সর্বপ্রথম পাগল নূরুর-কাণ্ড-কারখানা নিয়ে তোর এত রাগ হওয়া ভয়ানক অন্যায়। যে বাঁধন নেবে না, তাকে জোর করে বাঁধতে গিয়েছিলি, সে কখনও সম্ভব হয় রে বোন? পাগলা হাতি আর উদমো ষাঁড়কে জিঞ্জির বা দড়াদড়ি দিয়ে বাঁধলে হয় তারা বাঁধন ছিঁড়বে, নয় আছাড় খেয়ে খেয়ে মরে বন্ধনমুক্ত হবেই হবে। আর যদিই ব্যতিক্রম স্বরূপ বেঁচে যায়, তবে সে বাঁচা নয়, সে হচ্ছে জীয়ন্তে-মরা! মুক্ত আকাশের পাখিকে সোনার শিকল, মণি-মাণিক্যের দাঁড়, দুধ-ছোলা দেখিয়ে হয়তো প্রলুব্ধ করা গেলেও যেতে পারে, কিন্তু তাকে কেউ বেঁধে রাখতে তো পারবে না। সেও অমনি করে বন্ধনমুক্ত হবেই! যার রক্তে-রক্তে বাঁধন-হারার ব্যাকুল ছায়ানটের নৃত্য-চপলতা নাচচে, শিরায়-শিরায় পূর্ণ তেজে নট-নারায়ণ রাগের ছন্দ-মাতন হিন্দোল-দোল দিচ্ছে, তাকে থামাতে যাওয়া মানেই হচ্চে, তার ওই নৃত্য-চপলতা আর হিন্দোল দোলে আরও আকুল চঞ্চলতা জাগিয়ে দেওয়া, আরও বিপুল দোল-উন্মাদনা দুলিয়ে দেওয়া! তুই ওকে ঘুম পাড়িয়ে শান্ত করতিস? হাসি পায় তোর ছেলে-মানুষি কথা শুনে! আগ্নেয় পর্বত দু-চার দিন শান্ত থাকলেও তার বুকের আগুন-দরিয়া যাবে কোথায়? আমরা বাইরে থেকে তাকে শান্ত ভেবে খুব চাল চালতে পারি তার ওপরে,কিন্তু এটা যে আমরা ভুলে যাই যে, তার বুকের অগ্নি-সিন্ধুতে অনবরত ঊর্মি-লীলার তাণ্ডব-নাচ চলেছে ; ওই তুঙ্গ তরঙ্গ-গতির সমস্ত শক্তি জমে জমে এক এক বার যখন হু-হু করে আগুনের প্রতাপ-ফোয়ারা ছোটে, তখন আমরা গালে হাত দিয়ে ভাবি, – ইস্ হল কী!… নয়? আমি তো তোকে হাজার বার মানা করেছিলাম যে, মিছে বোন এ খ্যাপাকে গারদে পুরবার চেষ্টা, এ হচ্ছে বিশ্ব-মাঠে ছেড়ে-দেওয়া চিরমুক্তের দাগ। উদ্মো ষাঁড়! গরিবের কথা বাসি হলে ফলে!… আমার বুক-ভরা বেদনা-ঝঞ্ঝা এনে এই বাঁধন-হারার ব্যথার প্রশান্ত মহাসাগরে দুরন্ত তরঙ্গ-সংঘাত আর কল-কল্লোল জাগিয়ে দেওয়ার যে বদনাম তুই আমার ওপর দিয়েছিস, তাতে সত্য হলে আমি সগৌরবেই সায় দিতাম। কিন্তু আদতে যে সেটা ভুল বোন। এ ঘর-ছাড়া পাগলের দলকে কে যে কোন্ চিরব্যথার বন থেকে ঘর-ছাড়া ডাক ডাকছে, তা আমিও বলতে পারব না, তুইও পারবিনে, এমনকি ওই ঘর-ছাড়া পাগল নিজেই বলতে পারবে না!সে তো আজকের গৃহ-হারা নয় রে রেবা, সে যে চির উদাসী, চিরবৈরাগী! সৃষ্টির আদিম দিনে এরা সেই যে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে, আর তারা ঘর বাঁধল না। ঘর দেখলেই এরা বন্ধন-ভীতু চখা হরিণের মতন চমকে ওঠে। এদের চপল চাওয়ায় সদাই তাই ধরা পড়বার বিজুলি-গতিতে ভীতি নেচে বেড়াচ্ছে! এরা সবাই কান খাড়া করে আছে, কোথায় কোন্ গহন-পারের বাঁশি যেন এরা শুনছে আর শুনছে! যখন সবাই শোনে মিলনের আনন্দ-রাগ, এরা তখন শোনে বিদায়ী-বাঁশির করুণ গুঞ্জরন! এরা ঘরে বারেবারে কাঁদন নিয়ে আসছে, আবার বারেবারে বাঁধন কেটে বেরিয়ে যাচ্চে! ঘরের ব্যাকুল বাহু এদের বুকে ধরেও রাখতে পারে না। এরা এমনি করে চিরদিনই ঘর পেয়ে ঘরকে হারাবে আর যত পরকে ঘর করে নেবে! এরা বিশ্ব-মাতার বড়ো স্নেহের দুলাল, তাঁর বিকালের মাঠের বাউল-গায়ক চারণ-কবি যে এরা! এদের যাকে আমরা ব্যথা বলে ভাবি, হয়তো তা ভুল! এ খ্যাপার কোনটা্ যে আনন্দ, কোনটান যে ব্যথা তাই যে চেনা দায়! এরা সারা বিশ্বকে ভালোবাসছে, কিন্তু হায়, তবু ভালোবেসে আর তৃপ্ত হচ্ছে না! এদের ভালোবাসার ক্ষুধা বেড়েই চলেছে, তাই এরা অতি সহজেই স্নেহের ডাকে গা ঘেঁষে এসে দাঁড়ায়, কিন্তু স্নেহকে আজও বিশ্বাস করতে পারল না এরা। তার কারণ ওই বন্ধন-ভয়। এদের ভালোবাসা এত বিপুল আর এত বিরাট যে, হয়তো তোমরা তাকে উন্মাদের লক্ষণ বলেই ভাব।… আর অগ্নির কথা? আগুন যদি না থাকবে, তবে এদের চলায় এমন দুর্বার গতি এল কী করে? এরাই পতঙ্গ, এরাই আগুন। এরাই আগুন জ্বালে, এরাই পুড়ে মরে। আগুন তো এদের খেলার জিনিস।
আগুনে এ যে কত বার ঝাঁপ দেবে, কত বার পুড়বে, কত বার বেরিয়ে আসবে, তা তুই তো জানিসনে, আমিও জানিনে!
