হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে
সজল কাজল আঁখি পড়িল মনে॥
অধর করুণা-মাখা,
মিনতি বেদনা-আঁকা,
নীরবে চাহিয়া-থাকা
বিদায় ক্ষণে,
হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে॥
ঝর ঝর ঝরে জল বিজুলি হানে,
পবন মাতিছে বনে পাগল গানে।
আমার পরানপুটে
কোনখানে ব্যথা ফুটে,
কার কথা বেজে উঠে
হৃদয় কোণে,
হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে॥
গান হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে দু-চারজন সমঝদার টেবিল, বই, খাটিয়া যে যা পেয়েছেন সামনে, তাই তালে-বেতালে অবিশ্রান্ত পিটিয়ে চলেছেন। এক একজন যেন মূর্তিমান ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি!’ আবার দু-একজন বেশি রকমের রসজ্ঞ ভাবে বিভোর হয়ে গোপাল রায়ের অনুকরণে – ‘দাদা গাই দেখ্সে, গোরু তার কী দেখব; দ্যাখ ঠাকুদ্দার বিয়ে, ধুচনি মাথবায় দিয়ে; – বাবারে, প্যাট গ্যালরে, শা … তোর কী হল রে’ ইত্যাদি সুমধুর বুলি অবিরাম আওড়িয়ে চলেছেন। যত না বুলি চলছে, মাথা-হাত-পা-মুখ নড়ছে তার চেয়ে অস্বাভাবিক রকমের বেশি! গানটা ক্রমে ‘আঙ্কোর প্লিজ’ – ‘ফিন জুড়ো’ প্রভৃতির খাতিরে দু-তিনবার গীত হল। তারপর যেই এসে সমের মাথায় ঘা পড়েছে, অমনি চিত্র-বিচিত্র কণ্ঠের সীমা ছাড়িয়ে একটা বিকট ধ্বনি উঠল, ‘দাও গোরুর গা ধুইয়ে! – তোমার ছেলের বাপ মরে যাক ভাই! তুই মরলে আর বাঁচবি নে বাবা!’ সঙ্গে সঙ্গে বুটপট্টি-পরা পায়ে বীভৎস তাণ্ডব নৃত্য! – এদের এ উৎকট সমঝ-বুদ্ধিতে গানটার অনেক মাধুর্য নষ্ট হয়ে গেলেও মনে হচ্ছে এও যেন আমাদের আর একটা ছাত্রজীবন। একটা অখন্ড বিরাট আমোদ এখানে সর্বদাই নেচে বেড়াচ্ছে। যারা কাল মরবে তাদের মুখে এত প্রাণ-ভরা হাসি বড্ড অকরুণ!
আমার কানে এখনও বাজছে –
– পড়িল মনে
অধর করুণা-মাখা,
মিনতি-বেদনা-আঁকা,
নীরবে চাহিয়া-থাকা
বিদায় ক্ষণে।
আর তাই আমার এ পরানপুটে কোন্খানে ব্যথা ফুটচে, আর হৃদয়কোণে কার কথা বেজে বেজে উঠচে।
আমি আমার নির্জন কক্ষটিতে বসে কেবলই ভাবচি যে, কার এ ‘বিপুল বাণী এমন ব্যাকুল সুরে’ বাজচে, যাতে আমার মতো শত শত হতভাগার প্রাণের কথা, হৃদয়ের ব্যথা এমন মর্মন্তুদ হয়ে চোখের সামনে মূর্তি ধরে ভেসে ওঠে? ওগো, কে সে কবিশ্রেষ্ঠ, যাঁর দুটি কালির আঁচড়ে এমন করে বিশ্বের বুকের সুষুপ্ত ব্যথা চেতনা পেয়ে ওঠে? বিস্মৃতির অন্ধকার হতে টেনে এনে প্রাণ-প্রিয়তমের নিদারুণ করুণ স্মৃতিটি হৃদয়ের পরতে-পরতে আগুনের আখরে লিখে থুয়ে যায়? আধ-ভোলা আধ-মনে-রাখা সেই পুরানো অনুরাগের শরমজড়িত রক্তরাগটুকু চির-নবীন করে দিয়ে যায়। কে গো সে কে? – তার এ বিপুল বাণী বিশ্ব ছাপিয়ে যাক, সুরের সুরধুনী তাঁর জগতময় বয়ে যাক! তাঁর চরণারবিন্দে, কোটি কোটি নমস্কার!
