এইবার অন্যান্য দরকারি কথা কটা বলে ফেলি। তিন দিন থেকে একটু একটু করে যতই চিঠিটা লিখছি, কথা ততই বেড়েই চলেছে দেখছি।
তুই বোধ হয় শুনেছিস যে, তোর সই সোফিয়ার বিয়ে। কিন্তু তোর চিঠিতে ওর কোনো উল্লেখ না দেখে বোঝাও তো যায় না যে তুই এ-খবর জানিস। আর জানবিই বা কী করে বোন? আমিই জানতাম না এতদিন। তোমার এই সোজা শেওড়া গাছ ভাইটি তো কম নন ‘নিম্নমুখো ষষ্টি, ছেলে খান দশটি!’ এ মহাশয়-লোকটির কুঠে কুঠে বুদ্ধি। তিনি তলে তলে এসব মতলব পাকিয়ে ‘চুনি বিল্লু’র মতো চুপসে বসেছিলেন, অথচ ঘরের কাউকে এমনকী এ-বান্দাকেও কখনও এতটুকু ইশারায়ও জানতে দেননি। – একদিন গম্ভীরভাবে এসে বললেন কী, – “ছেলেটি দেখতে শুনতে বেশ, এ-বছর বি.এ. দেবে, স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধেও জোর ‘সাট্টিফিস্টি’ পাওয়া গেছে, তার সম্বন্ধে কোনো খটকা নেই, আর যা দু-একটু দোষ-ঘাট আছে তা তেমন নয় – নিষ্কলঙ্ক চাঁদই বা আর কোথায় পাওয়া যাবে!” ইত্যাদি। আমি তো বোন প্রথমে ভেবেই পাইনে উনি কী বলছেন। পরে মনে করলাম, হতেও পারে। পরে কত ‘নখরা্ তিল্লা’ করে বলা হল যে, আমাদের মনুয়রের সঙ্গেই সম্বন্ধ তিনি অনেকদিন থেকে মনে এঁটে রেখেছেন। আমাকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্যই এত দিন তা বলা হয়নি।… সে যাই হোক, এইবার কিন্তু দুই বাঁদর-বাঁদরি মিলবে ভালো। মনুটা যেমন বাঁদর বেলেল্লা, সোফিও তেমনই আফলাতুন কাহারবা মেয়ে! ঝ্যাঁটার চোটে বিষ নামিয়ে দেবে সে! বিয়ের পর ওদের যদি রোজ হাতাহাতি না হয়, তো আমার নাম আর-কিছু রাখিস! … এইখানে আর একটা কথা, – এ-বিয়ের কথাবার্তা হওয়ার পর থেকেই সোফি যেন কেমন গুম হয়ে গিয়েছে! সামনা-সামনি হলে কেবল যেন একটা টেনে-আনা হাসির আভা সে তার গম্ভীর মুখে ফুটিয়ে তুলতে চায়, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে সেটা সকলের আগে তারই কাছে ধরা পড়ে যায়, আর সে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরটাতে গিয়ে শুয়ে পড়ে! তার চোখের নিচে প্রচ্ছন্ন বেদনার একটা স্পষ্ট দাগ যেন দিন দিন কালো হয়ে ফুটে উঠচে! আমি তো হয়রান হয়ে গেছি বোন ওকে জিগগেস করে করে। সে শুধু হেসেই আমার কথা উড়িয়ে দেয়, আবার দু-একবার বেশি জিগগেস করলে রাগের চোঠে ঠোঁট ফুলিয়ে আমার পায়ে মাথা কুটে মরে, নয়তো নিজের চুলগুলোকে নিজে নিজেই ছিঁড়ে পাড়িপাড়ি করে ফেলে। তার চিল্লানি শুনে আর ‘তিখানি’ দেখে বোন এখন আমার তার কাছে যেতেও ভয় হয়। মা গো মা! এমন ‘ঢিট’ মেয়ে আমি আর কখনও দেখিনি। ওর এরকম গতিক দেখে তোমার ভাইজিও যেন কেমন ক্ষুণ্ণ শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন, অথচ যার ব্যথা তার কোথায় যে কী ব্যথা, তা আর বুঝবার কোনোই উপায় নেই। আমি নাচার হয়ে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছি। আমার মতন মাঝি যার মন-দরিয়ায় কূল-কিনারা পেলে না, সে সহজ পাত্তর নয়! ওর মতলবটা কী বা কেন যে সে অমন করচে তুই কি কিছু জানিস রে? তোতে ওতে মানিক জোড়ের মতন দিন-রাত্তির এক জায়গায় থাকতিস কিনা, তাই শুধোচ্চি, যদি তুই ওর মন-দরিয়ার কোনো মণি-মুক্তার খবর রাখিস। তোর মতন কাঁচা ডুবুরি যে কিছু তুলতে পারবে, তার আশা নেই; তাই দেখিস মাঝে থেকে যেন কাদা ঘেঁটে জলটাকে ঘোলা করে দিসনে। আমি যে এখন কোন্ দিক দেখি ছাই, তা আর ভেবে পাচ্ছিনে। এত ঝঞ্ঝাট, বাবাঃ! যা হোক, তুই এখানে এলে যেন একটু তবু নিশ্বাস ফেলে বাঁচতে পারব মনে করছি। হাজার দিককার হাজার জঞ্জাল-ঝক্কির মাঝে পড়ে জানটা যেন বেরিয়ে যাওয়ার মতোই হয়েচে! শিগগির তোর ভাইজি যাবেন তোদের আনতে। এই কদিন তোদের না দেখে মনে হচ্চে যেন কত যুগ দেখিনি! দেখিস অভিমান করে আবার ‘যাব না’ বলে বায়না ধরিসনে যেন।
