ওঁর মরবার আগে আমি মুখরা ছিলাম না বলে যে তুমি আমাকে দোষ দিয়েছ বুবুজান, সে তোমার বুঝবার ভুল। আমি চিরদিনই এমনই কাঠ চোটা কথা কয়ে এসেচি, তবে তখন ছিল একদিন আর আজ একদিন। তখন আমাদের এ মন ভাঙাভাঙিও হয়নি আর তোমার ভালোবাসাটাও হয়তো সত্যিকারই ছিল, তাই আমার ও ঝাঁজানো কথা শুনেও শুনতে না। আজ যেই মনের মিথ্যা দিকটা ধরা পড়েছে, অমনি তোমারও চোখে পড়ে গিয়েছে যে মাগি চশমখোর মুখরা! এবার আরও কত শুনব।
খামোখা রবিয়ল বাবাজিকে কষ্ট করে এখানে পাঠিয়ো না বোন, আমি এখন যাব না। আইবুড়ো জোয়ান মেয়েকে যদি এমনি করে নালতে শাকের মতন হাট-বাজারে নিয়ে ঘুরে বেড়াই, তাহলে সবারই বদনাম। তা ছাড়া, এখন মাহ্বুবাকে এখান থেকে নিয়ে গেলে আমার বাপ-মায়ের বা ভাইদের অপমান করা হয় না কি? তাঁরা কি এতই ছোটোলোক যে, তাঁদের ঘরের আবরু এমন করে নষ্ট হতে দেখে বসে বসে হুঁকো টানবেন? আরও একটা সত্যি কথা বলছি বুবু, রেগো না যেন। আমরা গরিব হলেও মানুষ, আমাদের মান-অপমান জ্ঞান আছে। এত অপমানের পরও আমরা কোন্ মুখে সেখানে আবার মুখ দেখাব গিয়ে? এখানে যদি কুকুর বিড়ালের মতোও অনহেলা হেনস্তা হয় তাও স্বীকার, তবু আর খোদা যেন ও সালার-মুখো না করেন। আমি দূর থেকেই সালারকে হাজার হাজার সালাম করচি বোন,। তুমি শুধু নিজের দিকটা দিয়েই ওই কুকুর-কুণ্ডলি কাণ্ডটা নিয়ে বিচার করেছ, কিন্তু এ গরিবদের বেদনাটুকু বুঝতে হয় বোন সেই সঙ্গে। কথায় বলে, – তাঁতি তাঁত বোনে, আপনার দিকে ভাঁড় টানে। তোমারও দেখচি তাই। আচ্ছা, এই যে মাহ্বুবার বাপ হঠাৎ মারা গেলেন, এটা কার দোষে, কোন্ বেদনার ঘা সামলাতে না পেরে? তা কী জানো? আমি তক্ষুনিই বলেছিলাম, দড়াতে দড়িতে গিঁঠ খায় না, তা তোমাদের ঝোঁকে উনি সোজা মানুষ আমার কথাই কানে উঠালেন না। তার পর সত্যি সত্যিই ‘তেলি, না, হাত পিছলে গেলি’ করে নূরু আপনার এক দিকে পালিয়ে গেল – পালিয়ে বাঁচল, কিন্তু মাঝে পড়ে সর্বস্বান্ত হলাম আমরা – গরিবরা। মাহ্বুবার বাপ সে আঘাত সে অপমান সহ্য করতে না পেরে দুনিয়া থেকে সরেই পড়লেন, মেয়েরও আমার বুক ভেঙে গেল! মা আমি, আমার কাছে তো আর মেয়ে মন লুকিয়ে চলতে পারে না। মাহ্বুবা যতই চেষ্টা করুক আমার আজ এটা বুঝতে বাকি নেই যে হতভাগি মরেছে। কিন্তু এও আমি বলে রাখলাম যে, আমি বেঁচে থাকতে যদি আমার এই মেয়ের ফের নূরুর সঙ্গে বিয়ে হতে দিই, তবে আমার জন্ম শাহজাদ মিয়াঁ দেননি! মাহ্বুবার বাবার উঁচু মন, তিনি মরণকালে তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করে গিয়েছেন, কিন্তু আমি আজও তোমাদের কাউকে ক্ষমা করতে পারিওনি আর পারবও না। এ সত্যি কথা আজ মুখ ফুটে বলে দিলাম। নূরুকে আমি বদ দোয়া করব না, সে যুদ্ধ থেকে সহি-সালামতে ফিরে আসুক আমিও প্রার্থনা করছি, কিন্তু তাকে ক্ষমা করতে পারব না তাই বলে। যে অপমান, যে আঘাতটা আমাদের সইতে হয়েছে তা অন্য কেউ হলে এতদিন তার হাজার গুণ বদলা নিয়ে তবে ছাড়ত!