তার ওপর আবার তোমাদের এই কাণ্ড! তোমাদের এতটুকু কষ্টের কথা ভাবতেও যে আমি মনে কত কষ্ট পাই, তা বলতে গেলে বলবে যে মায়াকান্না কাঁদচে। কেননা এখন সেদিন আর নেই। কোথা থেকে কী একটা গোলমাল মধ্যে থেকে বেধে গিয়ে আমার না হোক তোমার যে মন একেবারে ভেঙে গিয়েছে, এতে কোনোই সন্দেহ নেই। এই মন-ভাঙা-ভাঙির আগে কিন্তু এরই পাশাপাশি বাড়িতে থেকে আমাদের অতকাল কেটে গেল, কিন্তু কোনোদিন কোনো মনান্তর তো দূরের কথা, তেমন কোনো খুঁটিনাটিও হয়নি।… আজ যদি মাহ্বুবার বাপ (আল্লাহ্ তাকে জিন্নতে জায়গা দেন!) বেঁচে থাকত, তাহলে কী তোমরা তার বাপ-দাদার ভিটে এমন করে ছেড়ে যেতে সাহস করতে? এক দূরসম্পর্কের বোন না হয়ে তুমি যদি আমার মায়ের পেটের ‘সোদর’ বোন হতে, তাহলে হয়তো আমার এতদিনের এত বড়ো অধিকারকে ‘পা’মাড়িয়ে যেতে পারতে না। মাহ্বুবার বাপ বেচারা তো চিরটা কাল আমার আপন ছোটো ভাইটির মতোই আদর আবদার নিয়ে আসত, ওতে আমার যে কত আনন্দ হত, আমার বুক যে কীরকম ভরে উঠত, তা আমিই জানি আর আল্লাহ্ জানেন। তুমি হয়তো বলবে যে, সে অন্য সম্পর্কে আমার্ ছোটো দেবরই ছিল, কিন্তু সত্যি বলতে গেলে শুধু তার জন্যে নয়, তোমার জন্যেও তার ওপর আমার স্নেহমায়াটা এত বেশি করে পড়েছিল। তোমার বিয়ের কথা আমিই উঠাই তার সঙ্গে, সে সময় সে হাসতে হাসতে বলেছিল, – ‘ভাবিসাহেবা, আজকাল বউ পসন্দ করে নেওয়ার একটা হুজুগ পড়েছে, কিন্তু দেখচি আমার হয়ে আপনিই সমস্ত করে দিলেন! তবে আমি এই ভরসায় রাজি হচ্চি যে, আপনার মতো ঝুনো দালালের হাতে ঠকবার কোনো ভয় নেই!’ আর সে কী হাসি! আজও আমার কানে ওর অমনি কত কথা কত হাসি মনে পড়চে। তোমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর সে আমায় সালাম করতে এসে হেসে কুটিকুটি হয়ে বলেছিল, – ‘ভাবিসাহেবা, আজ থেকে কিন্তু আপনি আমার ‘জেড়শাস’ অর্থাৎ কিনা জ্যেষ্ঠা শ্যালিকা। আর আমাদের হিন্দুদের ঘরে জ্যেষ্ঠা শ্যালিকারা ছোটো বোনের স্বামীর সাথে হাসি-ঠাট্টা করলেও আমাদের সমাজে কিন্তু উলটো নিয়ম, আর সে নিয়ম অনুসারে আপনার আমার সঙ্গে কথা কওয়া তো দূরের কথা, দেখা-শোনাও হতে পারে না!’ আজ সে নেই, তার সে হাসিও নেই! ও আর নূরুটা গিয়ে আমাদের পাড়াটা যেন দিন-দুপুরেই গোরস্থানের মতো সুনসান হয়ে রয়েচে!