তোর সহজ বুদ্ধি দিয়ে তুই সহজভাবে নূরুকে যেরকমভাবে বুঝে আমায় চিঠিতে লিখেচিস, তা দু-এক জায়গা ছাড়া সবই সত্যি। হয়তো আমার ভুল হতে পারে বুঝবার, তবে কিনা, তোদের সংসারী লোকের চেয়ে সংসারের বাইরে থেকে নানান ব্যথা-বেদনার মধ্যে দিয়ে আমরা মানব-চরিত্র বা মানুষের মন বেশি করে বুঝি আর সেই হিসাবেই আমি এই বাঁধন-হারাদের সম্বন্ধে এত কিছু মনস্তত্ত্ব বা দর্শন লিখে জানালেম তোকে।
নূরুকে স্রষ্টার বিদ্রোহী বলে তোর ভয় হয়েছে বা দুঃখ হয়েছে দেখে আমি তো আর হেসে বাঁচিনে লো! নূরুটাও স্রষ্টার বিদ্রোহী হল, আর অমনি স্রষ্টার সৃষ্টিটাও তার হাতে এসে পড়ল আর কী!… এখন ওর কাঁচা বয়েসে, গায়ের আর মনের দুই-এরই শক্তিও যথেষ্ট, তার শরীরে উদ্দাম উন্মাদ যৌবনের রক্ত হিল্লোল বা খুন-জোশি তীব্র উষ্ণ গতিতে ছোটাছুটি করচে, তার ওপর আবার এই স্বেচ্ছাচারী উচ্ছৃঙ্খল বাঁধন-হারা সে, – অতএব এখন রক্তের তেজে আর গরমে সে কত আরও অসম্ভব সৃষ্টি-ছাড়া কথাই বলবে! এখন সে হয়তো অনেক কথা বুঝেই বলে, আবার অনেক কথা না বুঝেই শুধু ভাবের উচ্ছ্বাসেই বলে ফেলে! একটা বলবান জোয়ান ষাঁড় যখন রাস্তা দিয়ে চলে, তখন খামখাই সে কত দেওয়ালকে কত গাছকে ঢুঁস দিয়ে বেড়ায় দেখেছিস তো? এটা ভুলিসনে যেন রেবা যে, এ-ছেলে বাংলাতে জন্ম নিলেও বেদুইনদের দুরন্ত মুক্ত-পাগলামি, আরবিদের মস্ত গোর্দা, আর তুর্কিদের রক্ত-তৃষ্ণা ভীম শ্রোতাবেগের মতো ছুটছে এর ধমনিতে-ধমনিতে। অতএব এসব ছেলেকে বুঝতে হলে এদের আদত সত্য কোন্খানে, সেইটেই সকলের আগে খুঁজে বের করতে হবে। এত বড়ো যে ধর্ম, তারও তো সামাজিক সত্য, লৌকিক সত্য, সাময়িক সত্য ইত্যাদি-ইত্যাদি কত রকমের না বাইরের খোলস-মুখোশ রয়েছে, তাই বলে কি এই সব অনিত্য সত্যকে ধর্মের চিরন্তন সত্য বলে ধরতে হবে? অবিশ্যি সত্য কখনও অনিত্য বা নৈমিত্তিক হতে পারে না, শুধু কথাটা বোঝাবার জন্যে আমাকে ওরকম করে বলতে হল। প্রত্যেক ধর্মই সত্য – শাশ্বত সত্যের ওপরই প্রতিষ্ঠিত এবং কোনো ধর্মকে বিচার করতে গেলে তার এই মানুষের গড়া বাইরের বিধান শৃঙ্খলা দিয়ে কখনও বিচার করব না ; আর তা করতে গেলে কানার হাতি দেখার মতোই ঠকতে হবে ; তেমনি মানুষকে – তার চির-অমর আত্মাকে – তার সত্যকে বুঝতে হলে তার অন্তর-দেউলে প্রবেশ করতে হবে ভাই! তার বাইরের মিথ্যা আচার-ব্যবহারকে সত্য বলে ধরব কেন?