হাঁ, কীজন্য তোকে এত কথা জানিয়ে বা বাজে বকে বিরক্ত করলাম তা পরে জানাচ্ছি। এখন, কী কথা থেকে এতসব প্রাণের কথা এসে পড়ল? … আমি বলছিলাম যে, নারীর নারীত্ব কিছুতেই মরবার নয়। সত্যি-সত্যিই বোধ হয় অহল্যা নারী চিরকাল পাষাণী থাকতে পারে না! নারীই যদি পাষাণী হয়ে যায়, তবে যে বিশ্ব-সংসার থেকে লক্ষ্মীর কল্যাণী মূর্তিই উবে যায়, আর বিশ্বও তখন কল্যাণ-হারা হয়ে তৈলহীন প্রদীপের মতোই এক নিমিষে নিভে গিয়ে অন্ধকার হয়ে যায়! এই কল্যাণী নারীই বিশ্বের প্রাণ! এ-‘নারী’ হিম হয়ে গেলে বিশ্ব-প্রাণের স্পন্দনও এক মুহূর্তে থেমে যাবে!… আমি যখন নিজেকে নারীত্ব-বিবর্জিতা এক পাষাণী প্রতিমা মনে করে অমনি অশ্রুবিহীন মৌন ক্রন্দনে আমার মর্মর পাষাণ মর্ম-কন্দরের আকাশ-বাতাস নিয়ত বিষাক্ত তিক্ত আর অতিষ্ঠ ভারি করে তুলেছিলাম, তখন তোর ওই চিঠির লেখার গোটা কয়েক মাত্র আঁচড় কী করে বুকের এক দিককার এত ভারি পাষাণ তুলে ফেলে অশ্রুর একটি ক্ষীণ ঝরনাধারা বইয়ে দিলে? কী করে আজ আমার অনেক দিনের বাঞ্ছিত কান্না তার মধুর গুঞ্জনে আমার মূক মন-সারীর মুখে বাক ফুটালে? তাই ভাবচি আর বড়ো প্রাণ ভরেই এই কান্নার মৃদুল মধুর বুদ্বুদ্-ভাষা প্রিয়তমের বাঁশির পাতলা গিটকিরির মতোই আবেশ-বিহ্বল প্রাণে শুনচি! তোর চিঠিটা এতদিন পরে এমনি না-চাওয়ার পথ দিয়ে হঠাৎ আমার পাষাণ-দেউলের খিড়কিতে এসে আচমকা ঘা না দিলে তা এত সহজে খুলত না, তা আমি এখন বেশ বুঝতে পারছি। এ যেন দোর-বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে একেবারে অপ্রত্যাশিত প্রিয়জনের মুখে ডাকনাম ধরে আহ্বান শুনে চমকে দোর খুলে দিয়ে পুলক-লাজে অপ্রতিভ হওয়া! কিন্তু এখন আবার ভয় হচ্চে বোন যে, এ-দোর অভিমানে আবার বন্ধ হতেও তো দেরি না হতে পারে। অনেক কালের পরে ফিরিয়ে-পাওয়া প্রিয়জনকে দেখে বুকে হরষণ যেমনই জাগে, তার পিছু পিছু অভিমান-ক্রন্দনও তেমনই জলভরা চোখ নিয়ে এসে সে দাঁড়ায়! তাই বলি কী, তুই এমনি অপ্রত্যাশিত পথ দিয়ে এমনি করে আচমকা কুক দিয়ে দিয়ে আমার মর্মর-মন্দিরের পাষাণ অর্গল খুলে ফেলিস! এখন আমার যা মনের অবস্থা, তাতে যদি তুই রোজ এসে এমনি করে দেখা দিস তাহলে হয়তো আবার আমার মনের খিড়কি বন্ধ হয়ে যাবে। কী বলিস ভাই? লক্ষ্মীটি, এতে যেন অভিমানে তোর পাতলা অধর ফুলে না ওঠে! তোর সেই হারিয়ে-যাওয়া ‘সাহসি’ সইটিকে আগে এই গম্ভীরা শিক্ষয়িত্রী মহাশয়ার মাঝে জাগিয়ে তোল, তাহলে আবার নয়তো শিং ভেঙে বকনা হওয়া যাবে!