তারই একটি কণা স্মৃতি মরণ-কালে আমার হাতে সঁপে-দেওয়া মাহ্বুবা মা-জানকে যে তুমি এমন করে বেদিলের মতন আমার বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, তা আমি কোনোদিনই ভাবতে পারিনি। তোমার বোধ হয় মনে আছে, ছেলেবেলায় ও তোমার কোল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ত আমার কোলে এসে আমার দুধ খেতে, আর সে সময় সোফিতে আর ওতে কীরকম খামচা-খামচি চুলোচুলি হত! তুমি যদি বা ভোল, সে ভুলবে না ; আমার বুকের রক্ত যে তার রক্তে মিশে রয়েছে!… আর তোমার কথাই বলি, – তুমি তো কোনোদিনই আমার মুখের ওপর একটি কথা কইতে সাহস করনি, – কিন্তু সেই তুমি কিনা যেই তোমার ভাই তোমায় নিতে এলেন অমনি আমাদের সবারই ঘরগুষ্টির এত কাঁদন পায়ে-পড়া অনুরোধ উপেক্ষা করে উলটো আরও পাঁচ কথা শুনিয়ে চলে গেলে! কোনোদিন তো তোমার কাছ থেকে এমন ব্যাভার পাইনি, তাই সেদিনকার কথাগুলো আমার বুকে যেন শেলের মতোই গিয়ে বেজেছে। তুমি যে এমন করে মরার উপর খাঁড়ার ঘা দিতে পারবে, তা জানতাম না। তাই আগে থেকে প্রস্তুতও ছিলাম না। তুমি নূরুর ব্যাভারের যে খোঁচা দিয়ে গেলে তা আমি অবশ্য স্বীকার করে নিলেও, ওতে যে আমাদের নিজের কতটা দোষ ছিল, তা নিয়ে তুমিও তো আর কিছু অ-জানা ছিলে না। আমার পেটের ছেলে না হলেও আমার রবুর চেয়েও সে বেশি, সুতরাং তার এই খ্যাপামো হঠকারিতায় কী তোমার চেয়ে আমি কম কষ্ট পেয়েছি, না, সে কি আমারও বুক ভেঙে দিয়ে যায়নি? তোমার চেয়ে যে সে আমারই অপমান করেছে বেশি। আর মাহ্বুবাকে কি আমি কোনোদিন সোফির চেয়ে কম করে দেখেচি? সে যে এইরকমই কিছু একটা পাগলামি করে বসবে, বিয়ের কথা আরম্ভ হতেই কী-জানি-কেন আমার মনে কেবলই ওই শঙ্কা জাগছিল। কেন না এই পাগলা ছেলে কতবার বিয়ের কথা শুনেই এক-দু মাস করে এখানে ওখানে পালিয়ে বেড়িয়েছে। শুধু রবুর আর বৌমার জিদের আর উৎসাহের জন্যে আমি কিছু বলে উঠতে পারিনি, পাছে তারা মনে করে যে আমার মনটা শুধু অলুক্ষুণে কথাই ভাবে। মা ছেলেকে যেমন বোঝে তেমন আর কেউ বোঝে না। আমি ওকে খুব ভালো করেই চিনেছিলাম যে, ও আমার বাউল উদাসীন ছেলে। তাই আমি কোনোদিনই তার বিয়ের জন্যে এতটুকু চিন্তিত হইনি বা আশাও করিনি। মনে করতাম, আহা থাক আমার ও কোল-মুছা খ্যাপা ছেলে হয়ে! দু-দিন বাদে সোফিয়া শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। রবু সংসারী হয়ে ছেলে-মেয়েদের পেয়ে হয়তো বুড়ো মাকে আর মনে করবে না, কিন্তু চিরদিন থাকবে আমার কোল ঠান্ডা করে, এই চিরশিশু নূরু – এই ঘর-ছাড়া উদাস ছেলে আমার! হায়, মানুষ ভাবে এক, আর খোদা করেন আর এক! একটা হুজুগের মাতামাতিতেই ছেলে আমার এমন করে মালিক-উল-মউতের হাতে গিয়ে জানটা সঁপে দিল – এই রাক্ষসী লড়াইয়ে চলে গেল। আর আমি কিছু চাইনে বোন এখন, খোদার রহমে আর তোমাদের পাঁচ জনের দোয়াতে ছেলে আমার বেঁচে বাড়ি ফিরে আসুক – সে না হয় চিরটা দিন থুবড়োই থাকবে। বউমার যেমন অনাসিষ্টি ঝোঁক, কী করতে গিয়ে শেষে কী হয়ে গেল। কেন, আমার মাহ্বুবার মায়েরই কি বিয়ে হত না, যে এমন আকাল-হুড়োর মতন কাড়াকাড়ি? আমি বি.এ-এম.এ পাশ করা সোনার চাঁদ ছেলে এনে তার বিয়ে দিতাম। তাতে যত টাকাই খরচ হোক। জমি-জায়গা টাকা-কড়ি কাদের জন্যে? ছেলে-মেয়েদের সুখী করে তাদের মুখে হাসি দেখে তা আমরা চোখ মুদি, তারপর খোদা তাদের নসিবে যা লিখেচেন হবে! তখন তো আমরা আর কবর থেকে উঠে, তা দেখতে আসবো না। কথায় বলে – ‘চোখ মুদলে কেবা কার!’ … যাক, যা হয়ে গেছে, তা গিয়েছে ; নসিবের উপর চারা নাই। তা নিয়ে অনুতাপ করেও কোনো ফল হবে না। কী করি, মন বালাই – কোনো মানা মানে না, তাই দুটো কথা না বলেও পারি না! দু-একবার মনে হয়, দূর ছাই। পরের ছেলেকে আপনার করতে গিয়েও যখন আর হল না, তখন আর কেঁদেই কী হবে – মন খারাপ করেই বা কী পাব? হায় বোন, কিন্তু মন সে কথা বুঝতে চায় না! রাত্তি-দিন রোজা নামাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি, আল্লার নাম নিয়ে দুনিয়ার মায়া কাটাতে চাচ্ছি, কিন্তু মেয়েদের বিশেষ করে মাদের মনে যে খোদা কি দুর্বলতা দিয়ে দিয়েছেন যার জন্যে বেহেশ্তে গিয়েও আমাদের জান চায়েন হয় না। শুধু বাচ্চা-হারা বাঘিনীর মতো অশান্ত মন কেঁদে কোঁকিয়ে মরে! আমারই হয়েছে তাই মুশকিল। জিন্দেগির বাকি কালটা যে আল্লার নাম নিয়ে কাটিয়ে দেব, তাও বুঝি তিনি কপালে লেখেননি!