নূরুটা ক্রমেই স্রষ্টার প্রতি বিদ্রোহী হয়ে উঠচে দেখছি, আবার এ-খবর শুনলে তো সে বিধাতা পুরুষের হপ্তা-পুরুষ উদ্ধার করবে। আমাদের বুক কাঁপে রে ভাই ভয়ে দুরু দুরু করে পাছে কোনো অমঙ্গল হয়। তার চিঠির যদি ঝাঁজ দেখতিস। উঃ, যেন একটা বিপুল ঘূর্ণিবায়ু হু-হু-হু-হু করে ধুলো উড়িয়ে সারা দুনিয়াটাকে আঁধার করে তুলতে চাইছে। … আমি তার চিঠির এক বর্ণও বুঝে উঠতে পারিনে বোন, এক বর্ণও না। শুধু বুঝি, একটা তিক্ত কান্নার তীব্রতা যেন তাকে ক্রমেই শুষ্ক তীক্ষ্ণ করে ফেলচে।… খোদা ওকে শান্তি দিন।
চারিদিককার এই গোলমালে আমার মনে শান্তি একেবারে উবে গিয়েছে। আমার এই সাজানো ঘর যেন আজ আমাকেই মুখ ভ্যাংচাচ্চে।
মা আর সোফিও আলাদা জীব হয়ে উঠেছেন আজকাল। মায়ের দুঃখ অনেক, কিন্তু এই কচি মেয়ে সোফিটা – ? তুই এলে তবে একবার ওর গুমোর ভাঙে। মাগো মা, রাত-দিন মুখ যেন ভার হয়েই আছে। ছুঁতে গেলেই নাকে-কান্না। এমন ছিঁচকাঁদুনে ছুঁড়ি তো আমি আর জন্মে দেখিনি, যেন রাংতার টেকো আর কী!
আর লজ্জার কথা শুনেছিস রে ‘সাহসি’? আজকাল সে তোর ভয়ানক ভক্ত হয়ে উঠেছে। এখন কথায় কথায় তোর নজির দেওয়া হয় – ‘সাহসিদিই তো ভালো কাজ করেছেন – বিয়ে করা একবারে বিশ্রী কাজ, আমিও চিরকুমারী থাকব’ ইত্যাদি ইত্যাদি! আমার তো চক্ষুস্থির! ওরে বাপরে, – এখন তুই এসে একে তোর কাছে নিয়ে গিয়ে এক-আধটা শিক্ষয়িত্রীর পদ-টদ খালি থাকে তো দিয়ে দে! বেশ চেলা জোটাচ্ছিস কিন্তু ভাই। আমি বলি কী, তোরা যত সব চিরকুমারী আর চিরকুমারের দল মিলে একটা নেড়া-নেড়ির দল বের কর। কেমন লো, – কী বলিস?
তোর বর না হয় তোর রূপ-গুণের জৌলুস দেখে ভয়েই পিঠটান দিল, কিন্তু আমাদের এই শ্রীমতী সোফিয়া খাতুনের ঝগড়া-করা আর নাকে-কাঁদা ছাড়া অন্য কী গুণ আছে, যাতে করে তাঁর ‘অচিন-প্রিয়তম’ তাঁকে ত্যাগ করে গেলেন? কিন্তু এইখানে কথা হচ্চে যে, এই ঝগড়াটে ছুড়ির আবার ‘প্রিয়তম’ই বা কে? সে কি কোনো পরিস্থানের শাহজাদা উজিরজাদাকে খোয়াবে-টোয়াবে দেখেছে নাকি? এসব কথা তুই-ই এসে জিজ্ঞেস করবি ভাই, আমি বলতে গেলে এখন আমায় সে লাঠি নিয়ে তাড়া করে আসে। জানি না, ওঁর ‘পীতম’ কোন্ গোকুলে বাড়ছে। কিন্তু দেখিস ভাই, এসে ওকে যেন আবার চেলা বানিয়ে নিসনে।
আর, তুই নিজে কি এমনই সন্ন্যাসিনীই রইবি? হায় রে শ্বেতবসনা সুন্দরী, তোর বসন্ত বৃথাই গেল! চোরের সঙ্গে ঝগড়া করে ভুঁই-এ ভাত খাবি নাকি? আয় তো এখানে একবার, তারপর মনে করেছি কী, তোকেও একটা বুড়ো হাবড়া বর জুটিয়ে দিয়ে ‘নেকা’ দিয়ে দেব! কী বলিস, বিবি হতে পারবি তো? তবে আজ এখন আসি। ইতি–
তোর ভুলে-যাওয়া সই
রাবেয়া
————-
বিডন স্টিট, কলিকাতা
প্রথম বৈশাখ (সকাল)
ভাই রেবা!
