হাঁ, তারপর ঠিক সেই সময় কী সব জমিদারি ব্যাপার নিয়ে না কী জন্যে আমার শ্বশুর সাহেব মরহুম তখন বাঁকুড়াতেই সপরিবারে বাস করছিলেন। আর তোমার এই গুণধর ভাইজি বাঁকুড়ার কলেজে পড়ছিলেন। আমাদের বাসা একরকম কাছাকাছিই ছিল, কাজেই অল্প দিনের মধ্যেই আমাদের সঙ্গে এঁদের বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়, আর তখনই আমার বিয়ের কথা ওঠে। আমাদের ‘ইনি’ (বর্তমানে ‘খুকির বাপ’) অর্থাৎ তোমার ভাইজি তখন কী জানি কেন আমাদের বাড়ি ঘন ঘন যাওয়া-আসা করতে লাগলেন। ওঁর নানা অসিলা করে হাজারবার আমাদের বাড়ি আসা আর একবার আড়চোখে মাথা চুলকাতে চুলকাতে ফস করে চারিদিকে চেয়ে-নেওয়া দেখে আমার খুব হাসিও পেত, আবার বেশ মজাও লাগত। তিনি এক-আধ দিন বিশেষ কাজে আসতে না পারলে ক্রমে আমারও মনটা যেন কেমন উড়ু উড়ু উদাসীন ভাব বোধ হত। দুষ্ট সাহসিকা তো এই নিয়ে আমায় গান শুনিয়ে টিপনি কেটে একেবারে অস্থির জ্বালাতন করে ফেলত! অবশ্য, তখনও আমাদের দেখা-শোনা হয়নি, – আমাদের বললে ভুল হবে, কেননা আমি নানা রকমে তাঁকে দেখে নিতাম, কিন্তু পুরুষদের দুর্ভাগ্যই এই যে, কোনো সুন্দর মুখ আড়াল থেকে তাকে দেখচে কিনা বেচারা ঘুণাক্ষরেও তা জানতে পারে না। সাহসিকা দু-এক দিন দুষ্টুমি করে আমার ঘরে বেশ একটু জোর গলায়, যাতে উনি শুনতে পান, গান জুড়ে দিত –
সখী, প্রতি দিন হায় এসে ফিরে যায় কে?
তারে আমার মাথার একটি কুসুম দে।
তখন যদি তোমার এই শান্তশিষ্ট ভাইটির ছটফটানি দেখতে! আল্লাহ! হাঁ করে তাকিয়ে এদিক ওদিক দেখচেন, কখনও বা গভীর মনোনিবেশ সহকারে চুপ করে বসে গম্ভীর হয়ে পড়ছেন, আবার কখনও বা কবির মতো মাথার চুলগুলো খামচে ধরে মস্ত লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন! আমরা তো দু সই-এ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিয়ে লুটিয়ে পড়তাম! বাবা, এত বেহায়াও হয় পুরুষে? ছিঃ মা! এখন তোর ভাইজিকে সে কথা বললে, তিনি বলেন যে, গানটা বড্ড বেসুরো শুনাতো বলে তিনি ওরকম করে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন! হায় আল্লাহ! এত মিথ্যাবাদীও হয় মানুষে। আজকাল আমাদের অনেক মিয়াঁ-সাহেবরাই জোর গলায় বলচেন, অনেকে আবার লিখেও জানাচ্ছেন যে, আমাদের এ হেরেমের পাঁচিল পেরিয়ে পূর্বরাগ এ জেনানা ঘরে ঢুকতেই পারে না। হায় রে অন্ধ পুরুষের দল! এঁরা ঠিক যেন চোখে ঠুলি-পরা কলুর ঘানির বলদ। এঁরা খালি সামনেটাই দেখতে পান, আশে-পাশের খবর একদম রাখেন না। এঁদের এই দৃষ্টিহীনতা দেখে আমার মতো অনেকেই লুকিয়ে হাসে। আমি এঁদের লক্ষ করে জোর গলায় বলতে পারি, – ‘ওগো কানা বলদের দল! বিয়ের আগেও হেরেমের বা অসূর্যম্পশ্যা মেয়েদের মনে পূর্বরাগের সৃষ্টি হওয়াটা কিছুই বিচিত্র নয়!’ তোমরা তো আর জোয়ান মেয়ের বা যুবক ছোকরার মন বোঝ না, সোজা খাও দাও আর উপর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে তারা গোনো। তবে তোমাদের ভাগ্যি বলতে হবে যে, অনেক পোড়ারমুখিরই এই পূর্বরাগটা অধিকাংশ সময় অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়, নইলে এমনই একটা কেলেঙ্কারির সৃষ্টি হত যে, এ পুরুষরা এ কথার ঠিক উলটো বলতেন। কত অভাগির মনে যে ওই অঙ্কুর আবার মহিরূহে পরিণত হয়ে ওঠে, আবার কত জনা যে মনের বেদন মনেই চেপে তুষের আগুনের মতন ধিকি ধিকি করে পুড়ে ছাই হয়, কে তার খবর রাখে? কে তা জানতে চায়? জানলেও কার বুকে তার বেদন বাজে? একটা কাচের বাসন ভাঙলেও লোকে ‘আহা’ করে, কিন্তু বুক ভাঙলে, হৃদয় ভাঙলে, জেনেও কেউ জানতে চায় না, ‘আহা উহু’ করা তো দূরের কথা। কিন্তু কোনো ‘মুখপুড়ি’ যদি কুলে কালি দিয়ে ভেসে যায়, তখন এদের আস্ফালনে গগন বিদীর্ণ হয়ে যায়। পুরুষরা এত সুবিধে করে উঠতে পেরেছেন, তার কারণ মেয়েরা মুখ থাকতে বোবা, বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না! – এই নে, ফের কোথায় সরে পড়েছি। –
