আজ যে আমি তবে হালকা বা খেলো হয়ে পড়েছি তোর কাছে, তার কারণ, আমি দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে যে দিকে যতই বাড়ি, তোর কাছে ওই বাঁদরি ছুড়ি, লো, টে, খুব জোর ‘সাহসি’র বেশি বিশেষণে তো আর জীবনে কখনও বিশেষিত হলামও না, আর ভবিষ্যতে যে হবও না তার প্রমাণ তোর এই এতদিন পরের চিঠিটা! তাই আমার অতগুলো মর্দানি লেবাস সত্ত্বেও এবং এক মস্ত ধিঙ্গি আইবুড়ো মাগি হয়েও আজ শুধু মনে হচ্চে আমাদের সেই বাঁকুড়ার ছেলেবেলাকার কথাটা! এখন আর আমাতে আমি নেই, এখন বাঁকুড়ার চুলবুলে সাহসী ছুঁড়ি এসে আমার মনের আসনে জোর জড় গেড়ে বসেচে! এখন আমার কী মনে হচ্চে বুঝলি লো ‘খুকির-মা’? এখন বড্ড সাধ যাচ্ছে যে, সেই আমাদের কিশোরী জীবনের মতন দুই সই-এ পা ছড়িয়ে চুল এলিয়ে পাশাপাশি বসি আর খামচা-খামচি নুচোনুচি খুনসুড়ি মস্তানি করি এবং সঙ্গে সঙ্গে খুব পেট ভরে মা-দের গাল খাই! নয়তো তোর ওই এক বোঝা চুল নিয়ে বেণি গাঁথতে তেমনি মশগুল হয়ে যত সব রাজ্যের ছিষ্টি-ছাড়া গপপো করি। এখন আমি এই চিঠি লিখচি তোকে আর আপনাতে আপনিই বিভোর হয়ে গিয়েছি! আঃ, কেমন করে মানুষের কত পরিবর্তন হয় বোন। আমার এত আনন্দের বাজার কে ভাঙলে, আর কেমন করেই বা ভাঙল তাই ভাবতে গিয়ে অনেক দিন পরে আমার চোখের পাতা ভিজে এল!
দ্যাখ, ভাই রেবা, নারীর নারীত্ব কিছুতেই মরবার নয়, এ কথাটা আজ আমি খুবই বুঝতে পাচ্চি। তার কারণ বলচি তোকে, শোন।… নানান দিক থেকে নানা রকমের ঘা আর আঘাত খেয়ে খেয়ে যখন আমার ভিতরে নারীর মাধুরী, সমস্ত পেলবতা – নমনীয়তা ক্রমেই হিম জমাট হয়ে আসতে লাগল, তার রাত-দিন মর্দানি কায়দা-কানুনের চাপে চাপে অন্তরের নারী আমার অহল্যার মতোই পাষাণ হয়ে গেল, তখন আমি সব বুঝতে পারলাম মাত্র, কিন্তু না পারলাম কাঁদতে, না পারলাম তেমন কিছু বেদনা অনুভব করতে! হায় রে বোন, তখন যে আমি পাষাণী! আমার কি আর তখন কোনো কোমল অনুভূতি জমে পাথর হতে বাকি আছে, যে তার সাড়া পেয়ে বাকি অনুভূতিগুলো একটু নড়া-চড়া করেও উঠবে! ওই পাষাণ-বুক নিয়ে শুধু শুকনো অশ্রুহীন কাঁদন কেঁদেচি যে, হায়, আমার আর মুক্তি নেই – মুক্তি নেই! অহল্যারও মুক্তি হয়েছিল, আমার মুক্তি নেই – নেই। আমার মনে হল, ওই অহল্যা নারী যখন পাষাণ হয়েছিল, তখন তার মাঝে যে আমিও ছিলাম! আজ আবার এই আমার মাঝে সেই অহল্যা তার পাষাণী মূর্তি নিয়ে এসেচে, কিন্তু এবার যেন মুক্তিটাকে বাদ দিয়ে। এই আমির মাঝে আমার সেই বহুযুগ আগের আমি তো নেই, তার যে মৃত্যু হয়েচে!