যাক বোন, এখন আসল কথা হচ্চে তোমরা ফিরে এসো। বেশ হল, বুকে এত বড়ো ‘দেরেগে’ শোক পাওয়ার পর দু-দিন বাপ-মায়ের বাড়িতে বেরিয়ে মন বাহালিয়ে নিলে, এখন আবার ঘরের বউ ঘরে ফিরে এস। বাপ-মায়ের বাড়িতে বেশি দিন থাকা ‘আয়েব’ ও বটে, আর তাতে মান-ইজ্জতও থাকে না। এখন তোমাকে শ্বশুরকুলের আর মৃত স্বামীরই সম্মান রক্ষা করে চলতে হবে। যে ঘরের বউ তুমি, সে ঘরের মাথা উঁচু রাখতে তুমি সব দিক দিয়ে বাধ্য। রবুকে পাঠিয়ে দেব পালকি নিয়ে তোমাদের আনবার জন্যে। আমি নিজেই যেতাম, কিন্তু তাহলে ঘর দেখবে কে? বউ-বেটি ছেড়ে কি আমার কোথাও যাওয়ার জো আছে! আর রাগ অভিমান করিসনে বোন। তোরা সবাই মিলে যদি আমার মনে এমন করে কষ্ট দিস তা হলে দেখচি কোনো দিন বিষ খেয়ে আমাকে হারামি মউত মরতে হয়। আর তা নইলে তো তোমাদের এই হাড়-জ্বালানো স্বভাব থামবে না। আমার মাহ্বুবা মাকে নিয়ে আর বেশি দিন সেখানে থাকা মস্ত বড়ো দোষের কথা। আইবুড়ো মেয়ে – হোক না মামার বাড়ি, লোকে তো দশটা কথা বলতে কসুর করবে না ; আর তা শুনে শুনে তুমিও অতিষ্ঠ, তেতো-বেরক্ত হয়ে উঠবে। তোমরা যেদিন আসতে চাও, সেই দিনই শ্রীমান রবিয়ল বাবাজীবন সেখানে পালকি নিয়ে গিয়ে হাজির হবে। তোমরা এর মধ্যে প্রস্তুত হয়ে থেকো। পত্রপাঠ উত্তর দিতে ভুলো না যেন, একথা আমি তোমার কান কামড়ে বলে দিচ্ছি।
খুকি যে তোর জন্যে “থোত দাদি দাবো – থোত দাদি দাবো’ বলে মাথা খুঁড়চে এখানে! মাবুর জন্যেও কত কাঁদে। হায় রে কপাল, এমন বে-দরদ ছোটো দাদি যে একটা চিঠি দিয়েও পুতিনের খবর নেয় না! আর সেই পুতিনের আবার ছোটো দাদির জন্যে এমন মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে কান্না!
হাঁ, আর একটা মস্ত বড়ো জরুরি কথা, – ছাই ভুলেও যাচ্ছিলাম। আমার কি কিছু মনের ঠিক-ঠাক আছে বোন! এখন মরণ হলেই বাঁচি!… বলছিলাম কী আমাদের সোফিয়ার বিয়ে বউমার ছোটো ভাই মনুয়রের সঙ্গেই ঠিক করেছি। রবু বোধ হয় চিঠি দিয়ে আগেই সেকথা জানিয়েছে। তুই একবার এসে সব কাজ দেখে শুনে গুছো এসে; সোফি তোরই তো মেয়ে। আর, মাহ্বুবা মা না এলে সোফি বোধ হয় বিয়েই করবে না। আমি বোন এ-সব ঝামেলা সইতে পারব না এ মন নিয়ে।
সেখানকার সকলকে দর্জামতো সালাম দোয়া দেবে। হাঁ, আর একবার তোর হাত ধরে বলছি বোন আমার, দেখিস নূরুকে কোনো আহা-দিল বদ-দোয়া দিসনে যেন, বাছা আমার কোথায় কোনো দেশে পড়ে রয়েচে, হয়তো এতে তার অকল্যাণ হবে। ইতি –
তোমার বড়ো বোন
রকিয়া
————–
শাহপুর
১লা চৈত্র
বুবু সাহেবা!
তোমার চিঠি পেয়েছি। নানান কারণে উত্তর দেওয়া হয়নি।
মাহ্বুবাটাও বোধ হয় বউমার কিংবা সোফিয়ার চিঠি পেয়েচে, তাই এই কদিন ধরে শুধু তার কাঁদো-কাঁদো ভাব দেখা যাচ্চে।
আজকালকার ছেলে-মেয়েরা এমনই বেইমান! আমার মেয়ে কিনা আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলতে চায়। মাহ্বুবা এখন আমাকে দেখলেই একপাশে সরে যায়, চোখ মুখে তার কান্না থমথম করে ওঠে! বাপরে বাপ, এ কলিকালে আরও কত দেখব বুবুজান, – দশ মাস দশদিন গর্ভে-ধরা বুকের লোহু দিয়ে মানুষ-করা একমাত্র মেয়ে সেও কিনা দুঃখিনী মায়ের বিদ্রোহী হয়? গরিবের মেয়ের – যার দিন-দুনিয়ায় আপনার বলতে কেউ নেই, তার আবার এত গরব কীসের! এসব দেখে আমার বোন দুঃখও হয়, হাসিও পায়!