‘বিদায় ক্ষণের’ নীরবে চেয়ে থাকার স্মৃতিটা আমার সারা হৃৎপিণ্ডটায় এমন একটা নাড়া দিলে যে, বত্রিশ নাড়ি পাক দিয়ে আমারও আঁখি সজল হয়ে উঠেচে। ভাই মনু, আমায় আজ পুরানো দিনের সেই নিষ্ঠুর স্মৃতি বড্ড ব্যথিয়ে তুলেছে! বোধ হয় আবার ঝর ঝর করেই জল ঝরবে। এ আকাশ-ভাঙা আকুল ধারা ধরবার কোথাও ঠাঁই নেই।
খুব ঘোর করে পাহাড়ের আড়াল থেকে এক দল কালো মেঘ আবার আকাশ ছেয়ে ফেললে! আর কাগজটা দেখতে পাচ্ছি নে, সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
(বিকেলবেলা)
হাঁ, এইবার চিঠিটা শেষ করে ফেলি। সকালে খানিকক্ষণ গান করে বিকেলবেলা এখন মনটা বেশ হালকা মতো লাগচে।
চিঠিটা একটু লম্বা চওড়া হয়ে গেল। কী করি, আমার লিখতে বসলে কেবলই ইচ্ছা হয় যে, হৃদয়ের সমস্ত কথা, যা হয়তো বলতে সংকোচ আসবে, অকপটে লিখে যাই। কিন্তু সবটা পারি কই? আমার সবই আবছায়ার মতো। জীবনটাই আমার অস্পষ্টতায় ঘেরা।
রবিয়লকে চিঠি লিখেছি কাল সন্ধ্যায়। বেশ দু-একটা খোঁচা দিয়েছি! রবিয়ল অসংকোচে আমার উপর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের যেরকম দাবি করে, আমি কিছুতেই তেমনটি পারি না। কী জানি কেন, তার ওপর স্বতই আমার ভক্তিমিশ্রিত কেমন একটা সংকোচের ভাব আসে। তবুও সে ব্যথা পাবে বলে আমি নিতান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতোই তার সঙ্গে চিঠি-পত্তর ব্যবহার করি। কথাটা কী জান? সে একটু যেন মুরব্বি ধরনের, কেমন রাশভারি লোক, তাতে পুরোদস্তুর সংসারী হয়ে পড়েছে। এরূপ লোকের সঙ্গে আমাদের মতো ছাল-পাতলা লোকের মোটেই মিশ খায় না। কিন্তু ও আর আমি যখন বাঁকুড়া কলেজিয়েট স্কুলে পড়তাম, তখন তো এমন ছিল না!
লোকটার কিন্তু একটা গুণ, লোকটা বেজায় সোজা! এই রবিয়ল না থাকলে বোধ হয় আমার জীবন-স্রোত কোনো অচেনা অন্য দিকে প্রবাহিত হত। রবু আমায় একাধারে প্রাণপ্রিয়তম বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ ভ্রাতার মতোই দেখে। রবিয়লের – রবিয়লের-চেয়েও সুন্দর স্নেহ আমি কখনও ভুলব না।
সংসারে আমার কেউ না থাকলেও রবিয়লদের বাড়ির কথা মনে হলে মনে হয় যেন আমার ভাই-বোন-মা সব আছে!
রবিয়লের স্নেহময়ী জ্যোর্তিময়ী জননীর কথা মনে হলে আমার মাতৃবিচ্ছেদ-ক্ষতটা নতুন করে জেগে ওঠে। – আমি কিন্তু বড্ড অকৃতজ্ঞ! না? বড্ড অকৃতজ্ঞ! না? এখন আসি ভাই, – বড্ড মন খারাপ কচ্চে। ইতি –
হতভাগা
নূরুল হুদা
বাঁধনহারা – পরিচ্ছেদ ০২
[খ]
সালার
২৯শে জানুয়ারি
(প্রভাত,– চায়ের টেবিল সম্মুখে)
নূরু!