… এত দুঃখ আমার বোন, কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও কাঁদতে পারিনি! জীবনের যত দুর্ঘটনা যত রকম সম্ভব করুণ করে মনে করে কাঁদতে চেষ্টা করেচি ; মার, বাবার ফটোগুলি, তাঁদের হাতের লেখা ইত্যাদি সামনে ধরে, আমার জীবন-ভরা হারানো প্রিয় মুখগুলি মনে করে করে যতই কাঁদতে গিয়েছি, ততই খালি কাপাস-হিম-হাসি ঠোঁটের কোণে এক রেখা ম্লানিমার মতো মাত্র ফুটে উঠেচে! ভাব দেখি একবার এই দুর্বিষহ যাতনার বিড়ম্বনা! নারী, বিশ্বের সব কিছু কোমলতা আর মাধুর্য-সুষমা দিয়ে গড়া নারী, হাজার করেও তার বুকে কান্না জাগে না, বেদনাও আঘাত দিতে পারে না! এর যাতনা আর ছটফটানি বুঝিয়ে বলবার নয় রে বোন, এ – কষ্টে যার হৃদয় কখনও এমনি শুকিয়ে ঠনঠনে পাথর হয়ে গিয়েছে সেই বুঝবে!… বৈশাখের কান্না দেখেছিস? তার ওই হু-হু-হু-হু রোদ্দুরে, ধু-ধু-ধু-ধু গোবি-সাহারায় ধুলো-বালি, শন-শন-শন-শন শুকনো ঝড়-ঝঞ্ঝা, পাহাড়-ফাটা শুষ্কতার বিপুল চড়চড়ানি, দীর্ণ-বিদীর্ণ রুক্ষ খোঁচা খোঁচা উলঙ্গ মূর্তির রুদ্র বীভৎসতা আর খাঁ খাঁ নগ্নতার হাহাকার ক্রন্দন শুনেচিস? তার ওই কঠোর কাঠচোটা অট্টহাসির খনখনে কাংস্য আওয়াজের মাঝে সারা বিশ্বের বিধবার অশ্রুহারা সকরুণ কান্নার নীরব ধ্বনি শুনেচিস? এ-বিষাক্ত তিক্ত কাঁদন বুঝিয়ে বলবার নয় রে বোন, এর লক্ষ ভাগের এক ভাগও বাইরে প্রকাশ করে দেখানোর ক্ষমতা আমার নেই! এ শাস্তি যেন অতি বড়ো দুশমনেরও না হয়! এই তো সবচেয়ে বড়ো নরক-যন্ত্রণা! এই তোদের ‘বাবিয়া দোজখ’। এতে মানুষ মরে না বটে, কিন্তু এই কূট হলাহল-যন্ত্রণা তাকে নিশিদিন জবাই-করা অসহায় প্রাণীর মতন ছট-ফটিয়ে কাতরিয়ে কাতরিয়ে মারে! শিব নাকি সমুদ্র-মন্থনের সমস্ত বিষ পান করে নীলকণ্ঠ নাম নিয়েছেন, কিন্তু তিনি যত বড়ো দেবতাই হন, তাঁর শক্তি যত বেশি অনির্বচনীয় হোক, আমি জোর করে বলতে পারি যে, এই অশ্রুহীন কান্নার তিক্ত বিষ এক ফোঁটা গলাধঃকরণ করলেই তাঁর কণ্ঠ ফেটে খান খান হয়ে যেত! তবে আমরা যে এখনও বেঁচে আছি? হায় রে বোন! আমরা যে মানুষ – রক্ত মাংসের মানুষ! আমাদের শরীরে যা সয়, তা যদি দেবতাদের শরীরেও সইত, তবে তাঁরা এতদিন দেবতা না থেকে মানুষ হয়ে জন্মে মুক্তিলাভ করতেন! কেননা দেবতাদের চেয়ে মানুষ ঢের ঢের, অনেক – অনেক উঁচু! তাঁদের যে একটা অমানুষিক শক্তিই রয়েচে সমস্ত সহ্য করবার। কিন্তু মানুষের এই ক্ষুদ্র বুকের ক্ষুদ্র শক্তির সহ্যগুণ ক্ষমতা যতটুকু তার চেয়ে অনেক বিপুল বহু বিরাট দুঃখ-কষ্ট ব্যথা-বেদনা আঘাত-ঘা যে সহ্য করতে হয়! এত কষ্টেও কিন্তু সে সহজে মরে না। মরণ এ-দুঃখীদের প্রতি বাম! তার রথ এসব আর্তদের পথ দিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, এ বিড়ম্বিত হতভাগাদের কর্ণে তার দূরাগত চাকার ধ্বনিও শ্রুত হয় না! বৃথাই সে হাঁক-ডাক মারে, – ‘মরণ রে, তুহুঁ মম শ্যাম সমান। কিন্তু শ্যাম ততক্ষণে অন্ধকার পথ দিয়ে মরণ-ভীতুদের কানে গিয়ে তাঁর মৃত্যু-বাঁশির বেলাশেষের তান শুনান!…