তোমরা আমাদের খুবই উপকার করেছ বুবুজান, আমরা গরিব হলেও সে উপকার ভুলে যাওয়ার মতন বেইমানি আমাদের মধ্যে নেই। আমাদের গায়ের চামড়া দিয়ে তোমাদের পায়ের জুতো বানিয়ে দিলেও সে ধার শোধ হয় না। তবে কথা কি জানো আমরা গরিব, তাই হয়তো লোকের ভালো কথাও এসে অপমানের মতন আমাদের বুকে বাজে। আর বোধ হয়, সেই জন্যেই মনে করচি তোমরা উপকার করে মায়ামমতা দেখিয়ে আজ আবার তারই খোঁটা দিচ্ছ! বড়ো দুঃখেই লোকে অন্যের কাছ থেকে সাহায্য নেয়। আমি যদি সমান দরের লোক হতাম তা হলে হয়তো খুব সহজেই তোমার ও উপকার, অত স্নেহ-মায়া অসংকোচে নিতে পারতাম ; কিন্তু আমি গরিব বলেই মনে করি, ও তোমাদের বড়ো মনের অসহায়ের প্রতি সহানুভূতি আর দয়া ভিন্ন কিছুই নয়। আর, ও নিতে আমার মন তাই চিরটা দিনই লজ্জায় ক্ষোভে অপমানে এতটুকু হয়ে যেত। মাহ্বুবার বাপ যতদিন বেঁচেছিলেন, ততদিন আমি ও কথা তোমায় বলি-বলি করেও বলতে পারিনি, আর বলতে গেলেও উনি বলতে দিতেন না । এতে হয়তো তুমি মনে বড়ো কষ্ট পাবে বুবুজান, কিন্তু আর সত্যি কথাটা লুকিয়ে নিজের মনের দংশন-জ্বালা সইতে পারছিনে বলেই বড়ো কঠিন হয়েই এ কথাটা জানাতে হল। আমার এত আত্মসম্মান থাকাটা কিন্তু আশ্চর্য নয়, কেননা আমি গরিবের ঘরে বউ হলেও আমার বাপ মস্ত শরিফ। এইসব অপ্রিয় কথাগুলো বলে তোমাকে খুবই কষ্ট দিচ্চি বুঝি, কিন্তু কত দুঃখে যে আমার মুখ দিয়ে এসব নির্মম কথাগুলো বেরোচ্ছে তা এক আল্লাই জানেন। উনি তো বেহেশ্তে গিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন কিন্তু এ -অভাগিকে তুষের আগুনে একটু একটু করে পুড়ে মরতে রেখে গেলেন! এখন এই যে আইবুড়ো ধিঙ্গি মেয়ে বুকের ওপরে, এ তো মেয়ে নয় – আমার বুকের ওপর যেন কুলকাঠের আগুনের খাপরা। ওকে নিয়েই আমার যত ভাবনা, তা নইলে আমার আজ চিন্তা কী? উনি যে দিন চলে গেলেন, সেই দিনই এ পোড়া জানের ল্যাঠা চুকিয়ে দিতাম।
আমাদের এখানে কোনো কষ্টই নেই। ওই হতভাগি মেয়ে বোধ হয় লিখে জানিয়েছে সব দরদি বন্ধুদের, না? ও মেয়ে দেখচি দিন দিন আমারই দুশমন হয়ে দাঁড়াচ্চে। হাড় কালি করে ছাড়লে হতচ্ছাড়ি পোড়ারমুখি, তবু তার আশ মিটল না। এখন আমার কলজেটা বের করে খেলেই ওর সোয়াস্তি আসে। এই ঢিবি বেয়াড়া মেয়ে নিয়ে রাত-দিন ঘরে-বাইরে মুখনাড়া হাতনাড়া সহ্য করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লাম। য়্যা বড়ো-মান্ষি চাল, যেন কোনো নবাবের মেয়ে! সত্যি বোন, তোমরাই ওকে অমন আমিরজাদির মতন শাহানশাহি মেজাজের করে তুলেছ। এখন আমায় সর্বদাই পাহারা দিয়ে থাকতে হয় তাকে, পাছে কখন কোন্ অনাছিস্টি করে বসে থাকে বা কারুর মুখের ওপর চোপা করে একটা ঝগড়া-ঝাঁটির পত্তন করে বসে। খোদা আর কোনো দিকে সুখ দিলেন না।