিটি পরিয়ে দিয়ে চোখে কাজল টিপটি দিয়ে যখন মুখে ঘন ঘন চুমো খান তখন আবার সেই দুরন্ত ছেলের প্রাণ-ভরা হাসি দেখেছিস? – নূরুটারও এখন হয়েছে তাই। বিশ্ব-মাতা এখন তাকে ধুয়ে-মুছে রগড়ে সাফ করে নিচ্ছেন, আর সেও তাই এই হাত-পা ছুঁড়ে কান্না জুড়ে দিয়েচে। মা যেদিন কোলে নিয়ে চুমো খাবেন, সেদিন কোথায় থাকবে এর এই ভূতোমি আর কোথায় থাকবে এই কান্না আর লাফালাফি। তখন সব সুন্দর – সুন্দর! সুন্দর! এ শুভ দিন তার জীবনে জাগবেই ভাই, দেখে নিস তুই। তবে তার হয়তো এখন অনেক দেরি। তার জীবনে হৃত্য রয়েচে, তবে রুদ্র মূর্তিতে! এর পরেই যখন কল্যাণ জাগবে জীবনে, তখন দেখবি সব সুন্দর হয়ে গিয়েছে। ছেড়ে দে বোন, ওকে ছেড়ে দে! চলুক ও নিজের একরোখা পথ দিয়ে – কল্যাণকে আপনিই ও খুঁজে নিবে। কল্যাণ নিজেই ওর পিছু পিছু মালা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্চে, সময় বুঝলেই সে এই পাগলার গলায় মালা দিয়ে ওকে ভুজ-বন্ধনে বেঁধে ফেলবে। তুই লাল কালিতে ডগডগে করে লিখে রেখে দে এই কথা। আমি জানি, আমার এ ভবিষ্যদ্বাণী ফলবেই ফলবে, যদিও আমি পয়গম্বর নই।