তোর চিঠিটা আমার ভোজপুরি দারোয়ান মশায়ের ‘থ্রু’ দিয়ে কাল সান্ধ্য-চায়ের টেবিলে ক্লান্ত করুণ বেশে এসে হাজির। দেখি, রিডাইরেকটের ধস্তাধস্তিতে বেচারার অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। আমি ক্ষিপ্রহস্তে সেই চক্রলাঞ্ছিত, ওষ্ঠাগতপ্রাণ, প্রভুভক্ত লিপিবরের বক্ষ চিরে তার লিপিলীলার অবসান করে দিলাম। – বেজায় উষ্ণমস্তিষ্ক চায়ের কাপ তখন আমার পানে রোষকষায়িত লোচনে চেয়ে চেয়ে ধূম্র উদ্গিরণ করতে লাগল। খুব ধৈর্যের সঙ্গে তোর লিপিচাতুর্য – যাকে আমরা মোটা কথায় বাগাড়ম্বর বলি দেখে খানিকটা ঠাণ্ডা দুধ ঢেলে আগে চায়ের ক্রোধ নিবারণ করলাম। তারপর দু-চামচ চিনির আমেজ দিতেই এমন বদরাগী চায়ের কাপটি দিব্যি দুধে-আলতায় রঙিন হয়ে শ্রান্ত-মধুর-রূপে আমার চুম্বনপ্রয়াসী হয়ে উঠল। তুই শুনে ভয়ানক আশ্চর্য হবি যে, তোর ‘কোঁদলে’ ‘চামুণ্ডা’ ‘রণরঙ্গিণী’ ভাবিসাহেবা ‘তত্রস্থানে’ সশরীরে বর্তমান থাকা সত্ত্বেও (অবিশ্যি, তখন গুম্ফশ্মশ্রুবহুল বিশাল লাঠিস্কন্ধে ভোজপুরি মশাই ছিলেন না সেখানে) এবং তাঁর মৌরসিস্বত্ব বেমালুম বেদখল হচ্ছে দেখেও তিনি কোনো আপিল পেশ করেননি।
আহা হা! তাঁর মতো স্বামীসুখাভিলাষিণী, ‘উদ্ভট ত্যাগিনী’ এ ঘোর কলিকালে মরজগতে নিতান্তই দুর্লভ রে, নিতান্তই দুর্লভ। আশা করি মৎকর্তৃক তোর শ্রদ্ধেয়া ভাবিসাহেবার এই গুণকীর্তন (কোঁদলে রণরঙ্গিণী আর চামুণ্ডা এই কথা কটি বাদ দিয়ে কিন্তু!) তোর পত্র মারফতে তাঁর গোচরীভূত হতে বাকি থাকবে না।
আমাদের খুকির বেশ দু-একটি করে কথা ফুটছে। – এই দ্যাখ, সে এসে তোর চিঠিটার হাঁ-করে থাকা ক্লান্ত খামের মুখে চামচা চামচা চা ঢেলে তার তৃষ্ণা নিবারণ করচে, আর বলচে ‘চা – পিয়াচ!’ – সে তোর ওই রণসাজ-পরা খেজুর গাছের মতো ফটোটা দেখে চা-চা করে ছুটে যায়, আবার দু-এক সময় ভয়ে পিছিয়ে আসে। এই খুদে মেয়েটা সংসারের সঙ্গে আমায় পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলেছে। শুধু কি তাই? এ ‘আফলাতুন’ মেয়ের জুলুমে মায়েরও পরমার্থ-চিন্তা অনেক কমাতে হয়েছে। আর সোফিয়ার তো সে জান্! মাকে সেদিন এই নিয়ে ঠাট্টা করাতে, মা বললেন, ‘বাবা, মূলের চেয়ে সুদ পিয়ারা! এখন ঠাট্টা করছিস, পরে বুঝবি যখন তোর নাতি-পুতি হবে।’ – মা-র নমাজ পড়ার তো সে ঘোর বিরোধী। মা যখন নমাজ পড়বার সময় ‘সেজদা’ যান, সে তখন হয় মায়ের ঘাড়ে চড়ে বসে থাকে, নতুবা তাঁর ‘সেজদা’র জায়গায় বসে ‘দা-দা’ করে এমন করুণভাবে কাঁদতে থাকে যে, মায়ের আর তখনকার মতো নমাজই হয় না! আবার মায়ের দেখাদেখি সেও খুব গম্ভীরভাবে নমাজ পড়ার মতো মায়ের সঙ্গে ওঠে আর বসে! তা দেখে আমার তো আর হাসি থামে না! এই এক রত্তি মেয়েটা যেন একটা পাকা মুরুব্বি! ঝি-দের অনুকরণে সে আবার হাত-মুখ খিঁচিয়ে মায়ের সাথে ‘কেজিয়া’ করতে শিখেছে। দুষ্টু ঝিগুলোই বোধ হয় শিখিয়ে দিয়েছে, – খুকি কেজিয়ার সময় মাকে হাত নেড়ে নেড়ে বলে, ‘দুঃ! ছতিন! – ছালা – ছতিন!’