… যাক সে সব কথা, এ-ভাঙা মন আর জুড়বেও না, আমি সেখানে যেতে পারব না, ‘ও মন আমার কাঁচের বাসন, ভাঙলে ও-মন আর জোড়ে না!’ সালারেরও দানা-পানি আমার কপালে আর নেই বোন ; তা সেই দিনই ফুরিয়েছে যেদিন মাহ্বুবার বাপ মারা গিয়েছেন। আমি সব ভুলতে পারি, কিন্তু তাঁর মৃত্যুটা আমি ভুলতে পারি না – শুধু এই কথাটা মনে রাখবে।
আমার ভায়েরা বীরভূম জেলার শেঙানের এক খুব বড়ো জমিদারের সঙ্গে মাহ্বুবার বিয়ের সব ঠিক-ঠাক করেছেন। তিনি এক মস্ত হোমরা-চোমরা বুনিয়াদি খান্দানের, তবে বয়েসটা চল্লিশ পেরিয়ে পড়েছে এই যা। কিন্তু তাঁর আগের তরফে বিবির এক মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। তারও আবার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তারও ঘরে ছেলে মেয়ে। বরের বয়েসটা একটু বেশি, তা হলে আর কী করব! গরিবের মেয়ের জন্য কোন্ নওয়াবজাদা বসে আছে বলো! এই মাসেই বিয়ে হয়ে যাবে। মাহ্বুবাও মত দিয়েছে ; – এ শুনে তোমরা তো আশ্চর্য হবেই, আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি। … আল্লাহ্ এত দুঃখও লিখেছিল অভাগির কপালে! আমার বুক ফেটে যাচ্ছে বুবু সাহেবা, বুক ফেটে যাচ্ছে!
যাক, তোমাদের দাওত করলাম, এসে এই দুঃখের বিয়ে দিয়ে যেয়ো – মায়ের আমার বিসর্জন দেখে যেয়ো বোন! যদি না আসতে পার, তবে সবাই মিলে দোয়া কোরো যেন পোড়ামুখি সুখী হয়।
মা সোফিয়ার বিয়েতে যেতে পারব তা আর মনে হয় না বুবুজান। তাহলে আমার ঘরের এ কাজ দেখবে কে? আমি আমার জান-দিল থেকে দোয়া করচি, খোদা আমার সোফি মাকে রাজরানি করুন। তার মাথার সিঁদুর হাতের পঁইচি অক্ষয় হোক! বেশ সুন্দর হবে, মনুয়রের সাথে ওকে মানাবেও মানিক-জোড়ের মতন। আমি এ দৃশ্য দেখতে পারলাম না বলে ছটফট করছি।
আবার লিখছি বোন খামোখা রবু বাবাজিকে আমাদের নিতে পাঠিয়ো না, পাঠিয়ো না! অনর্থক হাল্লক হয়ে ফিরে যাবে। আমি জান থাকতে সেখানে যেতেও পারব না, আর মাহ্বুবার এ বিয়েও বন্ধ করতে পারব না।
বহুমাকে আর সোফিয়াকে আমার বুক-ভরা স্নেহ-আশিস দেবে। খুকিকে আমার চুমো দেবে, আমি বাস্তবিকই তার বে-দরদ দাদি!
আসি বুবুজান, মাথাটা ঘুরে আসছে! আবার আমার পুরোনো ভিরমি রোগটা কদিন থেকে কষ্ট দিচ্ছে! –
তোমার ভাগ্যহীনা ছোটো বোন
আয়েশা
——————-