আজ যে নতুন বছরের প্রথম দিনের প্রথম সকালে তোর নামটিই সর্বপ্রথমে আমার মনের কোণে উঁকি মারল, আমার এ বিপুল আনন্দের নিবিড় মাধুরী তুই হয়তো বুঝবিনে ; কেননা, তুই এখন ঘরের লক্ষ্মী, তোর ভালোবাসা পাওয়ার আর দেওয়ার অনেক লোক আছে, কিন্তু আমাদের তো আর পোড়াকপালে সেসব কিছু জুটল না। আমার বন্ধু আছেন অনেক, কিন্তু সেসব মামুলি ; তাঁদের সঙ্গে শুধু লৌকিকতার খাতিরটুকু মাত্র, প্রাণের সঙ্গে কারুর কোথাও এতটুকু মিল নেই। তোকে যেমন অসংকোচে একেবারে সেই ছেলেবেলাটির মতন সহজ হয়ে আমার অন্তরের বাইরের সবকিছু জানাতে পারব, এমনটি তো আর কাউকে পারব না ভাই! আমার ভেতরটা এই নীরস সামাজিকতার আর লোক-দেখানো প্রীতির চাপে যখন ক্রমেই শুকনো কাঠ হয়ে উঠছিল, তখন তোর এই হঠাৎ-পাওয়া ছোট্ট চিঠিখানি যে কত অন্তরতম বন্ধুর মতন সেই শুকনো হিয়ায় পরশ বুলিয়ে তাকে আবার ফুলের ফসলে ভরিয়ে তুললে, তা আমার এই ভাবাবেগময়ী লিপি-দূতীর চেহারা দেখেই বুঝতে পারবি।
এতদিন তোর ‘সাহসি’ সই ‘পুয়াল-চাপা’ ছিল, তার কাঠামোটা নিয়ে যিনি এতদিন এই কলকাতা শহরের মহিলাদের পর্দাপার্কে, মাঝে মাঝে রাস্তায়, বোর্ডিং-এ স্কুলে গম্ভীরা হয়ে বেড়িয়ে বেড়াতেন, তিনি হচ্চেন মিস সাহসিকা বোস! বুঝলি? শুধু কী তাই! এক প্রখ্যাত ব্রাহ্মবালিকা বিদ্যালয়ের প্রধানা শিক্ষয়িত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হোমরা-চোমরা গ্রাজুয়েট, তদুপরি অনুপমা সুন্দরী, বিদূষী, কলা-সরস্বতী! আমার আরও অনেকগুলো বিশেষণ আছে, সেগুলো আর চিঠিতে লিখে জানাচ্চিনে, তোকে একবার আমার এই কুঞ্জ-কুটিরে এনে হাতে-কলমেই দেখানো যাবে! তুই এতক্ষণ বোধ হয় তোর দুষ্টু হাড়-জ্বালানো ননদিনি সোফিকে ডেকে এনে খুব কুটি-কুটি হয়ে হাসচিস, নয়? সত্যি বলচি ভাই রেবা, এ আর আমি কী বললাম, আমার সব মহিলা বন্ধুরা আমাকে কোনো নতুন-দেখা সুন্দরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এইরকম যে কত পাঁয়তারা কসরত করে যে অহম সুর-সুন্দরীর গুণ-ব্যাখ্যা ও কীর্তন করেন, তা শুনে শুনে আমারও অনেক সময় মনে হয়, – নাঃ, আমি আর এখন কেউকেটা নই! যেই ভাবা, আর যায় কোথা, অমনি সঙ্গে সঙ্গে প্রাবৃট-মেঘের মতন গুরু-গম্ভীর হয়ে পড়া! প্রথম প্রথম দিন কতক একটু অসোয়াস্তি বোধ হত, কিন্তু এখন দিব্যি সয়ে গিয়েছে ; শুধু সয়ে গিয়েছে বললে ভুল হবে, এখন বরং কোনো জায়গায় ওইরকম বিশেষণ-বিশেষিত অভ্যর্থনা না পেলে মনে একটু রীতিমতোই লাগে! দেখেছিস এইসব মিথ্যা বাজে জিনিসের ওপরও আমাদের মায়া কত বেশি!