তোকে অনেক কথাই জানাতে হবে। কাজেই চিঠিটা হয় তোরই মতো ‘বক্তিমে’য় ভরা বলে বোধ হবে। অতএব একটু মাথা ঠান্ডা করে পড়িস। আমরা হচ্ছি সংসারী লোক, সবসময় সময় পাই না। আবার সময় পেলেও চিঠি লেখার মতো একটা শক্ত কাজে হাত দিতে ইচ্ছে হয় না। তাতে আমার ধাত তো তোর জানা আছে, – যখন লিখি তখন খুবই লিখি, আবার যখন লিখি নে তখন একেবারে গুম। তুই আমার অভিমানের কথা লিখেছিস, কিন্তু ওই মেয়েলি জিনিসটার সঙ্গে আমার বিলকুল পরিচয় নেই। আর তারহীন বার্তাবহের সন্দেশ বলে বেশি লাফালাফি করতে হবে না তোকে, ও সন্দেশওয়ালার নাম আমি চোখ বুঁজেই বলে দিতে পারি। তিনি হচ্ছেন, আমার সহধর্মিণী-সহোদর শ্রীমান মনুয়র! দেখেছিস আমার দরবেশি কেরামতি! তুই হচ্ছিস একটি নিরেট আহাম্মক, তা না হলে ওর কথায় বিশ্বাস করিস? হাঁ, তবে একদিন কথায় কথায় তোকে কাঠখোট্টা বলে ফেলেছিলাম বটে! কিন্তু তোর এখনকার লেখার তোড় দেখে আমার বাস্তবিকই অনুশোচনা হচ্চে যে, তোকে ওরকম বলা ভয়ানক অন্যায় হয়ে গেছে। এখন আমার ইচ্ছে হচ্চে, তোর ঘাড়ে কিছু ভয়ানক রকমের উপাধিব্যাধি চড়িয়ে দি, কিন্তু নানান ঝঞ্ঝাটে আমার বুদ্ধিটা আজ মগজে এমন সাংঘাতিক রকমে দৌড়ে বেড়াচ্ছে যে, তার লাগামটি কষে ধরবারও জো-টি নেই!…
এই হয়েছে রে, – হ – য়ে – ছে! – ইতিমধ্যে পাশের ঘরে মুড়ো ঝ্যাঁটাহস্তে দুটো ঝি-এর মধ্যে কোঁদল ‘ফুল ফোর্সে’ আরম্ভ হয়ে গেছে। – বুঝেছিস, এই মেয়েদের মতো খারাব জানোয়ার আর দুনিয়ায় নেই। এরা হচ্ছে পাতিহাঁসের জাত। যেখানেই দু-চারটে জুটবে, সেখানেই ‘কচর কচর বকর বকর’ লাগিয়ে দেবে। এদের জ্বালায় ভাবুকের ভাবুকতা, কবির কল্পনা এমন করুণভাবে কর্পূরের মতো উবে যায় যে, বেচারিকে বাধ্য হয়ে তখন শান্তশিষ্ট ল্যাজবিশিষ্ট একটি বিশেষ লম্বকর্ণ ভারবাহীর মতোই নিশ্চেষ্ট ভ্যাবাকান্ত হয়ে পড়তে হয়। গেরো –গেরো! দুত্তোর মেয়েমানুয়ের কপালে আগুন! এরা এ ঘর হতে আমায় উঠাবে তবে ছাড়বে দেখছি। অতএব আপাতত চিঠি লেখা মুলতবি রাখতে হল ভাই। আমার ইচ্ছে হয়, এই মেয়েগুলোকে গোরু-খেদা করে খেদিয়ে তেপান্তরের মাঠে ঠেলে উঠাই গিয়ে। ওঃ, সব গুলিয়ে দিলে আমার!