উপমাটা নেহাত ওঁচা হয়ে পড়ল, না লো? সে যেই হোক, তোমার সেই চির-কিশোরী সাহসিটা যে মরেছে, একদম মরেছে লো! তাকে বাঁচতে হলে কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় রস আনতে হবে! বুঝলি? পারবি তো? দেখিস বেহায়া ছুঁড়ি, তুই যেন এই অবসরে আমার জন্যে বরাদ্দ করা চোখে চালসে-লাগা বুড়ো-হাবড়া বলদ বরের দোহাই পাড়িস নে! হাঁ, লো! আমার এখনও বিয়েই হল না, আর এরই মধ্যে নিকের জন্যে কোনো হাবড়া-বুড়োকে মোতায়েন করলি? তা ভাই, তোর যদি কোনো নানাজি বা দাদাজি থাকেন তা হলে খবর দিস, এক দিন বর পসন্দ করতে নাহয় যাওয়া যাবে। তাঁকে এখন থেকে চুলে কলপ দাড়িতে খেজাব আর চোখে সুরমা লাগানো অভ্যেস করতে বলবি কিন্তু! কন্যা-পক্ষের কিন্তু একটা কথা ভাই, দেখিস, সে নানা-বরের যেন ওই সেই বাঁকুড়ার শুকলাল বুড়োর মতো (মনে আছে তাকে?) য়্যা এক-কুলো দাড়ি না থাকে! মা গো মা! সে যে আমার মাথার চুলের চেয়েও বড়ো রে! বুড়ো চলেছে তো চলেছে, যেন রাজসভার বন্দিনী চামর ঢুলোতে ঢুলোতে চলেছে! এত যে বলছি তার কারণ দাড়ির ওই জটিল জটিলতার মধ্যে হাত-মুখ জড়িয়ে গেলে একেবারে জবর-জং আর কী, নড়ন-চড়ন নাস্তি।
দাঁড়া, আগে আমার নিজের রামপটের আরও একটু না বললে আর মনের উতপুতোনি মিটচে না। এইটে বলে বাকি দরকারি কথা কটা সেরে ফেলতে হবে। কেননা, এরই মধ্যে প্রায় নটা বেজে গেল। যদিও আমি গল্প-উপন্যাস লিখে থাকি, কিন্তু আমার এই প্রিয়জনদের চিঠি লেখবার সময় আর কিছুতেই সব কথা বেশ গোছালো করে লিখতে পারিনে। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। কিন্তু তা যেন অন্তত আমার কাছে ভাই বেশ মিষ্টি লাগে। এতে কেরদানি করে লেখবার চেয়ে যে আসল প্রাণটুকুর – সত্যের সত্য-মিথ্যা ধরা পড়ে যায়! এই জন্যে খুব বেশি ভাবাবেগ থাকা আমার বিবেচনায় খারাপের চেয়ে ভালোই বেশি। তাছাড়া, এতে লাগাম-ছাড়া ঘোড়ার (যেমন তোদের নূরুল হুদা বাঁধন-হারা) মতন একটা বন্ধনহীন উচ্ছৃঙ্খল আনন্দ বেশ গাঢ় করে উপভোগ করা যায়। এ আনন্দ কিন্তু বন্ধন-দশাপ্রাপ্ত বেচারিদের কাছে একটা অনাসৃষ্টি চক্ষুশূলের মতোই বাজবে। আহা, এ-বেচারাদের প্রাণে যে আনন্দই নেই, তা তারা আনন্দের মুক্তির মাধুর্য বুঝবে কী করে? একটু সাংসারিক সামান্য মামুলি সুখের মায়াতেই এরা মনে ভাবে, কেন এই তো আনন্দ! সেই দাড়িওয়ালা রাজার দাড়িতে তেঁতুল-গুড় লাগিয়ে সেই দাড়ি চুষে আম খাওয়ার স্বাদ বোঝা আর কী!… যাক সে সব কথা, আমরা তো আর জোর করে মরা লোককে বাঁচাতে পারব না! যার প্রাণে আনন্দই নেই তাকে বুঝাব কী – দু চুলোর ছাই আর পাঁশ?
দেখলি? কী বলতে গিয়ে ছাই ভুলেই গেলাম! যাক গে!…
আমার পরম স্নেহের পাগল পথিক-ভাই নূরুকে নিয়ে যখন আমায় খোঁচাই দিয়েছিস রেবা, তখন তার দিক হয়ে আমায় রীতিমতো ওকালতি বাক্যুদ্ধ (দরকার হলে মল্লযুদ্ধও অসম্ভব নয়!) করতে হবে দেখচি তোর সাথে। কেননা, আমিই এখন এ স্নেহ-হারার বড়ো বোন, আর সে হিসাবে তুই আমার ভাই-এর ভাবি অর্থাৎ কি-না আমার ভাজ! অতএব আমি তোর ননদিনি! তবে আয় একবার ননদ-ভাজে বেশ করে একটা কাজিয়া-কোঁদল পাকানো যাক, একেবারে কাহারবা বাজার মতো জোর! আমি এই আমার আঁচলপ্রান্ত কোমরে জড়ালাম! তুইও তবে তোর মালসা-খ্যাংরা নিয়ে বস।