তোর জন্যে চিন্তা করিনে, তুই কেন তোর ঘাড় আসবে ; না এলে ধরে পালকিতে পুরবো, বলব এ আমাদের ঘরের বউ, এর বিয়ে হয়ে গিয়েছে নূরুর সাথে! ভয় যত তোর আম্মাজানকে নিয়ে! তাঁকেও মা চিঠি দিলেন। তিনি কিছু আপত্তি করলে আমরা সবাই গিয়ে পায়ে ধরে তাঁকে নিয়ে আসব। … খুকি তো তোর আসবার কথা শুনে এই দু-দিন ধরে ঘন্টায় হাজার বার করে শুধোচ্ছে, – ‘মা, লাল ফুপু কখন আসবে?’ কত রকম কৈফিয়ত দিয়ে তাকে ফুসলিয়ে রাখতে হয়, নইলে সে কেঁদে চেঁচিয়ে চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় করে ফেলে! তাকে তোর যেরকম ন্যাওতা করে ফেলেচিস, তাতে এখন তাকে যে ভুলিয়ে রাখা দায়। একটু কিছু হলেই ‘লাল ফুপু গো’ বলে ডাক ছেড়ে কাঁদা হয়। মেয়েটা এমন নিমকহারাম, মাকে ছেড়ে তোকেই এত করে চিনলে! এখন তোর মেয়ে তুই সামলে রাখ ভাই এসে! নয়তো সাথে নিয়ে যা। এই দু মাসেই মেয়েটা যেন শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছে।…
সেখানে আর যতদিন থাকিস, একটু সংযত হয়ে থাকিস বোন। কী করবি, পরের বাড়ি দুটো মুখনাড়া সইতেই হবে।
তোর কথামতো গত মাসের সমস্ত মাসিক পত্রিকাগুলি পাঠিয়ে দিলাম। দেখবি, আমাদের মেয়েরাও এবারে বাংলা লিখছেন, যা আমি কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।…
খালাজির পাক কদমানে হাজার হাজার আদাব দিবি। ইতি
শুভাকাঙ্ক্ষিণী – তোর ভাবিজান
রাবেয়া
বাঁধনহারা – পরিচ্ছেদ ০৮ (শেষ)
[জ]
সালার
১৩ই ফাল্গুন
বোন আয়েশা!
তুমি আমার হাজার ‘দোয়া’ জানবে। মা মাহ্বুবাকে আমার বুকভরা স্নেহাশিস দেবে। এখানে খোদার ফজলে সব ভালো। সোফিয়া আর বহুবিবি মা-জানের কাছে তোমাদের সব খবর জানতে পারলাম। আমায় চিঠি দেবে বলে গিয়েছিলে, তা বোধ হয় বাপের বাড়ি গিয়ে ভুলেই গিয়েছ।… আমি যেন আভাসে বুঝতে পারছি তোমাদের সেখানে অনেক অসুবিধা ভোগ করতে হচ্চে। তোমার না হলেও আমার মাহ্বুবা মায়ের যে খুবই কষ্ট হচ্চে, এ কথা কে যেন আমার পোড়া মনে সারাক্ষণই উসকে দিচ্চে। আহা, খোদা তোমাদের সহি সালামতে রাখুন বোন! আমার মাহ্বুবা মায়ের আলাই-বালাই নিয়ে মরি! এই কদিন মেয়েটাকে না দেখে আমার জান যে কীরকম ছটফট করচে, তা তুমিও তো মেয়ের মা, সহজেই বুঝতে পার! মা-আমার সেই যে কাঁদতে-কাঁদতে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে বিদায় নিলে অথচ একটা কথাও বলতে পারলে না, তাই আমার দিনে-রাতে হাজার বার করে মনে হচ্চে! সোফি আর ও দুইজনে মিলে ঘরটাকে যেন মেছো-হাট করে রাখত, ওর যাওয়ার পর থেকে সোফিটা মন-মরা হয়ে শুধু নিজের ঘরটাতে পড়ে থাকে, আর কিছু শুধোলে আমার কোলের ভিতর মুখ গুঁজে কাঁদে। সে কী ডুকুরে ডুকুরে কান্না বোন ওর, দেখে চোখের পানি সামলানো দায়! মা আমার যেন দিন দিন শিকড়-কাটা লতার মতন নেতিয়ে পড়চে। কী হল ওর, ওই জানে আর ওর খোদাই জানে। হাজার শুধোলেও কোনো কিছু বলচে না। এমন চাপা মন তো ওর কোনো কালে ছিল না বোন। আমার এত ভয় হচ্চে! কাল দিন বাদে ওর বিয়ে, আর এখন থেকেই কিনা এমন হয়ে শুকিয়ে পড়চে। হায় আমি যে কী করব কিছুই ভেবে পাচ্ছিনে! মাহ্বুবাটা থাকলেও বোধ হয় ও এমন হত না। যাক, খোদা যা লিখেচেন অদৃষ্টে তাই হবে, আর ভেবে কী ফল!