তারপর বোন, সত্যি বলতে কী, তোর এই সোজা মানুষ ভাইটিকে ক্রমেই আমার বেশ ভালো লাগতে লাগল। বিশেষ করে এঁর কণ্ঠ-ভরা গান আমার কানে বড্ড মিষ্টি শুনাত। পরে জেনেছি, এই ভালো লাগাটাই হচ্চে পূর্বরাগ। এখন মনে হয়, পুরোপুরি ভালোবাসার চেয়ে এই পূর্বরাগের গোলাবি রাগটারই মাদকতা আর মাধুর্য বেশি, এর পাতলা অরুণ ছোপ বুকে নিবিড় হয়ে না লাগলেও এর তখনকার রঙটা বেশ চমকদার। যদিও আমি থাকতাম অন্তঃপুরের অন্তরতম কোণে অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে, তবুও ওঁর পায়ের ভাষা আমি অতি সহজেই বুঝে ফেলতাম। রোজ সন্ধ্যা হওয়ার অনেক আগে থেকেই তাঁর গান শোনবার জন্যে আমি উৎকর্ণ হয়ে থাকতাম, – কেননা তিনি মনুকে গান শিখানোর অসিলাতেই অন্য সময় ছাড়া সন্ধেটাতে রোজ আসতেন আর শেখানোর চেয়ে নিজে গাওয়াটা বেশি পসন্দ করতেন : কেননা নিশ্চয়ই তাঁর এ আশা থাকত যে একটি তরুণ প্রাণী লুকিয়ে থেকে তার গান শুনছে। … আমার এই উন্মনা ভাবটা অন্তত মায়ের চক্ষু এড়ায়নি, এটাও আমি বুঝতে পারতাম। এইখানে আর একটা কথা বলে রাখা আবশ্যক, – আমাদের পূর্বরাগটা একতরফা হয়নি অর্থাৎ শুধু আমি নয়, তোমার ভাইজিকেও নাকি ওই একই রোগটায় বেশ একটু বেগ পেতে হয়েছিল। কেননা আমাদের বিয়ে হওয়ার পর এই সত্যবাদী ভদ্রলোক মুক্তকণ্ঠে আমার কাছে স্বীকার করেছিলেন যে, কোনো এক গোধূলি-লগ্নে সদ্যস্নাতা আলুলায়িতা-কেশা আমায় তিনি আমাদের মুক্ত বাতায়নে উদাস আনমনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন, তা ছাড়া আরও দু-একদিন – কোনো দিন বা আঁচলের প্রান্ত, কোনো দিন বা চুলের একটি গোছা, কোনো দিন বা ঈষৎ ‘আবছা’ চোখের চাওয়া, আবার অভাবে কোনো দিন বা চাবির রিং-এর বা রেশমি চুড়ির রিনিঝিনি – এই রকম যত সব ছোটো-খাটো পাওয়ার আনন্দেই তিনি একেবারে ‘রাশি রাশি ভাঙা হৃদয়ের মাঝারে’ তাঁর হৃদয় হারিয়ে ফেলেছিলেন! তা নাহলে তিনি এতদূর নিঃস্বার্থ পরোপকারী হয়ে ওঠেননি যে, পরের বাড়ি গিয়ে এতবার এতক্ষণ ধরে ধন্না দিয়ে আসেন। তাঁর অবস্থা নাকি আবার আমার চেয়েও শোচনীয় হয়ে পড়েছিল এই বিরহ-ভোগের ঠেলায়, আর তারই প্রমাণস্বরূপ এমন ভালো ছেলে হয়েও সেবার তিনি বি.এ. ফেল করলেন। অগ্রেই সত্যিকার বিয়ে পাশ করে ফেলার দরুণেই নাকি তিনি সেবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ.টা পাশ করতে পারেননি। সাহসিকাই এই কথাটা ওঁকে লিখে জানিয়েছিল, সে আরও লিখেছিল যে, আপাতত বিশ্ববিদ্যালয়ে ডবল ‘অনার্স’ উঠে গিয়েছে কিনা, তাই ‘বিয়ে’ অনার্সের পর আর একটা অনার্স মঞ্জুর হল না! – এইখানে আমার কথাটি ফুরালো, নটে গাছটি মুড়ালো! আমাদের অনেক ঘরের কথা তোকে জানিয়ে দিলাম এই জন্যে যে, তোর উপন্যাস আর গল্প পড়ার ভয়ানক সখ। আর এটা নিশ্চয় জানিস যে, গল্প-উপন্যাস সব মনগড়া কথা, তাই আমাদের এই সত্যিকার ঘটনাটা তোকে উপন্যাসের চেয়েও হয়তো বেশি আনন্দ দেবে। এতে আমার লজ্জার কিছুই নেই, আর এরকম করে বলা বা লেখাও মেয়েদের পক্ষে কিছুই কঠিন নয়। মেয়েরা যা একটু লজ্জাশীলা থাকে বিয়ের আগেই, তারপর বিয়ে হয়ে গেলেই (তাতে যদি ছেলের মা হল, তাহলে তো কথাই নেই) তাদের সামনে দিকটার এক হাত ঘোমটা পিছন দিকে দু-হাত ঝুলে পড়ে। তাছাড়া এ আমাদের ননদ-ভাজের ঘরোয়া গোপন চিঠি, এ তো আর অন্য কেউ দেখতে আসছে না।…